কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর তার লাশ ঘিরে টেলিভিশনের পর্দায় এবং পত্রিকার পাতায় পাতায় আবেগের ছড়াছড়ি। খুবই আবেগঘন একটি বিষয় বলে স্বভাবতই অনেকে মাত্রা ছাড়িয়েছেন। তবে এর পাশাপাশি হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে একটি ট্র্যাজিক আবহ তৈরি হয়েছে। এই ঘটনাগুলোর খুব ভালো পর্যবেক্ষক এক তরুণী আমাকে জানিয়েছেন, বাবার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে লেখকের প্রথম স্ত্রী গুলতেকিনের সন্তানদের অনুভূতি কেমন ছিল। 'আমি জানি এ সময় অনুভূতিটা কেমন হয়। নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়।' বিখ্যাত বাবার সন্তান হয়েও তাদের যে বেদনার ভার সইতে হয়েছে অনেক! তাদের বাবা তাদের মাকে ছেড়ে অন্য নারীকে বিয়ে করেছেন। মৃত বাবার জন্য তাই তাদের অনুভূতিটা হয় মিশ্র–গভীর কিন্তু একই সঙ্গে দ্বান্দ্বিক।
বিষয়টা খুব জটিল কিন্তু এ সব ক্ষেত্রে সন্তানদের জন্য এটাই স্বাভাবিক। এর ফলে সবার সম্মিলিত ক্রোধ গিয়ে পড়েছে শাওনের ওপর। সাধারণত এটাই হয়–এ ধরনের ঘটনায় দ্বিতীয় স্ত্রীকে 'সংসার ভাঙ্গার জন্য' দায়ী করা হয়। তাকে সবাই 'রাক্ষুসী' হিসেবে চিহ্নিত করেন। সবাই তাকে ঘৃণা করতে শুরু করেন। হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়েই যে শুধু এমন ঘটছে তা নয়, বাঙালি মধ্যবিত্তের মূল্যবোধে আঘাত লেগেছে বলেই শাওন এমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন।
শাওন কখনও সাধারণের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন না। কারণ সবাই মনে করেন তিনি 'অর্থলোভী।' কোনও তরুণী কোনও ধনবান বা খ্যাতিমান বয়স্ক পুরুষকে বিয়ে করলে সে নারীকে এমনটাই মনে করা হয়। অর্থ বা খ্যাতির মোহে নয়, ভালোবেসেই তিনি ওই পুরুষটিকে বিয়ে করেছেন এমন কেউ ভাবেন না। পশ্চিমে এ ধরনের ঘটনা প্রচুর। সেখানে ট্য্যাবলয়েড ম্যাগাজিনগুলো চলেই ওসব কেচ্ছাকাহিনীর বিবরণ ছাপিয়ে।
এ যুগে নারীরাও ক্যারিয়ারে উন্নতির মাধ্যমে বড় বড় সেলিব্রিটিতে পরিণত হচ্ছেন। তাই এখন তাদের বেলায়ও বিপরীত ধরনের ঘটনা ঘটছে। তাদের বেলায় একই ধরনের টার্মের প্রয়োগের ছড়াছড়িও দেখা যাচ্ছে। 'কুগার' শব্দটি দিয়ে এমন কোনও বয়স্ক নারীকে বোঝানো হচ্ছে যিনি তারুণ্য ধরে রাখতে তরুণদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ছেন। আর এমন কোনও নারীর পছন্দের তরুণ-যুবাকে বলা হচ্ছে 'টয়বয়।' আধুনিক নারী-পুরুষরা অবশ্য বেশি বয়সে এসে এ ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেও টাকা-পয়সার ব্যাপারে সতর্ক থাকছেন। তাই ওই ধরনের টার্মগুলো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। তবু বিলুপ্ত হয়ে যায়নি।
আমাদের একেবারে মধ্যবিত্ত সামাজিক কাঠামোতে এখনও পরিবারের ধারণাটা প্রাধান্যশীল। এই মূল্যবোধটা ধরে রেখে আমরা নিজেদের বাঁচিয়ে রাখছি। হুমায়ূন-শাওন-জাতীয় ঘটনা আমাদের মনের গহীনে লালন করা এই মূল্যবোধে আঘাত হানে। এটা সমাজের নিয়মের ব্যত্যয় ঘটায়। তাই হুমায়ূন আহমেদ যা করেছেন শাওনকে তার জন্য চরম মূল্য দিতে হচ্ছে।
এই জুটি আমাদের দুটো ট্যাবুতে আঘাত করেছেন। প্রথমটি হল, বিয়ে ভেঙে দেওয়া। আমাদের সামাজিক মূল্যবোধে বিয়ে হল একটা 'পবিত্র বিশ্বাসের বন্ধন', কোনও কার্যকর সামাজিক চুক্তি নয়। বিয়েবন্ধন থেকেই পরিবারের উৎপত্তি ঘটে আর পরিবার হল সমাজের চালিকাশক্তি। তাই পরিবার ভেঙে দিলে সবাই নিজেদের বিচ্ছিন্ন বা অসহায় মনে করতে থাকেন। হুমায়ূন-শাওন জুটি দ্বিতীয় যে ট্যাবু ভেঙেছেন সেটি হল, কন্যার বন্ধুকে বিয়ে করা। এই ট্যাবুটিই সবচেয়ে শক্তিশালী। কারণ কন্যার বন্ধু 'কন্যাতুল্য' বলেই বিবেচিত হয়। তাই সমাজের চোখে এটা প্রায় 'অজাচারের মতোই।' দ্বিতীয় বিয়ে করা যতটা না নিন্দনীয়, তার চেয়ে অনেক বেশি নিন্দনীয় এই ধরনের বিয়ে। আমাদের মূল্যবোধে এটা যৌন-আচরণের ব্যাপারে সব শালীনতাকে অতিক্রম করে।
এমনতর ঘটনা সমাজে প্রায়ই ঘটে। তবে এমনটা যখন ঘটে, তখন পরিবারের কাঠামোর ভেঙে পড়ে, সনাতন অসহায়ত্ব-বোধ আমাদের আস্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। অনিশ্চয়তার সাগরে আমরা হাবুডুবু খেতে থাকি। হুমায়ূন-শাওনের বিয়ের ঘটনায়ও এটাই ঘটেছে।
এই ঘটনার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হল, শুধু শাওনের দিকেই সবগুলো বিষমাখা তীর ছুঁড়ে মারা হচ্ছে। সবকিছুর জন্য তাকেই দায়ী করা হচ্ছে। হুমায়ূনের কবরের জায়গা নির্বাচনের ক্ষেত্রে শাওনের সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে তাদের পরিবার বাধ্য হওয়ায় এটাও বলা হচ্ছে যে শাওন হুমায়ূন আহমেদের পুরো সম্পদ গ্রাস করতে চাচ্ছেন। তিনি যেন 'লেডি ইন দ্য ব্ল্যাক'– সব খারাপ ঘটনার জন্য যে দায়ী। এমনকি হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর জন্যও তাকে দায়ী করা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে একটি মামলা পর্যন্ত হয়ে গেছে। সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে একজন প্রকাশকের নাম যিনি এই পরিবারের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। যুক্তরাষ্ট্রে হুমায়ূনের চিকিৎসার পুরো সময় জুড়ে এ দুজনই সঙ্গে ছিলেন। ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ওরা গুরুতর অসুস্থ হুমায়ূনের চিকিৎসার ব্যাপারে ঠিকঠাক পদক্ষেপ নেননি, দায়িত্বে অবহেলা করে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছেন।
এই সব চিন্তা-ভাবনা থেকে আমাদের দুঃখের আগুনে যেন ঘি পড়ছে। আবেগের স্ফুলিঙ্গগুলো আরও জোরেশোরে জ্বলে উঠছে। আমাদের মনে প্রতিশোধের ছাইচাপা আগুনটাও উস্কে দিচ্ছে এসব কথাবার্তা। শাওন এখানে খুব সহজ আর সঠিক শিকার। ঠিক এমনটিই ঘটেছিল ব্রিটেনের রাজবধূ প্রিন্সেস ডায়নার মৃত্যুর পর। তখন তার সাবেক স্বামী প্রিন্স অব ওয়েলস চার্লসের প্রেমিকা ক্যামিলা পার্কারকে সবকিছুর জন্য দায়ী করা হয়েছিল। তিনি হয়ে উঠেছিলেন 'সুপার ভিলেন।' অথচ লেডি ডায়না চার্লসের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর একাধিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। আসলে দুঃখ আর ক্রোধ যখন স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার চেয়ে বেশি হয়ে যায়, তখন বোঝা যায় আমাদের মনের গভীরে লুকানো অন্য কোনও গভীর ক্ষত রয়ে গেছে।
কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ নামক ব্যক্তিটির কী হবে? তিনিই গুলতেকিনকে ত্যাগ করেছিলেন, পরিবার ভেঙে দিয়ে ছেলেমেয়েদের অসহায় অবস্থায় ফেলে কন্যাসম কন্যার বন্ধুকে বিয়ে করেছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ না হয়ে অন্য কেউ এমন কাণ্ড করলে আমরা কি তাকে মেনে নিতাম? আসলে তিনি খুব সফল একজন মানুষ। বাঙালিদেরকে তিনি এমনভাবে ছুঁয়ে গেছেন যা এর আগে কেউ পারেন নি। তার পাঠকরা যা হতে চান তাই নিয়ে তিনি লিখেছেন। তাকে অস্বীকার করা মানে নিজেদের অস্বীকার করা। নিজেদের কণ্ঠটাকে রুদ্ধ করে দেওয়া। তাই তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই যে তাকে টিকিয়ে রাখতে হবে।
হুমায়ূন নিজেই এমন একটা মধ্যবিত্তের জগত তৈরি করেছেন যেখানে কোনও কিছুতেই প্রবল কোনও ঝাঁকুনি দেওয়া যায় না। মধ্যবিত্তের এই জগতটা খুব সহজ, খুব মাপা-মাপা। হুমায়ূন আহমেদের একটা কথা আমার খুব মনে পড়ে। আটের দশকে তার জনপ্রিয় ধারাবাহিক 'এইসব দিনরাত্রি'র চরিত্রগুলো নিয়ে আমরা ওআরএস-এর একটি বিজ্ঞাপন তৈরি করছিলাম। কথাপ্রসঙ্গে একদিন তিনি আমাকে জানালেন, তার আইডল হচ্ছেন কোলকাতার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি সুনীলের ওই সাহিত্যিক অর্জনটায় পৌঁছাতে চান। নিঃসন্দেহে এটাও খুব বড় একটা লক্ষ্য ছিল। এভাবেই তিনি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে চেয়েছিলেন। এই সাফল্যটা তিনি অর্জনও করেছেন এবং পাঠকদের হৃদয়-মন হয়ে উঠেছিলেন তিনি। হুমায়ূন আহমেদের বা আমাদের নিজেদের মনোজগতকে অস্বীকার করা অসম্ভব। তাই হুমায়ূন আহমেদের কর্মকাণ্ডকে আমরা মেনে নিয়েছি। তিনি এমন এক পর্যায়ে চলে গিয়েছিলেন যার ফলে তার কোন কর্মকাণ্ডের জন্যই তাকে দায়বদ্ধ করি না।
আর এর ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই সব দায় গিয়ে পড়েছে শাওনের ওপর। আমরা বলছি, শাওনের প্ররোচনাতেই হুমায়ূন তার প্রথম স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন। তার ছলাকলায় ভুলে পত্নী-পরিজন ছেড়ে শাওনকে নিয়ে নতুন করে ঘর বেঁধেছেন।
হুমায়ূনের মৃত্যুর পর শাওনকে তাই সবার ক্রোধের জ্বালা সইতে হচ্ছে। নিজেদের আশঙ্কা থেকে যে যেভাবে পারছি শাওনকে ক্ষতবিক্ষত করছি আমরা। এটা কি ন্যায়সঙ্গত কাজ হচ্ছে? শাওনের মতো অসংখ্য ভক্ত ছিল হুমায়ূন আহমেদের যারা তার কাছে গেলে একই কাজ করতে পারতেন। শাওন এখানে ব্যতিক্রম নন। তিনি একজন সাধারণ স্বার্থান্বেষী মানুষ। আমরা বেশিরভাগই যেমন। তিনি নিজের সুন্দর একটা ভবিষ্যত চেয়েছিলেন। সুযোগটা পেয়ে সেটা কাজে লাগিয়েছেন। এটা কোনও রাক্ষুসী বা দানবীর কাজ নয়। তাছাড়া তিনি বয়সে তরুণী বলে কোনও দায়িত্ব নিতে চাননি। তার কাজের জন্য অন্য কারও ক্ষতি হলে তার দায়ও তিনি নেবেন না- এটাই স্বাভাবিক। তবু সবাই তার দিকেই সমালোচনার তীর ছুঁড়ে মারছেন। এটা করার আগে আমাদের নিজেদের ভেবে দেখা উচিত, যার ওপর পুরো দায়িত্বটা ছিল তিনি কিন্তু ছয় ফুট মাটির গভীরে শুয়ে আছেন; আমাদের চোখে তার কোনও অপরাধ নেই, কোনও দায় নেই।
হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন আর তার সন্তানদের জন্য এখন যে সমবেদনা তৈরি হয়েছে সেটা এই ক্রোধেরই আরেকটা প্রকাশ। একা শাওন নিশ্চয়ই এতকিছুর জন্য দায়ী নন। আমাদের সমাজে যে কোনও ঘটনার জন্য নারীকে দায়ী করার একটা প্রবণতা রয়েছে। এ সমাজের জন্য এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে এ ধরনের দায় চাপানোর ঘটনা মেনে নেয়া যায় না। শাওনের স্বামী এখন তাকে রক্ষা করতে পাশে নেই, তিনি মুত্যুর হিমশীতল কোলে আশ্রয় নিয়েছেন। এ অবস্থায় যে বিয়ে নিয়ে এত ক্ষোভ সে বিয়ের পুরোটা দায় একজন একা নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া নারী সম্পর্কে আমাদের সনাতন ধারণারই প্রকাশ।
তাই এ ধরনের আলোচনা এখনই বাদ দেওয়া উচিত। হুমায়ূন-শাওনের বিয়ের জন্য তাদের পারিবারিক জীবনে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে তার সমাধান পরিবারের সদস্যরাই করবেন। তারাই বুঝবেন কী করতে হবে। আমরা কেন এত মোটা দাগে, এত অশোভনভাবে সবকিছু বিচার করব?