সালটি ১৯৯৭। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনে নির্বাচনে জিতে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেছেন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ প্রচারিত হয়েছে। আমাদের বয়োজেষ্ঠ্য এক কবি যিনি বঙ্গবন্ধুকে খুব সম্মান করেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার সাড়া জাগানো কয়েকটি কবিতাও রয়েছে, তিনি আজিমপুরের এক বিপণীবিতানে বিএনপি সমর্থক এক ভদ্রলোকের সঙ্গে নিয়মিত আড্ডা দেন, তাস খেলেন। ওই ভদ্রলোকের স্কুলমুখী দুটি শিশু রয়েছে। শিশু দুটির একটি মেয়ে, একটি ছেলে। তাদের বাসায় জিয়াউর রহমানের ছবি ঝোলানো। ওই শিশু দুটি কোনদিন বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখেনি, ভাষণও শোনেনি। দূরদর্শনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার পরে শিশু দুটি পোস্টার আর ছবির দোকানে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবি কিনেছে। ছবিটি বাসায় নিয়ে এসেছে। দেয়াল থেকে জিয়াউর রহমানের ছবি নামিয়েছে। তারপর দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর ছবি ঝুলিয়েছে। ঘটনাটা সত্য! এই ঘটনা থেকে আমরা কী বুঝলাম?
এবার আরও একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করব। সুইডেনের সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দলের প্রধানমন্ত্রী ওলফ পালমের কথা আমরা অনেকেই জানি। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু আর ওলফ পালমে একই ভাবধারার ছিলেন। ওলফ পালমে ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার বিরুদ্ধে জোরালো কণ্ঠস্বর ছিলেন। যে ঘটনার জের ধরে আমেরিকা স্টকহোম থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করেছিল। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা আমরা ভাল করেই জানি।
১৯৭৫ সালে খুনিরা খুন করলো বঙ্গবন্ধুকে। আর ১৯৮৬ সালে ওলফ পালমেও একই ভাগ্য বরণ করলেন। এই ওলফ পালমে ১৯৭০ আর ১৯৮০ এর দশকে কয়েক দফায় সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তার সরকারের আমলে তিনি বেশ কয়েকটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। তার মধ্যে সন্তানের মায়ের সঙ্গে সন্তানের বাবার জন্যও দীর্ঘমেয়াদী পিতৃত্বকালীন ছুটির ব্যবস্থা করা। এই সিদ্ধান্তের পক্ষে ওলফ পালমের বড় যুক্তি ছিল ভবিষ্যতের পরিবারে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করতে হলে, শুরুটা করতে হবে গোড়া থেকেই।
যে শিশু তার বাবাকে দেখবে পরিবারের কাজে মায়ের সঙ্গে হাত মেলাতে খুঁটিনাটি বিষয়ে মায়ের মতই বাবাকেও পাশে পাবে। সে শিশু বড় হয়ে আনন্দের সঙ্গেই এই কাজ করবে।
এই দুটি ঘটনা থেকে আমরা শিশু মনস্তত্ব বিকাশে এবং তার মানসগঠনে তার পরিবার আর চারপাশ কিভাবে প্রভাব ফেলতে পারে তার কিছুটা ধারণা লাভ করতে পারি।
এবার অন্য একটি প্রসঙ্গে কথা বলব। ১৮ অক্টোবর শেখ রাসেলের জন্মদিন। তিনি জন্মেছিলেন ১৯৬৪ সালে। বেঁচে থাকলে আজ তার বয়স হত ৫৫। ঘাতকরা তাকে বাঁচতে দেয়নি। তার আকুতি ঘাতকদের মনকে বিন্দুমাত্র ধাক্কা দেয়নি। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে খুনিদের শিশুকাল কেমন ছিল! রাসেলের একটি কথা আমাদের কানে খুব বাজে। সে বলেছিল − আমাকে মেরো না। আমাকে ছেড়ে দাও। আমি হাসু আপার কাছে চলে যাব।
তার হাসু আপা আজ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। বিশ্ব রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর। সম্প্রতি দিল্লী সফরকালে গ্রহণ করলেন আন্তর্জাতিক ঠাকুর শান্তি পুরস্কার ২০১৯। সেই হাসু আপা তাকে নিয়ে লিখেছেন, 'আমাদের ছোট রাসেল সোনা' বইটি। চমৎকার ঝরঝরে গদ্যে লেখা।
এক শিশুর সংক্ষিপ্ত জীবনীতে উঠে এসেছে আমাদের জাতিরাষ্ট্রের ইতিহাসের আবশ্যক গল্প। গল্পগুলো শেখ রাসেলকে ঘিরে।
এই প্রেক্ষাপটে কয়েকটা কথা বলে নিতে চাই। আমাদের জাতীয় জীবনে জাতীয় ইতিহাসে নানা বাঁকে সংস্কৃতির ভাঙাগড়ার খেলায় আমাদের জাতীয় আদর্শ যেমন বঙ্গবন্ধু রয়েছেন − রয়েছেন লালন শাহ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, তাজউদ্দিন আহমদসহ আরো অনেকে। অন্যদিকে নারী জাগরণের বেলায় বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, বেগম ফজিলাতুননেসা, জাহানারা ইমাম আর অতি অবশ্যই শেখ রাসেলের 'হাসু আপা', আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামটিও অগ্রগণ্য। এবার প্রশ্ন হল − আমাদের জাতীয় ইতিহাসে শিশু মডেল কে? যে শিশু আমাদের জাতীয় ইতিহাস, অস্তিত্ব, ঐতিহ্য রুচি আর সামগ্রিক প্রেক্ষাপটকে ধারণ করে।
ইতিহাসকে কেবল পাঠ্যপুস্তকে ঢুকিয়ে দিলেই শিশুকে আত্মস্থ করানো সহজ নয়। আজকের শিশুকে ইতিহাসের পাঠ দিতে হবে তার মনের খবর করেই। তাই ইতিহাসের দৃশ্যে, অঙ্কে একজন শিশু যখন দেখবে তার মতই আরেক শিশু শেখ রাসেলের গল্প, সেই শিশু আগামী দিনে রুচি আর সামগ্রিক প্রেক্ষাপটকে ধারণ করবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের পথে আর শেখ রাসেলের বিচরণ পথেই নিজেকে কল্পনা করবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যে শিশুর নামকরণ করেছিলেন দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের নামের সঙ্গে মিলিয়ে- শেখ রাসেল।
আজকের শিশু কিশোরের সামনে বঙ্গবন্ধুর ছবি আর তার জীবনের গল্প যেমন জরুরি তেমন তাৎপর্যপূর্ণ রাসেলের জীবনের গল্পও। আমার জানা নাই আধুনিক ইতিহাসে কোন জাতির জীবনে এরকম কোন শিশু মডেল আছে কি না, তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কয়েকটা প্রস্তাব রাখতে চাই − আমাদের শিশু একাডেমির নাম হতে পারে শেখ রাসেল শিশু একাডেমি। তার নামে বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ না নিয়ে এটা একটা মোক্ষম কাজ হতে পারে। একইভাবে সংশ্লিষ্টরা প্রাসঙ্গিক আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে আন্তর্জাতিক শিশু কিশোর দিবসের ঘোষণায় শেখ রাসেলের কথা অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে সম্ভাব্যতা যাচাই করে নিতে পারেন।
লেখাটা শেষ করার আগে প্রসঙ্গক্রমে কয়েকটা কথা বলে রাখতে চাই। বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙানোর ব্যাপারে নীতিমালা আর সরকারি নির্দেশনা রয়েছে। সাধুবাদযোগ্য উদ্যোগ। তবে আমাদের বাড়িতে, দপ্তরে আদালতে দৈনন্দিন জীবনে বঙ্গবন্ধুর ছবির আবেদন আর গুরুত্ব সরকারি নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে না। কথায় আছে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। তার উদাহরণ আমি শুরুতেই দিয়েছি- বিএনপির ভদ্রলোকের দুই শিশু জিয়াউর রহমানের ছবি নামিয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙিয়েছে।
অন্যদিকে সরকারের নির্দেশের পরও দেশের কোন কোন জায়গায় বঙ্গবন্ধুর ছবি সব দপ্তরে শোভা পায় না। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও বঙ্গবন্ধুর ছবি সব বিভাগের দপ্তরে শোভা পায় এই কথা হলফ করে বলা যাবে না। দুই এক বছর পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগে বঙ্গবন্ধুর ছবি টানানোর সময় কতিপয় শিক্ষক জোরালোভাবে বিরোধিতা করেছিলেন।
অবাক করার বিষয়, বিরোধীতাকারী একাধিক শিক্ষক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটিতে জায়গা করে নিয়েছেন। এরই নাম দ্বিচারিতা? ভেতরে বঙ্গবন্ধুর ছবি টানাতে বিরোধিতা করবেন। বাইরে বঙ্গবন্ধুর নামে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করবেন। ডাবল স্ট্যান্ডার্ড জিনিসটা এতটাই গুবলেটে!