বাবরি মসজিদ : ভূতের ভবিষ্যৎ

হাসান মাহমুদহাসান মাহমুদ
Published : 21 Nov 2019, 09:14 AM
Updated : 21 Nov 2019, 09:14 AM

বিষয়টা কিন্তু খুবই সিম্পল ছিল। কিন্তু সেটাকে এতো প্যাঁচানো হয়েছে যে বলার নয়। কেউ যদি বাবরি মসজিদের ওপরে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়টার ব্যবচ্ছেদ থেকে আইন ও তার অপপ্রয়োগ শিখতে চান তবে তাদের জন্য গোল্ড মাইন হল ন্যাশন্যাল একাডেমি অফ লিগ্যাল স্টাডিজ এন্ড রিসার্চ-এর ভাইস চ্যান্সেলর ড. ফাইজান মুস্তাফা'র করা বাবরি মসজিদের ওপরে ভিডিও সিরিজ। সেটা দেখলেই আমাদের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে যে দানবীয় মগ্ন-মৈনাক, তার চুড়োটা দেখা যাবে। ঘটনা অনেক, অতি সংক্ষেপে:-

  1. মসজিদটা বানানো হয়েছিল ১৫২৮ সালে।
  2. ১৮৮৫-এর পর থেকে ওখানে উপাসনার অধিকার ও জমির মালিকানা নিয়ে হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে ক্রমাগত মামলার পর মামলা হয়েছে।
  3. ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের গবেষণার রিপোর্টে বলা হয়েছে মসজিদের নীচে বহু পুরোনো একটি কাঠামোতে কুমীর, মানুষ ও পশুপাখির টেরাকোটা পাওয়া গেছে যা মসজিদ সংস্কৃতির সাথে যায় না। কিন্তু কাঠামোটা যে মন্দিরেরই ছিল তা সুস্পষ্ট নয়।
  4. মামলাগুলো চলাকালীন কোর্টের "স্টে অর্ডার" অর্থাৎ "ওখানে কেউ যেতে পারবে না" অবস্থাতে পুলিশের উপস্থিতিতেই ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, ভারতীয় জনতা পার্টি ও শিবসেনা'র নেতৃত্বে হাজার হাজার অস্ত্রধারী গুন্ডারা এসে মসজিদটা ভেঙে ফেলে।
  5. এর প্রতিক্রিয়ার দাঙ্গার শিকার হয়েছে উপমহাদেশের হাজারো হিন্দু-মুসলিম।
  6. ৯ নভেম্বর ২০১৯, দালিলিক প্রমাণ নয় স্রেফ "হিন্দুদের বিশ্বাসের ভিত্তিতে" ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে ভগ্ন মসজিদের ২.৭৭ একরের ওপর মন্দির বানানো হবে এবং মুসলিমদেরকে মসজিদ বানানোর জন্য অন্যত্র ৫ একর জমি দেয়া হবে।
  7. যখন বহু আগে থেকেই জমির মালিকানা নিয়ে মামলা চলছে তখন যদি ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর হাজার হাজার অস্ত্রধারী গুন্ডারা মসজিদটা না ভাঙ্গতো তাহলে সেটা আজও দাঁড়িয়ে থাকত। সেক্ষেত্রে কোর্ট কি মসজিদ ভেঙে জমিটা মন্দিরের জন্য দিতে পারতেন?

না, পারতেন না। জমি মসজিদেরই থাকত।

তাহলে?

সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ভারসাম্যহীনতা এতই স্পষ্ট যে এর কড়া সমালোচনা করেছে হিন্দু আইনজীবী, প্রাক্তন বিচারপতি থেকে শুরু করে সন্ন্যাসী, সুশীল সমাজ হয়ে গৃহবধূ পর্য্যন্ত। সবাই বিশ্লেষণ করছেন মামলাটার প্রেক্ষাপট ও তার "ভূত" অর্থাৎ অতীত। আমি তাকিয়ে আছি সেই ভূতের ভবিষ্যতের দিকে। আমার কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে জ্বলজ্বলে হিংস্র চোখে তাকিয়ে আছে অজানা এক হিন্দুর ফেসবুক পোস্ট, ওটা আমাকে পাঠিয়েছে উৎকণ্ঠিত এক মুসলিম বন্ধু। পোস্টটাতে তিনটে ছবি আছে, (১) বামদিকে ভগ্ন বিধ্বস্ত বাবরি মসজিদ, (২) ডানদিকে এক বিশাল সুসজ্জিত মন্দির, ও (৩) মাঝখানে সুপ্রিম কোর্ট। ফেসবুক পোস্টে লেখা আছে- "হাঃ হাঃ হাঃ!! ……."(এর পরে আমাদেরকে, আমাদের ধর্মকে ও স্রষ্টাকে এত কুৎসিত ও অশ্লীল শব্দে বাক্যে ঠাট্টা অপমান করা হয়েছে যে লেখা যায় না)।

গল্প নয়। একদিকে, ভারতে ক্রমাগত দাঙ্গায় পিষে গেছে হাজারো মুসলিম, এখনো তাদের প্রতিটি দিন উৎকণ্ঠায় কাটে। অন্যদিকে, গত অর্ধ শতাব্দী ধরে পাকিস্তান বাংলাদেশে হিন্দুদের চোখের সামনে ক্রমাগত ভাঙা হয়েছে শত শত মন্দির আর বিগ্রহ, বেদখল হয়ে গেছে জমিজমা বাড়িঘর, শাস্তি পায়নি অপরাধীরা। কোটি হিন্দুরা পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে বৌ-বাচ্চার হাত ধরে বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাসে রওনা হয়েছে অজানা অনিশ্চয়তার দিকে, মানুষের ইতিহাসে এতবড় অশ্রুসজল নীরব মাইগ্রেশন আর কখনো হয়নি।

"ওয়াতান জমিঁ-হি রহি, হাম সরহাদোঁ মে বাঁট গ্যয়ে,

না জানে কব হাম মন্দির ঔর মসজিদোঁ মে বাঁট গ্যয়ে" – (অজানা)।

মাতৃভূমির মাটি সেই আগের মতোই আছে, আমরা সীমান্ত দিয়ে খণ্ডিত হয়ে গেছি,

জানি না কবে আমরা মন্দির আর মসজিদ দিয়ে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছি …..

(ধর্ম নয়, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সম্বন্ধে বলা হচ্ছে)।  

এখন সুপ্রিম কোর্টের রায়ের শক্তিতে তাদের অনেকেরই মনে রক্তচোখে উঠে দাঁড়াবে বহু বছর ধরে জমে ওঠা তীব্র ক্ষোভ ও ক্রোধ। ভাঙা মসজিদের জায়গাটায় মন্দির হলে হিন্দু সন্ত্রাসীরা ভাঙা মসজিদের ছবির পাশে নতুন মন্দিরের ছবি ইত্যাদি একত্রিত করে অনন্তকাল ধরে ইন্টারনেটে জয়ডংকা বাজিয়ে মুসলিমদেরকে অপমান ও আঘাত করতে থাকবে। ফলে কোনো এক মারাত্মক মুহূর্তে কোনো ক্রুদ্ধ মুসলিম যুবকের হাতে ঘাতক অস্ত্র ঝলসে ওঠার সম্ভাবনা শতকরা ১০০%। তার জবাবে মুসলিমদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে হিংস্র হিন্দুশক্তি, সেই আগুনে অনতিবিলম্বে ঘি ঢালবে হিংস্র ধর্মগুরুরা। শুরু হবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সেই দাবানল-তরঙ্গ এসে আছড়ে পড়বে বাংলাদেশেও। আবারও ব্যর্থ হবেন শান্তিময় আলেমরা, ঠিক যেমন ১৯৯২ সালে গুজরাটের দাঙ্গায় মুসলিম-হত্যা থামাতে ব্যর্থ হয়েছিল হিন্দুদের শান্তির পক্ষের জনগণ, রাজনীতিক এমনকি সন্ন্যাসীরাও।

শিক্ষা নাও ইতিহাস থেকে। রজ্জুকে সর্পভ্রম করলে অসুবিধে নেই কিন্তু সর্পকে রজ্জুভ্রম করা সমূহ বিপজ্জনক। রাষ্ট্র সমর্থিত সাম্প্রদায়িকতার মতো বিষাক্ত কালনাগিনী আর নেই। হিন্দুত্ববাদের অক্টোপাস সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের নাগপাশে বেঁধে ফেলেছে ভারতের মুসলিমদেরকে, যেমন করেছিল পাকিস্তানের হিন্দুদেরকে আইয়ুব খানের "এনিমি প্রপার্টি" আইন। হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে যে গজ-কচ্ছপ লড়াই বাধিয়ে দিয়েছে কিছু রাজনৈতিক ধর্মনৈতিক নেতা সেটা থামাতে গরুড় হয়ে কবে কোন নেতা আসবেন জানি না। এর মধ্যে লম্ফ দিয়ে উঠেছে বলিউড, অজয় দেভগন'কে নিয়ে বাবরি মসজিদের ওপরে মুভি বানাবে তারা।

৬ নভেম্বর ১৯৯২ বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রতিক্রিয়াতে বাংলাদেশে দাঙ্গায় বাংলাদেশের হিন্দুদের প্রতি হুংকার উঠেছিল- "তোরা আমাদের মসজিদ ভাঙলি কেন"? এই আহম্মক প্রশ্নের কি জবাব দেবে বাংলাদেশের হিন্দুরা? ১৯৪৬ সালের জিন্নাহ'র ডাকা ১৬ অগাস্টের "ডায়রেক্ট অ্যাকশন"-এর ফলে সৃষ্ট ভয়াবহ দাঙ্গাতেও কলকাতায় প্রশ্ন ছুঁড়েছিল মুসলিম দাঙ্গাবাজ- "কয়টা হিন্দু মারিয়াছেন আপনি? মুখে মুখেই মুসলিম প্রীতি!" – 'আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর', আবুল মনসুর আহমদ, পৃষ্ঠা ২৫৪। সব ধর্মের দাঙ্গাবাজেরই এটা কমন দাবি- "ওদের কয়টাকে মেরেছ?"

মত্ত দরিয়া, নাও ডুবুডুবু, মৃত্যু জীবন-নদীর দুধারে,

এধারে রক্তচক্ষু পুরাণ, রক্তচক্ষু কোরান ওধারে ….

কেতাবে যাই লেখা থাকুক বাস্তবে এই হল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।

এর মধ্যেই ইন্টারনেটে তথাকথিত "বিশেষজ্ঞদের নির্ভরযোগ্য গবেষণা"-এর ভিত্তিতে অজস্র পোস্টিং দিয়েছে উগ্র হিন্দুরা- ভারতে নাকি এই এই হাজারো জায়গায় এই এই হাজারো মসজিদ এমনকি তাজমহলও নাকি বানানো হয়েছে মন্দিরের ওপর। সেগুলোর কি হবে তাহলে? বৌদ্ধ রাজত্ব শেষ হলে হিন্দু রাজারা অনেক বৌদ্ধমন্দির ধ্বংস করে সেখানে মন্দির বানিয়েছিল। জায়গা ও মন্দিরের নাম ধরে ধরে সেই একাডেমিক রিসার্চের তালিকা আমরা পেয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে। সেগুলোর কি হবে তাহলে? কেউ কি এই কমনসেন্স প্রশ্নটা করবেন, মোগল বাদশাদের জমির এমন কি অভাব ছিল যে মন্দিরের ওপর মসজিদ বানাতে হবে? কেউ কি এই কমনসেন্স দাবিটা করবেন- অতীতে যা হয়েছে হয়েছে, তার জন্য আজ আমরা কিছুতেই পরস্পরের কল্লা কাটব না, পরস্পরের বাচ্চাদের কল্লা কাটব না?

ভারতের মুসলিম নেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রায়টার ওপরে রিভিউ-এর আবেদন করবেন। একটা জলজ্যান্ত মসজিদ যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল কয়েক শতাব্দী, নামাজ হয়েছে দোয়া কালাম খুৎবা হয়েছে, জমির মালিকানা তো তাতেই প্রমাণিত। সুপ্রিম কোর্ট যদি সেটা নাও দিতে পারেন তাহলেও ওখানে "সম্প্রীতি হাসপাতাল" বা "সম্প্রীতি সৌধ পার্ক" বা "সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি জাদুঘর" ধরণের কিছু একটা করা যেতে পারে। এর অন্যথা হলেই জন্ম নেবে অনন্তকাল ধরে হিংস্র ও রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সম্ভাবনা। মনে রাখা দরকার, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মূল চালিকাশক্তি ধর্মপালন ও স্রষ্টাকে তুষ্ট করার প্রবণতা।

"মানুষের ওপরে মানুষ কখনো এতো উল্লাসের সহিত এতো সর্বগ্রাসী হিংস্রতা করে নাই যখন সেই হিংস্রতা সে তাহার স্রষ্টাকে তুষ্ট করিবার জন্য করিয়াছে"।