গণমাধ্যমে নারীর রূপ

সৈয়দা ফারজানা জামান রুম্পা
Published : 5 Dec 2019, 09:54 AM
Updated : 5 Dec 2019, 09:54 AM

কয়েক বছর আগে ভারতের একটি বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেলে একটি নাটক শুরু হয়। যেখানে মেয়েটি একজন নিউট্রিশনিস্ট কোনো এক অজানা কারণে মেয়েটি এক বাসায় "হোম-ডিউটি" শুরু করে। ওটা এমনই এক বাসা যেখানে তাকে উঠতে বসতে রীতিমত গৃহকর্মীর মত আচরণ করা হয়। এবং পরবর্তীকালে মেয়েটির সঙ্গে ওই বাসার ছেলেটির প্রেমের সম্পর্ক এবং বিয়ে হলে তাকে তার পেশা এবং পেশার সময় নিয়ে শ্বাশুড়ির কাছ থেকে ক্রমাগত 'কথা' শুনতে হয়। ফলে একটা সময় মেয়েটি তার শ্বশুড়বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়। সিরিয়ালটি প্রচারিত হতো 'সনি টিভি'তে, নাম 'কুছ রঙ্গ পেয়ার কে – অ্যায়সি ভি'।

আরেকটি নাটকে দেখা যায়- ভীষণ ফ্যাশন সচেতন একটি মেয়ে, যে কিনা ডাক্তার। তার সাথে বেশ 'বড়লোক' একটি পরিবারের ছেলের প্রেম হয়। ছেলেটির বাসায় কোনোভাবেই "ঘরের বউ কাজ করবে" এমনটা মেনে নেওয়া হয় না। তার বড় ভাইয়ের স্ত্রীও কাজ ছাড়তে "বাধ্য" হয়েছিল। ফলে তারা বিয়ে করে এবং মেয়েটির ডাক্তারি পেশা ছাড়তে হয়। এরপর নাটকে দেখানো শুরু হয় একটি মেয়ের পেশার আশা বাদ দিয়ে সংসারধর্ম শেখার প্রতিযোগিতা। কিছুটা সমালোচনার মুখে নাটকটির সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়- এবং তাদের ওয়েবসাইটে নাটকটির নামও নেই।

সংসারের সঙ্গে পেশার সংঘাত না থাকলেও কোনো না কোনোভাবে এই সংঘাতকে বার বার বিভিন্ন নাটক, সিনেমায় বা গানে দেখানো হচ্ছে- যেটাকে কখনো কখনো দর্শকরা, বলার অপেক্ষা রাখে না- বেশিরভাগ সময়েরই দর্শক "হিরোইজম" হিসেবে আখ্যা দেয়। এবং দুঃখজনক হলেও সত্য- উপরের দুটি উদাহরণ হিন্দি চ্যানেলের হলেও জনপ্রিয়তার দৌঁড়ে টিকে থাকতে বাংলাদেশি চ্যানেলেও তা এখন বেশ ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। যেখানে নারীর কাজ শুধুই অন্যের জীবনসহ আশেপাশে জটিলতা সৃষ্টি করা।

এতো গেল নাটকের কথা। বাংলা বা হিন্দি সিনেমার অসংখ্য দৃশ্যে আছে– যেখানে নায়িকাকে রীতিমত উত্যক্ত করে নায়ক নিজের করে নিচ্ছে. যেমন হালের 'কবীর সিং'। স্বামী মদ্যপ অবস্থায় আসলেও তার জুতো খুলে আরাম করে বিছানায় ঘুম পাড়ানির দৃশ্য বেশ সাধারণ স্বামীকে সঠিক পথে নিয়ে আসার জন্য। শাবানা, রাজ্জাক, আলমগীর অভিনীত 'স্বামী স্ত্রী' সিনেমাতে স্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করে সহবাসে বাধ্য করাও দেখানো হয়েছে। হয়তো নির্মাতা বুঝতেও পারেননি কি ভয়ানক বার্তা চলে যাচ্ছে এসকল শিল্পীদের ভক্তদের কাছে!

নারীর প্রতি সহিংসতার পেছনে এই কন্টেন্ট বা নানা ধরনের প্রচারণার উপাদান কাজ করে কিনা- সেই প্রসঙ্গে আসার জন্য উপমহাদেশে কি ধরনের কন্টেন্ট বানানো হচ্ছে সেটা নিয়ে আলোচনার দরকার আছেই বলেই এতো দীর্ঘ ভূমিকার প্রয়োজন পড়লো।

দর্শক কি দেখছে, কি বুঝছে বা কি নিচ্ছে সেটা কিন্তু তাদের মস্তিষ্কে এক ধরনের প্রভাব বিস্তার করে। সাদা চোখে নিখাদ বিনোদন মনে হলেও– এই বিনোদনই কিন্তু দর্শকরা আত্মস্থ করে। কিভাবে? ছোট্ট একটি উদাহরণ; যখন তারকার মত করে কেউ পোশাক পরে, কোনো চরিত্রের নামের 'পোশাক' জনপ্রিয় হয় তখন বুঝে নিতে হবে এই শিল্পীর ঐ ক্যারেক্টার দর্শকরা নিজের মাঝে দেখছে। সেটা নারী হোক বা পুরুষ। বা খল চরিত্রেরই হোক।

এ কারণেই নারী যে গৃহস্থালী পর্যায়ে নানা রকমের আক্রমণের শিকার হচ্ছে তার পেছনে কোনো না কোনোভাবে বিনোদন মাধ্যম-গণমাধ্যমের অংশীদার হওয়াকে অস্বীকার করা যায় না। মনোচিকিৎসক সিফাত ই সৈয়দ বলেন, "সরাসরি বিনোদন মাধ্যমকে দায়ী না করা গেলেও অবশ্যই বিনোদন বা বৃহত্তরভাবে বললে অবশ্যই গণমাধ্যমের ভূমিকা আছে। বিভিন্ন সিনেমা, নাটক বা গানে নারীকে পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে মূল্যায়ণ করা হয়েছে এবং ফলশ্রুতিতে নারীর জীবনের ভালো-মন্দ সবকিছু পুরুষের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।"

এমনকি পেশাগত জীবনে নারীকে অনাগ্রহী করার জন্যও নানাভাবে প্ররোচিত করার হয়েছে বিভিন্নভাবে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন কন্টেন্টের মাধ্যমে যা দেখানো হয়, তা আপাতদৃষ্টিতে হানিকর মনে না হলেও তার পেছনের গাঢ় ক্ষত তৈরি হওয়ার আশঙ্কা কেউ ফেলে দিতে পারে না। যেমন এক নায়িকার জন্য নায়ক-খলনায়কের যুদ্ধ বা সংঘাত। নায়িকাকে "জয়" করার স্পৃহা বা জিঘাংষা অনেক সিনেমাতেই প্রতীয়মান। যার বাস্তব উদাহরণ রিফাত-নিম্মি-নয়নবন্ডের সাড়া জাগানো ঘটনার সঙ্গে সদৃশ্যপূর্ণ হতে পারে।

শুধু তাই নয়, নারীর প্রতি অসম্মান বা সহিংসতার অন্যতম কারণ যেখানে ত্বকের রং, সেখানে মিডিয়ার ভূমিকা অবশ্যই প্রকট। সাধারণত ফরসা ত্বকের অধিকারীকেই সুন্দরী আখ্যা দেওয়া হয়। এবং বিভিন্ন কন্টেন্টে নারীকে সেভাবেই উপস্থিত করানো হয়। দেশের ৮৫% মানুষ যেখানে এখনও বিভিন্ন কন্টেন্টের মাধ্যমে নিজের অবসর কাটায়, সেখানে নারীকে এভাবে উপস্থাপন করার ফল কেমন হতে পারে– তার উদাহরণ হতে পারে ক্রমাগত ত্বক ফর্সা করার পণ্যের বিজ্ঞাপন। আর তারওপর নানাভাবে ত্বককেন্দ্রিক বৈষম্য কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।

সরেজমিনে দেখা গেছে, জামালপুরের আইন ও সালিশ কেন্দ্রে বিচারের আশায় আসা এক নারীও এই ধরনের অভিযোগই নিয়ে এসেছেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী, অল্পবয়সে তার বিয়ে হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত তাকে নানা রকমের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। কারণ তিনি "দেখতে ভালো না"। তবুও সেই নারী স্বামীর ঘর ছাড়তে নারাজ।

অপরদিকে হাসনাহেনা নামের এক নারীকে পুরুষের অন্যরকম সহিংসতার শিকার হওয়ার গল্পটিও জানা গেছে জামালপুরের আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সহায়তা কেন্দ্র থেকে। এই নারী যখন শহরের একটি গার্মেন্টসে কাজ করতো, তার প্রতিবেশি যুবক একপ্রকার ছলের মাধ্যমে তাকে বিয়ে করতে বাধ্য করে। শুধু তাই নয়। সেই নারীকে বিয়ে করতে বাধ্য করার জন্য রীতিমত 'নাটকের'র প্লট রচনা করে যেখানে তখন 'প্রেমটাই মুখ্য হয়ে' ধরা দেয়। কিন্তু পরবর্তীকালে ঐ নারীকেও স্বামী এবং শ্বশুড়বাড়ি কর্তৃক সহিংসতার শিকার হতে হয়। যার কারণে তিনি বাধ্য হয়েছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দারস্থ হতে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের বিভিন্ন জরিপ এবং কেইস স্টাডি থেকে নারীর সহিংসতার পেছনে গণমাধ্যমের প্রচ্ছন্ন প্রভাব ফুটে উঠে বেশ ভালোভাবেই। বিভিন্ন বিজ্ঞাপনেও নারীকে শুধু ঘরের কাজে পারদর্শী হতে দেখানো, ঘরের কাজে শুধু নারীর অংশ নেওয়া, কোনো পণ্যের সঙ্গে মিলিয়ে নারীকে উপস্থাপন করা ইত্যাদিও তাদের বিভিন্ন কেইস বিশ্লেষণে ফুটে উঠেছে।

পণ্যের 'মজা'র সঙ্গে নারীর সম্পর্ক, পণ্যের অবয়বের সঙ্গে নারীর তুলনা, যা হরহামেশা হচ্ছে তাতে করে দর্শকের মাথায় নারীর একটা চিত্র বসতে বাধ্য বলে মনে করেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রেহনুমা। শুধু তাই নয়, নারীকে ঠিক সেভাবেই পাবার আকাঙ্ক্ষা ও না পাওয়ার হতাশাও নারী নির্যাতনের অন্যতম কারণ বলে তিনি মনে করেন।

অপরদিকে রং ফর্সাকারী ক্রিমের প্রক্রিয়াজাতকারী একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, দেশের আপামর জনসাধারণ এখনও ত্বকের রংকেই সৌন্দর্য মনে করেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠান তার দায়বদ্ধতা বিবেচনায় এখন আত্মবিশ্বাসের দিকে বেশি লক্ষ্য দিচ্ছে এসব পণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে।

শুধু যে কন্টেন্ট দিয়ে নারীর প্রতি সহিংসতা বা নারীর অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে তা নয়।

সম্প্রতি উন্নয়নকর্মী রাফায়েথ রশীদ মিথিলার ব্যক্তিগত কিছু ছবি এবং ভিডিও প্রকাশিত হলে গণমাধ্যমে তাকে কেন্দ্র করে যাবতীয় খবর চটুলতার সঙ্গে প্রচার করা হয়েছে। যা একাধারে সংবাদ প্রচারের নীতিমালা এবং মানবিকতার পরিপন্থী। সেখানেও নারী হিসেবে তার ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। এবং কোনো না কোনোভাবে তার উপর মানসিক নির্যাতনের কারণ হতে প্রচ্ছন্ন ভূমিকা পালন করেছে।

অপরদিকে, প্রয়াত লেখক হুমায়ূন আহমেদের সাবেক স্ত্রী গুলতেকিন খানের বিয়ের খবর প্রকাশেও নারীর প্রতি এক প্রকারের হীনমন্যতার প্রকাশ দেখা গিয়েছে। যেখানে তাকে প্রথম স্ত্রী হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। যদিও তাদের বিচ্ছেদ সম্পন্ন হয়েছে।

নারীকে ঢাল, পণ্য বা শিরোনাম করে নানাভাবে গণমাধ্যমে আনার চর্চা বহু পুরানো। বিশেষ করে এই উপমাহদেশে নারী মানেই কোনো না কোনো সময়ে 'ঘরের শোভা" বৃদ্ধিকারী কোনো একটি অবয়বে পরিণত হয়। যার কারণে নারীর প্রতি অবহেলা, বৈষম্য বা নির্যাতন কখনোই কমে যায়নি হয়তো তার রূপ বা পোশাক বদল হয়েছে। ডা. সিফাত ই সৈয়দ তাই আরেকবার উল্লেখ করেন, "এই নির্যাতন শুধু সমাজের একস্তরে নয়- সকল স্তরে বিদ্যমান। যে কারণে নারীর শারীরিক-মানসিক উভয় স্বাস্থই হুমকির সম্মুখীন।"

নারীর সম্মান এবং অধিকার নিশ্চিত করতে কেবল দপ্তর বা ঘরে আইন নয়, চাই মানবিক উপস্থাপনও যেখানে অগ্রনায়ক হতে পারে গণমাধ্যম। আর তার ‍জন্য চাই সুচিন্তিত কন্টেন্ট তৈরি ও উপস্থাপন।

শেষে একটি সিনেমার উদাহরণ না দিলেই নয়। সাধারণত হিন্দি সিনেমাকে 'চটুল' বা হালকা হিসেবে নিলেও এখন অনেক সিনেমা হচ্ছে যেখানে নারীকে নারীর রূপে শক্ত হয়ে নিজেকে উপস্থাপন করতে দেখা গেছে। যেমন 'দিল ধাড়াক নে দো'। এই সিনেমাতে প্রিয়াংকা চোপড়ার চরিত্রটি একজন উদ্যোক্তার। যারা বাবা বা স্বামীর পর্যাপ্ত অর্থ থাকার পরেও নিজেই নিজের অলঙ্কার বিক্রি করে ব্যবসা শুরু করে। এবং একটা সময়ে সমাজের প্রচলিত রীতি থেকে সরে এসে নিজের বক্তব্যকে পরিবারের সামনে তুলে ধরে অসুখী দাম্পত্য থেকে বের হয়ে আসে। অপর দিকে 'ইংলিশ-ভিংলিশ' সিনেমাটিতে দেখা যায়, শ্রীদেবীর চরিত্রটি তার ইংরেজি না জানার দূর্বলতাকে নিজের মানবিক শক্তি দিয়ে কাটিয়ে উঠে। স্বামীকে বুঝিয়ে দেয়- তিনি শুধুই কারও স্ত্রী হিসেবে নন বেঁচে আছেন নারী হিসেবে, পালন করছেন স্ত্রীর ধর্ম।

নারী মানেই কোমল, মা, বোন, স্ত্রী বা প্রেমিকা হতেই পারে। থাকতে পারে নারীর নানা রূপ। কিন্তু পৃথিবীর বুকে সে সবার আগে মানুষ। আর গণমাধ্যমই পারে সমাজ থেকে নারী-পুরুষের বৈষম্য ধীরে ধীরে বিলুপ্ত করতে।