সেন্টমার্টিন রক্ষায় সমুদ্র বাঁচাও আন্দোলন জরুরি

মাহমুদ সোহেল
Published : 18 Nov 2019, 09:22 AM
Updated : 18 Nov 2019, 09:22 AM

সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। অযত্ন, অবহেলা আর অজ্ঞতার কারণে দ্বীপটি এখন হুমকির মুখে। কয়েক বছর হলো এর উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে ভাঙ্গন ধরেছে। সেই সাথে ধারণ ক্ষমতার বাইরে পর্যটকদের ভীড় আর সইতে পারছে না পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার এই দ্বীপটি। বিভিন্ন উদ্ভিদরাজীসহ বহু প্রাণী ইতিমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। সামুদ্রিক কাছিমসহ বিভিন্ন প্রাণীর বিচরণ অনেক কমে গেছে।

বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমার সীমান্তের পার্শবর্তী ৮.৩ বর্গকিলোমিটার জুড়ে এটির অবস্থান। দ্বীপটিতে স্থায়ী বাসিন্দার সংখ্যা প্রায় ৯ হাজার। এছাড়া প্রতিদিন গড়ে আরও ৯ হাজার পর্যটক সেখানে অবস্থান করে। ১৮ হাজার মানুষের চাপ নিতে হয় দ্বীপটিকে। চাহিদা মেটাতে বৈদ্যুতিক পাম্প দিয়ে নীচের স্তরের মিষ্টি পানি উত্তোলন, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং খোলা পায়খানা নির্মাণসহ নানা পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড চলছে। শংকটাপন্ন কোরালসহ জীববৈচিত্র্য। চারদিকের বাতাসে দুর্গন্ধ। বলতে গেলে সেন্টমার্টিন এখন মুমূর্ষু।

এসব সমস্যার সমাধান না করে সরকার এখন উল্টো পথে হাঁটছে। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড পর্যটনকে বিকশিত করতে বিভিন্ন এলাকার জোনিং করছে। এর আওতায় সেন্টমার্টিনও রয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে ওখানে জীববৈচিত্র বলতে আর কিছুই থাকবে না।

নানা জরিপে দেখা গেছে, সেন্টমার্টিন দ্বীপের চারদিকে রয়েছে প্রবাল, পাথর, ঝিুনক, শামুকের খোলস, চুনা পাথরসহ প্রায় কয়েক শত প্রজাতির সামুদ্রিক জীব। দ্বীপের এই দৃশ্য দেখতে ছুটে যাচ্ছে পর্যটকরা। এতে দিন দিন এ দ্বীপের জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়েছে। গত দুই দশক ধরে এ দুটি দ্বীপের পরিবেশ-প্রতিবেশ সংকটাপন্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সমুদ্রের জীববৈচিত্র সংরক্ষণে কাজ করছে সেভ আওয়ার সী এবং ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি নামক বেশ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। পরিবেশবাদী এই সংগঠনগুলো বারবার সতর্ক করছে। তারপরও এ নিয়ে কপালে চিন্তার ভাঁজ নেই সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাদের। দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ এখনো নেই তাদের। আসল ব্যাপারটি হলো সমুদ্রের পরিবেশ একটি ব্যাপক বিষয়। তাই এ নিয়ে পুরোপুরি ধারণা নেই খোদ সংশ্লিষ্টদেরও।

সমুদ্রের জীববৈচিত্র কি জিনিস? সমুদ্রের সাথে আমাদের কি আচরণ করা উচিৎ? তা আমরা কতটুকু জানি? সাধারণ মানুষ হিসেবে বছরে একবার যারা সেন্টমার্টিনে যান তাদের বিষয়টি না জানারই কথা। সমুদ্রে প্লাস্টিক, পলিথিন ফেললে তার সুদূরপ্রসারী কি কি ক্ষতি হতে পারে? সামান্য এই সচেতনা বাড়াতে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই বলেই মানুষ অজ্ঞ থেকে যাচ্ছে। ফলে দ্বীপটি পড়েছে হুমকির মুখে।

নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণকালে শুকনো খাবার হিসেবে প্লাস্টিক মোড়কজাত চিপস বা বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যদ্রব্য বহন করেন প্রয়োজন অনুপাতে। সাথে মিনারেল ওয়াটার, জুস, কোল্ডড্রিংসসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় দ্রব্যও থাকে। খাওয়ার পর যত্রতত্র তা ছুড়ে ফেলে। যা প্রতিনিয়ত দ্বীপের অস্তিত্বকে ঝুঁকিতে ফেলছে। নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে সামুদ্রিক কোরালসহ সব ধরনের জীব ও প্রাণীবৈচিত্রে। তাই ধীরে ধীরে দ্বীপের অস্তিস্ব আজ সংকটাপন্ন।

২৪ এপ্রিল ২০১৯, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট ভবনে "বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়নের জন্য সুনীল অর্থনীতি" শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, বিশিষ্ট সমুদ্র বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কাওসার আহমেদ মূল প্রবন্ধে বলেন, সমুদ্র নিয়ে দেশে এখন ১৮টি মন্ত্রণালয় কাজ করছে। সেখানে তিনি দাবি তোলেন, আলাদা সমুদ্র মন্ত্রণালয় গঠন উন্নত রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য।

কথায় আছে- "অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট", সমুদ্র নিয়ে ১৮টি মন্ত্রণালয় কাজ করায় অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানী মন্ত্রণালয়ে ব্লু ইকোনোমি বা সুনীল অর্থনীতি সেল গঠন করা হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এ বিষয়ে সঠিক ধারণা না থাকা এবং সমন্বয়হীনতার কারণে কোনো কাজই হচ্ছে না। সে কারণে বাংলাদেশ সমুদ্র সীমানা জয় করলেও আজো সমুদ্রের সুফল পাচ্ছে না। চোখে পড়ছে না বড় কোনো অর্জন। তাই সমুদ্র বাঁচাও আন্দোলন এখন সময়ের দাবি।

দরকার সমুদ্র স্বাক্ষরতা দিবস। স্কুল, কলেজের সিলেবাসে বাধ্যতামুলক থাকতে হবে সমুদ্র পরিচিতি। তা করা গেলে সেন্টমার্টিনে পিকনিকে যেয়ে সমুদ্রের সাথে কি আচরণ করতে হবে তরুণ প্রজন্ম তা জেনে যাবে। তখন প্যাকেট, পলিথিন, বোতল, পণ্য, ক্যানসহ বিভিন্ন বর্জ্যব্যবস্থাপনার কাজ নিজেরাই করতে শিখবে ট্যুরিস্টরাও। বজায় থাকবে ইকোসিস্টেম। বিদেশী পর্যটকদের সমুদ্রে এসে উল্টো পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে দেখা যায়। অথচ ভিন্ন চিত্র আমাদের বেলায়। অজ্ঞতাই এখানে প্রধান কারণ। তাই সমুদ্র বাঁচাতে এখনই স্বোচ্চার হতে হবে দেশের কোটি শিক্ষিত যুব সমাজকে। এজন্য জরুরি কিছু তথ্যও জেনে রাখা দরকার।

  • সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষায় যেকোনো ধরনের প্লাস্টিক মোড়কজাত খাবার ও ক্যান এবং প্লাস্টিক বোতলসহ প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হওয়া জরুরি।
  • পরিবেশ মন্ত্রণালয়, ট্যুরিজম বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট কর্তাদের ঘনঘন সরকারি টাকার তসরুফ করে বিদেশ সফর বাতিল করা দরকার। এর পরিবর্তে তাদেরকে সৈকতে এসে মোটা দাগে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। তাহলে দ্বীপে আসা পর্যটক ও সাধারণ মানুষের মাঝেও সচেতনতা বাড়বে।
  • জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অতিরিক্ত কার্বিন ডাই-অক্সাইড সমুদ্রের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাই প্রতিবছর আইলা, সিডর বা বুলবুলের মুখোমুখি হচ্ছি আমরা। ৫০ থেকে ৭০ ভাগ অক্সিজেন আমরা সরাসরি সমুদ্র থেকে পাই। যা বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।
  • সুমদ্র পাড়ে যে পরিমাণ গাছ লাগানোর কথা তা নিয়ে কারো উচ্চবাচ্য নেই। আর রেইন ফরেস্টের ধারণা থেকে অনেক দূরে বাংলাদেশে। তাহলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সমুদ্রকে আমরা কিভাবে কাজে লাগাবো তা এখন বড় প্রশ্ন।
  • প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন জীববৈচিত্র সমৃদ্ধ অঞ্চল৷ কিন্তু পরিবেশবাদী কিছু সংগঠন ছাড়া এর অযত্ন ও অবহেলা নিয়ে কাউকে চিন্তিত দেখা যায় না। সমুদ্র সৈকতে অনুমোদনহীন অপরিকল্পিত নির্মাণকাজের কারণে চিরহরিৎ বৃক্ষসহ বনায়ন উজাড় হচ্ছে।

সমুদ্র সৈকত, দ্বীপ কিংবা দ্বীপপুঞ্জ মানুষের অবসর কাটানোর এক আকষর্ণীয় স্থান৷ তাই কক্সবাজার এবং সেন্টমার্টিনে পর্যটকরা আসবে এটাই স্বাভাবিক। তবে তা হতে হবে নিয়ন্ত্রিত। এটাকে সমস্যা না ভেবে সম্ভাবনায় পরিণত করতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ট্যুরিজম খাত থেকে বছরে কয়েক কোটি মিলিয়ন রাজস্ব আয় করে। বাংলাদেশকেও সেই কৌশল রপ্ত করতে হবে।

এ কথা বলাই যায়, পর্যটনকে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ সরকারের ২০৪১ সালের উন্নত রাষ্ট্রের ভিশন বাস্তবায়ন সহজ হয়ে যাবে। পরিকল্পনা থাকলে অর্জন করা যাবে এসডিজি ১৪ গোলও। এজন্য ট্যুরিজমকে প্রমোট করার পাশাপাশি পরিবেশ সচেতনতাও নিয়ে জোরালো কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে হবে। সরকার জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯৯ সালে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে সরকার। তবে তা মানছে না কেউ।

সেন্টমার্টিনে ৬৮ প্রজাতির প্রবাল, ১৫১ প্রজাতির শৈবাল, ১৯১ প্রজাতির মোলাস্ক বা কড়ি-জাতীয় প্রাণী, ৪০ প্রজাতির কাঁকড়া, ২৩৪ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৫ প্রজাতির ডলফিন, ৪ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ২৮ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী, ১২০ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১৭৫ প্রজাতির উদ্ভিদ, ২ প্রজাতির বাদুড়সহ নানা প্রজাতির বসবাস ছিল। এসব প্রাণীর অনেকগুলোই এখন বিলুপ্তির পথে। জলবায়ু পরিবর্তনের কঠিন চ্যালেঞ্জ আর অধিক দূষণের কারণে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এসব জীববৈচিত্র্য।

চলতি বছরের ৪ মে জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের ব্লু ইকোনোমি সেল আয়োজিত সমুদ্র  অর্থনীতি নিয়ে প্রাক-বাজেট আলোচনায় সেভ আওয়ার সি'র মহাসচিব মুহাম্মদ আনোয়ারুল হক বলেন, সমুদ্র থেকে সত্যিকার অর্থে লাভবান হতে হলে এসডিজি-১৪ অনুযায়ী আমাদের এগোতে হবে। যদি আমরা সাগরে ইকোলোজিক্যাল সার্ভিসটা সঠিকভাবে নিশ্চত করতে পারি, তাহলে ইকোনোমিক্যাল সার্ভিসটা সঠিক ও টেকসই হবে। ইকোলোজিক্যাল সার্ভিসটা সঠিকভাবে নিশ্চত করতে হলে রিয়েল ওশানোগ্রাফার তৈরি করতে হবে, কনসার্ভেশন ভ্যালু বুঝতে হবে।

তিনি আরো বলেন, বর্তমানে আমাদের দেশে যারা সমুদ্র বিজ্ঞানের অ্যাকাডেমিশিয়ান তারা ডাঙ্গায় বসে সমুদ্র বিষয়ক গবেষণা করেন। তাদের লোনা পানিতে নামতে হবে। আমাদের কাছে বঙ্গোপসাগরের প্রাণীজ সম্পদ বিষয়ক কোনো ডেটা নেই। যদি এখনই সাগরের ফিশিংকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে মৎস সম্পদ যা আছে, তা আগামী দশ বছরে হারিয়ে যাবে।

কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের উপদেষ্টা বিশ্বজিত সেন এক সেমিনারে দাবি করেন, এখনি রক্ষা করা না গেলে এই দ্বীপটি সাগরেই বিলীন হয়ে যাবে। বাকি আছে কেবল শ্রীহীন এই দ্বীপটির পানিতে ডুবে যাওয়ার দৃশ্য দেখার। তিন বছরের জন্য সেন্টমার্টিনে পর্যটকদের ভ্রমণ বন্ধ রাখতে হবে। তাহলে এই সময়ের মধ্যে সেন্টমার্টিনকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সহজ হবে।

ছবির ক্যাপশন: সেন্ট মার্টিন সমুদ্র সৈকতে ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক সংস্থা ওশান কনজারভেন্সি ও কেওক্রাডং বাংলাদেশের আয়োজনে ইন্টারন্যাশনাল কোস্টাল ক্লিনআপ দিবস উপলক্ষে পরিচ্ছন্নতা অভিযানে অংশ নেন স্থানীয় স্কুলশিক্ষার্থীরা। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান