স্থপতি মাজহারুল ইসলাম একজন শুদ্ধাচারী মানুষের নাম

মোনায়েম সরকারমোনায়েম সরকার
Published : 13 April 2014, 02:37 PM
Updated : 1 August 2012, 01:16 PM

খ্যাতনামা স্থপতি, বিত্তের চেয়ে চিত্ত যার ছিল অনেক বড়, সেই মাজহারুল ইসলাম আমাদের অনেকের শ্রদ্ধেয়-প্রিয় মজু ভাই চির বিদায় নিলেন গত ১৪ জুলাই। পরিণত বয়সেই বিদায় নিলেন মজু ভাই। তারপরও তিনি নেই– ভাবতেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে, চোখের পাতা ভারী হয়ে যায়। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রখ্যাত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক কামাল লোহানী লিখেছেন, 'মাজহারুল ইসলাম শুধু দেশের জন্য করেই গেছেন। নিজে কখনও কোন সুবিধা ভোগ করেননি। তিনি ছিলেন তিন দশকের সাহসী নেতা। তিনি শুধু স্থাপত্য শিল্পের গুরুই ছিলেন না, সমাজ সচেতনতামূলক নানা কাজে সব সময় নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন। আজীবন তিনি যেমন আমাদের পথ দেখিয়েছেন, তেমনি তার মৃত্যুর পরও তার কাজ আমাদের পথ দেখাবে।' সৈয়দ শামসুল হক বলেছেন, 'বাংলাদেশের স্থাপত্য শিল্পে তিনি মহৎ প্রবর্তক। বৃটিশ ও পাকিস্তান শাসনে নিষ্পেষিত বাংলার মানসজগতকে তিনি মুক্ত করতে চেয়েছিলেন তার স্থাপত্য কর্মের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের চিত্রকলায় যেমন জয়নুল, সঙ্গীতে আব্বাসউদ্দীন, নৃত্যে বুলবুল চৌধুরী, তেমন স্থাপত্যে আধুনিকতার মহান প্রবর্তক মাজহারুল ইসলাম।' এছাড়া অনেকেই আরো তাকে স্থাপত্য কলার গুরু হিসেবে অবহিত করেছেন। শিল্পবোদ্ধারা স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে শিল্পের নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করবেন। আমি সেদিকে যাবো না। আমি একজন মানবদরদী প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আমার দেখা মাজহারুল ইসলাম সম্পর্কে কিছু বলার চেষ্টা করবো।

মজু ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম পরিচয় কিভাবে হয়েছিল তা আজ আর মনে নেই। পাকিস্তান আমলে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের সময়েই মাজহারুল ইসলাম এবং তার স্ত্রী বেবী আপার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়। পরিচযের পর থেকেই তিনি আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো দেখতেন। তখনকার কমিউনিস্ট ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতারা যেমন মণি সিংহ, খোকা রায়, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, অনিল মুখার্জি, বারীন দত্ত, জ্ঞান চক্রবর্তীসহ আরও অনেকে বছরের পর বছর আত্মপোগনে থেকে পার্টির কাজকর্ম পরিচালনা করতেন। তাদের গোপনে সাহায্য করার লোক তখন ঢাকা শহরে ছিল হাতে গোনা। মাজহারুল ইসলাম ছিলেন সেই স্বল্প সংখ্যকদের অন্যতম। তিনি ছিলেন মনে-প্রাণে অসাম্প্রদায়িক-প্রগতিশীল এবং খাঁটি দেশপ্রেমিক। পাকিস্তান আমলে তার পেশাগত আয় ছিল ঈর্ষণীয়। আয়ের একটা বড় অংশ তিনি কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন, খেলঘর, উদীচী, ছায়ানটসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠনের নেতাকর্মীদের পেছনে ব্যয় করতেন অকাতরে এবং তার ধানমন্ডি ও পরিবাগের বাসা কাম অফিস ছিল প্রগতিশীলদের আশ্রয়স্থল।

'৬০-এর দশকে পাকিস্তানের এ অঞ্চলের রাজনৈতিক পরিবেশে গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীদের সম্পর্কে সমাজে উচ্চ ধারণা ছিল। ১৯৬৭ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত পদার্থ বিদ্যায় এমএসসি পাস করে ন্যাপের সার্বক্ষণিক কর্মীর খাতায় নাম লেখানোর পর আমার অজান্তেই মজু ভাইয়ের স্ত্রী বেবী আপা আমার অলিখিত অভিভাবকে পরিণত হয়েছেন। ব্র্যাকের আড়ং চালু হওয়ার পর প্রথম সিল্কের কাজ করা পাঞ্জাবি তিনশ' টাকায় বেবি আপা আমাকে উপহার দেন। যার দাম আজ তিন/চার হাজার টাকা হবে। আজ এত বছর পরও তার সেই আসনটি পাকাপোক্তভাবেই আছে। আমি কালক্রমে এই পরিবারের একজন সদস্য হয়ে উঠেছে। পাকিস্তান আমলে আমি মজু ভাইয়ের ছোট ছেলে তান্নাকে অঙ্ক করাতাম, তান্নার বিশিষ্ট বন্ধু শেখ কামালও মাঝেমধ্যে যোগ দিত। ব্যবসা-বাণিজ্য তথা অফিসের কাজকর্মে দায়িত্ব অন্যদের উপর দিয়ে প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পরতে লাগলেন মজু ভাই। তার বাসায় এলেই খাওয়া এবং কিছু দক্ষিণা পাওয়া প্রায় নিশ্চিত ছিল। ছাত্র ইউনিয়ন এবং সংগ্রাম পরিষদের টাকাপয়সার দরকার হলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোন কর্মীকে পাঠিয়ে পরিবাগের বাসা থেকে তা সংগ্রহ করাটাই হয়েছিল রেওয়াজ। পাকিস্তান আমলেই মজু ভাইয়ের একটি মার্সিডিজ ব্যাঞ্জ এবং একটি বক্স ওয়াগান জীপ ছিল। একটি ড্রাইভার চালাত আর একটি মজু ভাই নিজে চালাতেন। আমি প্রায়ই মজু ভাইয়ের সঙ্গে গাড়িতে যাতায়াত করতাম। এমনকি কাঁচা বাজার পর্যন্ত আমার গন্তব্য ছিল। মজু ভাই খুব বেশি খেতেন না কিন্তু বাজার করতেন প্রচুর। তবে খাওয়ার পরিবেশটা খুব খানদানী ছিল। প্রফেসর বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর মজু ভাইকে 'শুদ্ধাচারী' বলে আখ্যায়িত করেছেন। একেবারে উপযুক্ত বিশেষণ। তার প্রতিটি কাজেই ছিল অত্যন্ত গোছানো, পরিপাটি। খাপছাড়া বা এলোমেলো কিছু তিনি সহ্য করতে পারতেন না। গাড়ি চালাতে গিয়ে ট্রাফিক পুলিশ, রিকশা চালক কিংবা অন্য গাড়ি চালক বা পথচারী কেউ আইন ভঙ্গ করলে তিনি ভয়ানক ক্ষেপে যেতেন এবং ট্রাফিক আইন মেনে চলার পরামর্শ দিতেন। আমাদের বন্ধু নির্মল বিশ্বাস ভানু চা বা কফির কাপে চুমুক দেওয়ার সময় শব্দ করতো। এ জন্য মজু ভাইয়ের নিকট থেকে কত যে গালাগাল খেয়েছে বেচারা ভানু, তার কোনো ইয়ত্তা নাই। কিন্তু দুঃখের বিষয় ভানুর এই বদঅভ্যাস মজু ভাই পরিবর্তন করতে পারেন নাই।

দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা রাজনৈতিক সঙ্কটকালে মজুভাই ও তার পরিবার সক্রিয়ভাবে এগিয়ে এসেছেন। অর্থবিত্তের দিকে থেকে উপরতলার লোক হয়েও গরিব ও মেহনতী মানুষের প্রতি তার ও তার পরিবারের ছিল দারুণ মমত্ববোধ। '৬৯ সালে ডেমরার প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির খবর পেয়ে মজু ভাই বিচলিত হন এবং তৎক্ষণাৎ রিলিফ কমিটি গঠন করে সকলের সাথে নিজেও ত্রাণকার্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ত্রাণকার্যে দিনরাত পরিশ্রম করেছিলেন এবং কর্মীদের থাকা ও খাওয়ার জন্য সর্বশক্তি নিয়োজিত করেছিলেন। আমি ও মজু ভাই তার মার্সিডিজ গাড়ি নিয়ে মেরাদিয়ার কাচা সড়ক দিয়ে প্রতিদিন ত্রাণ কর্মীদের শুকনো খাবার, পানীয় ইত্যাদি সরবরাহ করতাম, ওই এলাকায় কলেরার প্রাদুর্ভাব হওয়ার পর। মজু ভাই আমাকে বিকালে ডেমরা ঘাট থেকে পুনরায় গাড়ি করে নিয়ে আসতেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কলকাতায় ন্যাপের কাজকর্মে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হয়ে পড়েন এবং রাতদিন অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন। ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ দলীয় অনেক কাজে তার ওপর নির্ভর করতেন। যেহেতু তার ছাত্র জীবন কলকাতায় কেটেছে সেহেতু কলকাতায় তার অনেক পুরানো বন্ধুর সাথে যোগাযোগ হয় এবং তাদেরকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমবেত করে ভারতীয় জনগণ ও সরকারের মনোভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে সচেষ্ট হন। তার এই সকল বন্ধু যার যার কর্মক্ষেত্রে সবাই প্রতিষ্ঠিত ছিল। এ ছাড়া মুজিবনগর সরকার, বিশেষ করে তাজউদ্দিন আহমেদ তাকে অত্যন্ত উচ্চ মূল্যায়ন করতেন। সঙ্গত কারণে ন্যাপের পক্ষ থেকে ভারত সরকার ও মুজিবনগর সরকারের সাথে যোগাযোগের কাজটাও তিনি করতেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকায় ফিরে এসে মজু ভাই তার পেশাগত দায়িত্বের কথা ভুলে গিয়ে আমাদের সাথে দেশ গড়ার আন্দোলনে অত্যন্ত উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং ন্যাপের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে দলের কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পান। দলীয় তহবিল সংগ্রহে তার সঙ্গে আমি প্রায়ই ঢাকার দেশের কথা ভাবেন এমন বিত্তবানদের সাথে দেখাসাক্ষাৎ করতাম। যেহেতু তিনি পাকিস্তান সরকারের উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন সেই কারণেই সবাই তাকে সম্মান করতো। বাংলাদেশের স্বনামধন্য ব্যবসায়ী জহুরুল ইসলাম তাকে স্যার বলে সম্বোধন করতেন। শুনেছি তিনি নাকি এক সময়ে মজু ভাইয়ের অধীনে ছোট চাকরি করতেন। আমি বহুবার মজু ভাইয়ের সাথে জহুরুল ইসলামের অফিসে গিয়েছি। মজু ভাইয়ের কথাতেই তিনি তোপখানা রোডের ন্যাপ অফিসে লম্বা টিনশেড হাফ বিল্ডিংটি তার অফিসিয়েল তত্ত্বাবধানেই করে দিয়েছিলেন।

শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে মজু ভাইয়ের অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। বঙ্গবন্ধু মজু ভাইকে উচ্চ মূল্যায়ন করতেন, মজু ভাইও বঙ্গবন্ধুকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। এছাড়াও দুই পরিবারের মধ্যেও একটি অত্যন্ত নিবিড় সম্পর্ক ছিল। মজু ভাইয়ের ছোট ছেলে তান্না ও শেখ কামাল খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। স্বাধীনতার পর শেখ কামাল ও তান্নার প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠেছিল আবাহনী ক্লাব। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার পর মজুভাই আবার অনেকের সাথে কলকাতায় আশ্রয় নেন এবং প্রতিবিপ্লবকে পরাস্ত করার জন্য আবার মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মত উদ্দীপনা নিয়ে রাজনৈতিক কাজকর্মে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সেই সময়ে আমিও কলকাতা যাই এবং মজু ভাইয়ের সঙ্গে একযোগে বিভিন্ন কাজকর্মে ঝাঁপিয়ে পড়ি।

আমি কলকাতায় বুদ্ধিজীবী এবং সরকারি ও বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ নানা পেশার লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য জনমত গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করি। মুজিব হত্যার প্রতিবাদে প্রকাশিত সাপ্তাহিক 'প্রতিরোধ', 'বাংলার ডাক', 'সোনার বাংলা', ইংরেজি 'সানরাইজ' ইত্যাদি পত্রিকা এবং নানা রকম পোস্টার ও লিফলেট ছাপিয়ে সেগুলো সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। লন্ডন আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট শোক সভায় তিনি কলকাতা থেকে আমাদের পক্ষে যোগদান করেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি গাউস খান, রুহুল কুদ্দুস সিএসপি ছাড়াও প্রখ্যাত লেখক ও কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী মজু ভাইয়ের লন্ডন সফর সফল করার জন্য সহযোগিতা করেছেন।

১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করলে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি উক্ত নির্বাচনে অংশ নিয়ে ক্ষমতা জবরদখলকারী স্বৈরাচারী সরকারকে পরাজিত করে মুজিব হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। তখন আমরাও তিন বছরের স্বেচ্ছা নির্বাসন শেষে দেশে ফিরে আসি। ভোট কারচুপির ওই নির্বাচনে প্রগতিশীল শক্তি পরাজিত হয়। তখনকার বিশেষ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মজু ভাই, আমি, মতিয়া চৌধুরীসহ ন্যাপের বেশ কিছু নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগদান করি। তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জননেতা আবদুর রাজ্জাক। আবদুর রাজ্জাককে নিয়ে আমি ও মজু ভাই তার পরীবাগের বাসায় বসে অনেক রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা যেমন করেছি তেমনি ওই বাসায় বসেই নেওয়া হয়েছে নানা ধরনের উদ্যোগ। বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন, ১৪০০ সাল উদযাপন কমিটি গঠন, স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী কমিটি গঠন ইত্যাদি মজু ভাইয়ের বাসাতেই হয়েছে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সের যে জায়গায় মঞ্চ থেকে দাঁড়িয়ে ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে বীরদর্পে ঘোষণা করেছিলেন, 'এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম', সেই জায়গায় আমরা এরশাদের পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে রাতের অন্ধকারে সিমেন্ট ও রড দিয়ে শক্তপোক্ত একটি স্থাপনা নির্মাণ করেছিলাম ১৯৮৫ সালের ৭ মার্চের আগেভাগে। এই স্থাপনাটিও মজু ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে তার পরীবাগের বাসায় রাজমিস্ত্রি দিয়ে বানানো হয়েছিল। তখন মজু ভাইয়ের বাড়ির আঙ্গিনায় বিশ্বব্যাংকের অফিসের নির্মাণ কাজ চলছিল। সেখানেই নিচতলায় বসে আমরা এই স্মারকচিহ্নটি বানিয়েছিলাম। এই স্মারক চিহ্নটি আজও শিশুপার্কের দক্ষিণ দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে, যেখান থেকে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। আর এই স্মারকচিহ্নের পথ ধরেই আজ শিখা চিরন্তন ও স্বাধীনতার স্মারক স্তম্ভ তৈরি হচ্ছে। এছাড়া ১৫ আগস্ট পালনের জন্য প্রথম নাগরিক কমিটি এবং '৮৮-এর বন্যার ত্রাণ কমিটির সকল সভা মজু ভাইয়ের উদ্যোগে তার বাসাতেই অনুষ্ঠিত হতো। আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা যখন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হয়ে দেশে ফিরলেন, তখন তাকেও বঙ্গবন্ধু পরিষদের পক্ষ থেকে প্রথম সংবর্ধনা দেওয়া হয় মজু ভাইয়ের পরীবাগের বাসার বিস্তৃত সবুজ প্রাঙ্গণে।

মজু ভাই ও বেবী আপার সঙ্গে আমার যে কত স্মৃতি তা অল্প কথায় বলে শেষ করার মতো নয়। ২/৪ দিন দেখা না হলে দুইদিক থেকেই একটা দেখা-সাক্ষাতের তাগিদ অনুভূত হতো। মজু ভাই বিগত ২/৩ বছর যাবৎ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় শয্যাশায়ী ছিলেন। শেষদিকে তিনি স্মৃতি ও বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। আমি মাঝে মাঝে গুলশানের বাড়িতে তাকে দেখতে যেতাম। একদিন আমাকে গালে হাত দিয়ে আদর করতে করতে বললেন, কাল আবার আসবেন। শেষের দিকে তিনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের মতই ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন, কিছু বলতে পারতেন না। তবে বেবী আপা, ডালিয়া, নাজিয়া, রফিক, তান্না ও আমাকে চিনতে পারতেন। এ যে কত কষ্টের তা বলার মতো নয়। অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ব্যাংককে উন্নতর চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়। সেখানে ২/৩ মাস চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরেন। তারপর অ্যাপোলো ও ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় আমি নিয়মিত হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়েছি। মৃত্যুর মুহূর্তেও আমি হাসপাতালে উপস্থিত ছিলাম।

টিপটপ এবং গোছানো মানুষ মজু ভাই দেশের গ্রামগুলোকে গুচ্ছগ্রাম করে সারাদেশটিকে গোছাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনীতি তার প্রত্যাশিত পথে না চলায় তিনি ভীষণ কষ্ট পেতেন এবং প্রায়ই ক্ষেপে গিয়ে গালাগাল করতেন। মজু ভাই আজ আমাদের মাঝে নেই কিন্তু আমাদের প্রজন্মের যারা মজু ভাইয়ের সাথে আন্তরিকতার সঙ্গে মিশেছে তারা মজু ভাইকে স্মরণ রাখবে তার ব্যতিক্রমী চিন্তা-চেতনার জন্য। মজু ভাই চিন্তা-চেতনায় ছিলেন আমাদের সময়ের চেয়ে অনেক অগ্রসর। ফলে সব কিছু ক্রমশ খারাপ মানুষ ও দুষ্ট চক্রের দখলে চলে যাওয়ায় তিনি পদে পদে কষ্ট পেতেন। কিছু অভিমানবশতই হয়তো শেষ পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্যে থেকেও তিনি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিলেন। এই সমাজ তাকে বুঝতে পারেনি, আর তিনিও তার উচ্চ নৈতিক মূল্যবোধের কারণেই এই সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে পারেন নি। আমার প্রিয় মজু ভাইয়ের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। জয়তু শুদ্ধাচারী স্থপতি মাজহারুল ইসলাম।
৩১ জুলাই ২০১২

মোনায়েম সরকার : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও রাজনৈতিক কর্মী।