ফসলের সঠিক মৌসুম নির্ধারণে বিপাকে কৃষক

মো. আববাস আলী
Published : 19 Nov 2019, 10:37 AM
Updated : 19 Nov 2019, 10:37 AM

আমরা জানি, বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, তাপমাত্রা,বায়ু-প্রবাহ এবং বৃষ্টিপাতের ধরণের পরিবর্তনের কারণে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের ঐতিহ্যবাহী ছয় মৌসুমের অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি, যা বাংলাদেশের ভবিষ্যতকে হুমকির মুখে ফেলছে। ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ফ্ল্যাশফ্লাড, ঘূর্ণিঝড়, বজ্রপাত এবং ভূমিধসের ক্রমবর্ধমান ঘটনা ও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন মানুষের জীবন ও প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি করছে। Global Climate Risk Index 2019-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯৯৮ থেকে ২০১৭ অর্থাৎ গত ২০ বছরে "চরম আবহাওয়াজনিত দুর্যোগগুলির" কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তমতম ক্ষতিগ্রস্থ দেশ।

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কয়েক বছর ধরে সেশনের দৈর্ঘ্য ও সময়কাল পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়ার রীতি অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করেছে। আবহাওয়ার এরূপ অদ্ভুত আচরণের কারণে কখন একটি মরসুম শুরু হবে বা শেষ হবে তা আমরা বা কৃষকরা এখন অনুমান করতে পারি না। গত বছরের ডিসেম্বরে কম শীত অনুভব করেছি এবং শীতের দৈর্ঘ্য খুব কম ছিল। আমরা প্রত্যক্ষ করছি যে, এই বছরেও নভেম্বর শেষ হতে যাচ্ছে এবং ডিসেম্বর শুরুর দিকে কিন্তু শীতের তীব্রতা প্রত্যাশিত পর্যায়ে নেই। শীত মৌসুম এই বছর খুব সংক্ষিপ্ত হবে বলে মনে হচ্ছে। ইদানিং আমরা জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে তাপমাত্রা বৃদ্ধির একটা প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি। এখন আর বর্ষাকালে আগের মত বৃষ্টিপাত হয় না, বরং প্রচণ্ড গরম অনুভব হয় এবং শীতকালের দৈর্ঘ্য কম হওয়ায় ভুট্টা, আলু, শীতকালীন সবজি, ধান, গম, টমেটো ও অন্যান্য ফসলের সঠিক মৌসুম বা বপন ও রোপণের সময় নির্ণয় করা কৃষকের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আবহাওয়ার অস্বাভাবিক গতি-প্রকৃতির কারণে বাংলাদেশের কৃষকরা বিভিন্ন ফসলের আবাদ করতে গিয়ে ভীষণ সমস্যায় পড়ছেন। তাপমাত্রা বৃদ্ধি বিভিন্ন উদ্ভিদের ফুল ও ফল ধরার সময়কে প্রভাবিত করছে। বাংলাদেশে ফসলের উৎপাদনের সামগ্রিক অনিশ্চয়তা দিন দিন বাড়ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বায়ু প্রবাহ এবং বৃষ্টিপাতের ধরণের পরিবর্তনের কারণে কৃষকদের জন্য ফসলের সঠিক মৌসুম নির্ধারণ করাটা কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। অন্যদিকে কৃষি উপকরণ সরবরাহকারী যে সব সরকারি ও প্রাইভেট কোম্পানি আছে তাদের কৃষি উপকরণ যেমন ভুট্টার বীজ, হাইব্রিড ধান বীজ, বিভিন্ন ধরণের সবজির বীজ, আলুর বীজ, উফসী ধান বীজ, টমেটোর বীজসহ অন্যান্য বহু বীজ আমদানি ও বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বিশাল প্রভাব পড়ছে। দিন ও রাতের তাপমাত্রার হেরফেরের কারণে ফসলের ফলনের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে, যেটা হয়তো অনেকে আমরা বুঝতে পারছি না বা বুঝলেও বড় ফ্যাক্টর মনে করছি না কিন্তু কিউমিলেটিভ হিসেবে হিসাব করলে, এর ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে এক বিরাট অংকের টাকা। কৃষি বিশেষজ্ঞ,আবহাওয়া অধিদপ্তর, পরিবেশ বিজ্ঞানী, কৃষক ও কোম্পানি প্রতিনিধি এবং সরকারের নীতিনির্ধারক যারা আছেন তাদের সবাইকে নিয়ে ফসল পঞ্জিকা বা ক্রপ ক্যালেণ্ডার ফাইন টিউনিং বা ঠিকঠাক করা বিষয়ে একটি গোলটেবিল বৈঠক করা অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে।

ফসলের সঠিক মৌসুম নির্ধারণে কৃষক ব্যর্থ হলে প্রত্যেকটি ফসলের উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিক্রয়ের সময়ের তারতম্য হবে ফলে কৃষিপণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে একটা বিশাল ফারাক আমরা অতি সম্প্রতি দেখতে পাবো। তাছাড়া মৌসুমের সময়ের পরিবর্তনের কারণে নিত্য নতুন পোকা-মাকড়, রোগ-বালাই দেখা যাচ্ছে, যেগুলোর সমাধান এখন পর্যন্ত কোনো বহুজাতিক তথা দেশীয় কোম্পানিগুলোর সঠিক সমাধান আনতে পারেনি যার দরুণ কৃষকদের মধ্যে একটা অসহায় অবস্থা বিরাজ করছে।

আমরা জানি ডিসেম্বর–জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এই তিন মাস শীত, মার্চ-এপ্রিল ও মে গ্রীষ্ম, জুন-জুলাই ও অগাস্ট বর্ষা এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ও নভেম্বর হলো বর্ষা পরবর্তীকাল হালকা তাপমাত্রা থাকার কথা কিন্তু আমরা গত ১০ বছরে এর বেশ তারতম্য দেখতে পাচ্ছি যার ফলে বিভিন্ন ফসল বপনে, রোপনে ও ফলনেও ব্যাপক তারতম্য দেখা দিচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- আলুর ক্ষেত্রে মাটির তাপমাত্রা যত বেশি ঠাণ্ডা হবে টিউবার বা আলুর ফরমেশন ও সংখ্যা তত বেশি হবে, আলুর জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা হলো ১৫-২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড কিন্তু কোনো কারণে যদি তাপমাত্রার বেশি তারতম্য হয় তাহলে ফলনে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। আবার টমেটোর ফল ধরার জন্য দিন ও রাতের তাপমাত্রা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, রাতের তাপমাত্রা ১০-১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং দিনের তাপমাত্রা ২৫-৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হলে ফুল ধরা ও ঝরাতে কোন সমস্যা হয় না কিন্তু তাপমাত্রা যদি পর পর ২ দিন ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের উপরে থাকে তাহলে টমেটোর ফল ধরা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। অপরদিকে ভুট্টা বীজের সঠিকভাবে গজানোর জন্য ১৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা খুবই উপযুক্ত এবং সঠিকভাবে বৃদ্ধি ও গুণগত মানসম্পন্ন দানার জন্য ২৪-৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড অত্যন্ত জরুরি। যদি কোনো কারণে তাপমাত্রা খুব বেশি গরম, খুব বেশি ঠাণ্ডা ও খুব বেশি শুকনো হয় তাহলে মোচার মাথার শুরুতে কোনো দানা গঠন হবে না। পেঁয়াজের পাতা, মূল এবং কন্দ বা বাল্ব গঠনের জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা প্রয়োজন ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। একবার যদি পেঁয়াজের কন্দ বাড়া শুরু হয়ে যায় তখন তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের উপরে গেলেও কোনো সমস্যা হয় না। তেমনিভাবে ফুলকপি অত্যন্ত তাপমাত্রা সেনসিটিভ, যদি কোনো কারণে তাপমাত্রা ২৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের উপরে চলে যায়, সেক্ষেত্রে ফুলের মধ্যে পাতা গজিয়ে যায়, যেটাকে আমরা বাঁটনিং বা বল্টিং বলি। ধান একটি থার্মোফলিয়াস ফসল অর্থাৎ বেশি তাপমাত্রা পছন্দনীয় ফসল, সাধারণত, ২৫-৩৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা হলে এর ফলনে কোন হেরফের হয় না। ডাল জাতীয় শস্যের বর্ধনশীল অবস্থায় কম তাপমাত্রা কিন্তু পরিপক্কতার সময় উচ্চ তাপমাত্রার দরকার হয়, তবে সঠিকভাবে বাড়ার জন্য গড় তাপমাত্রা ১৮-৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হলে কোনো অসুবিধা হয় না।

জলবায়ু ও আবহাওয়াগত পরিবর্তনের কারণে উল্লেখিত ফসলগুলির সঠিক মৌসুম নির্ধারণে বর্তমানে বাংলাদেশের কৃষকদের জ্ঞান ও ধারণা খুব কম, ফলে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্জিত টাকা দিয়ে নতুন করে ফসল ফলাতে অসহায় কৃষকদের প্রায়শই বিপাকে পড়তে হয়। তাই সময় এসেছে যারা কৃষি বিশেষজ্ঞ, আবহাওয়া অধিদপ্তর, পরিবেশ বিজ্ঞানী, সচেতন সমাজ, কৃষি বিষয়ক সাংবাদিক, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াসহ কৃষক ও কোম্পানি প্রতিনিধি এবং সরকারের নীতিনির্ধারক যারা আছেন তাদের সবাইকে নিয়ে ফসল পঞ্জিকা বা ক্রপ ক্যালেন্ডার ফাইন টিউনিং বা ঠিকঠাক করার বিষয়টি নিয়ে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা বা ক্যাম্পেইন করা যাতে করে বিষয়টি সবার দৃষ্টিগোচর হয় এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট যত স্টেকহোল্ডার আছে তাদেরকে সচেতন করা যাতে করে ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশকে কোনোরকম খাদ্য ঘাটতিতে পড়তে না হয় এবং জিডিপিতে এখনও প্রায় ২২% অবদান রাখা সেক্টরটি যেন হুমকির সম্মুখীন না হয়। খাদ্য, কৃষি ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং সেই সাথে দেশী ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাববেন বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।