স্মার্টফোন অনন্য, স্মার্টফোন জঘন্য

শেখ আনোয়ার
Published : 1 Jan 2012, 12:04 PM
Updated : 13 Nov 2019, 10:46 AM

ডিজিটাল প্রযুক্তি দিন দিন মানুষের জীবনযাত্রা সহজ এবং আরামদায়ক করে দিচ্ছে। সত্যি সত্যিই বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। হাতের মুঠোয় নিয়ে চলার জন্য হাতে উঠেছে মুঠোফোন। তারপর আরও আধুনিক স্মার্ট হয়ে এলো দরকারি স্মার্টফোন। এখন স্মার্টফোনে কী না করা যায়? টাকা পয়সা লেনদেনে ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা থেকে শুরু করে, সবার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ (সামাজিক: ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটস অ্যাপ, ইমো ইত্যাদি) ব্যাকআপ বা তথ্য সংরক্ষণ, খেলাধুলা, টিভি, বিনোদন, চিঠিপত্র, কেনাকাটা, পরিবহন টিকেট, নিজের স্বাস্থ্যের খোঁজ খবর, চলাফেরায় জিপিএস রোড ম্যাপ, বাজারের ফর্দ, ভর্তি, ক্লাস-রুটিন, এলার্ম ইত্যাদি সবকিছুই হচ্ছে স্মার্টফোনে। দৈনন্দিন জীবনের শত শত কাজ এই স্মার্টফোন যন্ত্র দিয়ে সহজে অনায়াসেই করা যাচ্ছে। এমন ছোট্ট 'স্মার্টফোন' আজ কতই না দরকারি। স্মার্টফোনের এই কার্যকর জনপ্রিয়তার কারণে 'ফোরজি' থেকে বিশ্বব্যাপী ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছে অত্যাধুনিক 'ফাইভজি' নেটওয়ার্কের জয়-জয়কার ব্যবহার। আর তাই, স্মার্টফোনের সঙ্গে আষ্ঠে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে এ সময়ের মানুষ। বলা যায়- সকাল থেকে রাত অবধি সারাদিনের কর্মকাণ্ডে 'স্মার্টফোন না হলে চলেই না।'

জি হ্যাঁ। বিশ্ব জুড়ে স্মার্টফোনের ব্যবহার এমনই রমরমা বেড়েছে। অফিস, বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শপিং সেন্টার, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সবখানেই এখন ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে স্মার্টফোন। বড়দের পাশাপাশি আজকাল শিশুরাও ভিডিও গেম ও কার্টুন দেখতে হাতে তুলে নিচ্ছে স্মার্টফোন। ক্ষুদ্র আর নিত্য ব্যবহার্য স্মার্টফোনের গ্রাহক যুক্তরাষ্টে পঁচিশ মিলিয়ন। ব্রিটেনে ব্যবহার করে মোট জনসংখ্যার সত্তর শতাংশ মানুষ। আর ফিনল্যান্ডের নিরানব্বই শতাংশ লোকই ব্যবহার করে স্মার্টফোন। উন্নত দেশে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের অধিকাংশের বয়স ষোলো থেকে ত্রিশ বছর।

স্কুল-কলেজে স্মার্টফোন নিষিদ্ধ কেন?

আপনি জানেন কি স্মার্টফোনের মারাত্মক ক্ষতির কথা? সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এক ডজন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্মার্টফোন ব্যবহার নিয়ে গবেষণা হয়েছে। দেখা যায়, অতিরিক্ত স্মার্টফোন ব্যবহার যোগাযোগ মাধ্যমে কাছে নিয়ে আসার বদলে মানুষকে আরও বেশি দূরে ঠেলে দিচ্ছে। একা করে দিচ্ছে। স্মার্টফোন মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে সোশ্যাল সাইটগুলো সেকেন্ডে সেকেন্ডে আপডেট হচ্ছে। টেক্সট, নোটিফিকেশান, মেইল এসবের সার্বক্ষণিক রিপ্লাই দেয়ার প্রবণতার কারণে মানুষের নির্দিষ্ট কোনো ওয়ার্কিং সময় বলতে কিছু থাকে না। যা মানুষকে হতাশ এবং নিঃসঙ্গ করে তোলে। এক পর্যায়ে তৈরি হয় 'ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সিটি'সহ নানান মানসিক যন্ত্রণা। এছাড়া স্মার্টফোনে অতিরিক্ত গেম খেলার অভ্যাস, দরকারি কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে বাঁধাগ্রস্ত করে। এসব নানাবিধ ভিজ্যুয়াল আসক্তির কারণে বাস্তবের সামাজিক মানুষ দিন দিন আরও বহুদূরে চলে যায়। যা সুষ্ঠু মানসিক বিকাশের পথে অন্তরায়। আর তাই, যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু স্কুল-কলেজে ইতোমধ্যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে স্মার্টফোন। কারণ আর কিছুই না। এই স্মার্টফোনের গামা রশ্মি, শব্দ তরঙ্গ, নীল আলো আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার এবং অতি ব্যবহার। যা ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়মিত পড়াশোনায় মনোনিবেশে দারুণ ব্যাঘাত ঘটায়। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় প্রকাশ, একজন কলেজ শিক্ষার্থী দৈনিক গড়ে দশ ঘন্টা স্মার্টফোন ব্যবহার করে থাকে। হতে পারে সেটা ফেসবুক জাতীয় সোশ্যাল সাইট, মেসেজিং, গুগল ব্রাউজিং, ইউটিউব বিনোদন, পিডিএফ ফাইল পড়াসহ বিভিন্ন কাজ। দেখা গেছে, ছাত্র-ছাত্রীরা দিনে বিভিন্ন সোশ্যাল সাইটে যতগুলো মেসেজ আদান-প্রদান করে, ততো কথা তারা সারাদিনে কারো সঙ্গেই বলে না।

মানসিক ও স্নায়ুবিক সমস্যার জন্য দায়ী স্মার্টফোন

অন্য এক সমীক্ষায় প্রকাশ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ৫ জন স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর ৩ জনই মানসিক সমস্যার নিকটবর্তী রয়েছে। যারা ৬০ মিনিটের বেশি একবারও ফোন চেক না করে থাকতে পারে না। তার মানে কি? অতিরিক্ত স্মার্টফোন ব্যবহার মানসিকভাবে উদ্বিগ্ন এবং হতাশ করে তোলে। যুক্তরাষ্ট্রে এক ডজন কলেজের এক হাজার ছাত্র-ছাত্রীকে ২৪ ঘন্টা স্মার্টফোন, গেজেট, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ, সোশ্যাল সাইট ইত্যাদি থেকে দূরে রেখে দেখা যায়, তারা আরও বেশি নিঃসঙ্গ বা একা হয়ে গেছে। এরপর বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রী এই সময়ের মধ্যে শারীরিক এবং মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে। এমন কি অনেকে শেষ পর্যন্ত স্মার্টফোন থেকে মাত্র ২৪ ঘন্টা সময় দূরে থাকতে ব্যর্থ হয়। এভাবে স্মার্টফোন শুধু যে মানসিক সমস্যা তৈরি করছে তা কিন্তু নয়। স্নায়ুবিক সমস্যার জন্যও দায়ী এই স্মার্টফোন। যেমন, অতিরিক্ত স্মার্টফোন ব্যবহারের ফলে মেরুদণ্ড ও মস্তিষ্কে যেসব স্নায়ুর সাহায্যে সংযোগ স্থাপিত রয়েছে তা অতিরিক্ত উত্তাপ ও চাপে সংকুচিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলাফল- তীব্র মাথা ব্যাথা, মাইগ্রেন ইত্যাদি সমস্যা। সমীক্ষায় প্রকাশ, স্মার্টফোন অতিমাত্রায় ব্যবহারের কারণে ১৬ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে ৪৫% তরুণ ব্যাকপেইনসহ মেরুদণ্ডের নানান সমস্যায় ভুগছে।

স্মার্টফোন: সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ

স্মার্টফোন এ সময়ের এক অনন্য দরকারি ডিজিটাল পণ্য। তাই এ নিয়ে অতোটা ভাবা হয়নি এতোদিন। অধুনা এই ক্ষুদে অ্যান্ড্রয়েড গেজেটের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সঙ্গত কারণেই ভাবতে হচ্ছে স্মার্টফোনের ভালো-মন্দ দিক। শুনতে ভয়ংকর মনে হলেও কথা সত্যি। স্মার্টফোনকে এখন দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য দায়ী করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, যন্ত্রণাদায়ক তীব্র মাথা ব্যথা-মাইগ্রেন থেকে শুরু করে মরণঘাতি ক্যান্সার পর্যন্ত নানাবিধ জটিল রোগের জন্য দায়ী হচ্ছে স্মার্টফোন। স্মার্টফোনের স্ক্রিনের দিকে এক নাগাড়ে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা খুব ভালো অভ্যাস নয়। কারণ স্মার্টফোনের ডিসপ্লে থেকে উজ্জ্বল নীল আলো নির্গত হয়। এই নীল আলো মস্তিষ্কে মেলাটোনিন উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। আর কে না জানে, মেলাটোনিন এমন একটা হরমোন; যা শরীরকে ঘুমের সংকেত দিয়ে বলে দেয়: 'ওহে বাছাধন! এখন তোমাকে ঘুমোতেই হবে'। অথচ স্মার্টফোনের উজ্জ্বল স্ক্রিনের দিকে অধিক সময় তাকিয়ে থাকার কারণে নিদ্রাচক্র ব্যহত হচ্ছে। যা শরীর-স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ বৈকি!

শুধু কি তাই? স্মার্টফোনের নীল আলো সরাসরি চোখে এসে পড়ায় এবং খুব কাছ থেকে অনেকক্ষণ ধরে একটানা স্মার্টফোন ব্যবহার করায় রেটিনার মারাত্মক ক্ষতি হয়। এভাবে স্মার্টফোন দৃষ্টিশক্তি কমিয়ে দিয়ে চোখের ক্ষতি করছে। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা 'ম্যাকুলার ডিজেনারেশান' নামক রোগের জন্য দায়ী করছেন এই স্মার্টফোনকে। এ রোগে আক্রান্ত হলে চোখের দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে অনেকটাই হারিয়ে যায়। এক পর্যায়ে চিরতরে অন্ধত্বের দিকে ঠেলে দেয়। এছাড়া শরীরের রক্তচাপ বৃদ্ধি, স্মরণশক্তি হ্রাস, অবসাদগ্রস্ততা, চোখ কিটকিট করে কামড়ানো, মাথা ভোঁ ভোঁ করা, নেশা নেশা ভাব জন্মানোসহ নানাবিধ নতুন নতুন শারীরিক সমস্যার জন্য দায়ী এই স্মার্টফোন। তাই সিগারেটের প্যাকেটের মতো স্মার্টফোনের স্ক্রিন কভারে সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ ঘোষণার দাবি তুলেছেন বিশ্বের স্বাস্থ্য সচেতন জনতা। স্মার্টফোনের বিরুদ্ধে মামলা করার চিন্তুাও করছেন অনেকে।

স্মার্টফোন ছড়ায় জঘন্য কার্বন

শুনতে আজগুবি শোনালেও কথাটা ঠিক। জঘন্য কার্বন ছড়ায় এই স্মার্টফোন। সমীক্ষায় প্রকাশ,স্মার্টফোনের মাধ্যমে জনপ্রিয় ভিডিও স্ট্রিমিং অ্যাপস বিশেষ করে- নেটফ্লিক্স, অ্যামাজনে বিভিন্ন জনপ্রিয় মুভি বা ওয়েবসিরিজ দেখার মাধ্যমে এই কার্বন নিঃসরণ সবচেয়ে বেশি ঘটছে। আর এতে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। পরিসংখ্যান মতে মাত্র ৩০ মিনিট নেটফ্লিক্সের স্ট্রিমিং দেখলে, পরিবেশে ১ দশমিক ৬ কিলোগ্রাম কার্বন ডাইঅক্সাইড উৎপন্ন হয়। যা ৬ দশমিক ২৮ কিলোমিটার গাড়ি চালানোর কার্বন নিঃসরণ এর সমপরিমাণ। কতটা ভয়ানক ব্যাপার! ভাবা যায়? গবেষকরা জানান, ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের সময় ভালো ছবির মানোন্নয়নে প্রতি ইঞ্চিতে বেশি পরিমাণ পিক্সেল ব্যবহৃত হয়। হাই-ডেফিনিশন (এইচডি) মুভি নির্মাণে অনেক বড় ডিজিটাল ফাইল নিয়ে কাজ করতে হয় পরিসেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোকে। সেই বড় ফাইলকে আবার ইন্টারনেটের মাধ্যমে সারা বছর গোটা বিশ্বে নিরবচ্ছিন্ন স্ট্রিমিং বজায় রেখে গ্রাহকসেবা দিতে ডাটা সেন্টারগুলো বাধ্য হয় আরও বেশি ডাটা এবং বিদ্যুৎ খরচ করতে। সে কারণেও বাতাসে অতিরিক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গত হচ্ছে। সমীক্ষায় প্রকাশ, স্পেনের মতো দেশে সারাবছর সামগ্রিকভাবে যে পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড উৎপন্ন হয়, ততোধিক পরিমাণ উৎপন্ন কার্বন ডাইঅক্সাইড শুধু ২০১৮ সালে অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের কারণে দূষিত করেছে গোটা বিশ্বের পরিবেশ। এতো কিছুর পরও স্মার্টফোনে নানাবিধ সুবিধা থাকার কারণে 'ফোরজি' হতে বিশ্বব্যাপী ক্রমশঃ ছড়িয়ে পড়ছে স্মার্টফোনের নতুন প্রজন্ম- 'ফাইভজি' নেটওয়ার্ক। স্মার্টফোনে তাই দিন দিন আরও জনপ্রিয় হচ্ছে নেটফ্লিক্স-অ্যামাজন, প্রাইমের মতো শক্তিশালী অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং প্লাটফরম। সঙ্গত কারণেই আরও বেশি পরিমাণে ছড়িয়ে পড়ছে এই কার্বন। আর কে না জানে, কার্বনের নিঃসরণ এমন একটা বিষয় যে, পৃথিবীর যেখান থেকেই বেশি পরিমাণে কার্বন নিঃসৃত হোক না কেনো, মুহুর্তে তা ছড়িয়ে পড়ে গোটা পৃথিবী জুড়ে। এই অতিরিক্ত কার্বনের ক্ষতিকর বিরুপ প্রতিক্রিয়ার ভুক্তভোগী হয় পৃথিবীর সমস্ত মানুষ। সিসকো নেটওয়ার্কের সাম্প্রতিক সমীক্ষায় প্রকাশ, ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ইন্টারনেট ভিত্তিক ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের পরিমাণ চারগুণ বেড়ে যাবে। আর ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের জন্য ২০২২ সালে পৃথিবীর সামগ্রিক ইন্টারনেট ট্রাফিকে ৮০ শতাংশ ডাটা ব্যবহৃত হবে। অতএব আগামী দিনে স্মার্টফোনের দূষণও বেড়ে যাবে বহুগুণ; এতে কোন সন্দেহ নেই। স্মার্টফোনের দূষণের এই মাত্রা হবে ধারণার বাইরে।

স্মার্টফোন ছড়ায় ব্যাকটেরিয়া

কথাটা শুনে চমকে উঠলে কি চলে? চলে না। কারণ ঘটনা তো সত্যি। স্মার্টফোনে সারাক্ষণ কিলবিল করছে ব্যাকটেরিয়া। এই ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া বিচরণ করছে স্মার্টফোনের স্ক্রিন ও কভারের সদর-অন্দর সর্বত্র। টয়লেট সিট আর স্মার্টফোনের উপর তুলনামূলক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে সম্প্রতি এক নতুন তথ্য জানিয়েছেন অ্যাবার্ডিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাকটেরিয়া বিশেষজ্ঞরা। তারা পর্যবেক্ষণ করে জানান, জঘন্য টয়লেট সিটে ২২০ থেকে ২৫০টির মতো ব্যাকটেরিয়া থাকে। অথচ আপন হাতে ব্যবহৃত স্মার্টফোনে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যাটা হয় ১ হাজার ৪৭৯ থেকে দেড় হাজারের মতো। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য এক গবেষণায় প্রকাশ, একটা টয়লেট সিটের উপরিভাগে যে পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া থাকে তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি ব্যাকটেরিয়া রয়েছে স্মার্টফোনে। অথচ টয়লেট নিয়মিত পরিষ্কার করলেও স্মার্টফোন পরিষ্কার করা হয় না। আর টয়লেট সিট যতই পরিষ্কার থাকুক নিশ্চয়ই সেখানে কেউ মুখ ঘষে না। অবাক হলেও সত্যি, স্মার্টফোন সঠিক পদ্ধতিতে পরিষ্কার ছাড়াই সারাদিন কথা বলতে মুখ লাগাতে বাধ্য হয় মানুষ।

স্মার্টফোনে তেজস্ক্রিয়তা

স্মার্টফোনকে বলা হয় অ্যান্ড্রয়েড পিসি। কারণ এটা শুধুমাত্র গ্রাহক যন্ত্র এবং প্রেরক যন্ত্র নয়। অসংখ্য অ্যাপস, ক্যামেরা, ব্লুট্রুথ, ওয়াইফাই, ডাটানেট, জিপিএস, মাইক্রোসফট অফিস, ফটোশপ, ভিডিও এডিটিং, মাল্টিমিডিয়াসহ তাবৎ দুনিয়ার সকল পিসি'র সবকিছু রয়েছে এই স্মার্টফোনে। নানাবিধ অনলাইন ভিজুয়াল সুযোগ সুবিধাযুক্ত বিভিন্ন দরকারি অ্যাপস, স্বয়ংক্রিয় সাইন ইন হয়ে নির্দেশের অপেক্ষায় সারাক্ষণ নীল আলোর সংকেত দিয়ে যায় স্মার্টফোন। কী নেই এই যন্ত্রে? এটা নানাবিধ আধুনিক সুবিধা সমৃদ্ধ এক সমন্বিত ডিভাইস। যা সব সময় নিয়ন্ত্রণ করে নিকটবর্তী ওয়াফাই বা ইন্টারনেটের বেইজ স্টেশন বা মোবাইল ট্রান্সমিটার। বিজ্ঞানীরা বলেন, 'ঘরের মধ্যে থাকা স্মার্টফোন, ওয়াইফাই মডেম ও রাউটার থেকে সব সময় বের হয় ঈষৎ নীল রঙের আলোর বিকিরণ। এই বিকিরণ ঘরের বাতাসকে দূষিত করে তুলছে। স্মার্টফোনের এই বিকিরণ নানান ক্ষতি করছে মানবদেহে। বিশেষ করে শিশুদের শরীরে ক্ষতির প্রভাবটা সবচেয়ে বেশি। ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে গর্ভবতী মায়েরাও। স্মার্টফোনের সুইচ অন করার সঙ্গে বিশ সেকেন্ডের মধ্যে নিকটবর্তী ওয়াইফাই, ব্লুট্রুথ ও মোবাইল ট্রান্সমিটার; এমনকি অন্য আরেকটা স্মার্টফোনকে বৈদ্যুতিক সঙ্কেতের মাধ্যমে জানান দেয়- 'আমি এখানে আছি'। গবেষকরা সতর্ক করে বলেন, 'স্মার্টফোনের এসব নানাবিধ ইলেকট্রনিক সিগন্যাল আসলে এনার্জি ধ্বংসকারী মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশন।' কে না জানে, এই মাইক্রোওয়েভ মানুষের গোটা দেহ শোষণ করে থাকে। এই মাইক্রোওয়েভ চলাচলের সময় দেহের অভ্যন্তরের এনার্জি ধ্বংস করে। পরমাণু বিস্ফোরণ যেমন তেজস্ক্রিয়তা ছড়ায়, এক্সরে কক্ষ যেমন তেজস্ক্রিয়তা ছড়ায়, সূর্যরশ্মি যেমন তেজস্ক্রিয়তা ছড়ায়, ঠিক অনুরূপ তেজস্ক্রিয়তা স্মার্টফোনেও ছড়ায়। এই তেজস্ক্রিয়তায় রয়েছে এক্সরে বা রঞ্জন রশ্মি, এবং গামা রশ্মি। রঞ্জন রশ্মি রক্তের অণুচক্রিকা ভেঙ্গে দেয়। আর গামা রশ্মি সরাসরি আঘাত হানে শরীরের নানাবিধ আনুষঙ্গিক নরম কোষকলায়। এই গামা রশ্মি ডিএনএ (ডি অক্সিরাইবো নিউক্লিয়িক এসিড) কে পরিবর্তন করতে পারে। এমন কি এই তেজস্ক্রিয়তা জীবদেহের কোষকলায় দীর্ঘমেয়াদী জ্বলুনি-পুড়ুনি তোলে। পরিণামে ক্যান্সারসহ নানাবিধ বংশগত ক্রটিবিচ্যুতি সৃষ্টি হয় এবং তা যুগের পর যুগ চলতে থাকে। স্মার্টফোন ঠিক তেমনই তেজস্ক্রিয়তা ছড়াচ্ছে। তবে একথাও সত্যি, সবধরণের ইলেকট্রনিক্স দ্রব্য-সামগ্রী যেমন, টিভি থেকে শুরু করে রান্নাঘরের মাইক্রোওয়েভ ওভেন পর্যন্ত তেজস্ক্রিয়তা নির্গত করে। তবে স্মার্টফোন যন্ত্রটা ব্যবহারকারীর দেহের কোমল অঙ্গের অতি নিকটে অবস্থান করে। মাথা, ঘাড় ও কানের সঙ্গে সার্বক্ষণিক লেগে থাকে স্মার্টফোন। একারণে এই স্মার্টফোনের মাইক্রোওয়েভ বা ক্ষুদ্র তরঙ্গ মানবদেহের টিস্যু, ডিএনএ শোষণ করে নেয়। শরীরের জলীয় কোষকলা তৈরিতে বাঁধা সৃষ্টি করে।

স্মার্টফোনের বিকিরণ কতটা ক্ষতিকর?

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, স্মার্টফোনের এই তেজস্ক্রিয় বিকিরণ কতটা ক্ষতিকর? গবেষকদের মতে, স্মার্টফোনের তেজস্ক্রিয় বিকিরণ মানুষের ব্রেইনওয়েভে পরিবর্তন আনতে সক্ষম। সুইস গবেষকরা ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৭ শ কিশোর-তরুণের উপর বছরখানেক ধরে গবেষণা করে। তাতে দেখা যায়, স্মার্টফোনের এই রেডিয়েশন কিশোর-তরুণদের মস্তিষ্ক বিকাশের উপর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করেছে। অবশ্য কোনো কোনো গবেষকের মতে, স্মার্টফোনের রেডিয়েশন ততটা ক্ষতিকর নয়। তাদের যুক্তি: 'এমনিতেই মানুষের মস্তিষ্ক ও শরীর অনেক বেশি তাপমাত্রা সহনশীল। মানবদেহ এমনিতে ষাট ওয়াট বৈদ্যুতিক তাপশক্তি উৎপন্ন করে। দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এই তাপশক্তি এমনিতে থাকে। তাই স্মার্টফোনের তেজস্ক্রিয়তা আপাতত: কোন সমস্যা হতে পারে না।' তা সত্ত্বেও ব্রিটেনের ন্যাশনাল জিওলজিক্যাল প্রোটেকশন বোর্ড, স্মার্র্টফোনের রেডিও মাইক্রোওয়েভ ত্যাগের একটা মাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে। তা হচ্ছে- শূন্য দশমিক এক ওয়াট। তবে এই পরিমাণ মাইক্রোওয়েভ মস্তিষ্কের কোষকলা দহন করতে কতটা সক্ষম সেটা অবশ্য এখনও স্পষ্ট নয়। অধিকাংশ গবেষকের মতে, স্মার্টফোনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এখনও ততটা স্পষ্ট বোঝা না গেলেও আকস্মিক সম্ভাব্য বিপদ এড়াতে এ ব্যাপারে আগে থেকে প্রস্তুতির জন্য জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। বর্তমানে তাই স্মার্টফোনের ক্ষতিকর দিক নিয়ে ব্যাপক গবেষণার জোর দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) স্মার্টফোনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার বিষয়গুলো ইতোমধ্যে গবেষণায় অন্তর্ভূক্ত করেছে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণার বিস্তৃত ফল বেরুতে সঙ্গত কারণেই সময় লাগবে আরও কয়েক বছর।

বর্তমান সময়ে ডিজিটাল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে স্মার্টফোন,ওয়াইফাই ছাড়া মোটেও চলা সম্ভব নয়। তবে স্মার্টফোনের পরিমিত ব্যবহার আমাদের জীবনযাত্রাকে যেমন অনেক সহজ করে দেয়। অতিরিক্ত ব্যবহার তেমনই ক্ষতি করে। অতিরিক্ত সবকিছুই কোনো না কোনোভাবে খারাপ কিছু ডেকে আনে। তখন সেই ক্ষতি শুধু ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। লক্ষণীয় বাজে প্রভাব সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।