ধর্মনিরপেক্ষ বনাম ইসলামী রাষ্ট্র (৩): আবারও জঙ্গি?

হাসান মাহমুদহাসান মাহমুদ
Published : 12 Nov 2019, 08:54 AM
Updated : 12 Nov 2019, 08:54 AM

বিডিনিউজ, ৬ নভেম্বর ২০১৯- দেশে এখনো আরো ৬টি জঙ্গি সংগঠন সক্রিয়। অর্থাৎ অন্যান্য বিষয় নিয়ে আপনার মন মগজ যতই ভরা থাকুক যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো জায়গায় আপনার ওপর আরেকটা হলি আর্টিজান ঘটে যেতে পারে। যদি ওই জঙ্গিদেরকে দেখানো যেত রসূলের (স) বলে যাওয়া ইসলাম কি, "ইসলামী রাষ্ট্র-এর তত্ব ও বাস্তবে কত ফাঁক রয়েছে তবে হয়ত তাদের অনেকেই ফিরে আসত। সরকারকেও বুঝতে হবে শুধু আইন আর বন্দুক দিয়ে ধর্মীয় হিংস্রতা উচ্ছেদ করা যাবে না, ওই ধর্ম থেকেই শান্তির ব্যাখ্যা তুলে আনতে হবে যা করেছেন অতীত বর্তমানের অনেক ইসলামী বিশেষজ্ঞ। এখন দরকার তাদের সেই ইসলামী ব্যাখ্যা জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া।

জঙ্গিরা কোন ধরণের ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করতে চায়? ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সুস্পষ্ট সংজ্ঞা আছে কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রের নেই এবং সংজ্ঞা না থাকলে আলোচনায় নিয়ন্ত্রণ থাকে না। সৌদি আরব পাকিস্তান ইরানসহ যেসব দেশের সংবিধানে আছে রাষ্ট্র চলবে শারিয়া মোতাবেক, সেগুলো কি "ইসলামী রাষ্ট্র"? অনেক আলেম বলেন 'হ্যাঁ', অনেকে বলেন 'না'। সিরিয়া ইরাকের ইসলামিক স্টেট সুবিশাল এলাকা দখল করে "শাসন" করছে, সারা বিশ্ব থেকে সেখানে হাজারো মুসলিম ছুটে গেছে "খলীফা"র হাতে বায়াত করে "জিহাদ" করতে অথচ বহু আলেম দাবি করছেন ওটা ইসলামী রাষ্ট্রই নয়। ড. জাকির নায়েক তো ঘোষণাই করেছেন আসলে ওটা "অ্যান্টি ইসলামিক স্টেট" অর্থাৎ "ইসলাম-বিরোধী রাষ্ট্র"। অর্থাৎ আমাদের অবস্থা হল:- "একভাবে যাহা 'না' আরেকভাবে তাহা যদি 'হাঁ' হয় তবে সেই ছিদ্র দিয়া সমস্ত জগৎ যে গলিয়া ফুরাইয়া যাইবে"– কবিগুরুর "চতুরঙ্গ"। ইসলাম নিয়ে এই "হ্যাঁ-না"-এর শুভংকরে আমাদের সমস্ত শক্তি "গলিয়া ফুরাইয়া" গেছে, বাকী আছে প্রধানত: বাগাড়ম্বর আর পরস্পরের বিরুদ্ধে হুংকার গালাগালি। এর অবসান দরকার এবং কাজটা আলেমদেরই।

অতঃপরম? ইসলামী রাষ্ট্র কি তাহলে? অনেকে বলেন- "ইসলামী রাষ্ট্র সেই রাষ্ট্র যেখানে ইসলাম প্রয়োগ করা হয়"। ওকে! তাহলে, ইসলাম কি?

আলেমরা বলেন ইসলাম হচ্ছে তৌহিদের স্বীকৃতি, আল্লাহ-রসূলের (স) আনুগত্য করা, শির্ক থেকে মুক্ত থাকা…….ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো ইসলামের বর্ণনা মাত্র, সংজ্ঞা নয়। বিশ্ব মুসলিমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও ইসলামের সংজ্ঞার অভাবে বিভিন্ন ফিরকা তরিকার বিশ্বাস ও আচরণের বিপুল পার্থক্য ও বিরোধে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে বিশ্ব-মুসলিমের ঐক্য (তার সাথে যোগ হয়েছে ভূ-রাজনীতির গরল)। অথচ পথ ছিল। ইসলাম যিনি এনেছেন স্বয়ং সেই তিনি নিজেই "ইসলাম কি" এ প্রশ্নের সুস্পষ্ট জবাব দিয়ে গেছেন যা জঙ্গিরা ধরে রাখলে মানুষের রক্ত আর অশ্রুস্রোতে "ইসলামী রাষ্ট্র"-এর সাম্পান বাইতে হতো না। সেটাই দেখা যাক এবারে।

ইমাম আন্ নাবাবী'র বিখ্যাত কেতাব "ফরটি হাদিস" হাদিস নং ২। হযরত ওমর (রাঃ) জানাচ্ছেন, একদিন রসূল (স) তাদের সাথে বসেছিলেন, জিবরাঈল এসে বললেন- "হে মুহম্মদ (স)! আমাকে ইসলাম সম্বন্ধে বলুন"। রসূল (স) বললেন ইসলাম হল (ক) কলমা পড়া, (খ) নামাজ প্রতিষ্ঠা করা, (গ) জাকাত দেয়া, (ঘ) রমজানে রোজা রাখা এবং (ঙ) সক্ষম হলে হজ্ব করা।

এই হল সিরাতুল মুস্তাকিম, সহজ সরল পথ। এর মধ্যে "ইসলামী রাষ্ট্র" কোথায়? অথচ মওদুদী দাবি করেছেন ('উইটনেস টু ম্যানকাইন্ড' পৃষ্ঠা ৩২):- "ইসলামের নীতি ও শিক্ষাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন না করা পর্যন্ত আমাদের শাহাদা (কলমা পড়া) পূর্ণ হইবে না"। কেন পূর্ণ হইবে না? কোটি কোটি মুসলিমের কলমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অধিকার তাকে কে দিল? এই সেই "সীমা লঙ্ঘন" করা যার বিরুদ্ধে কোরান বারবার তর্জনী তুলেছে আর জঙ্গিরা রসূলের (স) দেয়া ইসলাম ছেড়ে সীমা লঙ্ঘনকারীর পেছনে ছুটেছে। ওপরের হাদিসটা ওয়াজ মহফিলে আমরা কদাচিৎ শুনি কিন্তু বিভিন্ন বর্ণনায় এটা আছে বহু কেতাবে, যেমন:-

"একদিন হযরত জিব্রাইল মানুষের বেশে নবীজীর কাছে আসিলেন এবং বলিলেন, হে নবী। ইসলাম কাহাকে বলে?" তিনি বলিলেন, "ইসলাম হইল, তুমি আল্লাহ'র ইবাদত করিবে এবং কাহাকেও শরিক করিবে না, নামাজ প্রতিষ্ঠা করিবে, জাকাতকে ফরজ হিসাবে পালন করিবে" (সহি বুখারি ও মুসলিম, ২য় খণ্ড পৃষ্ঠা ৭৩৩, নোট ১, এবং মিশকাতুল মাসাবিহ্ ১ম খণ্ড পৃষ্ঠা ২৩-২৫, নং ২(১)-এর সূত্রে বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন ২য় খণ্ড পৃষ্ঠা ৪৯৮)।

আবারও বলছি এই হল সিরাতুল মুস্তাকিম, সহজ সরল পথ। বেহেশতে তো প্রতিটি মুসলিমই যেতে চায়, জঙ্গিরাও চায়। সেই পথটাও তো বলে গেছেন স্বয়ং তিনিই, সেটা কেন মানছে না জঙ্গিরা? লম্বা দলিল, সংশ্লিষ্ট অংশটুকু তুলে দিচ্ছি:-

"আবদুল্লা কায়েস নামক গোত্রের একটি প্রতিনিধি দল … আরজ করিল:- "ইয়া রসুলুল্লাহ্ ! … আপনি আমাদিগকে কয়েকটি স্পষ্ট উপদেশ ও আদেশ নিষেধ বলিয়া দিন যাহা অনুসরণ করিয়া আমরা সকলে বেহেশত লাভের উপযুক্ত হইতে পারি। … রসুলুল্লাহ্ (দঃ) প্রথমতঃ তাহাদিগকে চারিটি কর্তব্যের আদেশ করিলেন। (১)কায়মনোবাক্যে এই অঙ্গীকার ও স্বীকারোক্তি করা যে একমাত্র আল্লাহ্ই মা'বুদ, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন মা'বুদ নাই এবং মোহাম্মদ (দঃ) আল্লাহ্'র রসুল। (২) নামাজ উত্তমরূপে আদায় করা, (৩) জাকাত দান করা, (৪) রমজান মাসে রোজা রাখা এবং গণিমতের মালের এক পঞ্চমাংশ দেওয়া। রসুলুল্লাহ্ (দঃ) তাহাদিগকে চারিটি বস্তু (পাত্র) ব্যবহার করিতে নিষেধ করিলেন। রসুলুল্লাহ্ (দঃ) তাহাদিগকে ইহাও বলিলেন, এই সব আদেশ নিষেধকে তোমরা ভালরূপে হৃদয়ঙ্গম করিয়া লইবে এবং দেশে গিয়া সকলকে ইহা জানাইয়া দিবে"- সহি বুখারী, আবদুল করিম খান সম্পাদিত হাফেজ আবদুল জলিলের বাংলা অনুবাদ, হাদিস নম্বর ১২।

এই হলো ইসলাম, বেহেশত লাভের গ্যারান্টি। এর মধ্যে "ইসলামী রাষ্ট্র" ও নেই শারিয়া আইনও নেই, ওগুলো ইমামদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ মাত্র। হ্যাঁ, "আল্লাহ'র বিধান যে মানে না সে কাফের" (মায়িদাহ-৪৪) কিংবা "রসূল (স) তোমাদের যা দেন তা গ্রহণ কর আর যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত হও"(হাশর: ৭) এরকম কিছু অনুষঙ্গ তো আছেই- সেগুলো নিয়ে বিশদ আলোচনাও আছে নীচে দেখানো বইগুলোতে। জঙ্গিরা কি জানে কতভাবে কত জায়গায় তাকে আমরা লঙ্ঘন করেছি? এ দাবিও করা হয়েছে- "প্রতিটি আয়াত যাহা আমাদের আলেমদের সিদ্ধান্তের (রুলিং) বিরুদ্ধে যায়, বলিতে হইবে 'পবিত্র কোরানের এই আয়াতটি বাতিল হইয়া গিয়াছে'" – দাবি করেছেন ১০ম শতাব্দী ইরাকের গ্র্যান্ড মুফতি আবুল হাসান আল খারকি- "দি ট্র্যাজেডি অফ ইসলাম"- বিখ্যাত ইমাম মুহাম্মদ তৌহিদী পৃষ্ঠা ৯৪:-

কি আশ্চর্য! মানুষের সিদ্ধান্ত আল্লাহ'র কালামকে বাতিল করে দেবে? এই হল সেই "সীমা লঙ্ঘন" করা যার বিরুদ্ধে কোরান বারবার তর্জনী তুলেছে। এই দাবির উল্লেখ আছে শারিয়া আইনের ওপরে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ট বই ড. হাশিম কামালী'র "ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স" পৃষ্ঠা ২০৩, বিশাল ভারতবর্ষে ইসলামী কেতাবের অন্যতম বৃহৎ প্রকাশক দিল্লীর "কিতাব ভবন"-এর বই "দি ডকট্রিন অফ ইজমা" পৃষ্ঠা ১৬। জঙ্গিদের অনেকেই হয়তো জঙ্গি হতো না যদি তারা ইসলামী রাষ্ট্রের বিরোধী আলেম ও মুসলিম বিশেষজ্ঞদের বইগুলো পড়ত, তাদের যুক্তিগুলো বোঝার চেষ্টা করত আর "ইসলামী রাষ্ট্র"-গুলোতে মানুষের অশ্রু ও রক্তস্রোত খেয়াল করত। সরকারের উচিত অনতিবিলম্বে এ বইগুলোর অনুবাদ ছড়িয়ে দেয়া। কয়েকটা বই:-

  1. The Illusion of an Islamic State -আলেম উলামা প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ ইসলামী সংগঠন "নাহদালতুল উলামা"- ২০১৩ সালে এর সদস্য ছিল প্রায় ৪ কোটি)।
  2. TOWARD our Reformation – From LEGALISM to VALUE ORIENTED ISLAMIC LAW and JURISPRUDENCE – Mohammad Omar Farooq.
  3. The Challenge of Fundamentalism – Bassam Tibi.
  4. Toward an Islamic Reformation – Abdullan An-Naim.
  5. Believing Women in Islam – Asma Barlas.
  6. The Forgotten Queens of Islam – Fatima Mernissi.
  7. এগুলোর কিছুটা সার সংক্ষেপ সংকলন করা আছে "শারিয়া কি বলে, আমরা কি করি" বইতে।

ইসলামী রাষ্ট্রের সমর্থনে যুক্তিগুলো আছে মওলানা মওদুদী, সৈয়দ কুতুব, আয়াতুল্লাহ খোমেনী ও পাকিস্তান/বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর বইগুলোতে। আর আছে শারিয়া কিতাবগুলোর মুখবন্ধে। এগুলোর সাথে ওপরের বইগুলো মিলিয়ে পড়লেই ইসলামী রাষ্ট্রের বিভ্রম স্পষ্ট হবে, এ নিয়ে পরে আলোচনা করব। বই পড়া সম্ভব না হলে জঙ্গিরা শারিয়া কেতাব খুলে আইনগুলো পড়লেই বুঝবেন কি মরিচীকার পেছনে ছুটছেন তারা। বাবা-মা, দাদা-দাদি, বা নানা-নানিকে খুন করলে খুনীর মৃত্যুদণ্ড হবে কিন্তু বাবা মা, দাদা-দাদি বা নানা-নানি যদি ছেলে-মেয়ে বা নাতি-নাতনিকে খুন করে তবে খুনীর মৃত্যুদণ্ড হবে না- বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন ১ম খণ্ড ধারা ৬৫ ক ও খ, শাফি'ই আইন Law #o.1.2.4। কিংবা খুন-জখম চুরি-ডাকাতির মামলায় নারীর সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়- হানাফি আইন পৃ. ৩৫৩ ; শাফি'ই আইন পৃ. ৬৩৮ − Law #o.24.৯, ক্রিমিন্যাল ল' ইন্ ইসলাম অ্যান্ড দ্য মুসলিম ওয়ার্ল্ড পৃ. ২৫১, মুহিউদ্দীন খানের অনুদিত বাংলা কোরাণ পৃ. ২৩৯।

এসব আইন দিয়ে ইসলামের বদনামও হয়, দেশও চলে না। মানবসভ্যতা আজ কঠিন সমস্যার অতলগহ্বরে পতিত। কাশ্মীরের পর বাবরি মসজিদের জমিও বেদখল হয়ে গেল। "হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী"-র সমাধান আমরা জানি না কিন্তু যাদের জানার তারা জানেন।

"আমার বিশ্বাস, যদি তাহার মতো কেহ যদি বর্তমান বিশ্বের স্বৈরশাসক (ডিক্টেটর) হইতেন তাহা হইলে তিনি সমস্যা সমাধানে এমনভাবে সফল হইতেন যাহাতে এতো প্রয়োজনীয় শান্তি ও সুখ আসিত"। "I believe that if a man like him were to assume the dictatorship of the modern world he would succeed in solving its problems in a way that would bring it the much-needed peace and happiness"- বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক ও লেখক জর্জ বার্নার্ড শ'।

কথাটা তিনি রসূলকে (স) পয়গম্বর হিসেবে নয়, একজন সফল শাসক হিসেবে বলেছেন। সামাজিক স্থিতি প্রতিষ্ঠায় সখ্য ও সংঘাত, যুদ্ধ ও শান্তিচুক্তি, কঠিন শাস্তি ও নিঃশর্ত ক্ষমা, এই বিপ্রতীপ শক্তিগুলোকে এতো সূক্ষ্ম ভারসাম্যে এমন প্রাজ্ঞ ও সফল প্রয়োগ আর কোনো নেতা করেছেন কিনা আমি জানি না। সেজন্যই ১৪০০ বছরের দূরত্ব থেকে তিনি আজও উদ্যত তর্জনী হেলনে পুরো বিশ্ব-মানবসমাজকে প্রচণ্ড শক্তিতে সবার চেয়ে বেশি প্রভাবিত করে চলেছেন। সেজন্যই তিনি মানুষের ইতিহাসে "সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী মানুষ"- "দি হান্ড্রেড", মাইকেল হার্ট।

জঙ্গিরা কবে তার দেয়া ইসলাম উপলব্ধি করবে?

সবাইকে সালাম।