রাজনীতিতে স্থবিরতা, রাজনৈতিক দলে অস্থিরতা

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 1 Jan 2012, 06:22 PM
Updated : 19 Nov 2019, 05:36 AM

দেশে এখন দৃশ্যত কোনো রাজনৈতিক চাঞ্চল্য নেই। সরকার চাপে আছে পেঁয়াজ, চালসহ কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দামের অস্থিরতা নিয়ে। পেঁয়াজের অস্বাভাবিক দাম বাড়ার কোনো যুক্তি-ব্যাখ্যা নেই। পেঁয়াজের ঘাটতি না থাকা সত্ত্বেও একশ্রেণির মুনাফালোভী ব্যবসায়ী যেভাবে দাম বাড়ানোর রেকর্ড তৈরি করেছেন, তা এক কথায় চরম অন্যায়। সব কিছুরই একটা সীমা থাকা উচিত। কিন্তু পেঁয়াজ কারবারিরা সব সীমা লঙ্ঘন করেছেন। ভারতেও পেঁয়াজের দাম বেড়েছে কিন্তু সেটা বাংলাদেশের মতো লাগামহীন নয়। পেঁয়াজের পর চাল নিয়ে তেলেসমাতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। পেঁয়াজের বাজার শান্ত বা স্বাভাবিক হয়ে আসার পর চালের বাজার যদি অস্থির হয়, তাহলে সেটা সরকারের জন্য বড় চাপ হবে। পেঁয়াজ কোনো মূল খাদ্য নয়। তারপরও পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষকে দিশেহারা করে তুলেছে। কিন্তু চাল আমাদের প্রধান খাদ্য চালের বাজারে আগুন লাগলে মানুষের মাথায় আগুন চড়ে যেতে পারে। পেঁয়াজ না খেলে কী হয় বলা সহজ কিন্তু চাল না হলে কী হয়, বলা খুবই কঠিন। সরকার বিরোধী দলের আন্দোলন-সংগ্রাম,, মিছিল-মিটিং প্রতিরোধে যতোটা দক্ষতা দেখিয়েছে, বাজার নিয়ন্ত্রণে ততোটাই দেখিয়েছে অদক্ষতা। একদিকে উন্নয়নের মূলা মানুষের নাকের ডগায় ঝুলছে, মানুষ দেখছে বিরাট বিরাট সব কর্মযজ্ঞ, অন্যদিকে সীমাহীন দুর্নীতি করে কিছু সংখ্যক মানুষের বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হওয়ার খরবও এখন আর গোপন নেই। যারা দুর্নীতি করছে, অনিয়ম করছে তারা সরকারি দলের আশ্রয়-প্রশ্রয় থেকেই তা করছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাশ টেনে ধরেছেন। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু হয়েছে। কিন্তু যাদের দুর্নীতি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের পারসেপশন তৈরি হয়েছে তারা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায়, তারা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বহাল থাকায় দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের ফলাফল নিয়ে অনেককেই খুব আশাবাদী হতে দেখা যাচ্ছে না। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতা নিয়ে তার চরম শত্রু ছাড়া আর কারো মনে কোনো সংশয় নেই। মানুষ ভালো কিছুর জন্যই অপেক্ষা করছে।

ভরসার কথা এটাই যে, দেশের রাজনীতি পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে। বিরোধী দল একেবারেই ঘরে বসে গেছে। দলীয় কার্যালয়, জিয়ার কবর, প্রেসক্লাবের ভেতর-বাইর ছাড়া এখন আর বিরোধী দলের তৎপরতা চোখে পড়ে না। বিএনপিপন্থি পেশাজীবীরাও এখন আর তেমন সোচ্চার নয়। দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন একেবারেই প্রাণ পাচ্ছে না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় মাঝেমাঝে গরম বা উত্তেজক কথা বলেন কিন্তু তা দলের মধ্যে তেমন প্রভাব ফেলে না। কয়েক বছর আগে যে বিএনপি ছিল সরকারের কাছে আতঙ্ক, সেই বিএনপি এখন ফোঁসফাঁস করলেও ছোবল মারার ক্ষমতারহিত। বিএনপি আর কবে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে তা নিয়ে বিএনপির মধ্যেই রয়েছে সন্দেহ। দলটা আসলে কার নির্দেশে, কীভাবে চলছে তা-অনেকের কাছে স্পষ্ট নয়। তবে সম্প্রতি দল থেকে পদত্যাগকারী সিনিয়র নেতা মোরশেদ খান বলেছেন, বিএনপি চলছে এখন স্কাইপের মাধ্যমে। অর্থাৎ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে বসে দল চালান বিভিন্ন জনের সঙ্গে স্কাইপের মাধ্যমে যোগাযোগ করে। তারেক রহমানের বুদ্ধি-পরামর্শে বিএনপির শক্তিবৃদ্ধি ঘটার পরিবর্তে শক্তিক্ষয় হচ্ছে বলে বিএনপির মিত্ররাই মনে করছেন। তারেক রহমানকে নিয়ে দলের মধ্যে স্বস্তি এবং অস্বস্তি– দুটোই আছে। একপক্ষ মনে করেন তারেক রহমানই বিএনপিকে আবার ক্ষমতায় নিয়ে যাবে। অন্য পক্ষ মনে করেন, তারেকের কারণেই বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে থাকতে হবে। এই টানাপোড়েনে বিএনপি এখন রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া । সাংগঠনিকভাবে এতিম। বিএনপিতে চলছে ভাটার টান। মরা গাঙে আবার বান ডাকার সম্ভাবনা অতি আশাবাদীরাও দেখছেন বলে মনে হয় না। তাই বিএনপির কেউ দল ত্যাগের ঘোষণা দিচ্ছেন, কেউ অবসরে যাচ্ছেন, কেউ সুযোগ খুঁজছেন নিরাপদ আশ্রয়ের বা নতুন ঠিকানার।

বিএনপিতে আশাবাদী মানুষ একেবারে নেই, তা-ও নয়। যেমন গয়েশ্বর রায়। দলত্যাগীদের নিয়ে তিনি মোটেও বিচলিত নন। ১১ নভেম্বর এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, বিএনপি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্ল্যাটফরম, একটি বটগাছ। ক্লান্ত শরীর নিয়ে মানুষ এখানে আসবে, বিশ্রাম নেবে এবং পিপাসা মেটানোর পর আবার চলে যাবে– এটাই স্বাভাবিক। এদের বেশি গুরুত দেওয়ার দরকার নেই, বিচলিত হওয়ারও কিছু নেই।

নদীর পাড় ভাঙা শুরু হলে যদি যথাসময়ে যথাযথভাবে বাঁধ দেওয়া না হয় তাহলে গ্রাম-জনপদ-বসতি বিলীন হওয়া সময়ের ব্যাপারমাত্র । বিএনপি যদি ভাঙন প্রক্রিয়াকে ছোট করে দেখে তাহলে তাদের বড় বিপদ মোকাবেলা করতে হতে পারে।

বিএনপির অতি আশাবাদীরা অবশ্য এটাও মনে করছেন যে, দেশে যদি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, মানুষ যদি নির্ভয়ে-নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়ার সুযোগ পায় তাহলে নাকি বিএনপির বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। তবে পরবর্তী নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছাড়ার জন্য প্রস্তুত কি না, মানুষ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে বিএনপি এবং তার মিত্রদের ক্ষমতায় আনতে চায় কি না, সামরিক-বেসামরিক আমলারা বিএনপির ক্ষমতায় ফেরা সানন্দ চিত্তে মেনে নেবে কি না, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে আগ্রহী বৈদেশিক শক্তিগুলোর মনোভাব ততোদিনে কী হবে– এসব নিশ্চয়ই আগামী নির্বাচনে নিয়ামক ভূমিকা রাখবে।

ক্ষমতাসীন দল এখনই আগামী নির্বাচন নিয়ে ভাবছে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগ এখন মনোযোগী দুটি বিষয়ের প্রতি। একটি আগামী বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালন এবং অন্যটি তারপরের বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন। এই দুটি ঘটনা এমনভাবে পালন করা হবে যা মানুষের সামনে নতুন আলো ফেলবে। আওয়ামী লীগ এর মধ্য দিয়ে তাদের সক্ষমতার পরিচয় জাতির সামনে তুলে ধরবে। আর এটা করার জন্য দলকেও প্রস্তুত করে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

এই প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই  আওয়ামী লীগের সব তৎপরতা এখন দলের কেন্দ্রীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে যারা দলের জন্য 'বোঝা' হয়ে উঠেছেন তাদের বাদ দিয়ে তুলনামূলক ক্লিন ইমেজের ব্যক্তিদের নিয়ে দলকে সাজানো হবে বলে শোনা যাচ্ছে। যারা বিতর্কিত, যারা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে বদনাম কুড়িয়েছেন তারা এবার আর নেতৃত্বে ঠাঁই পাবেন না। তবে কাজটি সহজ নয়। লোম বাছতে কম্বল উজাড় বলে একটি কথা আছে। শুদ্ধি অভিযান হবে দলকে শক্তিশালী করার জন্য, দুর্বল করার জন্য নয়। মানুষ গভীর আগ্রহ নিয়ে আওয়ামী লীগের সম্মেলনের দিকে তাকিয়ে আছেন। দেশের প্রায় সবগুলো রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে যখন অস্থিরতা চলছে, বড় ছোট সব দলেই যখন মতভেদ, বিভক্তি ভাঙনের পর্যায়ে যাচ্ছে, তখন আওয়ামী লীগের কাছে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের প্রত্যাশা বেশি। আওয়ামী লীগকে যারা অপছন্দ করেন, তারাও দলটির প্রভাব অস্বীকার বা উপেক্ষা করতে পারেন না। আওয়ামী লীগ যদি সংগঠিত এবং সংহত থাকে তাহলে দেশের রাজনৈতিক স্থিতি বজায় থাকার সম্ভাবনাই উজ্জ্বল হয়।