জিতবে সম্প্রীতি

Published : 21 Oct 2019, 07:02 PM
Updated : 21 Oct 2019, 07:02 PM

২০১২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর, কক্সবাজার জেলার রামু আর আজকের ভোলা। গত ৭ বছরে বড় পাঁচটি ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোর চরিত্র একই এবং যারা ঘটিয়েছে তারা একটিই পক্ষ। রামুতে হয়েছিল এক বৌদ্ধ যুবককে টার্গেট করে, এরপর সব হিন্দুদের কেন্দ্র করে। সিস্টেমটি খুব সহজ, একজন সংখ্যালঘুর ফেসবুক আইডি হ্যাক করা হবে, তারপর সেখানে ইসলাম বা মোহাম্মদ অবমাননাকারী কোন বার্তা বা ছবি পোস্ট করে ভাইরাল করে তৌহিদী জনতার নামে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, মন্দিরে হামলা করা হবে। 

দেশের দক্ষিণের জেলা ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলা সদরে রোববার সকালে এরকম একটি ঘটনায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিতে অন্তত চারজন নিহত হয়েছেন৷ যে যুবকের আইডি থেকে এটি করা হয়েছে, সে পুলিশকে আগেই তা জানিয়েছিল এবং পুলিশ কয়েকজনকে আটকও করেছিল। ইসলাম ও নবীর অবমাননা হয়েছে বলে যারা হিংস্রতায় নেমেছিল তারাও জানত এবং নিশ্চয়ই বোঝার কথা এটি কোন সংখ্যালঘূ যুবক এইভাবে করবেনা। তবুও তারা মাঠে নেমেছিল। একটি পক্ষ এখনও সক্রিয় আছে এই সহিংসতাকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার জন্য। 

অসহিষ্ণুতা, হিংসা, বিদ্বেষ, আর ঘৃণার রাজনীতি এটি। দুর্ভাগ্য মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের।  যারা এটি বারবার করছে তারা একটি সংগঠিত শ্রেণি। এরা নিরন্তর প্ররোচনা ও উস্কানির মধ্যে ফেলে রাখতে চায় ধর্মভীরু মানুষকে। এদের বড় একটা অংশ সেই ফেসবুক পোস্ট না পড়েই স্রেফ জনরবের ভিত্তিতে কিছু ধর্ম ব্যবসায়ীর কবলে পড়ে সহিংসতা করে যারা বরাবরই ইসলামের বিপন্নতার ধুয়ো তুলে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য। রণধ্বনি তুলে পথের হিংসায় নামতে নিজ সম্প্রদায়কে প্ররোচিত করেন এমনভাবে যেন রাস্তায় নেমে ভাঙচুর, অগ্নি সংযোগ, লুটপাট চালালেই সেই অবমাননা দূর হবে। এভাবেই ইসলাম বিপন্ন বলে প্রচার করে সমাজকে বিপন্ন করছে কিছু স্বার্থান্বেষী। 

এই ধর্মব্যবসায়ীরা যারা নানা ছুঁতোয় ইসলাম বিপন্ন বলে দেশে সহিংসতা ছড়ায়, তাদের কয়জনকে সামাজিক কল্যাণের কাজে উৎসাহ দিতে দেখা যায়? পিছিয়ে পড়া মানুষের শিক্ষার প্রসারে, শিশুদের স্বাস্থ্য নিশ্চিতে, নারীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়ার দাবিতে, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ দূর করার আন্দোলনে কখনো এদের দেখা যায়? যায়না, কারণ এ সব কাজে সম্প্রদায়ের মন জয় করা গেলেও তাকে ভীত সন্ত্রস্ত করে রাখা যায় না। আর সন্ত্রস্ত হয়ে না থাকলে তাদের জীবনে এই ব্যবসায়ী ধার্মিক গোষ্ঠী অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। 

তাদের কাজই হল ভয় দেখাও যে তোমার ঈমান, তোমার ধর্মকে অপসমান করা হচ্ছে। উসকে দিয়ে লোক খ্যাপাও, নামাজি সমাবেশ থেকে রণহুঙ্কার তোলো, তাতিয়ে দাও। যা নিয়ে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কোন মাথাব্যথা নেই, সেই অবান্তর, অকিঞ্চিৎকর, প্রান্তিক বিষয়কে সমাজের সামনে তুলে আনা, তাকে জীবন-মরণের, ধর্মের নিশান তুলে-ধরাই এদের কাজ। আর যদি এর সাথে স্বার্থান্বেষী রাজনীতিকদের সমর্থন থাকে তাহলেতো কথাই নেই।

সাম্প্রদায়িকতা তো বরাবরই বাংলাদেশের সমাজের ক্যানসার হয়ে রয়েছে। এদেশে বড় একটি অংশ কথায় কথায় অপ্রাসঙ্গিকভাবে অজুহাত হিসেবে ভারতে মুসলমানদের কথা টেনে আনে। এরা পাকিস্তান বা আফগানিস্তানকেই আদর্শ মানে যেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটি দিনও কাটেনা আক্রমণের শিকার হওয়া ছাড়া। যারা মন্দিরে হামলা করে, লুটতরাজ করে, তারা সেই শক্তির আদর্শে অনুপ্রাণিত যারা আরেকটি ১৯৭৫ চায়, যারা পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার প্রকল্প নিয়ে মাঠে সরব রয়েছে সব ধরনের সহিংসতা পুঁজি করে। 

এই পোস্টটি সেই হিন্দু ছেলেটির নয়। এটি পরিষ্কার জেনেও, দু:খজনক হলো ফেসবুকে, অনলাইনে এক শ্রেণির শিক্ষিত মানুষও সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। 

রামু, নাসিরনগর, রংপুর যেসব এলাকায় এসব ঘটনা ঘটেছে, পরে গিয়ে দেখা গেছে কী হিন্দু, কী মুসলিম- দু'পক্ষই শোকাহত। নিশ্চয়ই এক সময় ভোলায়ও তা প্রমাণিত হবে। এ ধরনের সহিংসতায়, হিংস্রতায় যে কোন পক্ষেরই লাভ হয় না, সে শিক্ষা নিতে পারছেনা সমাজের একটি শ্রেণি। রাজনীতির মুনাফা লাভে লোলুপ রসনা সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি থেকেই সুবিধা নিতে চায়। 

সময় এসেছে নতুন করে ভাবার। মানতেই হবে যারা এসব চান না তাদের উদাসীনতা বা আপসকামিতা ক্রমেই পরিস্থিতিকে আয়ত্বের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। আধুনিক বাংলাদেশে দুর্ভাগ্যবশত উদারতা ও অন্তর্ভুক্তির ঐতিহ্য সংকীর্ণবুদ্ধি সাম্প্রদায়িকতার কারবারিদের দ্বারা বিকৃত হয়ে চলেছে। এই গোত্রের তাত্ত্বিকরা একটি বৃহৎ সমগ্রের অঙ্গীভূত করার আমাদের সামাজিক ঐতিহ্যকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অপরিসর বৃত্তে সঙ্কুচিত করে ফেলছে। আর এর ফলেই সৃষ্টি হচ্ছে উগ্র, জঙ্গি, মারমুখী ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার। এই গোষ্ঠীর অনুগামী স্বেচ্ছাসেবকরা তাই সুযোগ পেলেই লাঠি আর রাম দা নিয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের শায়েস্তা করতে পথে বের হয়ে আসে। সহিষ্ণুতা, উদারতা ও অন্তর্ভুক্তির জীবনচর্যা ক্রমে অন্য ধর্মের মানুষদের ওপর আক্রমণের, তাদের বিতাড়নের ধর্ম হয়ে উঠছে। জানা নেই ধর্মীয় আচার আচরণ এবং রাজনীতির উদ্দেশ্য সাধনে ধর্মকে ব্যবহার করবার এই প্রবণতা কবে আলাদা করা যাবে।

আমরা যারা এসব চাইনা তাদের ভাবনার জগতে পরিবর্তন আনতে হবে। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকে মূলধন করে লোক খেপিয়ে ব্যবসা যারা করে তাদের খুব শক্ত হাতে প্রতিহত করতে হবে। একটা কথা বলা দরকার। যে রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী এই মৌলবাদী শক্তিকে খুশি রাখতে গিয়ে আপসের পথে চলছে তারাই এদের সবচেয়ে বড় হিংস্রতার শিকার হবে। ইতিহাস সে কথাই বলে। 

যারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে পথ চলতে চান, যে রাজনীতি শাসকের আসনে থাকতে চায়, তাকে ধর্মীয় উগ্রবাদ থেকে দূরে থাকতে হবেই। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ এসব অনেক দেখেছে, কিন্তু বারবারই জিতেছে সম্প্রীতি।