উপাচার্যদের আমলনামা আমলে নিন

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান
Published : 23 Sept 2019, 12:40 PM
Updated : 23 Sept 2019, 12:40 PM

বিশ্ববিদ্যালয় হলো রাষ্ট্রের মধ্যে আরেক ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। সেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য উপাচার্য হিসাবে যাঁদেরকে নিয়োগ দেওয়া হয়, তাঁদের অনেকেই চাকরিত্রাতা হিসাবে হোক, আর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হোক, নিজেদেরকে অনেক বড় কিছু মনে করেন। বিশেষ করে নব্বইয়ের দশকের পরে রাজনীতির ছত্রছায়ায় অনেকে উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ পেয়েছেন, যাদের উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ পাবার কথা ছিল না। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণার উন্নয়নের অনেক কিছু নির্ভর করে একজন একাডেমিক, দক্ষ প্রশাসক ও নৈতিক চরিত্রসম্পন্ন ভালো মানের একজন উপাচার্যের উপর। অন্যদিকে, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক ক্ষতিসাধনও নির্ভর করে একজন নীতিভ্রষ্ট, নন-একাডেমিক, দুর্নীতিবাজ, চরিত্রহীন উপাচার্যের কর্মকাণ্ডের কারণে। আর্ন্তজাতিক র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। এতে অবাক হওয়ারও কিছু নেই। শিক্ষক-ছাত্ররাজনীতির 'দাদাগিরি' বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছে। কাজেই তাৎপর্যপূর্ণ শিক্ষকরা গবেষণার চেয়ে 'উপাচার্য ও তাঁর প্রশাসনের চাটুকারিতা'-তে বেশি লাভ দেখেন। একইভাবে পড়াশুনা না করে ছাত্ররাজনীতির সাথে জড়িয়ে গেলে দলীয় পদ-পদবীর সাথে অপ্রত্যাশিত অনেক কিছু সহজে মিলে যায় এবং একই সাথে ক্ষমতা প্রদর্শনের একটি স্থান তৈরি হয়ে যায়।

দুই. সম্প্রতি গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ পাওয়া উপাচার্য প্রফেসর ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিন আইন বিভাগের বহিস্কার হওয়া এক শিক্ষার্থীর সাথে কথোপকথনের এক পর্যায়ে উক্ত শিক্ষার্থীকে 'তিন দিনের বাছুর' আখ্যা দিয়ে বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কি তোর আব্বার কাছে শুনিস। গ্যাছে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো দিন? (https://www.youtube.com/watch?v=mL0JrGCvcTo)'। উপাচার্যের এই বক্তব্য অনেকাংশে তার নিজের বাবার জন্য যেমন সত্য, তেমনি আমাদের অনেকের জন্যেও সত্য। সত্যি আমাদের অনেকের বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েননি, কিন্তু তাদের সন্তান-এই আমাদেরকে পড়িয়েছেন। আমরা অনেকেই বিশ্বাস করি, যে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আমাদের দরিদ্র্য পিতা-মাতা আমাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন, সেই সুযোগ-সুবিধা পেলে আমাদের মা-বাবা অক্সফোর্ড-কেমব্রিজসহ বিশ্বের অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। আর উপাচার্য নাসিরউদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছেন বলেই বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহে অধ্যয়নকালীন সময়ে ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা এবং শিক্ষক অবস্থায় বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত সাদা দল থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাছাড়া গোপালগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অত্যন্ত ধূর্ত উনি ২য় বারের মতো উপাচার্য পদে অধিষ্টিত হয়েছেন এবং বেশ চাতুর্যের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ডকে 'ম্যানেজ' করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিতে অনৈতিক এক শতাংশ (১%) 'ভিসি কোটা' চালু করে শত শত শিক্ষার্থীকে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে ভর্তি করিয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষাকে কলঙ্কিত করেছেন। আরো যত ফিরিস্তি তাঁর আছে, তা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়, বরং তা বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি রাখে।

তিন. গত ২১ নভেম্বর ২০১৫, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মিজানউদ্দিনের মেয়াদকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬২তম সিন্ডিকেট সভায় যেকোনো বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভাগীয় মেধা তালিকায় (১ম-৭ম) এবং প্রতিটি বিভাগ বা ইনস্টিটিউটে শিক্ষক নিয়োগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে সিজিপিএ ৩.৫০ থাকা আবশ্যক করা হয় (যুগান্তর, ১ জানুয়ারি ২০১৮)। কিন্তু বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ পেয়ে গত ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭৫তম সিন্ডিকেট সভায় শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যতা স্নাতক-স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিথিল করে (ন্যূনতম ৩.২৫) তাঁর মেয়েকে (২১তম) 'ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে' এবং জামাতাকে (যার ব্যাচে ৩.৫০ বা এর ওপরে সিজিপিএ পেয়েছেন ৬৬ জন) 'ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে (আইবিএ)' প্রভাষক পদে নিয়োগ দিয়েছেন (প্রথম আলো, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ঢাকার লিঁয়াজো অফিসে বসে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেন। পত্রিকায় প্রকাশ ৩৪০ দিনের মধ্যে ২৫০ দিনই তিনি ক্যাম্পাসে যাননি। একটি চিরকুট দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে সহায়তা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সহায়তায় কোটি টাকা ঈদ সালামি ভাগাভাগির খবর প্রকাশ পেয়েছে যদিও তা এখনো প্রমাণিত নয়। সত্যিই যদি এর নাম স্বায়ত্তশাসন হয়, তাহলে আমি আমার ডান হাত আত্মার উপরে রেখে বলছি, আমি এই প্রচলিত স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তন চাই। কেননা এর অনেক কিছুই ব্যতিক্রম কোন উদাহরণ নয়, বরং অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিত্য নৈমিত্তিক দৃশ্যপট। 

চার. প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে তাৎপর্যসংখ্যক বেশ কিছু শিক্ষক আছেন যারা সরকার, রাষ্ট্র এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ডানে গেলে তারা বামে যান, বামে গেলে ডানে যান এবং কোনো সময় মধ্যম পন্থা অবলম্বন করেন না। কারণ, সব সময় তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তবুদ্ধির চর্চা এবং সরকারের সমালোচনা করে নিজেদেরকে জাহির করতে চান। রাষ্ট্রীয় প্রথা-প্রতিষ্ঠান বিরোধী এক ধরনের দর্শন শিক্ষার্থীদের কানে ঢুকিয়ে দেন যা তাদেরকে বিপথে পরিচালনা করে। আবার, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকদের পেশা দুটি– শিক্ষকতা ও রাজনীতি। তবে, রাজনীতিবিদদের সাথে তাঁদের মৌলিক পার্থক্যের  অন্যতম একটি হলো, রাজনীতিবিদরা ভোট করেন রাষ্ট্রীয় ছুটির দিনে, আর প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতির নির্বাচন হয় ক্লাস-পরীক্ষা চলাকালীন দিনে। কোন নৈতিকতার ভিত্তিতে এগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় তার একটা সীমারেখা টানা দরকার। সেশনজটমুক্ত করার যুক্তিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমসাময়িক ভর্তির ব্যবস্থা করা কতটুকু যৌক্তিক এবং মানবিক তা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভেবে দেখল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা বাস্তবায়নের বিষয়টি নিয়ে প্রতি বছর আলোচনা শুরু হলেও শেষের দিকে এসে এটি আর সফল হয় না। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী শুধু এই অমানবিক পদ্ধতির কারণে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারে না তার হিসেব কেউ করে না। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়ন, প্রচলিত একাডেমিক ব্যবস্থার উৎকর্ষ সাধন এবং শিক্ষার আবহ আন্তর্জাতিক পরিসরে বিস্তৃতির লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)-কে রুপান্তর করে 'উচ্চশিক্ষা কমিশন' গঠনের অপরিহার্যতার বিষয়টিও কেউ ভেবে দেখছেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহমর্মিতা, জবাবদিহিতার খুব অভাব। একজন শিক্ষক তাঁর সহকর্মীর বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের সামনে, শ্রেণি কক্ষে প্রকাশ্যে গালমন্দ করেন যার কোন প্রতিকার হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সকল শিক্ষকের একটি পরিচিতি নম্বরসহ ডিজিটাল ডাটাবেজ তৈরির একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। পাশাপাশি, চারিত্রিক ও নৈতিক গুণাবলী; উচ্চশিক্ষা-গবেষণা, সমাজ ও দেশ সেবায় অবদান; মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের প্রতি অবিচল দৃষ্টিভঙ্গি; বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় পারদর্শিতা ও প্রশাসনিক দক্ষতা; ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক ও ব্যক্তিত্ববোধের মত গুরুত্বপূর্ণ সংবেদনশীল বিষয়গুলো পরীক্ষণ-নিরীক্ষণ এবং যাচাইয়ের প্রয়োজনসহ রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা প্রতিবেদনের গুরুত্ব বিবচেনায় নিয়ে একজন শিক্ষককে 'উপাচার্য'পদে অধিষ্টিত করা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন ম্যাকিয়াভেলি (১৪৬৯-১৫২৭) পড়েছিলাম। তিনি তাঁর 'দ্যা প্রিন্স' গ্রন্থে বলেছেন রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থার সাথে নৈতিকতার সম্পর্ক অনেক গভীর। যিনি নিজে সৎ, শাসন তিনিই করবেন এবং শাসক শ্রেণিকে অবশ্যই নীতিবান, সৎ এবং যোগ্য হতে হবে যাদের প্রতিশ্রুতি এবং বাস্তবায়নের মধ্যে থাকতে হবে মিল। ম্যাকিয়াভেলি আরো বলেন যে, শাসককে সততা ও নৈতিকতা দিয়ে জনগণের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সমর্থন এবং আনুগত্য আদায় করতে হয়। তার কাছে রাজনীতি মানেই হলো 'ক্ষমতা গ্রহণ আর প্রয়োগের নীতি'।

বর্তমানে দেশে যেভাবে দলীয় নেতা কর্মীর আমলনামা আমলে নিয়ে দল ও সরকার প্রধান শেখ হাসিনা কঠোর হয়েছেন, তাতে একদিকে যেমন দল উপকৃত ও শুদ্ধ হবে, অন্যদিকে উপকৃত হবে সরকার, দেশ ও দেশের মানুষ। তাই, প্রত্যাশা করি, প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয় ও উপাচার্যদের আমলনামা আমলে নিয়ে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করবেন, যেন বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা মাথা উচুঁ করে দাঁড়াতে পারে এবং  আগামী দিনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পথচলা সুন্দর-সুমসৃণ ও উন্নয়নমূলক হয়।