'স্যার, বাজারে তো লবণ নাই! লবণের কেজি ২০০ টাকা হয়ে যাচ্ছে। তাই ৫ কেজি লবণ একসাথে কিনে ফেললাম। স্যার, যা পারেন লবণ নিয়ে নেন। শেষ হয়ে যাচ্ছে, পরে কিন্তু আর পাবেন না, স্যার! আপনার অফিসে আসার পথে আমি দেখে এসেছি- মানুষ লাইন ধরে লবণ কিনছে! আপনি চাইলে না হয় আমার কাছ থেকেই আপনাকে দুই কেজি দিয়ে দেই?'- গত মঙ্গলবার বিকেলে (১৯ নভেম্বর,২০১৯) আমার অফিসে এসে তাক লাগানো এই কথাগুলো বলছিলেন আমারই খুব পরিচিত এক ক্লায়েন্ট।
অবাক না হলেও কিছুটা কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'পেঁয়াজের রেশ কাটতে না কাটতেই আবার লবণের কি হলো?' 'স্যার, লবণের নাকি সাপ্লাই শেষ!', বিস্মিত ক্লায়েন্টের জবাব। বললাম, 'ভাই, এসব গুজবে কান দিয়েন না। গুজবের পিছনে ছুটে আপনারা ৫ মাসের লবণ যদি এক দিনেই কিনে ফেলেন, তাহলে তো বাজারে লবণের কৃত্রিম সংকট তৈরি হবেই। অসাধু ব্যবসায়ীরা তো এটাই চায়। আপনি ধোঁকা খেয়ে বোকা হবেন, আর এ সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা হাতিয়ে নিবে কোটি কোটি টাকা। বরং এসব ক্ষেত্রে আমাদের উচিৎ- এসব গুজবতাড়িত পণ্য না কেনা, অথবা প্রয়োজনের চেয়েও পরিমাণে কম কেনা।' 'স্যার, কী বলেন? পেঁয়াজ ছাড়া তরকারি হয়, লবণ ছাড়া নয়!'
আমারও মনে পড়ে গেল- আমার স্ত্রীই তো ডিম ভাজিতে কখনোই পেঁয়াজ খান না, কিন্তু ভাতের সাথে বাড়তি কাঁচা লবণ না নিলে তার খাওয়াই যেন হয় না! তবে লবণ না খাওয়া মানুষের উদাহরণ খুঁজতেও বেশি দূর যেতে হলো না। আমি নিজেই পান্তা ভাতে কিংবা দুধভাতে কখনোই লবণ খাই না, এমনকি তরকারিতে লবণ কম হলেও কাঁচা লবণ নিই না। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, পেঁয়াজ-লবণ ছাড়াও খাবার খাওয়া যায়! কিন্তু এটা কোনো সুস্থ ও স্থায়ী সমাধান নয়। কারণ, আমার স্ত্রী ডিমভাজিতে পেঁয়াজ খান না মানে এই নয় যে, সে সব তরকারিই পেঁয়াজ ছাড়া খান। আমি পান্তাভাত আর দুধভাতে লবণ খাই না- এটাও ব্যতিক্রম, অন্যসব খাবারেই আমার স্বাভাবিক লবণ চাই। হরেক পদের মসলা ছাড়া রান্না চললেও মরিচ-পেঁয়াজ-লবণ ছাড়া রান্নার কথা তো ভাবাই যায় না। অনেক ব্যাচেলরদের তো এই মরিচ, পেঁয়াজ, লবণ, আলু আর ডালেই বছরের অর্ধেক অন্নাহার চলে। মরিচ-পেঁয়াজও বাদ দিয়ে দিলাম, কিন্তু লবণ ছাড়া চলবে কি? তরকারিতে লবণ নাই তো রান্নার স্বাদ নাই, রাঁধুনির গুণ নাই!
আর অতি প্রয়োজনীয় বলেই এসব ভোগ্যপণ্যকে তুরুপের তাস করে জিম্মি করা হচ্ছে সাধারণ ভোক্তাদের, পকেট কাটা হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষের। দাম বাড়ানোর কূটকৌশল হিসেবে বেছে নেওয়া হচ্ছে 'গুজব' নামক অস্ত্রকে। বর্তমানে ফেসবুকীয় যুগে এসব গুজব পাখা মেলতে সময় লাগে না। আবার এসব গুজবের বার্তাবাহক হিসেবে বোকা এবং হুজুগে মানুষের তো আর অভাব নেই আমাদের দেশে, যারা চাঁদে মানুষের মুখ আর পদ্মাসেতুতে কাটা মুণ্ডু দেখতে পায়। গুজবতাড়িত এসব সহজসরল মানুষগুলোকে বোকা বানিয়ে নীতি-নৈতিকতাবিবর্জিত এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী রাতারাতি টাকার কুমির বনে যেতে চান। সফলও হচ্ছেন অনেকাংশেই। আর তাই বারবার নানা গুজবের বাষ্পভর্তি বেলুন ছেড়ে দিচ্ছেন বাজারে। আর ক্রেতারা সেই বেলুনের পিছন পিছন দৌড়ে চলেন, ডানে-বামে কিছু না দেখে, না শুনে, না বুঝেই।
তবে কেবল আমাদের বোকামির কারণেই যে অভেদ্য সিন্ডিকেটগড়া এসব ব্যবসায়ীরা আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে- এমনটাও নয়। ভীতুমনারাও এসব গুজবে ঘি ঢালে। ভয় হয়, পাছে পানসে তরকারি খেতে হয়! লবণের না জানি কখন আবার পেঁয়াজের দশা হয়, তাহলে ৩৫ টাকার লবণ তো সাড়ে ৩০০ টাকায় কিনতে হতে পারে! তাই এখনি দেড়শ টাকা দরে হলেও যত বেশি লবণ কিনে ফেলা যায়, ততই যেন সাশ্রয়ী (!) হওয়া যায়। সাড়ে ৩০০ টাকায় কেনার চেয়ে দেড়শ টাকায় কিনতে পারলে অনেক সাশ্রয়- কেজিতে দুইশ টাকা! এ তো গেল ভীতু শ্রেণির কথা। আরেক শ্রেণি আছে- পেটুক আর লোভী শ্রেণি, বিজ্ঞাপনের মতো করে বলে ওঠেন- 'পেঁয়াজ আর লবণ ছাড়া আমার চলেই না!' তারা পেঁয়াজের কেজি হাজার আর লবণের কেজি পাঁচশ হলেও কিনবে। কারণ খাবারটা যে তাদের সুস্বাদু আর লোভনীয় হওয়া চাই-ই চাই!
মজুদদার, ফটকাবাজ শব্দগুলো ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেই আমরা শুনে আসছি। পণ্যের কৃত্রিম ঘাটতি তৈরি করতে ফটকাবাজ ব্যবসায়ীরা পণ্যের নিয়মিত সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে গুদামজাত করে রাখে। আবার কেউ কেউ ভবিষ্যতে আরও বেশি দামে বিক্রয়ের আশায় বেশি পণ্য অগ্রিম কিনে মজুদ করে রাখে, বিক্রয় বন্ধ রাখে। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে সৃষ্টি হয় সরবরাহ ঘাটতি। যতটুকু পাওয়া যায় সেটা কিনতে হয় স্বাভাবিক দামের চাইতে বাড়তি দামে। তবে এখন ভোক্তারাও ফটকাবাজদের সহযোগী হয়েছেন। ব্যবসায়ীরা মজুদ করেন, কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ভোক্তাদের জিম্মি করে বেশি মূল্য আদায় করতে। আর পেটুক ও ভোজনপাগল মানুষরা মজুদ করেন- পাছে কম খেতে হয় বা না খেয়ে থাকতে হয়- এই ভয়ে। এই দ্বিপক্ষীয় টানাটানিতে মজুদ দ্বিগুণ হচ্ছে- ফটকাবাজ ব্যবসায়ীর গুদামে আর হুমড়ি খেয়ে পড়া ক্রেতাদের রান্নাঘরে। এতে নিয়মিত বাজারে সরবরাহ সংকট দ্বিগুণ হয়, দামও বাড়ে জ্যামিতিক হারে।
ব্যবসায়ীদের এসব কারসাজি আর ভিত্তিহীন গুজব প্রতিহতকরণে তাই সাধারণ ভোক্তা পর্যায়ে বোধোদয় প্রয়োজন। দুই দিন উদরপূর্তি করে না খেয়ে, সবসময় পরিমিত খাওয়ার মানসিকতা গড়ে তুলা প্রয়োজন। আহারে, ভোজনে নিজেদের সংযমী চর্চায় অভ্যস্ত করা উচিৎ। আমাদের খাদ্যমন্ত্রী পেঁয়াজ ছাড়াই ২২ পদের তরকারি খান। আমাদের দিনের তিন বেলার খাবারে মোটামুটি ৯ পদের তরকারি হলেই চলে। ২২ পদের তরকারি পেঁয়াজ ছাড়া খাওয়া গেলে ৯ পদের তরকারিও লবণ ছাড়া খাওয়া যাবে। এটা হচ্ছে ব্যবসায়ীদের ঢিলের বিপরীতে আমাদের পাটকেলটি ছুঁড়ে দেওয়ার জন্য। তবে বিশেষ কোনো ব্রত ছাড়া বাধ্য হয়ে না খেয়ে থাকাটা অমানবিক।
তাই সর্বস্তরের ব্যবসায়ীদের নৈতিক উন্নয়ন প্রত্যাশা করি। মন্ত্রীরাসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে লাখ লাখ মানুষ শপথ করে বলবেন তারাও পেঁয়াজ কিনবেন না, আমার স্ত্রী পেঁয়াজ খাবেন না, আমি পান্তাভাত-দুধভাতে লবণ খাব না- এটা কোনো স্বাভাবিক চিত্র হতে পারে না। অভ্যাস বা ডায়েটিংয়ের প্রয়োজনে হলে দোষের কিছু নেই। তবে দামের বিরুদ্ধে অভিমানী বা প্রতিবাদী হয়ে কোনো পণ্য, বিশেষ করে ভোগ্যপণ্য বাধ্য হয়ে না খাওয়ার পণ করাটা নিশ্চয়ই এদেশের ব্যবসায়ীদের ধর্মীয় ও নৈতিক আদর্শের ভূলুন্ঠিত চেহারা দেখায়।