হুমায়ুন আজাদের একুশে পদকপ্রাপ্তি ও তাঁর মামলার বিচার

মৌলি আজাদমৌলি আজাদ
Published : 12 August 2012, 10:05 AM
Updated : 12 August 2012, 10:05 AM

"প্রতিটি মানুষ সৃষ্টিশীলতার কিছুটা বিকাশ ঘটিয়ে যায়, আমি এর বিকাশ ঘটিয়েছি লেখার মধ্য দিয়ে । আমার লেখার কয়েকটি ধারা রয়েছে। অমি কবিতা, সমালোচনা, ভাষাবিজ্ঞান, কিশোরসাহিত্য আর সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ক লেখা লিখেছি । লেখক হওয়াটাকে আমি খুব বড় ব্যাপার মনে করিনা , অনেকে লিখতে পারে, আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি গভীর উপলব্ধিবোধ এবং সৌন্দর্যচেতনাকে, আর তা প্রকাশের জন্য আমি লিখি" – লেখালেখির পিছনের কারণ হিসেবে আমার বাবা প্রয়াত লেখক হুমায়ুন আজাদের উক্তি এটি । কি চমৎকার অভিব্যক্তি-গভীর উপলব্ধিবোধ আর সৌন্দর্য বোধ থেকেই তার লেখার ইচ্ছা । তাই তিনি মাত্র ৫৭ বছর বয়সকাল পর্যন্ত এক মুহূত সময়ও অবহেলায় নষ্ট করেননি ।

অবিরাম বিভিন্ন বিষয়ের উপর বই পড়েছেন, পড়িয়েছেন আর যেসব গভীর চিন্তা তাকে প্রচন্ডভাবে আলোড়িত করেছে তা সৌন্দর্যসহ শক্তিশালী ভাষার মাধ্যমে গদ্যে ও পদ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন। কিনা লিখেছেন তিনি? কবিতা, সমালোচনা, ভাষাবিজ্ঞান, কিশোরসাহিত্য, সমাজ রাজনীতি সব শাখাতেই তিনি অবাধে দাপটের সাথে লিখেছেন । এ প্রসঙ্গে তার কিছু লেখার কথা না বললেই নয় । কিশোরদের জন্য বাংলা সাহিত্য সর্ম্পকে সহজ ভাষায় তার চমৎকার লিখিত বইটির নাম লাল নীল দীপাবলী । এই বইটি পড়লে কিশোরকিশোরী তরুণ তরূণীরা দিব্যি হারিয়ে যায় বাংলা ভাষার তিনকালের কবিদের মাঝে । তার রচিত ভাষাবিজ্ঞান বইগুলো বোধ করি বাংলা সাহিত্যের ছাত্রছাত্রীদের জন্য সারা জীবনের এক অমূল্য সম্পদ । কাব্যগ্রেন্থের মাধ্যমে তার লেখার শুরু হলেও তার কাব্যগ্রেন্থের সংখ্যা ছিল মাত্র ৭টি । তার কবিতা পাঠ করলে মনে হয় যেন তিনি শিল্প সৃস্টি করেছেন তার কবিতায় । মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবার রচিত ব্লাডব্যাংক কবিতাটি মুক্তিযোদ্ধাদের যুগিয়েছে সাহস ও অনুপ্রেরণা ।

তাঁর "সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে" বা "আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে" কবিতাগুলো পাঠ করলে তাকে একদিকে যেমন ক্রদ্ধ কবি মনে হয় অপরদিকে তার প্রেমের কবিতাগুলো পাঠ করলে মনে হয় যেন তিনি ভালবাসার এক কবি । বোধ করি কবিরা এমনই হন । বড়দের ভারিক্কি কবিতার পাশাপাশি বাবা ছোটদের জন্য লিখেছেন 'ভাল থেকো আম, ছায়া ঢাকা গ্রাম, ভালো থেকো, ভালো থেকো ঘাষ, ভোরের বাতাস ,' । ফুলের গন্ধে ঘুম আসেনা, আব্বুকে মনে পড়ে,আমাদের শহরে একদল দেবদূত— গ্রাম্য প্রকৃতি ও আবেগকে জানা ও উপলব্ধি করবার জন্য কিশোর কিশোরীদের প্রিয় অসাধারণ কিছু বই । তার রচিত প্রতিটি উপন্যাস যেন বাংলা সাহিত্যের সব উপন্যাসের গতানুগতিকাকে ভেঙে দিয়েছে, সৃষ্টি করেছে একেকটি মূল্যবান কথামালা । নারীবাদ বাবার সবসময় পছন্দের একটি বিষয় । তার রচিত নারীদ্বিতীয় লিঙ্গকে বাংলাভাষায় নারীদের নিয়ে রচিত প্রথম তথ্যবহুল এবং গবেষনাধর্মী বই বলা যেতে পারে । '

৯০-এর দশকে আজকের কাগজ পূর্বাভাষ সহ নানা পত্রিকায় বাবার লিখিত কলামগুলো নানাভাবে সমাজ জাগরণে, সমাজ পরিবর্তনে ব্যবহৃত হয়েছে । বাবা লেখার মাধ্যমে কখনো কখনও সমাজের প্রথাগুলো ভেঙেছেন। আর তাই আলোকিত পাঠকদের করতে পেরেছেন আরো আলোড়িত,চমকিত, আবেগতাড়িত আবার যেসব পাঠক দৃষ্টির প্রসার চান না তাদের করেছেন প্রচন্ডভাবে ক্সুব্ধ। মাঝে মাঝে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করি একজন লেখক যে অবিরাম এত লিখছেন–এর কারণ কী? শুধুই পাঠকের ভালোবাসা/ সম্মান পাওয়া নাকি প্রচুর বই বিক্রি হলে প্রকাশক কর্তৃক সম্মানী পেয়ে তাতে তৃপ্ত থাকা ?

বাবাকে কখনো এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়নি, তাই এর উওর জানা নেই । আবার নিজেকে প্রশ্ন করেছি যে একজন লেখকের জন্য উপরোক্ত প্রাপ্তিগুলোই কি যথার্থ ? মেধাবী লেখকদের মনে কি লেখার স্বীকৃতি স্বরুপ পুরস্কারপ্রাপ্তির কোন আকুতি থাকেনা ? থাকে নিশ্চয়ই, লেখক হলেও রক্তমাংসের মানূষ তো ! বাবা তার জীবদ্দশায় প্রচুর পুরস্কার পেয়েছিলেন, অনেক পুরস্কার তিনি গ্রহণও করেন নি । পুরস্কারের ভারে নিজেকে ভারাক্রান্ত করতে চাইতেন না কখনো । যথাযথ পুরস্কার পাবার জন্য তার চরম আকুতি ছিলো কিনা জানিনা, তবে তার লেখার স্বীকৃতিস্বরুপ বাংলা একাডেমী পুরস্কার যখন তিনি পেয়েছিলেন তখন তার চোখেমুখে তৃপ্তির আভা দেখেছিলাম,যা আজও আমার চোখে ভাসে । কিন্তু বাবা তার জীবদ্দশায় কোন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পাননি। কারণটা সহজেই অনুমেয়। এ ধরনের পুরস্কার পাবার জন্য অনেকসময় দলাদলি/তোষামোদি ব্যাপারটিও ব্যক্তির কর্মের চেয়েও বেশি বড় হয়ে দেখা দেয় । তার কর্ম সুবিশাল হলেও উপরোক্ত দুটি যোগ্যতা ছিল তার মাঝে অনুপস্থিত । আর তাই রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের ঝুলি ছিল তার সম্পূর্ন খালি । তবে বাবা বেঁচে থাকা অবস্থায় বেশ কয়েকবার শুনেছিলাম যে এবার হয়তো তিনিই রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পাচ্ছেন-কিন্তু শেষপর্যন্ত তার নাম আর ঘোষিত হয়নি । এতে ভিতরে ভিতরে তার কী প্রতিক্রিয়া হতো তা তিনি মুখ ফুটে পরিবারকে বলেন নি কখনো।

অবশেষে তার মৃত্যুর ৮ বছর বাদে ভাষা ও সাহিত্যে তার বিশেষ অবদানের জন্য দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক একুশে পদক তাকে দেয়া হলো । বাবার মরনোত্তর একুশে পদক প্রাপ্তিতে তার অগণিত ভক্তদের (তিনি নেই বিধায় ) কাছ থেকে আমাদের পরিবারের সকল সদস্যদের মুঠোফোনে অসংখ্য কল ও মেসেজ আসতে লাগলো । বেশির ভাগ ভক্তদেরই কথা অবশেষে বর্তমান সরকার হুমায়ুন আজাদকে যথাযথ সম্মান দিলেন বা অবশেষে বাংলাদেশের হুমায়ুন আজাদের কাছে যে ঋণ ছিল সে ঋণ পরিশোধ হলো। এরকম অসংখ্য শুভেচ্ছাবার্তায় বাবার অবর্তমানে আমরাই সিক্ত হলাম যেন । ইতিপূর্বে কোন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে যাওয়া হয়নি আমার । বাবার একুশে পদক প্রাপ্তিতে উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবার জন্য কন্যা হিসেবে চমৎকার একটি কার্ডও পেলাম । ওসমানী মিলনায়তনে সুধীজন পরিবেষ্টিত এরকম একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে একদিকে ভালো লাগা ও অন্যদিকে বুকের মধ্যে একটা দলা-পাকানো কান্নার অনুভূতি আসছিল যেন। চোখের লেন্সে অবিরাম বাবা ঘুরছিলেন । বসে ছিলাম ওসমানী মিলনায়তনে কিন্তু মন বারবার চলে যাচ্ছিল রাড়িখালে বাবার সমাধিক্ষেত্রে । মনের ভিতর বাইরে এরকম মিশ্র অনুভূতি যা আগে কখনো হয়নি।

বাবার একুশে পদকটি মাননীয় প্রধানন্ত্রীর কাছ থেকে আমাদের মা গ্রহণ করেন । পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠান শেষে কন্যা হিসেবে আবারো অসংখ্য অভিনন্দনে ভূষিত হলাম । হঠাৎই দুএকজন সাংবাদিকের কথায় অভিনন্দন বার্তা পাওয়ায় ছেদ পড়লো যেন । তাদের প্রশ্ন: স্যার বেঁচে থাকলে কি এই রাষ্ট্রীয় পুরস্কার গ্রহণ করতেন ? আমি বললাম, "আমি হুমায়ুন আজাদ নই, আমি তার কন্যা মাত্র, তিনি আজ নেই, তাই তিনি পুরস্কার গ্রহণ করতেন নাকি করতেন না সে সর্ম্পকে আমরা কোনদিনও আর তার মনোভাব জানতে পারবো না । তবে আমার বিশ্বাস, এখন ২০১২ সাল, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি ক্ষমতায়, দেশে এখন মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তিচিন্তার জোয়ার । তিনি আজ বেঁচে থাকলে এই মুক্ত, স্বাধীন পরিবেশে আরো শানিত ভাষায় লিখতে পারতেন । দুর্ভাগ্য তার, তার নশ্বর দেহ আজ নেই বলে তিনি লিখতে পারছেন না আর দুর্ভাগ্য জাতির কারণ আজ তারা হুমায়ুন আজাদের লেখা পড়তে না পেরে নতুন নতুন পথের সন্ধান পাচ্ছেন না। এই সময়ে তার জীবিত থাকা জরুরী ছিল।

আজ যেহেতু দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন, দেরীতে হলেও বর্তমান সরকার তাকে মূল্যায়িত করেছেন, সুতরাং আমার বিশ্বাস তিনি বেঁচে থাকলে এ পুরস্কার তিনি গ্রহণ করতেন । সব কিছুইতো অবস্থা ও সময়ের উপর নির্ভরশীল, তাই না ?" আমি ব্যক্তিগতভাবে বাবার পুরস্কার প্রাপ্তিতে খুশি ও বর্তমান সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ ।

আগষ্টের ১২ তারিখ বাবার ৮ম মৃত্যুবার্ষিকী, চোখের পলকে সময়গুলো চলে যাচ্ছে , কিন্তু বাবা ২০০৪ সালে বাংলা একাডেমী বইমেলা থেকে ফেরার পথে যে আত্রান্ত হয়েছিলেন সেই হত্যাপ্রচেষ্টা মামলাটির বিচার যেন থমকে আছে। বারবার মামলাটি বিভিন্ন হাতবদল হয়ে বর্তমানে হত্যামামলায় পরিণত হয়েছে, কিন্তু মামলাটির প্রথম বিচারের দিনেই কোন অগ্রগতি সাধিত হয়নি । আমি চাইনা বারবার মামলার ডেট পরুক আর অযথা এই মামলাটির বিষয়ে সময়ক্ষেপন করা হোক । বর্তমান সরকারের কাছে আমার একটাই আকুল আবেদন বর্তমান সরকারের সময়কালের মধ্যে হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলাটির বিচার যেন দ্রততার সাথে সঠিক আসামী ও ইন্ধনকারীদের চিহ্নিত করার মাধ্যমে নিষ্পন্ন হয়। একজন লেখকের উপর জঘন্য হামলার বিচার কি এদেশে হবেনা-এরকম বাংলাদেশই কি আমরা চেয়েছিলাম?