শতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টি এবং আজকের ভারত

গৌতম রায়
Published : 17 Oct 2019, 12:50 PM
Updated : 17 Oct 2019, 12:50 PM

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এক ঐতিহাসিক পটভূমিকার ভিতর দিয়ে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মানসিকতার দৃষ্টিভঙ্গির প্রচার, প্রসার ও প্রয়োগের বিপক্ষ ভাবনা হিসেবে জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল। সেই চিন্তায় ভিতর যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা ছিল। হিন্দু পুনরুত্থানবাদী বৈশিষ্ট্য ছিল। কিন্তু বিদেশী শাসকদের এদেশ থেকে তাড়ানোর ব্যাপারে কোনো দ্বিধা-সংকোচ কিন্তু ছিল না।

ব্রিটিশবিরোধী এই চিন্তা চেতনা জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার প্রথম কুড়ি বছর ভারতবর্ষের সামাজিক এবং রাজনৈতিক চেতনার স্তরকে নানাভাবে আন্দোলিত করেছিল। সেই ভাবনার ভিতরে খুব জোরদার ব্রিটিশবিরোধী মানসিকতা কিন্তু গড়ে ওঠেনি। তবে ভারতের মানুষ, মূলত বাংলা, মহারাষ্ট্রের মানুষদের নেতৃত্বে ধীরে ধীরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে বিদ্রোহ খুব দৃঢ় হচ্ছে, অচিরেই ব্রিটিশকে দেশ থেকে তাড়ানোর সংকল্পে দৃঢ় হবে– একথা বুঝতে দেরি হয়নি ব্রিটিশের।

তাই তারা বাংলার মানুষকে প্রশাসনিক সুবিধার নাম করে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজনের লক্ষ্যে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের অবতারণা করে। তার আগেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জেরে ধীরে ধীরে আধুনিক শিক্ষার প্রসারের ফলে উনিশ শতকের নবজাগরণ এসেছিল। সেই নবজাগরণ একদিকে বাংলায় আধুনিকতা, বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষা, ইংরেজি শিক্ষা, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সংকল্প, স্ত্রী শিক্ষা বিস্তারসহ নানা ধরণের প্রেক্ষিত রচনা করতে শুরু করে।

পরবর্তী সময়ে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেনসহ ব্রাহ্মেরা নারীকে একটি সম্পূর্ণ আকাশ দেওয়ার লক্ষ্যে ধরনের সামাজিক আন্দোলন শুরু করেছিলেন। এই কাজগুলি যে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামকে এক অর্থে দৃঢ় করেছিল সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ এই গোটা প্রেক্ষিতের নানা আর্থ-সামাজিক, ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতাকে অস্বীকার করে, বাংলার মুসলমান সমাজে ধীরে ধীরে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেছিল নবচেতনার উন্মেষে।

নবাব আব্দুল লতিফ থেকে শুরু করে ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী, বেগম রোকেয়া প্রমুখেরা সমাজ সংস্কারের যে কাজ শুরু করেছিলেন, তা কোনো অংশেই রামমোহন, বিদ্যাসাগর প্রমুখের ঐতিহাসিক কর্মকাণ্ড থেকে এতোটুকুই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেই বিষয়গুলিকে আমরা সঠিক মননশীলতার সঙ্গে আমাদের জাতীয় আন্দোলনের প্রেক্ষিতে, ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের প্রেক্ষিতের সঙ্গে যুক্ত করে আলোচনাতে কখনোই আনি না।

বাংলার এইরকম একটি আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পটভূমিকার ভেতরে ১৯২০ সালে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা একদিকে যেমন শোষণমুক্ত একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তনের একদম প্রাথমিক ভাবনা-চিন্তার প্রয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করা শুরু, তেমনিই আমাদের জাতীয় আন্দোলনে সাধারণ মানুষ, শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী জনতা, সেই সঙ্গে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ, নিম্নবর্গের মানুষ, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সমাজের সব স্তরের মানুষকে একত্রিত করবার লক্ষ্যে কাজের তাগিদের সূচনা বলা যেতে পারে।

ভারতবর্ষের আমজনতাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত করার ক্ষেত্রে মহাত্মা গান্ধীর যে ঐতিহাসিক ভূমিকা ও অবদান, সেই ভূমিকা ও অবদানের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভারতবর্ষের বুকে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট ও পার্টির পরবর্তী প্রয়াসকে। ভারতের মাটিতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন তথা সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে উচ্চবিত্তের, উচ্চবর্ণের, উচ্চ শিক্ষিত মানুষের অর্গল থেকে মুক্ত করে এনে, শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী-খেটে খাওয়া মানুষের দহলিজে উপস্থাপিত করবার ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টি তার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে শুরু করে, নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সেই ভূমিকাকে তাঁরা যেভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রসারিত করে, সেই ভূমিকা যে ভারতবর্ষের ব্রিটিশবিরোধী জাতীয় আন্দোলনকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে, মহাত্মা গান্ধীকে একটা বিশেষ রকমের শক্তি দিয়েছিল– তা গান্ধীবাদী রাজনীতিকরা স্বীকার না করলেও, এই ঐতিহাসিক সত্যকে আমরা কিন্তু কোনো অবস্থাতেই অস্বীকার করতে পারি না।

সশস্ত্র বিপ্লববাদী চিন্তা-চেতনার ভেতর দিয়ে যে সমস্ত মানুষ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে এদেশ থেকে বিতাড়িত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য নানা ধরনের সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেছিলেন, সেইসব চিন্তা চেতনাগুলিকে সুসংবদ্ধভাবে ঐক্যবদ্ধ করার সুযোগ কমিউনিস্ট পার্টি তার সূচনাকালে সেভাবে না পেলেও, পরবর্তী সময়ে এই সব বিপ্লবীদের একটা বড়ো অংশ যেভাবে কমিউনিস্ট পার্টির ছত্রছায়ায় নিজেদেরকে নিয়ে এসেছিলেন, তা থেকে এটা খুব পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারা যায় যে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র অভ্যূত্থানে বিশ্বাসী যুব সম্প্রদায়ের মানুষদের ভিতর কমিউনিস্ট পার্টির চিন্তা-চেতনা, বিশেষ করে সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে লক্ষ্য, সেই বিষয়বস্তুটি কিন্তু খুব গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি যে সময় প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই সময়কালে কিন্তু দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি ধীরে ধীরে তাদের মুখ ও দন্ত বিস্তারের চেষ্টা শুরু করে দিয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হবার মাত্র পাঁচ বছর আগে ১৯১৫ সালে হিন্দু মহাসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। সাভারকর, মদনমোহন মালব্য প্রমুখ ব্যক্তিত্বরা এই হিন্দু মহাসভার সঙ্গে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই জড়িত ছিলেন।

মদনমোহন মালব্য কিন্তু একাধারে হিন্দু মহাসভার নেতৃত্ব দিয়েছেন, আবার কংগ্রেসের ভিতরে দক্ষিণপন্থী, সাম্প্রদায়িক অংশের নেতৃত্বও দিয়েছেন। সেই নেতৃত্বে কিন্তু পরবর্তীকালে নানাভাবে তার নখদন্ত বিস্তার করে কংগ্রেসের ভিতরে দক্ষিণপন্থী, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে জোরদার করেছে। মহাত্মা গান্ধীর অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা-চেতনাকে নানাভাবে নানা সময় বিঘ্নিত করবার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে সেই শক্তি। কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাঁচ বছর আগে যেমন হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার  ঠিক পাঁচ বছর পরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস প্রতিষ্ঠিত হয়।

এই প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অল্পকাল পরেই একদিকে তাদের ইতালি ও জার্মানির ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের নানা ধরনের নাশকতামূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রচার, প্রসার, বিশেষ করে তাদের নানা ধরনের স্বশস্ত্র, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের উপক্রম ভারতের রাজনীতিতে দেখা দেয়। অপরপক্ষে এই প্রেক্ষিতের বেশ কিছুদিন আগে থেকেই হিন্দু মহাসভা যে সাম্প্রদায়িক প্রেক্ষাপট রচনা করে রেখেছিল, সেই প্রেক্ষাপটকে অবলম্বন করে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভিতর দিয়ে হিন্দু মুসলমানে বিভাজন তৈরি করে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সবধরনের স্বার্থ পূরণ আরএসএস এর প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।

হিন্দু মহাসভার জন্মের আগে অবিভক্ত পাঞ্জাবের একটা বড় অংশের হিন্দু বেনিয়া সম্প্রদায়, যারা' লালা' নামে পরিচিত ছিলেন, তারা ধর্মের ভিত্তিতে, সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে, হিন্দুদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবি জানিয়ে দিয়েছিল উনিশ শতকের শেষ লগ্নেই। লালা হরদয়াল, লালা লাজপত রাই প্রমুখেরা লাহোর থেকে প্রকাশিত 'ট্রিবিউন' পত্রিকায় মুসলিম লীগের 'লাহোর প্রস্তাব' উত্থাপনতো দূরের কথা, মুসলিম লীগের জন্মেরই অনেক আগে, ধর্মের ভিত্তিতে হিন্দুদের জন্য পৃথক বাসস্থানের দাবি প্রকাশ্যেই জানিয়েছিল।

তার পাশাপাশি আর্য সমাজ নামক একটি চরম দক্ষিণপন্থী, প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠন, যাদের নেতা স্বামী শ্রদ্ধানন্দ, যিনি প্রথম জীবনে পাঞ্জাবের "লালা" সম্প্রদায়ের হিন্দুদের প্রতিনিধি ছিলেন, তিনি যেভাবে ধর্মান্তকরণকে ঘিরে গোটা গোবলয়ের রাজনীতিকে একটা সাম্প্রদায়িক অভিমুখে পরিচালিত করতে শুরু করেছিলেন তা দেশের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে মুসলিম জাতিসত্তা ঘিরে প্রশ্ন ওঠার আগেই একটা বড়ো জায়গা করে নিয়েছিল।

আরএসএসকে তার রাজনৈতিক কর্মসূচি সাম্প্রদায়িকতা চলা, মুসলিম বিদ্বেষকে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের প্রচার ও প্রসারের ভিতর দিয়ে তুলে ধরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থরক্ষার দিকটি সুরক্ষিত করতে, এই হিন্দু মহাসভাকে রাজনৈতিক সংগঠন করে এবং অন্যান্য নানা শাখা সংগঠন তৈরি করে, একটা তথাকথিত সামাজিক কর্মকাণ্ডের নাম করে গোটা ভারতবর্ষে হিন্দু মুসলমান বিভক্ত করবার নোংরা খেলা তৈরি করতে জোরদারভাবে সাহায্য করেছিল।

কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রেক্ষাপট এবং সেই কর্মকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে সমাজের একেবারে নিম্নবর্ণের, নিম্নবিত্তের মানুষদের মধ্যে অধিকার সচেতন হয়ে ওঠবার প্রয়াস, সেই প্রয়াসকে যেকোনো মূল্যে প্রতিহত করবার জন্য ব্রিটিশ একদিকে যেমন তার শাসন তথা শোষণ নীতি চালিয়েছে, অপরদিকে রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ব্যবহার করেছে, যাতে নতুন তৈরি হওয়া কমিউনিস্ট পার্টি এবং তার সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষজনের দ্বারা সাধারণ মানুষ অধিকার সচেতন হয়ে উঠতে না পারে।

সাধারণ মানুষ আবেদন-নিবেদন রাজনীতির ভিতর দিয়ে, একটা বাঁধাধরা পরিকাঠামোর আওতায় এসে,রাজনৈতিক আন্দোলন করুক এতে বিষয় কোনো আপত্তি ছিল না ব্রিটিশের।এমনকি মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন এবং সেই আন্দোলনকে হিন্দু মুসলমানের বিভাজন তৈরি করবার বিরুদ্ধে একটা সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করা, জাতপাতের নামে মানুষের ভেতরে বিভাজন তৈরি করার প্রবণতাকে রোখবার চেষ্টা– এসব ব্রিটিশের মূল যে স্বার্থ, এই দেশ থেকে একটা ভয়াবহ অর্থনৈতিক শোষণ চালিয়ে ইংল্যান্ডের অর্থনীতিকে সচল রাখা, সেই স্বার্থ সেভাবে বিঘ্নিত না হওয়ায়, মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে গণজাগরণ ঘিরেও কিন্তু ব্রিটিশের তেমন কোনো ঘোরতর আপত্তি ছিল না।

কিন্তু ব্রিটিশের কাছে চক্ষুশূল ছিল সাধারণ গরিব খেটে-খাওয়া মানুষকে তাঁদের ন্যায্য অধিকার, ন্যায্য পাওনা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করবার লক্ষ্যে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ধীরে ধীরে জেগে ওঠা আমজনতার ভিতরে যে চেতনা, সেই চেতনাকে বিনষ্ট করতে ব্রিটিশ নানাভাবে প্রায় জন্মলগ্ন থেকে কমিউনিস্ট পার্টিকে এবং কমিউনিস্টদের প্রতিহত করবার চেষ্টা করেছে।

এই কাজে ব্রিটিশরা বারবার তার শ্রেণির মিত্র হিসেবে কংগ্রেস ও আরএসএসকে যে পাশে পেয়েছিল সে কথা বলবার কোন আলাদা করে উপলক্ষ লাগে না। মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শুরু করে হাজারো ধরনের ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম যুগের নেতাদের উপর নানা ধরনের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালিয়ে ব্রিটিশ চেষ্টার ত্রুটি করেনি কমিউনিস্ট পার্টিকে জন্মলগ্নের বিনষ্ট করে দিতে। কমিউনিস্টদের ভিতরে মনোবলকে ভেঙে দিতে।

বহু চেষ্টা করেও ব্রিটিশ কোনো অবস্থাতেই সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে একটা কৌশলের ভিতর দিয়ে যেভাবে কংগ্রেসের অধিবেশনে ভিতরে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে, তা কোন অবস্থাতেই ব্রিটিশ যেমন মানতে পারেনি, তেমনি কংগ্রেসের ভিতরকার দক্ষিণপন্থী নেতারাও মানতে পারেননি। আরএসএস তো মানতেই পারেনি।

কৌশলগত কারণে অবশ্য কমিউনিস্ট পার্টি তখন সরাসরি কংগ্রেস অধিবেশনের ভিতরে পূর্ণ স্বরাজের প্রশ্নে প্রস্তাব প্রত্যক্ষ ভাবে আনতে না অবশ্য পারে নি। কংগ্রেস দলের ভিতরে কমিউনিস্ট পার্টির যে সমস্ত নেতারা, কর্মীরা সাধারণ সমর্থকরা কৌশলগত কারণে মিলেমিশে কাজ করছিলেন, তারা সেই প্রস্তাব এনে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে এক ধরনের আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে দিতে পেরেছিলেন।

এই আতঙ্কের পরিবেশের কারণেই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে সশস্ত্র বিপ্লববাদী চিন্তা-চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ, যাঁদের একটা বড় অংশ পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট পার্টি বা কমিউনিস্ট ভাবধারার ছত্রছায়া নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করেছেন, তাঁদের এবং যাঁরা সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, সেইসব মানুষদের, তাঁদের চিন্তা-চেতনাকে, তাঁদের কর্মপদ্ধতিকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি ব্রিটিশেরা।

ভারতের জাতীয় আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে, তাকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী একটি দৃঢ় অবস্থানে উপস্থাপিত করবার ক্ষেত্রে, সেই আন্দোলনের সার্বিক চরিত্রে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী, ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাচেতনা প্রসারের ক্ষেত্রে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে যে ঐতিহাসিক ভাবধারার প্রসার ও প্রয়োগ ঘটেছিল, সেই চেতনাকে এগিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় আন্দোলনের কালে কমিউনিস্ট পার্টি গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। আজকের পাকিস্তান অবিভক্ত ভারতেরকালে পাখতুনদের নেতৃত্বে যে ব্রিটিশ বিরোধী মানসিকতাকে সাধারণ মানুষের ভেতরে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন খান আবদুল গফফর খান, সেই চিন্তা-চেতনার বিকাশের ক্ষেত্রেও একটা ক্ষেত্র প্রস্তুতের পর্যায়ে কমিউনিস্ট পার্টি বিশেষ ধরনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে।

তেলেঙ্গানা অঞ্চল এবং বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে স্বাধীনতার আগে এবং স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা ঐতিহাসিক। তেলেঙ্গানায় যে জমির লড়াই বা বাংলায় যে তেভাগার লড়াই, যে লড়াইয়ের ভিতর দিয়ে সামন্ততন্ত্রের হাত থেকে, জমিদার তন্ত্রের হাত থেকে বাংলা ভূমি ব্যবস্থা একটা উন্নত চিন্তা চেতনার দিকে পরিচালিত হওয়ার উপক্রম শুরু করে, সেই চিন্তা-চেতনার বিকাশের ক্ষেত্রে, ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের মূল শ্লোগান ছিল 'লাঙল যার জমি তার'- এসবই পরিচালিত হয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে।

মুসলিম জাতিসত্তার নাম করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নানা কৌশল এবং হিন্দু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শিবিরের নানা কৌশলের কারণে অবিভক্ত ভারতে মুসলমান জনসমাজের ভিতরে যে মানসিক সংকট এবং একটা বিভাজনের প্রবণতা তীব্র হয়েছিল, সেই প্রবণতাকে শ্রমিক-কৃষক মেহনতী মানুষের লড়াইয়ের ভিতর দিয়ে, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, জাতীয় আন্দোলনের অন্তিম পর্যায়ে কমিউনিস্ট পার্টি এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল।

জাতীয় আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে গত শতাব্দির চারের দশকের সূচনালগ্নে 'ভারত ছাড়ো আন্দোলন', 'তেভাগা আন্দোলন', 'নৌ বিদ্রোহ' এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রায় অন্তিম পর্যায়ে এসে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারের নামে প্রহসনের বিরুদ্ধে যে জনবিক্ষোভ, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত্তিকে সম্পূর্ণ টলিয়ে দিয়েছিল, এসবই সম্ভবপর হয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এক আপসহীন লড়াই য়ের লক্ষ্যে গণসংগ্রামের প্রস্তুতি এবং কর্মকান্ডের ফলে।

এই লড়াইয়ের পরিবেশটি স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরে নেতৃত্বে নানা সংকটের দরুন বেশ কঠিন হয়ে উঠেছিল দেশভাগের অব্যবহিত পরেই। দেশভাগের সময় কালে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবিতে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে গঙ্গাধর অধিকারী যে দলিলটি উপস্থাপিত করেছিলেন, সেই দলিলটিকে কখনোই বিতর্কের উর্ধ্বে স্থান দেওয়া যায় না।

মুজাফফর আহমেদ, আবদুল হালিম, প্রমোদ দাশগুপ্ত, জ্যোতি বসু, ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ প্রমুখ নেতৃত্বরা যখন খুব জোর গলায় দেশভাগের চরম বিরোধিতা করেছেন, হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতির কথা বলেছেন, হিন্দু মুসলমানের সম্প্রীতি অটুট রাখার ভিতর দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে এদেশ থেকে বিতাড়িত করে, এদেশে সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন, তখন যেভাবে গঙ্গাধর অধিকারী তাঁর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের তত্ত্ব উপস্থাপিত করেছেন, তার দায় যেমন তখন কমিউনিস্ট পার্টিকে বহন করতে হয়েছে, তার দায় থেকে কমিউনিস্ট পার্টি আজ পর্যন্ত নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি।

পরবর্তী সময় অজয় ঘোষের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি পন্ডিত জহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকারের শ্রেণি চরিত্র বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে যে ধরনের অবস্থান নিয়েছে, তা জাতীয় আন্দোলনের সময় কালের কমিউনিস্ট পার্টি লড়াই, ত্যাগ, তিতিক্ষা, সংগ্রাম- সবকিছুকেই একটা বড় ধরনের প্রশ্নচিহ্নের সামনে এসে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

বস্তুত স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকে ছয় দশকের প্রথম শতক প্রথম দিক পর্যন্ত অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, কমিউনিস্ট পার্টি এবং কমিউনিস্ট পার্টি নেতৃত্বাধীন আন্দোলনকে শ্রেণি সংগ্রামের পথ থেকে টেনে এনেছেন শ্রেণি সহযোগিতায় পথে। এই কাজে বার্ণস্টাইনের মানসপুত্রের ভূমিকা পালন করেছিল অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। এই চেষ্টার ভিতর দিয়ে তাঁরা কমিউনিস্ট পার্টি এবং ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন সব আন্দোলনকেই নিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন দক্ষিণপন্থী ঝোঁকের দিকে।

এই চেষ্টার ভিতর দিয়ে তাঁরা একদিকে যেমন দক্ষিণপন্থী হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সংহত হবার সুযোগ করে দিয়েছেন, আরএসএস ও তাদের তৎকালীন রাজনৈতিক সংগঠন ভারতীয় জনসংঘকে পায়ের তলায় জমি এনে দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন, তেমনিই তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বের প্রভাবে, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে কার্যত ভারতীয় বুর্জোয়া, সামন্ততন্ত্রের অন্যতম প্রধান প্রতিভূ কংগ্রেসের লেজুড়ে পরিণত করার সবরকম চেষ্টা করে গেছেন।

এমনকি ভারত-চীন সীমান্ত সমস্যার সময় হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি জাতীয়তাবাদের নামে, দেশপ্রেমের নামে উগ্রতার আমদানি ঘটিয়ে যে সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল কর্মকান্ড করেছে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাদের কাজকর্ম সেইসব কর্মকান্ডকেই শক্তি দিয়েছে। এভাবেই যেসব রাজনৈতিক শক্তি দেশপ্রেমের নামে উগ্রতাকেই তাদের রাজনৈতিক প্রচার-প্রসারের ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে তুলে ধরে, তাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে গেছে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির শ্রেণি সহযোগিতায় বিশ্বাসী নেতৃত্ব।

তার পাশাপাশি অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরে শ্রেণিসংগ্রামের মধ্যে দিয়ে, প্রলেতারিয়েতের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে টিকে তীব্র করার জন্য আন্দোলন, মতাদর্শগত লড়াইয়ের মাধ্যমে ক্রমশ শক্তিশালী হয়েছে। সেই শক্তি পরবর্তীকালে ১৯৬৪ সালে ভারতের যথার্থ একটি কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি করেছে। অতীতের অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির যে অংশটি কমিউনিস্ট নাম ধরে থেকে গেছে, তারা কার্যত শ্রেণির সহযোগিতার ভিত্তিতে, ভারতের প্রধান শাসক কংগ্রেসের লেজুড়ে পরিণত হয়েছে।

এই সময়কালে চরম প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি আরএসএস, তাদের রাজনৈতিক সংগঠন ভারতীয় জনসংঘকে দিয়ে, যা বর্তমান বিজেপির পূর্ববর্তী সংস্করণ, ভারতবর্ষের অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতিকে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে আবারো বিভাজিত করবার নানা ধরনের কৌশল ও প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছে। এই কাজে সেই সময়ে তথাকথিত সমাজতন্ত্রীরা( রামমনোহর লোহিয়া প্রমুখ) নানাভাবে শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্বে বিশ্বাসী কমিউনিস্টদের ঠেকাতে, হিন্দু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।

জাতীয় স্তরের এই পর্যায়ে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ, কেরাল, ত্রিপুরা মত রাজ্যগুলিতে শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্বে বিশ্বাসী কমিউনিস্টরা প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি করে, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে জীবন সংগ্রাম করে গিয়েছে। দেশভাগজনিত কারণে সেই সময়ে পশ্চিমবঙ্গ নানা ধরনের সমস্যায় দীর্ণ। ভয়াবহ খাদ্য সংকট। উদ্বাস্তু স্রোত। চরম বেকারি।

এইরকম একটি সময়ে যেমন কেন্দ্রে, তেমন রাজ্যে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সরকার ভারতবর্ষ থেকে চলে যেতে বাধ্য হওয়া ব্রিটিশ শক্তির কিছু উচ্ছিষ্টভোগী তখনো এদেশে করে কম্মে  খাওয়ার যে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের সেই করে কম্মে খাওয়াকে শক্তিশালী করার জন্য সবরকমভাবে নিজেদের নিবেদিত করে রেখেছিলেন। সেই অবস্থায় শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্বে বিশ্বাসী প্রকৃত কমিউনিস্টরা গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে মানুষের রুটি-রুজির লড়াইকে একটা বড় জায়গায় উপনীত করেছেন। ভূমি সংস্কারের দাবি ভিতর দিয়ে সাধারণ মানুষকে অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করেছেন।

আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জন্মভূমি কলকাতা শহর হওয়ার দরুন, দেশভাগের আগে থেকেই এ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির যে ভয়ঙ্কর দাপট ছিল, সেই সময় সেই দাপটকে শ্রেণি গত লড়াইয়ের ভিতর দিয়ে, মেহনতী মানুষের আপসহীন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে, শ্রেণি-সংগ্রামের তত্ত্বে বিশ্বাসী কমিউনিস্টরা একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রায় উপনীত করে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তিকে প্রতিহত করেছেন।

একদিকে তাঁরা প্রতিহত করেছেন হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে, অপরদিকে একই রকম ধৈর্য, আন্তরিকতা, ও সহমর্মিতার সঙ্গে প্রতিহত করেছেন মুসলিম সাম্প্রদায়িক শক্তিকে। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে একটি বড় অংশ কংগ্রেস রাজনীতির বুর্জুয়া মানসিকতার ভিতর দিয়ে যে ধরনের অভিজাত, উচ্চবর্ণের, উচ্চবিত্তের ধ্যান-ধারণাকেই রাজনীতির প্রধান উপজীব্য হিসেবে তুলে ধরেছিলেন, সেই চিন্তা-চেতনাকে অস্বীকার করে, শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি জনতার ভিতর থেকেই তাদের নেতৃত্বকে তুলে নিয়েছে শ্রেণি সংগ্রামের তত্ত্বে বিশ্বাসী কমিউনিস্টরা।

এভাবেই সাধারণ মানুষের কাছে অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইকে একটা ভিন্ন মাত্রা দান করেছেন কমিউনিস্টরা উদ্বাস্তুর অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই, জমি রক্ষার লড়াই, খাদ্যের দাবিতে লড়াই, বাসস্থানের দাবিতে লড়াই, শিক্ষার দাবিতে লড়াই, স্বাস্থ্যের দাবিতে লড়াই, নারীর অধিকারের পক্ষে লড়াই, সংখ্যালঘুর অধিকারের পক্ষে লড়াই, আদিবাসী-দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের অধিকার রক্ষার লড়াই– এমনতর হাজারো লড়াইয়ের ভিতর দিয়ে ভারতবর্ষের রাজনীতিতে কমিউনিস্টরা বিগত একশ বছর ধরে নিজেদেরকে রাজনীতির পরিমণ্ডলে একটি বিশেষ রকমের ব্যতিক্রমী চরিত্র ব্যতিক্রমী চেতনা, ব্যতিক্রমী ধ্যান-ধারণা সম্পন্ন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উপস্থাপিত করতে পেরেছে।

কেবল যে রাজনৈতিক আন্দোলনের ভিতরেই সীমাবদ্ধ কমিউনিস্টরা থেকেছে তা নয়। সুস্থ সাংস্কৃতিক আন্দোলন, মেহনতি জনতার চিন্তা-চেতনার সংস্কৃতির চর্চার ভিতর দিয়ে মানুষের চেতনা স্তরকে উন্নত করে, নানা ধরনের প্রতিক্রিয়াশীলতা, ভাষাভিত্তিক প্রতিক্রিয়াশীলতা, ধর্মভিত্তিক প্রতিক্রিয়াশীলতার কিংবা জাতপাতভিত্তিক প্রতিক্রিয়াশীলতা– যাই হোক না কেন, সেসবের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে, সাধারণ মানুষকে লড়াইয়ের ময়দানে নামিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছে গত একশ বছর ধরে ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে একমাত্র কমিউনিস্টরাই।

কমিউনিস্টদের বিগত একশ বছরের ধারাবাহিক লড়াইয়ের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এঁরা কখনো কোনো রকম অন্ধ আবেগের পেছনে নিজেদের চিন্তা-চেতনাকে এক মুহূর্তের জন্য পরিচালিত করেননি। কমিউনিস্টরা কোনোদিন, কখনো কোনরকম সাম্প্রদায়িকতা, অস্পৃশ্যতা, জাতিভেদ, মৌলবাদ– এই ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল চেতনা, যা সাধারণ মানুষের রুটি রুজির লড়াই য়ের বিরুদ্ধে তৈরি করার মানসিকতা সঙ্গে সম্পৃক্ত, তার সঙ্গে এক মুহূর্তের জন্যও আপোষ করেননি।

পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্টরা নানা ধরনের ভাবনা-চিন্তার বৈপরীত্য সহ দলগুলোর সঙ্গেও কোয়ালিশন করে ভারতবর্ষের প্রচলিত সংসদীয় ব্যবস্থার ভিতরে প্রায় দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে একটানা রাজ্য সরকার পরিচালনা করেছে। এতটা দীর্ঘ সময় ধরে এই সাংবিধানিক কাঠামোর ভিতরে একটি রাজ্য সরকার পরিচালনা করার ক্ষেত্রে মূল নেতৃত্ব যখন কমিউনিস্টরা দিয়েছে, নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার সামনে তাঁরা পড়েছে। প্রতিক্রিয়াশীলতার সামনে তাঁরা পড়েছে। কিন্তু তাঁরা কখনোই সেই প্রতিক্রিয়াশীলতা, সেই সব প্রতিবন্ধকতা সঙ্গে এতোটুকু আপোষ করেনি।

ভারতবর্ষের প্রচলিত বুর্জোয়া পরিকাঠামোর ভিতরে, বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ভিতরে, বুর্জোয়া সংবিধানের মধ্যে দাঁড়িয়ে, শ্রেণি-সংগ্রামের তত্ত্বে বিশ্বাসী কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে খানিকটা পরস্পর-বিরোধী চিন্তা চেতনা সম্পন্ন, এমনকি ফরওয়ার্ড ব্লকের মতো চরম কমিউনিস্ট বিদ্বেষী মানসিকতায় বিশ্বাসী চরম প্রতিক্রিয়াশীল, সুভাষচন্দ্র বসুকে একমাত্র রাজনৈতিক পুঁজি করে চলে, যেমন হিন্দুত্বকে ভিত্তি করে আরএসএস বিজেপি চলে, তাঁদের সঙ্গে একযোগে সরকার পরিচালনা করেছে।

কমিউনিস্টরা এই সরকার পরিচালনা করার ক্ষেত্রে হয়তো নানাভাবে গনআন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমনকি কমিউনিস্ট পার্টি লড়াই, সংঘর্ষের মূল ধারা গুলি বিঘ্নিত হয়েছে, তবু সাধারণ মানুষকে খানিকটা শাস্তি দেওয়ার লক্ষ্যে, সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, নারী সমাজের স্বাধিকারের দিগন্ত উন্মোচিত করবার লক্ষ্যে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ক্ষমতা হস্তান্তরের শর্তাবলীর সঠিক প্রয়োগের ভেতর দিয়ে তাঁদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কমিউনিস্টরা নানা সীমাবদ্ধতার ভিতর দিয়ে নিরলসভাবে পশ্চিমবঙ্গে একটানা ৩৪ বছর, কেরালা তে নানা পর্যায়ে বিভিন্ন সময় এবং ত্রিপুরার মতো একটি সমস্যাবহুল রাজ্যে নানা ধরনের সমস্যাকে অতিক্রম করে, সাধারণ মানুষের, মেহনতী মানুষের, খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে সাহায্য করেছে পৃথিবীর ইতিহাসে তার তুলনা মেলা ভার।

শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্বে বিশ্বাসী কমিউনিস্টরা ভারতবর্ষের আধা সামন্ততান্ত্রিক পরিকাঠামোর ভিতরে একটা দীর্ঘ সময় রাজ্য সরকার পরিচালনা করেছে। এই সরকার পরিচালনার সময় কালের নানা ধরনের বুর্জোয়া ভাইসিস, প্রতিক্রিয়াশীল ভাইসিস তাঁদের ভিতরে কামড় বসানোর সব রকমের চেষ্টা করেছে। সেই সব কামড় যে তারা একেবারে বসাতে পারেনি– এ কথা যদি বলা হয়, তাহলে সত্যের অপলাপ করা হবে। কিন্তু কেরলের ক্ষেত্রে স্বল্পকালীন সময়ে ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদের মুখ্যমন্ত্রীদের ইতিহাস, পরবর্তীকালে ইকে নানার প্রমুখের নেতৃত্বে ইতিহাস, ত্রিপুরায় নৃপেন চক্রবর্তী, দশরথ দেব, মানিক সরকারের নেতৃত্বে ইতিহাস, আর পশ্চিমবঙ্গে কিংবদন্তি জ্যোতি বসু, তারপরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গৌরবোজ্জল ইতিহাস, আমাদের এটাই দেখিয়ে দিয়েছে যে, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে নানা সীমাবদ্ধতার অলিগলিতে হেঁটে বেরিয়ে ও আধা সামন্ততন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে, বুর্জোয়া পরিকাঠামোর নানা ধরনের অপকৌশলকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে, রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তির যাবতীয় প্রচেষ্টাকে বিনষ্ট করে দিয়ে, কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে শ্রেণি-সংগ্রামের তত্ত্বে পরিপূর্ণ বিশ্বাসকে অক্ষুন্ন রেখে, কিভাবে কঠিন অবস্থাকে অতিক্রম করতে হয়।

সাধারণ মানুষ খেটে খাওয়া মানুষ, মেহনতী জনতার অধিকারকে যে অধিকার গত একশ বছর ধরে কমিউনিস্ট পার্টি তাঁর প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে ধীরে ধীরে অর্জন করেছে, সেই অধিকারকে সুরক্ষিত রাখা যায়– তার নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্বে বিশ্বাসী কমিউনিস্টরাই একমাত্র গোটা বিশ্বের মানুষের কাছে এক অনন্য নজির সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে।

আজ ভারতবর্ষ রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে বিঘ্ন। একদা ভারতবর্ষে বুর্জোয়া সামাজিক পরিকাঠামো তে জমিদার, জোতদার, সামন্ততান্ত্রিক প্রভুদের প্রধান ভূমিকা ছিল। সেই অংশের প্রতিনিধিত্ব করত কংগ্রেস। তাঁরা নির্বাচনী সংগ্রামের নানা কলাকৌশলী অভিপ্রায়ে এখন প্রায় একদমই কোণঠাসা। সংসদীয় গণতন্ত্রের হিসেব নিকেশের নিরিখে ভারতবর্ষের সংসদের কমিউনিস্টরা আদৌ ভাল অবস্থায় নেই। এইরকম একটা পরিস্থিতিতে কিন্তু কমিউনিস্টরা তাঁদের শ্রেণি সংগ্রামের মূল চেতনা থেকে এতোটুকুই সরে আসেনি।

নির্বাচনে জেতা, রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা, পুলিশ প্রশাসনকে করায়ত্ত করে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করা– এটা যে কমিউনিস্ট পার্টি, কমিউনিস্ট বা তাঁদের নেতা, কর্মীদের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হতে পারে না, সেটা ভারতের শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্বে বিশ্বাসী কমিউনিস্টরা খুব ভালোভাবেই দেখিয়ে দিয়েছেন।

ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে নষ্ট করতে, জাতীয় তথা আন্তর্জাতিক স্তরে কমিউনিস্ট চিন্তাধারার উপরে, প্রগতিশীল চিন্তাধারার উপরে, মানবমুক্তির চিন্তাধারার উপরে একটা প্রভাব বিস্তার করবার চেষ্টা-চরিত্র স্বাধীনতার আগের যুগ থেকে স্বাধীনতার পরবর্তীকালে কম হয়নি। এই প্রচেষ্টা আজকের সময় পর্যন্ত কম শক্তিশালী নয়। শ্রেণি সহযোগিতার তত্ত্বে বিশ্বাসী, বুর্জোয়া সামন্ততন্ত্রের দালালেরা নিজেদের কমিউনিস্ট পরিচয় দিয়ে গত একশ বছরে ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে শেষ করবার জন্য, শ্রেণি সহযোগিতার তত্ত্বকে কম প্রয়োগের চেষ্টা করেননি।

ভুলে গেলে চলবে না এই শ্রেণির সহযোগিতার তত্ত্বে বিশ্বাসী কমিউনিস্ট নামধারী প্রতিক্রিয়াশীলেরা ছিল কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার সবথেকে বড় সমর্থক ছিলেন। এই প্রতিক্রিয়াশীল কমিউনিস্ট নামধারী লোকজন কিন্তু একদা আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন জনসঙ্ঘের সঙ্গে সহযোগিতা করে দেশের কোনো কোনো অংশে সরকার পরিচালনায় অংশগ্রহণ পর্যন্ত করেছিল।

পাশাপাশি উল্লেখ করতে হয় কমিউনিস্ট আন্দোলনকে ভিতর থেকে ধ্বংস করার জন্য সাম্রাজ্যবাদের অতি বিশ্বস্ত দালাল হিসেবে সংকীর্ণতাবাদী রাজনীতিকদের ভূমিকা ও অবদানের কথা। ছয়ের দশকের শেষ দিক থেকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ মদদপুষ্ট একাংশের লোক শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্বে বিশ্বাসী কমিউনিস্টদের ভিতরেই সংকীর্ণতা বাদী চিন্তাধারার প্রসার ঘটিয়ে ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে সম্পুর্ণ বিপথে পরিচালিত করবার কম চেষ্টা করে নি। তাদের এইসব প্রচেষ্টার প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য ছিল কৃষক, শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার নাম করে সাধারণ মানুষের উপরে ভয়াবহ অত্যাচার।

সেই অত্যাচারের প্রধান লক্ষ্য ছিল শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্বে বিশ্বাসী কমিউনিস্টরা। এই উদ্দেশ্য নিয়ে সংকীর্ণতা বাদীরা যেমন কমিউনিস্টদের খতম করেছে, তেমনি ভারতবর্ষের প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার প্রতিভূ রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বহু মানুষের সম্বন্ধে কুৎসা, মনীষীদেল চিন্তা-চেতনা সম্বন্ধে অপপ্রচার চালিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে তুলেছে। সাধারণ মানুষকে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলেছে। ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত শতবর্ষ উদযাপনের প্রেক্ষিতে কমিউনিজমের নাম করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এই অতি বিশ্বস্ত দালাল, সংকীর্ণতাবাদী রাজনীতিকদের আত্মঘাতী নানাধরনের কাজকর্মের দিকে আমাদের একটু দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

শ্রেণি সহযোগিতার তত্ত্বে বিশ্বাসী কমিউনিস্ট নামধারী দেশীয় বুর্জোয়া শক্তির দালাল এবং সংকীর্ণতা বাদী রাজনীতিকরাও কমিউনিজমের নাম করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অতি বিশ্বস্ত সৈনিক হিসেবে কাজ করে গিয়েছে, এবং আজ পর্যন্ত যাচ্ছে। তাদের কাছ থেকে এই ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল মানসিকতা ভয়াবহ প্রতিবন্ধকতা না পেলে ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলন আজ আরও বেগবান, আরও ফলপ্রসূ হতো। সেই গতিবেগ ও তার প্রভাব খণ্ডিত ভারতবর্ষের বিভিন্ন অংশ, পাকিস্তান ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের খুব ভালভাবে পড়তো।

যে শ্রেণি সহযোগিতার তত্ত্বে বিশ্বাসী কমিউনিস্টরা, কমিউনিস্ট নামধারী প্রতিক্রিয়াশীলরা, ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে পিছন থেকে ছুরি মেরেছে, সেই শক্তিই বাংলাদেশে শ্রেণির সহযোগিতার তত্ত্বকে প্রসারিত করার লক্ষ্যে কমিউনিস্ট পার্টির ভেক ধরে, সে দেশের সমস্ত ধরনের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ক্ষেত্রগুলিকে স্বহস্তে উৎপাটিত করেছে।

যে হাজং বিদ্রোহ অবিভক্ত বাংলায় খেতমজুর, ভূমিহীন, আদিবাসী, তপশিলি জাতি-উপজাতিভুক্ত বাঙালীদের কাছে জমির লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, সর্বহারার একনায়কতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রেরণা জুগিয়েছিল, শক্তি দিয়েছিল, সেই হাজং বিদ্রোহের সঙ্গে যুক্ত মানুষজন, যাঁরা কমিউনিস্ট হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এঁকেছিলেন, তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশে রেখেছিলেন, তাঁরাই কিন্তু পরবর্তীকালে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আনার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপর সব থেকে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।

বাংলাদেশের '৭২-এর সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী বাংলাদেশ তথা গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের গণতন্ত্রের লড়াই, সম্প্রীতির লড়াই, বহুত্ববাদী সংস্কৃতি রক্ষার লড়াই, সমন্বয়ী চেতনার লড়াই, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই, সর্বোপরি শিক্ষার লড়াই, স্বাস্থ্যের লড়াই, সংখ্যালঘুর লড়াইসহ সার্বিক ক্ষেত্রকে কি ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড় করিয়ে গোটা বাংলাদেশকে পাকিস্তানের একটি ছায়া উপনিবেশে আবার পরিণত করেছিল, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।

কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার শতবর্ষের প্রাক্কালে আজ আমাদের এই শপথ নিতে হবে যে, ভারতবর্ষসহ পাকিস্তান, বাংলাদেশ সর্বত্রই ধর্ম, জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদের নাম করে যেভাবে মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরি করে, সাধারণ মানুষের রুটি-রুজির লড়াই, খেয়ে-পরে বেঁচে থাকবার লড়াই, শিক্ষার লড়াই, স্বাস্থ্যের লড়াই, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই, সংখ্যালঘুর লড়াই, আদিবাসীর লড়াই, দলিতের লড়াই বিঘ্নিত হচ্ছে– সেই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে, শ্রেণি-সংগ্রামের চিন্তা-চেতনাকে প্রসারিত করে, অর্থনীতির প্রাঙ্গণকে শ্রেণিসংগ্রামের ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করে, একটি শোষণমুক্ত সমাজের দিকে এগিয়ে যাওয়া, একটি লাল টুকটুকে, শোষনহীন? নির্যাতনহীন, নিষ্পেষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত করবার লড়াইকে একটা সুসংবদ্ধ রূপ দিক।

এটাই হবে আজ থেকে ঠিক শতবর্ষ আগে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট এবং শতবর্ষব্যাপী কমিউনিস্ট পার্টি ও তাঁদের হাজার হাজার কর্মী, সমর্থক, নেতা– সকলের জীবনপণ ও সংগ্রামের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা প্রদর্শন।