অনেকে বলছেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। বিসিবি কর্তাদের অনেকের মাথায় হাত। অথচ ঈশান কোণে ক্ষোভের মেঘ জমছিল অনেক দিন থেকেই। অবহেলা আর বঞ্চনায় মেঘ দানা বেঁধেছে ক্রমে। কর্তারা দেখেছেন, কিন্তু গুরুত্ব দেননি। ক্ষমতার চর্চা করতে করতে এসবকে পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। একটি জুতসই আঘাত তাই প্রয়োজন ছিল। ক্রিকেটারদের ধর্মঘট আর ১১ দফা দাবি হতে পারে সেই কাঙ্ক্ষিত বর্ষণ, যা ভাসিয়ে নেবে বিসিবির স্বেচ্ছাচারিতার দেয়াল।
ক্রিকেট খেলুড়ে দেশগুলোতে ধর্মঘট খুব বিরল কিছু নয়। তবে বাংলাদেশে টেস্ট জমানায় ধর্মঘট এটিই প্রথম। বাংলাদেশের ক্রিকেটে গত কয়েক বছরের ঘটনাপ্রবাহে এটি হয়ে উঠেছিল একরকম অবধারিত।
দিনের পর দিন নানাভাবে বঞ্চিত এবং দেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত ক্রিকেটাররা আস্তে আস্তে সংগঠিত হয়েছেন। ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশন একদমই অকার্যকর বলে নিজেরাই সংঘবদ্ধ হয়েছেন। যোগাযোগ হয়েছে অনলাইনে, আলোচনা হয়েছে ফোনে। ঠিক করা হয়েছে করণীয়।
রোববার জাতীয় লিগের দ্বিতীয় রাউন্ড শেষ হওয়ার পর ঢাকার বাইরে থাকা ক্রিকেটাররা ফিরেছেন। সোমবার সকালে তারা একসঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন সভায়। সেখানেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের দাবি দাওয়া উপস্থাপন করার।
বলার অপেক্ষা রাখে না, সোমবার দুপুর থেকে বিশ্ব ক্রিকেটেই অন্যতম বড় খবর বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ধর্মঘট। নেতিবাচক কিছুতে খবরের শিরোনাম হওয়া এমনিতেই বিব্রতকর। সঙ্গে ক্রিকেটারদের ১১ দফার প্রায় সবকটিই যে চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে, ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির খুব উজ্জ্বল বিজ্ঞাপন হয়নি তা।
ক্রিকেটারদের দাবিগুলোর প্রায় সবই মৌলিক অধিকারের পর্যায়ে পড়ে। একটি টেস্ট খেলুড়ে দেশে এসব প্রাথমিকভাবেই থাকা উচিত। অথচ টেস্টের জগতে ১৯ বছর কাটিয়ে দেওয়ার পরও এসবের জন্য ক্রিকেটারদের ধর্মঘট ডাকতে হয়। ক্রিকেট জাতি হিসেবে যথেষ্ট লজ্জাজনকই বটে।
দেশের শীর্ষ প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে যখন আন্দোলন করে বলতে হয় ভালো মানের বল দিয়ে খেলা হোক, তখন দেশের কোনো ক্রিকেট কর্তার আর দায়িত্বে থাকার অধিকার থাকে না।
মানীর মান মেলে না
যে কোনো কিছুর আর্থিক দিক নিয়ে বেশি আগ্রহ আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি। স্বাভাবিকভাবেই তাই ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিকের ব্যাপারটিই বেশি আলোচিত হচ্ছে। অথচ, ক্রিকেটাররা তাদের ১১ দফা দাবির সবকিছুর আগে বলেছেন, সম্মানের কথা। মাথায় তুলে রাখা নয়, প্রাপ্য সম্মানটুকু তারা চান।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের দুর্ভাগ্য, যাদের জন্য ক্রিকেট খেলা, যাদের জন্য বোর্ড, যাদের জন্য বোর্ডের এত আয় এবং যাদের জন্যই বোর্ড কর্তাদের নিয়োগ, সেই ক্রিকেটারদেরই আজ প্রাপ্য সম্মানের জন্য লড়াই করতে হয়!
কয়েক বছর আগেও টেস্ট খেলেছেন, এখন ঘরোয়া ক্রিকেটের শীর্ষ ক্রিকেটারদের একজন, এমন এক ক্রিকেটার শোনালেন এবার ঘরোয়া মৌসুম শুরুর আগের একটি ঘটনা। মিরপুর একাডেমি মাঠে তিনি রানিং করতে চাইছিলেন। কিন্তু মাঠকর্মীকে ওপরের নির্দেশ দেওয়া আছে, তখনই মাঠে পাইপ দিয়ে পানি দিতে হবে। ওই ক্রিকেটার অনুরোধ করেছিলেন ১০-১৫ মিনিট পর পানি দিতে, যাতে রানিং সেশন শেষ করতে পারেন। কিন্তু সেই 'ওপরওয়ালার' মনের বরফ হৃদয় গলেনি। তখনই পানি দেওয়া হয়েছে। সেই ক্রিকেটার রানিং করতে গিয়ে পিছলে পড়ে একাকার অবস্থা।
আনুষ্ঠানিক দাবি দাওয়া জানানোর সময় সিনিয়র ক্রিকেটার জুনায়েদ সিদ্দিক বলছিলেন, গত ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের পারিশ্রমিকের ৪০ শতাংশ টাকা এখনও তার দল থেকে পাননি তাদের অনেকেই। নিজেদের পাওনা টাকা আদায়ে ক্লাবে, বোর্ডে বারবার ধর্না দিতে হয় তাদের। "জাতীয় ক্রিকেটার হয়ে এভাবে বারবার আসা-যাওয়া ভীষণ দৃষ্টিকটু", জুনায়েদ যখন বলছিলেন এই কথা, তার চেহারায় তখনও অপমানের ছায়া।
এরকম বড় ঘটনা যেমন আছে, অসংখ্য ছোট ঘটনাও আছে, যেসবে ক্রিকেটারদের প্রতি বোর্ডের দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে ওঠে। ক্রিকেট বোর্ডের চাকুরে বা কর্মকতা পর্যায়ে যারা আছেন, তাদের অনেকে ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের প্রতি সত্যিকার ভালোবাসা দিয়েই কাজ করে চলেছেন। কিন্তু বড় কর্তাদের কাছে ক্রিকেটারদের মূল্য দৃশ্যত সামান্যই। নিজেদের ন্যায্য দাবির কথা বলতে ক্রিকেটাররা ভয়ে থাকেন, কুণ্ঠা বোধ করেন। দিনের পর দিন এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে, ক্রিকেটাররাই ক্রিকেট বোর্ডে যেন পর!
এভাবে সম্মানের জন্য আন্দোলন হয়তো ক্রিকেট ইতিহাসেই নেই!
দাবি, নাকি অধিকার?
ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সহ-সভাপতি দুইজনই বোর্ডের পরিচালক, ক্রিকেট ইতিহাসে এমন কিছুর নজির নিশ্চিতভাবেই নেই। দুটি দায়িত্ব তো সরাসরি সাংঘর্ষিক। ক্রিকেটারদের দাবি দাওয়া নিয়ে বোর্ডের সঙ্গে দেন দরবার করবে ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশন। অথচ সেই সংগঠনের প্রধান ব্যক্তিরাই বোর্ডের বড় বড় দায়িত্বে!
সভাপতি নাঈমুর রহমান, সহ-সভাপতি খালেদ মাহমুদকে এই প্রশ্ন গত কয়েক বছরে অসংখ্যবার করা হয়েছে। বরাবরই তারা বলেছেন, বোর্ডে থেকে ক্রিকেটারদের পক্ষে কাজ করা সহজ। দাবি আদায়ে নাকি সুবিধা হয়। অথচ তাদের কাজ করার কোনো প্রমাণ দৃশ্যত মেলেনি। ১১ দফা দাবির প্রথম দফাতেই ক্রিকেটাররা বললেন, ক্রিকেটারদের সংগঠন ক্রিকেটারদের পক্ষে কাজ করছে না।
ক্রিকেটারদের চাওয়া, তারা নিজেরা ভোট দিয়ে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। অথচ দাবি তোলা নয়, হওয়ার কথা ছিল স্বাভাবিক প্রক্রিয়া!
এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত পালও বিসিবির অধীনে দায়িত্ব পালন করেন ম্যাচ রেফারি হিসেবে। তারা নিজেরাও হয়তো ভুলে গেছেন, সবশেষ কবে সংগঠনের নির্বাচন হয়েছিল!
ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে যুগ যুগ ধরে ক্রিকেটারদের দল বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা ছিল। আর্থিক চাহিদা আর নিজের পছন্দ মিলিয়ে তারা ঠিক করতেন নিজেদের ঠিকানা। অথচ তাদের সেই অধিকার খর্ব করে 'প্লেয়ার্স বাই চয়েজ' নামের উদ্ভট এক পদ্ধতি বিসিবি চালু করেছে, যেখানে তারাই পারিশ্রমিক বেঁধে দেয়। ক্রিকেটারদের নিজেদের চাওয়ায় ক্লাব বেছে নেওয়ার স্বাধীনতাও নেই।
এই পদ্ধতি চালু করার সময় বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান জোর গলায় বলেছিলেন, "নিশ্চয়তা দিচ্ছি, এটি শুধু এবারের জন্যই।" কিন্তু সেই 'এবার' ফিরে এসেছে বারবার। বছরের পর বছর এই পদ্ধতি রয়েই গেছে।
জাতীয় ক্রিকেটারদের বাইরে দেশের বড় একটা অংশের ক্রিকেটারদের সারা বছরের আয়ের মূল উৎস এই প্রিমিয়ার লিগ। সেখানেই আয়ের পথ সঙ্কুচিত করে রাখা হয়েছে। নানা অজুহাতে প্রতিবারই প্লেয়ার্স বাই চয়েজে বিসিবি সভাপতি পত্যক্ষ অনুমোদন দিয়েছেন, পরোক্ষে দিয়েছেন উৎসাহ ও প্রণোদনা। ক্রিকেটারদের অসহায় আর্তি তার কপটতার দেয়ালে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
দেয়ালে পিঠ থেকে যাওয়া ক্রিকেটাররা তাই সামনে এগিয়েছেন এই অধিকার ফিরে পেতে।
বিপিএলের গত আসরের ফ্র্যাঞ্চাইজিদের সঙ্গে চুক্তি নবায়ন নিয়ে সমঝোতায় আসতে না পারায় হুট করেই বিসিবি জানাল, এবার তারা বিশেষ বিপিএল আয়োজন করবে। বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকীকে সামনে রেখে এবার হবে 'বঙ্গবন্ধু বিপিএল।' সবগুলি দলই থাকবে বিসিবির ব্যবস্থাপনায়।
বিপিএল আয়োজনের অন্যতম বড় একটি উদ্দেশ্য আর্থিক লাভ। বিসিবি কর্তারাই সেটি জোর গলায় বলেছেন অনেকবার। অথচ এবার বিসিবি সভাপতি জানিয়ে দিলেন, বিশেষ বিপিএল বলে এবার লাভের চিন্তা নেই বিসিবির। এটি কোনো পেশাদার বোর্ডের ভাবনা হলো?
জাতির জনকের প্রতি সম্মান জানাতে বিপিএলের নামকরণ বঙ্গবন্ধুর নামে করা হয়েছে। কিন্তু লাভজনক হতে সেটি বাধা হবে কেন? বিশেষ বিপিএল বলে কি ব্রডকাস্ট থেকে আয় কম হবে? অন্যান্য আয় কমবে? নাকি নিজেদের সম্ভাব্য ব্যর্থতা ঢাকতেই বর্ম করে নেওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নামটিকে!
ওই একই সংবাদ সম্মেলনে বিসিবি প্রধান জানালেন, ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক এবার কমবে। লাভের চিন্তা যদি না থাকে, তাহলে ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক কেন কমবে? বিসিবির তো টাকার সমস্যা নেই, বিপিএল থেকে আয়ও কম হয় না। আর বিপিএলের দলগুলির স্পন্সর হতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান লাইন ধরে আছে বলে বিসিবিই জানাচ্ছে!
বিশেষ বিপিএল বলে কি বিদেশী ক্রিকেটাররা কম পারিশ্রমিক নেবেন? বিদেশী কোচরা কম নেবেন? ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি কম নেবে? টিভি ক্রু যারা আসবেন, কম নেবেন টাকা? বোর্ডের খরচে বোর্ড পরিচালকরা চট্টগ্রাম-সিলেট উড়ে যাবেন খেলা দেখতে। থাকবেন-খাবেন ফাইভ স্টারে। তারা কি এবার থ্রি স্টারে থাকবেন? ট্রেনে-বাসে যাবেন? মোটেও না। তাহলে কোপ কেন দেশের ক্রিকেটারদের রুটি-রুজিতে?
ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক কমে যাওয়া মানে, দেশের কোচ, ফিজিও, ট্রেনার, এমনকি টিম বয়, যারা কিছু অর্থের জন্য বছরজুড়ে তাকিয়ে থাকে বিপিএলের দিকে, তাদের সবার আয় আরও কমে যাওয়া। জাতির জনকের জন্ম শতবার্ষিকীর টুর্নামেন্ট হওয়ার কথা উৎসবের আবহে। এখানে কেন ওরা সবাই মন খারাপ আর বিরক্তি নিয়ে থাকবে?
পারিশ্রমিকে বৈষম্য তো চলে আসছে শুরু থেকেই। বিদেশী ক্রিকেটারদের চেয়ে বেশি অর্থ দাবি দেশের ক্রিকেটাররা করেননি। কিন্তু পার্থক্য এত বেশি যে দেশের ক্রিকেটাররা রীতিমতো হীনন্মন্যতায় ভোগেন। বিদেশের অনেক মধ্যম মানের ক্রিকেটাররাও দেশের শীর্ষ ক্রিকেটারদের চেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পায়। এমনকি ড্রাফটে নিজের পছন্দের গ্রেডে নিজেকে রাখার সামান্য অধিকারটুকুও ক্রিকেটারদের দেয় না বোর্ড।
খুব বেশিদিন হয়নি, বোর্ড সভাপতি জোর গলায় বলেছিলেন, 'ঘরোয়া ক্রিকেটের জন্য টাকা-পয়সা কোনো সমস্যা নয়।' অথচ এবার জাতীয় লিগে পারিশ্রমিক বাড়ানো হলো না। ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সম্পদশালী বোর্ডের শীর্ষ প্রথম শ্রেণির টুর্নামেন্টে ম্যাচ ফি প্রথম স্তরে কেবল ৩৫ হাজার, দ্বিতীয় স্তরে মাত্র ২৫ হাজার, ভাবা যায়!
দেশের মধ্যম সারির ক্রিকেটাররাও ঢাকার বাইরে 'খ্যাপ' খেলতে গেলে টি-টোয়েন্টি ম্যাচেই এই টাকা পেয়ে যান। তারা চার দিন খেটে এই টাকার জন্য খেলতে আগ্রহী হবেন কেন?
দৈনিক ভাতা জাতীয় লিগে মাত্র ১৫০০ টাকা। ভালো হোটেলে খেতে গেলে যথেষ্ট হওয়ার কোনো কারণ নেই। ফিটনেস ধরে রাখার খাবার খেতে চাইলে তো খরচ করতে হবে আরও অনেক বেশি।
ভ্রমণ ভাতা ২৫০০। এই টাকায় বিমানে ভ্রমণের সুযোগ নেই। দুই ম্যাচের মধ্যে বিরতি কেবল তিন দিন। দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে হয় বাসে। যেতে-আসতেই অনেকটা সময় লেগে যায়। শরীরের রিকভারির সময় কোথায়, অনুশীলনের সময়ই বা কোথায়!
ক্রিকেটাররা বলেছেন, ভাতা দিতে হবে না, বিমানে ভ্রমণের টিকিট দিন। এই দেশে এটুকুও চেয়ে নিতে হয়!
ঘরোয়া ক্রিকেটের সময় এমন হোটেলে থাকতে চান ক্রিকেটাররা, যেখানে জিম আছে। এটা তো বোর্ডের এমনিই নিশ্চিত করার কথা ছিল!
জাতীয় লিগে ক্রিকেটারদের হোটেলে থেকে মাঠে নিয়ে যাওয়া হয় লক্কর-ঝক্কর লোকাল বাসে। দেশের ক্রিকেটের জীর্ণ অবস্থাও কি তাতে ফুটে ওঠে না?
ক্রিকেটাররা চেয়েছেন, বিভাগীয় পর্যায়ে বছর জুড়ে যেন ফিজিও-ট্রেনারের তত্ত্বাবধানে তাদের রাখা হয়। অনুশীলনের পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়। অথচ ক্রিকেট বোর্ডের মূল দায়িত্বই এসব। আন্দোলন করে কেন আদায় করতে হচ্ছে?
নাজমুল হাসানের নেতৃত্বাধীন বোর্ড টানা ৭ বছর আছেন ক্ষমতায়। দেশের ক্রিকেট অবকাঠামোর কতটুকু উন্নতি হয়েছে?
ঢাকায় মিরপুরের বাইরে ভালো একটি জিম করতে পারেননি তারা এত দীর্ঘ সময়েও। নেই ভালো কোনো ইনডোর। নেই কোনো নিজস্ব সুইমিংপুল।
মিরপুরের ইনডোরে ঢুকলেই দম বন্ধ হওয়ার জোগাড় হয়। অল্প সময় অনুশীলন করলেই হাঁপিয়ে ওঠেন ক্রিকেটাররা। তারা বছরের পর বছর ধরে বলে আসছেন সংস্কার করতে। অন্তত এসির ব্যবস্থা করতে। অনেক দিন আগে বোর্ড সভাপতি শুনিয়েছিলেন, এই ইনডোর ভেঙে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মতো কিছু করা হবে। সময় প্রমাণ করেছে, সেটি ছিল স্রেফ 'গালগপ্পো।' সামান্য এসিই লাগানো হয়নি!
সেই ইনডোরেও আবার জাতীয় ক্রিকেটারদের বাইরে অন্যদের প্রবেশাধিকার মেলে কদাচিৎ। বেশির ভাগ সময় মেলেই না। ঢাকার বাইরের অবস্থা তো বলার মতোই নয়।
মাসের পর মাস দিন-রাত খেটে যাচ্ছেন যে মাঠকর্মীরা, তাদের পারিশ্রমিকের অঙ্ক দুঃখজনক। দেশে প্রায় প্রতি সিরিজ শেষে আর দলের বিদেশ সফরের আগে ক্রিকেটাররা নিজেরাই চাঁদা ধরে বা অনেকে ব্যক্তিগত ভাবে মাঠকর্মীদের আর্থিক সাহায্য করেন। বোর্ড তাহলে কি করে?
মাঠকর্মীদের কথা উঠে এসেছে ক্রিকেটারদের দাবি দাওয়ায়। আম্পায়ারদের কথাও এসেছে। অথচ তাদের অভিভাবক বোর্ড!
এই বোর্ডের মেয়াদে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের ক্রিকেটের নিচের স্তরগুলো, যেখান থেকে ক্রিকেটাররা উঠে আসেন। প্রভাবশালী বোর্ড পরিচালকদের ক্লাবগুলোকে বাড়তি সুবিধা দিতে আম্পায়ারদের সাহায্যে অন্য ক্লাবগুলিকে হারানো, জোর-জবরদস্তি করাসহ এই টুর্নামেন্টগুলোকে বানিয়ে তোলা হয়েছে বিভীষিকা। যে টুর্নামেন্ট দিয়ে দেশের ক্রিকেটের মূল স্রোতে ক্রিকেটারদের হাঁটা শুরু হয়, সেই তৃতীয় বিভাগ বাছাই টুর্নামেন্টকে প্রায় ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে নিজেদের স্বার্থে।
এখন এসব ঠিকঠাক করতেও প্রকাশ্যে দাবি জানাতে হচ্ছে জাতীয় ক্রিকেটারদের। বোর্ড দেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ না ভাবলেও ক্রিকেটারদের দহন স্পষ্ট।
…এবং ক্রিকেটারদের দাবির বাইরে
ক্রিকেটারদের ১১ দফা দাবির সবই সরাসরি মাঠের ক্রিকেট বা ক্রিকেট সম্পর্কিত। এখানেই ঘাটতি, অভিযোগের শেষ নেই। কিন্তু এসবের বাইরে, বোর্ড পরিচালনা, আর্থিক দিকসহ অন্যান্য দিকগুলোয় নাজমুল হাসানের নেতৃত্বাধীন বোর্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমতে জমতে প্রায় এভারেস্ট ছুঁতে চলেছে।
কথায় কথায় বোর্ড প্রধানসহ অন্যরা আর্থিক দিক থেকে নিজেদের সাফল্যের কথা বলেন। বোর্ডের শত শত কোটি টাকার ফিক্সড ডিপোজিটের কথা বলেন। অথচ ক্রিকেটার থেকে শুরু করে মাঠের ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট প্রায় সব কাজের ক্ষেত্রে অর্থ সঙ্কট প্রবল দেখা দেয়! এত বছরেও অবকাঠামোর কোনো উন্নতি হয় না। বোর্ডের এত টাকা তাহলে যায় কোথায়?
বোর্ড পরিচালকদের সুযোগ-সুবিধা কখনও কমানো হয়েছে বলে শোনা যায়নি। দেশের ভেতরে সিরিজে যেখানেই খেলা থাকে, বোর্ড পরিচালকরা দল বেঁধে খেলা দেখতে যান বিমানে চেপে। ফাইভ স্টারে চলে থাকা-খাওয়া। দেশের বাইরের সফরে তারা পান বোর্ড থেকে মোটা অঙ্কের ভাতা। এসবে দেশের ক্রিকেটের উন্নতি কোথায় হয়, সেটির জবাব নেই।
দেশের ভেতরে হোক বা বাইরে, যেখানেই খেলা হোক, বোর্ড প্রেসিডেন্ট স্বয়ং উড়ে চলে যান প্রায় সব সিরিজেই। সঙ্গে বিশাল বহর। ক্রিকেট বিশ্বের ইতিহাসে আর কোনো বোর্ড সভাপতি এই চর্চা করেছেন বলে জানা নেই।
দল নির্বাচনে হস্তক্ষেপের কথা তিনি অবলীলায় বলেন সংবাদ সম্মেলনে। মাঠের ক্রিকেট নিয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত দেন প্রায়ই। কখনও ক্রিকেটারদের নাম ধরেই বিশ্লেষণ করেন কোচের মতো, কখনও ব্যাটিং কোচের মতো, কখনও বোলিং কোচ। ফিল্ডিংয়েও কম যান না। কখনও তিনি ম্যানেজার, কখনও নির্বাচক, কখনও অনুপ্রেরণাদায়ী। অথচ আসল কাজ যেটি, বোর্ড পরিচালনা, সেখানে অবস্থা ঠনঠন।
নাজমুল হাসান ও তার ঘনিষ্ঠদের একচ্ছত্র আধিপত্য ও স্বেচ্ছাচারিতা চর্চার প্রিয়প্রাঙ্গন হয়ে উঠেছে বিসিবি। তার ছায়ায় ও প্রশ্রয়ে বোর্ড পরিচালকদের অনেকের জীবন বদলে গেছে বলে অভিযোগ আছে।
বোর্ডের অন্যতম প্রভাবশালী পরিচালক ইসমাইল হায়দার মল্লিক আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পেয়েছেন একটি-দুটি কমিটির। কিন্তু বোর্ডের সব কমিটি থেকে শুরু করে সব জায়গায় তার প্রবল প্রভাবের অভিযোগ আছে দীর্ঘদিন ধরে। বোর্ডের ব্যবস্থাপনা, বোর্ডের আর্থিক যত দিক, নীতি নির্ধারণ থেকে শুরু করে ছোটখাটো সব ব্যাপারেও তার ইশারা ছাড়া কিছু হয় না বলে শোনা যায়।
মোহামেডানের ফুটবল সংগঠক হিসেবে ক্রীড়াঙ্গনে পরিচিত লোকমান হোসেন আচমকা ক্রিকেট বোর্ডে পরিচালক হয়ে ওঠেন নাজমুল হাসানের বন্ধু হিসেবে। বিসিবি প্রধানের কাছের মানুষ হিসেবে বোর্ডে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও পান। সেসব থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ নয়-ছয় করার অভিযোগ আছে লোকমানের বিরুদ্ধে। এখন তিনি ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে জেলে। নাজমুল হাসান বলেছেন, এসবের কিছুই তিনি জানতেন না। লোকমানের জন্য বোর্ড নাকি বিব্রতও নয়!
বোর্ডের ছোট থেকে বড়, যে কোনো টেন্ডার বা যে কোনো কাজ, দু-একজন বোর্ড পরিচালককে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ দেওয়া ছাড়া পাওয়া সম্ভব নয় বলে অভিযোগ উঠেছে বারবার। কোনো প্রতিকার মেলেনি।
একসময় স্পন্সরশীপ থেকে প্রাপ্ত যে কোনো পরিমাণের অর্থ সংবাদমাধ্যমকে জানাতো বোর্ড। বর্তমান বোর্ড সেই চর্চাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছে। 'গোপনীয়' কোনো অঙ্কই জানানো হয় না। অর্থ তছরূপের অভিযোগ এসবে আরও ভিত্তি পায়।
মন্ত্রী-এমপিদের ক্ষেত্রে যেমন আগে-পরে সম্পদের হিসাব খতিয়ে দেখা হয়, বিসিবি পরিচালকদেরও কয়েকজনের দায়িত্ব পাওয়ার আগে ও পরের সম্পদের পরিমাণ খতিয়ে দেখতে পারলে হয়তো চোয়াল ঝুলে যেতে পারে অনেকে।
নাজমুল হাসানের ঘনিষ্ট পরিচালকেরাই সব দায়িত্ব পান বোর্ডের। অথচ অভিজ্ঞ ও সত্যিকারের ত্যাগী যে দু-একজন সংগঠক আছেন, তারা এই বোর্ডে কোণঠাসা। তরুণ যে দু-একজন পরিচালক উদ্যমী, তারাও পান না বড় দায়িত্ব।
তিনজন সাবেক অধিনায়ক আছেন এই বোর্ডের পরিচালক হিসেবে; আকরাম খানম, নাঈমুর রহমান ও খালেদ মাহমুদ। সাবেক ক্রিকেটার হয়েও তারা ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের স্বার্থ দেখেছেন সামান্যই। বরং অনেক সময়ই সঙ্গী হয়েছেন নাজমুল হাসানদের নানা অব্যবস্থাপনায়।
২০১৫ থেকে ২০১৭ সময়টায় মাঠের ক্রিকেটে প্রচুর সাফল্য এসেছে ক্রিকেটারদের সৌজন্যে। অভিযোগ আছে, সেই সময়টায় আড়ালে লুটপাটের মহোৎসব চলেছে, ক্রমে ক্ষয়ে পড়েছে ঘরোয়া ক্রিকেটের ভিত। জাতীয় দলের সাফল্যে আড়াল করা হয়েছে ওই সবকিছুকে। এজন্যই এখনও এই বোর্ডের সব ভাবনা কেবলই জাতীয় দল কেন্দ্রীক। যেন জাতীয় দল ভালো করলেই সাত খুন মাফ!
সব মিলিয়ে, সাংগঠনিক পর্যায়ে দেশের ক্রিকেট দাঁড়িয়ে ক্রান্তি লগ্নে। এত অনাচার হয়েছে এই আঙিনায়, প্রবল প্রতিরোধেই কেবল সম্ভব চূড়ান্ত ধ্বংস থেকে রক্ষা করা। ক্রিকেটারদের এমন একতাবদ্ধ হওয়া, নিজেদের পাশাপাশি দেশের ক্রিকেটের সামগ্রিক উন্নয়নে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া সেই প্রতিরোধের প্রতিরূপ। এই শক্ত ঝাঁকুনিতেই এখন যদি আবার মেরুদণ্ড সোজা করে দঁড়ায় দেশের ক্রিকেট!