ভোপাল ট্র্যাজেডি এবং আমাদের শিক্ষণীয়

জহিরুল হক মজুমদার
Published : 5 Dec 2019, 07:08 AM
Updated : 5 Dec 2019, 07:08 AM

১৯৮৪ সালের ২-৩ ডিসেম্বর ভারতের মধ্যপ্রদেশের ভোপাল শহরটি হয়ে উঠেছিল দ্বিতীয় হিরোশিমা। ভোরের আলো ঠিকমতো ফোটার আগেই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মারা পড়েছিল কয়েক হাজার লোক। এটা ছিল পৃথিবীর শিল্প দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ভয়াবহতম। তাৎক্ষণিকভাবে প্রায় তিন হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। যদিও মধ্যপ্রদেশ সরকার সংখ্যাটি কমিয়ে ২২৫৯ জনের কথা বলতে চায়। অধিকার কর্মীদের মধ্যে যারা এই ট্র্যাজেডির ক্ষতিপূরণ এবং সুবিচারের জন্য সংগ্রাম করছেন তাদের মতে মোট মৃতের সংখ্যা আট থেকে দশ হাজার। সরকারি ভাষ্যমতে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ লোক এই দুর্ঘটনায় আহত হয় এবং প্রায় চার হাজার লোক স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যায়।

কীটনাশক উৎপাদনকারী মার্কিন কোম্পানি "ইউনিয়ন কার্বাইড" এর একটি গ্যাস রিজার্ভার এর ভাল্ব নষ্ট হয়ে গিয়ে নির্গত হতে থাকে ভয়াণ্রক বিষাক্ত গ্যাস মিথাইল আইসোসায়ানেট এবং অন্য আরও কিছু গ্যাস। বাতাসে মিথাইল আইসোসায়ানেট-এর মাত্রা ২১ পিপিএম ঘনত্বে পৌঁছলেই এই গ্যাস নিঃশ্বাসের সাথে শরীরে যাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে যেকোনো মানুষের মৃত্যু অনিবার্য। ভোপাল দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে এই মাত্রা পৌঁছেছিল এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশী ঘনত্বে।

ঘটনার সূত্রপাত ঘটে ২ ডিসেম্বর শেষ রাতে অর্থাৎ ৩ ডিসেম্বর ভোরের আলো ফোটার আগেই। কেমিক্যাল প্ল্যান্টটিকে শীতল রাখার জন্য যে পানি ব্যাবহার করা হয় সেই পানি মিশে যায় মিথাইল আইসোসায়ানেট-এর সাথে। ট্যাঙ্কের মধ্যে তৈরি হয় প্রবল চাপ। মুহূর্তে ট্যাঙ্কটি বিস্ফোরিত হয়ে বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে চারদিকের বাতাসে। মিথাইল আইসোসায়ানেট গ্যাস বাতাসের চেয়ে ভারী হওয়ায় তা ধোঁয়ার মেঘ তৈরি করে শহরের উপর দিয়ে উড়ে যেতে থাকে বিষ ছড়াতে ছড়াতে।

এই দুর্ঘটনার প্রথম নির্মম শিকার হয় কারখানার লাগোয়া বস্তি এলাকার মানুষগুলো। তারপর গোটা শহরের মানুষ। ১৯৮৪ সালে ভোপাল শহরের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে আট লাখ। এর প্রায় অর্ধেক লোক এই গ্যাস দুর্ঘটনার শিকার হয়। ভোপাল শহরে তখন মাত্র দুটি হাসপাতাল ছিল। ডাক্তাররা হিমশিম খেয়ে যান রোগীদের চিকিৎসা দিতে। কারো গায়ে র‍্যাশ, কারো চোখ জ্বলছে, কেউ বলছেন তিনি অন্ধ হয়ে গেছেন, কেউ বলছেন তিনি নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না। হাজার হাজার লোক হাসপাতালের দিকে দৌঁড়াচ্ছেন। দিনের আলো ফোটার সাথে সাথে উদ্ধারকর্মী, পুলিশ এবং চিকিৎসকদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় কোথা থেকে ঘটেছে এই দুর্ঘটনা। এবার আসতে থাকে সারি সারি লাশ। এরা তাৎক্ষণিক মারা গেছেন। সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। পথেঘাটে পড়ে ছিল ইঁদুর, বিড়াল আর পাখির মৃতদেহের পাশাপাশি ছিন্নমূল মানুষের মৃতদেহ কিংবা হাসপাতালের ছুটে আসতে গিয়ে মাঝপথে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া মানুষের মরদেহ। গোটা ভোপাল শহর যেন মানুষের বধ্যভূমি আর মৃত পশুপাখির ভাগাড়ের এক অসহনীয় অকল্পনীয় ছবি। ঘটনার পরবর্তী সময়ে হাসপাতালে আরও মারা যান অনেকে। তারা মারা গেছেন নিউমোনিয়া এবং অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে। আক্রান্ত হয় ষ্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের যাত্রীরাও।

মূল ট্র্যাজেডি পর্ব শেষ হয়ে যাওয়ার পর ৭ ডিসেম্বর ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন ইউনিয়ন কার্বাইডের চেয়ারম্যান এবং সিইও মার্কিন নাগরিক ওয়ারেন অ্যান্ডারসন। তাকে গ্রেফতার করে ভারতীয় পুলিশ। আদালতে তোলা হয় তাকে। কিন্তু জামিনে মুক্তি পেয়ে তিনি ফিরে যান নিউয়র্কে। বিচারের মুখোমুখি হওয়ার জন্য আর ফিরে আসেননি ভারতে। ভারত সরকারও মার্কিন সরকারের মাধ্যমে অনেক চেষ্টা করে তাকে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করতে পারেনি। অজুহাত আসে আসামী প্রত্যার্পণ চুক্তির। যেখানে কোম্পানির কাছ থেকে তিন বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়েছিল, সেখানে মাত্র চারশত সত্তর মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিয়ে গোটা ঘটনা থেকে হাত গুটিয়ে নেয় ইউনিয়ন কার্বাইড কোম্পানি। তাতে পরিবার প্রতি ক্ষতিপূরণ প্রাপ্ত হয় মাত্র দুইশ ভারতীয় রুপী।

যদিও ক্ষতিপূরণের পরিমাণটি দুই পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে ভারতের সর্বোচ্চ আদালতই নির্ধারণ করেন; অধিকার কর্মীরা মনে করেন আদালতের এই সিদ্ধান্তে ইউনিয়ন কার্বাইড কোম্পানিরই জয় হয়েছে- সাধারণ মানুষের নয়। প্রধান বিচারপতি রাজিন্দর পাঠক ভারতের অ্যাটর্নি জেনারেল কে পরাশরণকে এই পরিমাণ ক্ষতিপূরণে তিনি সম্মত আছেন কি না জানতে চান। অ্যাটর্নি জেনারেল পরাশরণ তাৎক্ষণিকভাবেই তার সম্মতিজ্ঞাপন করেন। প্রধান বিচারপতি পাঠক তার সিদ্ধান্তে এই ক্ষতিপূরণকে দুর্ঘটনা উদ্ভূত যেকোনো প্রকার মামলা, দাবি কিংবা দায়-এর চূড়ান্ত নিস্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করেন। ভারত সরকার এবং কোম্পানি দুই পক্ষই এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়।

ঘটনার এত বছর পরও ভোপালের জনগণ পঙ্গুত্ব, অন্ধত্ব এবং অন্যান্য শারীরিক বিপর্যয়কে সাথে নিয়ে জীবন সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। এখনো করে যাচ্ছেন সুবিচারের জন্য সংগ্রাম। ক্ষমতাদর্পী একটি বহুজাতিক কোম্পানি সাধারণ মানুষকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়ে প্রায় বিচারহীনভাবে নামমাত্র ক্ষতিপূরণ দিয়ে বিদায় হয়েছে বলেই অধিকার সচেতন মানুষেরা মনে করেন।

বাংলাদেশও বিদেশী বিনিয়োগ আকাঙ্ক্ষী একটি দেশ। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যেখানেই যাচ্ছেন সেখানেই আহ্বান রাখছেন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার জন্য। এটি অত্যন্ত শুভ উদ্যোগ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের শিল্প নিরাপত্তা পরিদর্শন, পরিবেশ আইন এবং বিচার ব্যবস্থাকেও সেই মাত্রায় শক্তিশালী করতে হবে। যাতে করে বাংলাদেশ কখনো একটি ভোপাল ট্র্যাজেডির মুখোমুখি না হয়। আমাদের অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগে যেসব শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটাচ্ছে সেগুলোর নিরাপত্তার দিকেও নজর দিতে হবে। আমাদের অভ্যন্তরীণ শিল্প দুর্ঘটনার সংখ্যাও নেয়ায়েত কম নয়। "জাহাজভাঙা শিল্প" সম্পর্কে দীর্ঘদিন ধরেই অনিরাপদ কর্ম পরিবেশ এবং পরিবেশ দূষণের অভিযোগ রয়েছে। 'অক্সিডেন্টাল' এর মত বহুজাতিক কোম্পানি মাগুরছড়ায় গ্যাস কূপ বিস্ফোরণের ফলে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় ঘটিয়ে কোনো প্রকার ক্ষতিপূরণ না দিয়েই বিদায় হয়েছে। এগুলো আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের অক্ষমতারই প্রমাণ বহন করে। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান এবং প্রবৃদ্ধির নামে জনজীবন যাতে ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে সে দিকে কড়া নজরদারি করা সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। জনজীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে, পরিবেশকে বিপন্ন করে প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়ন অর্থহীন।