৩৬০-উত্তর অক্ষাংশ, আরাতুসের কবিতা ও রাশিচক্রের উদ্ভব

ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী
Published : 30 July 2012, 05:02 PM
Updated : 30 July 2012, 05:02 PM

রাতের আকাশের সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। রাতের আকাশের অজস্র নক্ষত্র তাদের অপরিসীম রহস্য নিয়ে আমাদের হাতছানি দেয়। আমরা যারা একটু আধটু রাতের তারা দেখি, তারা হয়তো আরেকটু বেশি জানি – যেমন আমরা হয়ত রাতের আকাশের কয়েকটি প্রধান তারামন্ডলীর নাম জানব। আমরা হয়তো তাদের গল্পও বলতে পারব। যেমন শীতের রাতে আকাশে মাথার উপর খুব প্রকটভাবে কালপুরুষ (Orion) মন্ডলীকে দেখা যায়, ঠিক তেমনি সপ্তর্ষিমন্ডল (The Great Bear বা Ursa Major) কিংবা কৃত্তিকামন্ডলী কিংবা অ্যান্ড্রোমিডা নক্ষত্রপুঞ্জ আমরা হয়ত দেখে থাকবো। আবার আমরা সবাই কিন্তু রাশিচক্রের (zodiac) ব্যাপারটা খুব ভালোভাবে জানি। দেশী-বিদেশী হেন কোনো পত্রিকা নেই যা রাশিচক্রের মাধ্যমে 'আপনার ভাগ্য' বা 'এই সপ্তাহ কেমন যাবে' তা নির্ণয় না করে থাকে।

আমাদের দেশের দৈনিক পত্রিকায় যেনতেন কারণে বিজ্ঞান পাতা ছাপা না হতে পারে, কিন্তু দৈনিক রাশিচক্র ঠিকই ছাপা হবে। এখন প্রশ্ন হলো, এই রাশিচক্রের কিংবা এই যে বিভিন্ন প্রাণী বা বিভিন্ন মনুষ্যরূপী তারামন্ডলীর আকৃতি কল্পনা করা হয় তার উদ্ভব কবে, কীভাবে? ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন ১৯৩১ সাল থেকে ৮৮টি তারামন্ডলীর (constellations) স্বীকৃতি দিয়েছে। এদের মধ্যে ৪৮টির বর্ণনা পাওয়া যায় খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে টলেমির 'আলমাজেস্ট' গ্রন্থে। বাকি ৪০টি তারামন্ডলীর চিত্র সপ্তদশ শতাব্দী বা তার পরে যোগ হয়। টলেমির বিখ্যাত গ্রন্থে (যার মূল নাম Syntaxis Mathematik আরবি অনুবাদ যা দাঁড়িয়েছে Almagest) ৪৮টি তারকামন্ডলীতে ১০২২টি তারার অবস্থান ও উজ্বলতার নিখুঁত বর্ণনা পাওয়া যায়। ১৫০ অব্দের দিকে সংকলিত এই মহাগ্রন্থের সপ্তম ও অষ্টম খন্ডে (পুরো বইটি ১৩ খন্ডের) এই সম্পূর্ণ তালিকাটি পাওয়া যায় – এই তালিকায় রাশিচক্রের ১২টি, ক্রান্তিবৃত্তের (ecliptic) উত্তরের ২১টি ও দক্ষিণের ১৫টি তারামন্ডলীর চিহ্নিত হয়। তারামন্ডলীর বর্ণনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে টলেমি নক্ষত্রের অবস্থানের বর্ণনাত্মক বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। যেমন সাইগনাস বা বকমন্ডলীর সবচেয়ে উজ্জ্বল বা প্রথম তারাটির বর্ণনা তিনি এভাবে দেন – পাখিটির "লেজের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটি"। এই বর্ণনাত্মক বিবরণ আরবি অনুবাদে 'দেনেব' নামধারন করে যার অর্থ 'পুচ্ছ'। আলফা সাইগ্‌নির বাংলা নাম পাওয়া যায় পুচ্ছাগ্নি যা আসলে ঐ আরবি নাম অথবা ল্যাটিন অনুবাদেরই ধারাবাহিকতা নির্দেশ করে। তারামন্ডলীর এই টলেমি-কৃত বর্ণনাই আরবি ও ল্যাটিন অনুবাদ হয়ে আলব্রেখট ডুয়েরারের অপূর্ব কাঠখোদাইয়ে রূপান্তরিত হয়, যার শেষ হয় ১৬০৩ সালে জোহানেস বেয়ারের গ্রন্থ 'ইউরোনোমেট্রিয়া'তে যেখানে তারামন্ডলীর সুন্দর চিত্রসহ আমরা তাদের একটি সুন্দর বর্ণনাও পাই। টলেমির এই বর্ণনাই প্রাচীন যুগের তারাচিত্র সম্পর্কে সবচেয়ে নিখুঁত বর্ণনা এই তারাচিত্রের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়-
১. টলেমির তারামন্ডলীর বর্ণনায় তুলারাশির (Libra) তারাগুলিকে তিনি পার্শ্ববর্তী বৃশ্চিকের (Scorpion) বিভিন্ন অঙ্গের সাথে সম্পৃক্ত করে বর্ণনা করেছেন এবং এই তারামন্ডলীর নাম দিয়েছেন Chelae বা Claws। কাজেই মনে হয়, দক্ষিণাকাশে বৃশ্চিক রাশিটি আদিতে আকারে আরো অনেক বড়ো ছিল। পরে রাশিচক্রের উদ্ভবের সময়ে তা খন্ডিত হয়েছে। আরো লক্ষণীয় যে, রাশিচক্রের মধ্যে তুলারাশিই একমাত্র মণ্ডলী যা কিনা কোনো মনুষ্যরূপেও নয় বা কোনো প্রাণীও নয়। অন্যদিকে, খ্রিষ্ট্রপূর্ব ৭০০ অব্দে পাওয়া ব্যাবিলনীয় পোড়ামাটির খন্ডে ('মুল-আপিন সিরিজ') তুলারাশির নিখুঁত বর্ণনা পাওয়া যায়। আর খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দে কিউনিফর্ম লিপিতে রাশিচক্রের ১২টি মন্ডলীর যে প্রমিত চিত্রটি পাওয়া গেছে তাতেও তুলারাশির ছবি দাঁড়িপাল্লার মতো। কিন্তু টলেমি কখনো ব্যাবিলনীয় তুলা, কখনো গ্রিসীয় Claws-এর বর্ণনা ব্যবহার করেছেন। হতে পারে, টলেমির সময়ে দুটি ভিন্ন নাক্ষত্রিক ঐতিহ্য বহমান ছিল।
২. টলেমি তারামন্ডলীর শুধু বর্ণনাত্মক বিবরণই দেননি, তিনি অধিকাংশ উল্লেখযোগ্য তারার গাণিতিক অবস্থানও নির্দেশ করেছেন – ক্রান্তিবৃত্তের সাপেক্ষে নক্ষত্রের অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশের সাহায্যে। টলেমি জানতেন, দ্রাঘিমা সময়ের সাথে বাড়ে অয়নচলনের কারণে। বলা হয়ে থাকে, হিপার্কাস এই অয়নচলন আবিষ্কার করেন। তো টলেমি হিপার্কাস কর্তৃক নির্ধারিত অয়নচলনের হার (প্রতি একশ বছরে ১ ডিগ্রি) এবং বছরের হিসাব (যা সঠিক মানের তুলনায় কিছুটা বেশি) মেনে নিয়ে নক্ষত্রের অবস্থান গণনা করেন। ঐ দুই ভুলের কারণে হিপার্কাসের সময় থেকে টলেমির সময় পর্যন্ত ২৬৫ বছর সময়কালে নক্ষত্রের অবস্থান গণনা করে তারাতালিকা প্রণয়ন করেন। কিন্তু টলেমি তার সময়ের বিষুবন কাল দুটিও ঠিক করে নির্ণয় করতে পারেননি। এতোসব ভুলের মিলিত কারণে টলেমি বুঝতেই পারেননি যে নক্ষত্রের অবস্থান ভুল হয়েছে। তাই দেখা যায়, টলেমির তারার অবস্থান থেকে (অয়নচলনের ভুল হার ধরে) পেছন দিকে গণনা করলে ঠিক হিপার্কাসের সময়ের নক্ষত্রের অবস্থান পাওয়া যায়। তাই স্বভাবতই সন্দেহ জাগে টলেমি খুব সম্ভবত হিপার্কাসের ব্যবহৃত নক্ষত্রের সঠিক অবস্থানের সাথে ২৬৫ বছরের অয়নচলনের মোট পরিমাণ ২০৪০ (যার সঠিক মান ৩০৪০, অর্থ্যাৎ ৭২ বছরে ১০) যোগ করে একটি নতুন তারাতালিকা প্রনয়ন করেন। কিন্তু যদ্দূর জানা যায়, হিপার্কাসের কোনো সুনির্দিষ্ট তারাতালিকা পাওয়া যায়নি। তবে তিনি আরাতুসের কবিতায় উল্লিখিত ৮৫০ তারার বর্ণনা দিয়েছিলেন। তবে এমনও হতে পারে, হিপাকার্সের সমসাময়িক অন্য কোনো প্রধান তারাতালিকা টলেমি ব্যবহার করে থাকতে পারেন।

৩. টলেমি ও তার সমসাময়িক এবং পূর্বসূরীদের কাছে নক্ষত্রের সঠিক গাণিতিক অবস্থানের থেকে নক্ষত্রমন্ডলীর আকৃতি বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল। টলেমির তালিকায় সকল দৃশ্যমান নক্ষত্রেরও বর্ণনা নেই, বিশেষ করে কম উজ্জ্বল তারাদের অধিকাংশই অনুল্লিখিত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আকাশের দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি একটি অঞ্চলে প্রাচীন ও প্রখ্যাত কোনো তারামন্ডলীরই বিবরণ পাওয়া যায় না। একটি নির্দিষ্ট অক্ষাংশ থেকে আকাশ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে কিছু নক্ষত্রের কখনোই অস্ত ঘটে না (অস্তহীন তারা), অনেক নক্ষত্রের উদয়-অস্ত ঘটে, আবার কিছু নক্ষত্র কখনো দেখাই যাবে না। অয়নচলনের ফলে যেমন আমাদের ধ্রুবতারা বদলায়, তেমনি এমন অনেক তারামন্ডলী আছে যাদের আগে কখনো দেখা যায়নি (ফলে তাদের কোনো তারাচিত্র তৈরি হয়নি), কিন্তু এখন দেখা যায় (বিশেষ করে উত্তর গোলার্ধে)। এই অঞ্চলটিকে, যেখানে সুপরিচিত কোনো তারামন্ডলী নেই, বলে zone of avoidance বা তারাখালি অঞ্চল। টলেমির তারাতালিকায় অনুল্লিখিত তারা নিয়ে এমন এক তারাখালি অঞ্চলের নির্মাণ করা যায় এবং ঠিক কতকাল আগে এই অঞ্চল দক্ষিণ খ-মেরু নির্দেশ করত তা গণনা করা যায়।

প্রাচীন তারাচিত্র
বিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদরা জানাচ্ছেন যে, তারামন্ডলীর উল্লেখ ও বর্ণনা টলেমিরও আগে থেকে প্রচলিত। যেমন হিপার্কাস একটি কবিতায় উল্লিখিত তারাচিত্রের বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন সেগুলো আরও আগের। আরাতুসের ঐ কাব্যগ্রন্থ 'ফেনোমেনা' আসলে আরও পূর্বের ইউডক্সাসের তারা বর্ণনার উপর নির্ভর করে রচিত। ইতিহাসবিদরা দেখিয়েছেন, সুপ্রাচীন তারামন্ডলীগুলোর অধিকাংশই, রাশিচক্রসহ, এসেছে ব্যাবিলন থেকে, কিন্তু সবগুলি নয়। তারার উদয় ও অস্ত, তারাখালি অঞ্চলের অবস্থান, দক্ষিণ খ-মেরুর অবস্থান – এসব মিলিয়ে বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখিয়েছেন কবে এবং কোথায় প্রাচীনতম তারামন্ডলীগুলো তৈরি হয়ে থাকতে পারে:


বোঝা যায়, ৩৪০ থেকে ৩৬০ উত্তর অক্ষাংশে বসবাসকারী একদল মানুষের হাতে অন্তত ২৫০০-থেকে-২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে সুপরিচিত প্রাচীন তারামন্ডলীগুলির সৃষ্টি হয়। তবে, ব্র্যাডলি শেফার একটি ভিন্নমত উপস্থাপন করেছেন। তাঁর গণনা অনুযায়ী মণ্ডলীগুলির তারিখ অনেকটাই আধুনিক, ফলে মিনোয়ানন্দের দাবী নাকচ হয়ে যায় এবং মণ্ডলীনির্মাতা হিসেবে শুধু ব্যাবিলনীয়রাই টিকে থাকে।

অয়নচলের বা precession-এর কারণে পৃথিবীর ঘূর্ণন-অক্ষ প্রতি ২৬০০০ বছরে একটি পূর্ণ চক্র সম্পাদন করে। এই অয়নচলের ফলে ক্রান্তিবৃত্তের চারটি দিগ্‌বিন্দুও (cardinal points) প্রতি ২১৬০ বছরে এক তারামন্ডলী থেকে পার্শ্ববর্তী তারামন্ডলীতে স্থানান্তরিত হয়। এরই জন্যে ধ্রুবতারাও বদলায় – খ্রিষ্টপূর্ব ২৮০০ অব্দে যখন পিরামিডগুলো নির্মিত হচ্ছিল, তখন ধ্রুবতারা (আলফা আরসা মাইনরিস বা পোলারিস) উত্তর খ-মেরুর কাছাকাছি আসে এবং ২১০০ অব্দের পর এটি ক্রমশ দূরে সরে যেতে থাকবে। ১২০০০ বছর পর অভিজিৎ ধ্রুবতারার জায়গায় আসবে। এই অয়নচলনের জন্যই তারাখালি অঞ্চলও যুগে যুগে বদলায় – ফলে সেন্টরাস ও আর্গো মন্ডলীর তারা সেকালে বেশী দৃশ্যমান ছিল, আজকে বরঞ্চ এরিডেনাস ও পিসিস অন্ট্রিনাস বেশি উল্লেখযোগ্য। এই কারণে প্রাচীনকালে তারামন্ডলীর গুরুত্বও বাড়ত বা কমত। কারণ আদি কালে তারামন্ডলী ব্যবহৃত হতো ধর্মীয় উৎসবাদিতে, নবান্নে, দিক নির্ণয়ে, পঞ্জিকার কারণে ইত্যাদি। কিন্তু জ্যোতির্বিদ ও ইতিহাসবিদেরা গণনা করে বের করেছেন, তারামন্ডলীর আদি নির্মাতারা কোথায় ছিলেন এবং মোটামুটি কবেকার। এখন কথা হলো তারা কারা ছিলেন?

একসময়ে মনে করা হতো, কোনো একটি নির্দিষ্ট জায়গার নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী কোনো একটি সময়ে তারামন্ডলীগুলো বানিয়েছে স্রেফ কল্পনার ফানুস উড়িয়ে। এখন আমরা জানি, এটি মোটেও সঠিক নয়। যাহোক, ২৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ৩৬-ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশে বসবাসকারী দুটি বড় সভ্যতা হলো ব্যাবিলনীয় ও ভূমধ্যসাগরীয়। এই দুটি সভ্যতার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীনতম হলো ব্যাবিলনীয়, যারা আসলে সুমের-আক্বাদের ঐতিহ্যের উত্তরসূরী। ব্যাবিলনীয় লিপি ও রেকর্ডে রাশিচক্রের ১২টি এবং আরো বেশ অনেকগুলো তারামন্ডলীর বর্ণনা দেখা যায়। বোঝা যায়, খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ৪র্থ থেকে ১ম সহস্রাব্দের মধ্যে এদের 'নির্মাণ' হয়েছে। কিন্তু টলেমির ৪৮টি তারাতালিকার অনেকগুলোই আবার ব্যাবিলনের লেখাজোখায় নেই। এরা এলো কোথা থেকে? অনেকেই মনে করেন মিনোয়ান সভ্যতার ক্রিট দ্বীপের অধিবাসীদের হাতে বাকি সমুদ্র-সংক্রান্ত তারামন্ডলীগুলির জন্ম হয়েছে। কাজেই খ্রিষ্টপূর্বাব্দ দ্বিতীয় থেকে প্রথম সহস্রাব্দের মধ্যে একাধিক স্থানের একাধিক সংস্কৃতির মানুষের হাতে তারামন্ডলীগুলির রচনা সম্পন্ন হয়।

কিছু কিছু তারামন্ডলী আছে যেগুলো বহু প্রাচীন – প্রায় সবকালের মানুষেরাই তাদের জানতো। হোমার, হেসিয়ড ও বাইবেলের 'বুক অব জব'-এর লেখকের কাছে পরিচিত তারামন্ডলী হলো: সপ্তর্ষিমন্ডল, স্বাতী নক্ষত্র, লুব্ধক, কৃত্তিকা নক্ষত্রপুঞ্জ, কালপুরুষ ইত্যাদি। এটা হলো খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ৭০০-এর কথা। হেসিয়ডের কাব্যে আছে:
'যখন অ্যাটলাসের কন্যারা, কৃত্তিকা বোনেরা (ভোরে) উদয় হয়
ধান কাটা শুরু কর, আর চাষ শুরু কর যখন তারা অস্ত যায় (ভোরে)'
আরো কিছু তারামন্ডলী আছে যাদের উদ্ভব হয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব ২৮০০ অব্দের দিকে – যেমন দানবাকৃতির ভালুক ও সরিসৃপাকৃতির তারামন্ডলী। কিন্তু হৃদসর্পমন্ডল বা হাইড্রার মতো সমুদ্র সম্পর্কিত মণ্ডলীগুলো সম্ভবত ভূমধ্যসাগরীয় মানুষের হাতে তৈরি যারা ছিল নৌ-চালনায় দক্ষ ও সমুদ্রগামী। এই সমুদ্রগামী নেভিগেটর সম্প্রদায়ের বিস্তৃতি খ্রিষ্টপূর্ব ২৮০০ অব্দ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ অবধি। এই তারামন্ডলীগুলো রাতের অন্ধকার সমুদ্রে দিক নির্ণয়ে বিশেষ সহায়ক। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে থেরা পর্বতের (যার অন্য নাম স্যানেটোরিনি) ভয়াবহ অগ্ন্যুপাত ও তার ফলে সৃষ্ট ভূমিকম্প ও সুনামিতে ক্রিট দ্বীপ ভিত্তিক মিনোয়ান সভ্যতার পতন ঘটে। এরাই উপরোক্ত সমুদ্রগামী জনগোষ্ঠী বলে অনেকেই মনে করেন। অন্যদিকে রাশিচক্রের ১২টি মন্ডলী মেসোপটেসিয়ায় খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০০ থেকে ৫০০ অব্দের মধ্যে তৈরি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এই মণ্ডলীগুলি এই সময়কার মানুষের পূজনীয় বিভিন্ন দেবদেবীর আদলে তৈরী, পরে যা জ্যোতিষ ও ভাগ্য গণনার কাজে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। এই মন্ডলীগুলো পরে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ও মিশরে জনপ্রিয়তা পায়। গ্রিকদের মিথোলজিতে এরা অনেক পরে সংযুক্ত হয় এবং আরাতুসের কবিতায় এদের উল্লেখ নেই। শেষতক আরো কয়েকটি তারান্ডলীর বর্ণনা পুরোনো কোথায়ও পাওয়া যায় না। এগুলো গ্রিকদের হাতে তৈরি এবং গ্রিক পুরাণের সাথে এদের সর্ম্পক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ।

খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতকের গ্রিসে অনেক প্রাচীন তারামন্ডলী চেনা ও জানা ছিল। কিন্তু সবকটা পুরনো তারামন্ডলীর সম্পূর্ণ বর্ণনার ইতিহাস একমাত্র খ্রিষ্টপূর্ব ৩৭০ অব্দে ইউডক্সাসের কাছ থেকেই পাওয়া যায়। ইউডক্সাস তাঁর জ্যোতির্বিজ্ঞানের জ্ঞান মিশর থেকে পেয়েছিলেন। তিনিই প্রথম খ-গোলক বানান এবং এর নাম ছিল ইউডক্সাসের গোলক। এই ধাতব (অথবা পাথরের) গোলকের ওপর প্রাচীনকালে জ্ঞাত সকল উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, বিষুবরেখা এবং তারামন্ডলীর চিত্র আঁকা ছিল। ৪০৯ থেকে ৩৫৬ খ্রিষ্টপূর্ব অব্দের মধ্যে বেচে থাকা ইউডক্সাস দুটি বই লিখে যান – 'ফেনোমেনা' বা 'অ্যাপিয়ারেন্সেস' এবং 'ইনোপট্রন' বা 'মিরর অব নেচার'। এই দুটো বই এবং ইউডক্সাসের গোলকের সকল হদিস কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও প্রথম বইটির ওপর আরাতুসের লেখা কাব্যভাষ্য এবং সে সম্পর্কে হিপাকার্সের লেখা আমরা পেয়েছি। আরাতুসের জন্ম খ্রিষ্টপূর্ব ৩১৫ অব্দে সিলিসিয় শহর সোলেইতে। এথেন্সে বিখ্যাত দার্শনিক জেনোর অধীনে তিনি পড়াশুনা করেন। ম্যাসিডোনিয়ার রাজা অ্যান্টিগোনাস গোনাটাসের নির্দেশে ইউডক্সাসের কাজ সর্ম্পকে তিনি কাব্য রচনা করতে বসেন। 'ফেনোমেনা' নামে পরিচিত এই কাব্যভাষ্য প্রাচীনকাল ও মধ্যযুগ পর্যন্ত বিজ্ঞানের বই হিসেবে পরিচিত ছিল। এই গ্রন্থে তারামন্ডলীর আকৃতির বর্নণা এবং এর অন্তর্গত তারাদের বর্ণনা, তাদের উদয় ও অস্তের বর্ণনা, গ্রিক পুরাণে তাদের গল্প এবং নাবিকদের সুবিধার্থে আবহাওয়ার পূবার্ভাসে তারামন্ডলীর ব্যবহার উল্লিখিত আছে। এই বই নিয়ে প্রাচীন গ্রিসের বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ হিপাকার্সের বিশ্লেষণ অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক। হিপার্কাস দেখতে পান বিভিন্ন নক্ষত্রমন্ডলী্র উদয় ও অস্তের যে বর্ণনা দেওয়া আছে কিংবা অন্য পারিপার্শ্বিকতার সাথে যে বর্ণনা আছে তার সাথে হিপার্কাসের সময়ের (খ্রি:পূ: ১২৫ অব্দ) কোনো মিলই নেই। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, আরাতুস কোনো পর্যবেক্ষণ ছাড়াই ইউডক্সাসের বিবর্ণ 'কপি-পেষ্ট' করেছেন, বাস্তবের সাথে তার কোনো মিল নেই। এই বিবরণ থেকে হিপার্কাস অয়নচলনের ব্যাপারটা ধরতে পেরেছিলেন। তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন ইউডক্সাস ও আরাতুসের তারাবর্ণনা হাজার বছরের পুরনো এবং অয়নচলনের কারণেই রাতের আকাশে নক্ষত্রের অবস্থান বদলে গেছে। হিপার্কাসের পূর্ববর্তী গ্রিক লেখকরা আকাশের নক্ষত্রের এমন সব বর্ণনা দিতেন যা তখনি তামাদি হয়ে গিয়েছে এবং সেটা তারা অনুধাবনও করতে ব্যর্থ হয়েছিল। হিপার্কাসের পরে ১৩০-১৬০ খ্রিস্টাব্দে টলেমির 'আলমাজেস্ট' গ্রন্থে আমরা প্রাচীন তারামন্ডলীর একটি সুসংহত বর্ণনা পাই অবশেষে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো: সুপ্রাচীন ব্যবিলনীয় রাশিচক্রের ঐতিহ্য আর সমুদ্রগামী নাবিকদের নক্ষত্রমন্ডলীর ঐতিহ্য কবে-কোথায়-কীভাবে সমন্বিত হলো? উত্তর হলো: নিঃসন্দেহে গ্রিসে, খ্রিষ্টপূর্ব ৫৪০ থেকে ৩৭০ অব্দে। আর ইউডক্সাসই বা পুরানো মন্ডলীর বিবরণ পেলেন কোথায়? বিজ্ঞানীদের মতে, খুব সম্ববত মিশরে।

লুপ্ত হয়ে যাওয়া মিনোয়ান সভ্যতা থেকে প্রাপ্ত একটি আকাগোলকের নমুনা মিশরে ইউডক্সাসের হস্তগত হয়। এই আকাশ গোলক দেখেই ইউডক্সাস তাঁর তারাবর্ণনা লেখেন, নিজে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে নয়। কাজেই বহু প্রাচীনকালে এলামাইট শহর সুসা বা ঐ সময়কার প্রথম দিককার নগরগুলিতে ধীরে ধীরে তারামন্ডলীর ধারণা গড়ে ওঠে। এরপর সুমেরিয় ও আক্কাদিয় সভ্যতার সময়ে চার ধাপে রাশিচক্রের ১২টি তারামন্ডলী চিহ্নিত হয়। ব্যাবিলনীয়, এবং বিশেষ করে কালদিয়দের হাতে, জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিষশাস্ত্রের অংশ হিসেবে তারামন্ডলীর বর্ণনা ও রাশিচক্র পরিণত হয়। এই তারাবর্ণনা ক্রিট দ্বীপ ভিত্তিক মিনোয়ান সভ্যতার হাতে পড়ে আরো পরিপূর্ণতা পায়। অবশেষে টলেমির ৪৮টি মন্ডলীর বর্ণনা আমরা 'আলমাজেস্টে' পাই। এই তারামন্ডলীর চিত্রই আধুনিক কালে ব্যবহৃত হয়। পরিপূর্ণ তারামন্ডলীর সুস্পষ্ট ছবি আমরা পাই মিশরের দেনদেরা তারাচিত্রে (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৬ অব্দ) এবং খ্রিষ্টীয় ২য় শতকের ফারনিস অ্যাটলাস থেকে। এসব ছবিতে আমরা যে তারাচিত্র পাই, সেসবই পরবর্তী ১৫০০ বছর ধরে পুনরাবৃত্ত হতে থাকে – খ্রিষ্টিয় নবম শতকে ইউরোপীয়দের হাতে তৈরি আরাতুসের পান্ডুলিপিতে ব্যবহৃত ছবিতে, খ্রিষ্টীয় নবম শতকে রচিত টলেমির ওপর করা বাইজেন্টাইন পান্ডুলিপিতে এবং খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে কৃত একটি ইসলামী সংস্কৃতির প্রাসাদের ছাদে অঙ্কিত ছবিতে। নক্ষত্রমন্ডলীর এসব আকৃতিগত ছবি ও টলেমির বর্ণনার উপর ভিত্তি করে ১৪৪০ সালে নতুন করে ভিয়েনায় একটি স্কাই-ম্যাপ তৈরি হয়। এটিই পরবর্তীতে রেনেসাঁর যুগের কপি হতে থাকে।

তথ্যপঞ্জি:
১/ ওয়েন গিংরিচ, 'দ্য গ্রেট কোপার্নিকাস চেজ', কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯২। ২/ জন রজার্স, "অরিজিনস অব দ্য এনশেন্ট কনস্টেলেশন্‌স। পার্ট-টু: দ্য মেডিটেরিয়ান ট্রাডিশন্‌স", জার্নাল অব ব্রিটিশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন, খণ্ড ১০৮, সংখ্যা ২, পৃষ্ঠা ৭৯-৮৯, ১৯৯৮। ৩/ আর্চি রয়, "দ্য অরিজিন অব দ্য কনস্টেলেশন্‌স", ভিস্টাস ইন অ্যাস্ট্রোনমি, খন্ড ২৭, পৃষ্ঠা ১৭১-১৯৭, ১৯৮৪। ৪/ ব্র্যাডলি ই. শেফার, "দ্য ল্যাটিচ্যুড অ্যান্ড এপোক ফর দ্য অরিজিন অব দ্য অ্যাস্ট্রোনমিকাল লোর অফ ইউডক্সাস", জার্নাল ফর দ্য হিস্ট্রি অফ অ্যাস্ট্রোনমি, খণ্ড ৩৫, পৃষ্ঠা ১৬১-২২৩, ২০০৪।

ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী:বিজ্ঞান গবেষক ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।