রূপাচার্য!

আহসান কবিরআহসান কবির
Published : 19 Sept 2019, 01:38 PM
Updated : 19 Sept 2019, 01:38 PM

সরকারি বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন আর সেই সব উপাচার্যের দেখা মেলে না যারা স্বপ্নঘেরা অতীতের অংশ হয়ে আছেন। যাদের দেখা মেলে তারা সবাই এখন 'রূপাচার্য'! এই রূপাচার্যরা নিজ স্বার্থ আর সরকারের ইচ্ছা (?) রূপদান করতে এই পদে থাকেন! —একালের প্রবাদ (আহমদ ছফার উপন্যাস 'গাভী বিত্তান্ত' পড়লে এমন প্রবাদ আরও তৈরি করা সম্ভব হবে!)

গাভী বিত্তান্ত নামে আহমদ ছফার 'পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ময়' একটা উপন্যাস আছে যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির যাপিত জীবনের অনেক দিক উন্মোচিত হয়েছে। এই বই পড়িলে জানিতে পারিবেন–

এক. একজন তরুণ শিক্ষক গবেষণার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একটা হলের আবাসিক শিক্ষক হতে বেশি পছন্দ করেন। কখনো-সখনো এর জন্য জুতোর সুখতলী ক্ষয় করতে বাধ্য হন! গবেষণা এখন আর শিক্ষকদের আরাধ্য নয়। কেউ দেশ ও জাতির স্বার্থে কোনো গবেষণা করলে সেটা হিতে বিপরীত হতে পারে। যেমন খোলা বাজার থেকে বিভিন্ন কোম্পানির পাস্তুরিত তরল দুধসংগ্রহ করে সেটা নিয়ে গবেষণা ও ঐসব কোম্পানির দুধে মানবদেহের জন্য যে ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে তা দেখিয়ে দেবার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের অবস্থা কী হয়েছে তা অনেকেই জানেন!

দুই. গাভী বিত্তান্ত উপন্যাসের ভিসি মিঞা মোহাম্মাদ আবু জুনায়েদ জমির দালালদের সাথে মিশতে পছন্দ করতেন, পছন্দ করতেন কম দামে জমি কিনতে। কিন্তু যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দালালি, বহুজাতিক কোম্পানির পরামর্শক, এনজিওর ন্যাওটা হতেন ভিসি জুনায়েদ তাদের সম্পর্কে নিচু ধারণা পোষণ করতেন। একালের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াতে ভালোবাসেন, ভালোবাসেন সরকার বা সরকারি দলের গুডবুকে থাকতে। পৃথিবীর একহাজার বিশ্ববিদ্যালয়ে তালিকায় তাই এদেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম না থাকলেও কিছু যায় আসে না! নিজে বাঁচলে বাপের নাম!

তিন. গাভী বিত্তান্ত পড়লে আরও জানিতে পারিবেন যে, এখন আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমাজ বলে কিছু নাই। আছে হলুদ, বেগুনি, ডোরাকাটা এইসব দল। আপনার দল যত ভারী আপনি তত বড় শিক্ষক, আপনার ভিসি হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না। আপনি কোথায় কবে গবেষণা করলেন, দেশ বিদেশের কোন জার্নালে আপনার কোন গবেষণাকর্ম ছাপা হলো এসবে কারো আর খেয়াল নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কোণে নীলক্ষেত নামে একটা জায়গা আছে। যা নিয়ে গবেষণা করতে চান সব নাকি ঐখানে পাওয়া যায়। টাকা দিয়ে কিনবেন, প্রয়োজনে কপি-পেস্ট করে জমা দেবেন। কয়জন এমন 'টুকলিফাই' করে ধরা পরেছে সেই তালিকা নিয়ে কেউ নাকি ঘামায় না! আপনার দল বড় হলেই সাতখুন মাফ।

আহমদ ছফা মারা গিয়েছেন অনেক আগে। তিনি গিনেস বুকের রেকর্ডটা দেখে যেতে পারেননি। এখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে দশ টাকায় এক কাপ চা, একটা সিঙ্গারা, একটা সমুচা পাওয়া যায় যা আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায় জানতে পারলে গিনেস বুকে রেকর্ড হবে। এমন মন্তব্য করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান। তিনি আরও দুটি 'রূপাচার্যে'র কাজ করেছিলেন যেটি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে, টেলিভিশনের খবরে প্রচারিত হয়েছে।

এক. ঢাকার সাতটি কলেজের অধিভুক্তি আন্দোলনে ছাত্ররা তার বাসভবন ঘেরাও করলে তিনি নাকি ডেকেছিলেন ছাত্রলীগ কর্মীদের। এরপরের ঘটনা সবার জানা। ছাত্রলীগের বীর কর্মীরা ঘটনাস্থলে এসে আন্দোলনকারীদের মোটামুটি ফ্লাইংকিক মেরে কাবু করে ফেলে। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে এভাবেই ছাত্রলীগের ছেলেরা উদ্ধার করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবরুদ্ধ ভিসিকে!

দুই. বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে নাম ওলট পালট ও চিরকুট কেলেংকারি। নাম ওলট পালটের কেলেংকারি বাদ দিলেও ভিসি আখতারুজ্জামানের এই চিরকুটের বদৌলতে ছাত্রলীগের কয়েক ডজন কর্মী মাস্টার্সে কোনো লিখিত পরীক্ষা ও ভাইবা ছাড়া ভর্তির সুযোগ পান এবং ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হতে পারেন। অনৈতিক এমন সুযোগ দানের পরও তিনি বহাল তবিয়তে আছেন কারণ সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের ইচ্ছেকেই তিনি হয়তো বাস্তবে রূপদান করেছেন! নিয়মতান্ত্রিকভাবে ভিসি নিয়োগ না করে রাজনৈতিক বিবেচনায় সেটা করা হলে দলবাজিটাই সেখানে প্রবল থেকে প্রবলতর হয়। সেখানে দলীয় শিক্ষকদের পদোন্নতি আর আর্থিক অনিয়মের মাধ্যমে পকেট ভারীটাই আসল কাজ হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। তখন একজন উপাচার্য হয়ে যান রূপাচার্য, দলীয় আনুগত্যই প্রধান হয়ে উঠতে থাকে, তিনি হতে পারেন না একাডেমিক লিডার বা শিক্ষা ও গবেষণায় প্রভাবিত করার মতো কোন আদর্শ ব্যক্তি! তাই একালের উপাচার্যরা এমন অনেক  ঘটনার 'আধুনিক রূপ' দান করেন যা নিয়ে সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে দেশ। যেমন–

এক. জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ফারজানা ইসলাম বুঝিয়ে দিয়েছেন যে প্রশ্ন করা যাবে না। তাকে দুজন সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেছিলেন– বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্পের বাজেট থেকে এক কোটি ষাট লাখ টাকা ছাত্রলীগ নেতাদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে দেয়া হয়েছে এবং এই সংক্রান্ত একটা অডিও ফাঁস হয়েছে। ব্যাপারটা সত্যি কিনা? ফারজানা ইসলাম হুংকার দিয়ে বলেছেন– এমন প্রশ্ন করার সাহস কোথায় পেলে? টাকার ভাগ বাটোয়ারা ঠিক কীভাবে রূপদান করা হয়েছে তা স্পষ্ট না হলেও ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তাদের পদ হারিয়েছেন সংগঠন থেকে। যারা টাকা নেয়ার কারণে বা অভিযোগে পদ হারিয়েছেন তাদের যারা টাকা দিয়েছেন (অডিও তে একজন স্বীকার করেছেন যে তিনি টাকা পেয়েছেন। তিনি একাধিক পত্রিকা ও টেলিভিশনকে বলেছেন টাকা দেয়ার আলোচনার সময় ভিসির স্বামী ও ছেলে উপস্থিত ছিলেন। তারা এটাকে ঈদ সেলামি বলে উল্লেখ করেছিলেন) তারা কীভাবে নিজ পদে থাকতে পারেন? যদিও শিক্ষক ও ছাত্রদের একাংশ ভিসি ফারজানা ইসলামকে পদত্যাগ করার জন্য সময়সীমা বেধে দিয়েছেন। রূপাচার্যের বিরুদ্ধে যে শিক্ষকরা আন্দোলনে নেমেছেন তাদের ছয়জনের মোবাইলের সিম ব্লক করা হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি চেয়ারটাই কেন যেন নড়বড়ে। এ পর্যন্ত পাঁচজন ভিসি আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

দুই. টাকা ভাগ বাটোয়ার অডিও ফাঁসের মত আরও একটি অডিও ফাঁসের পর ভাইরাল হয়েছে। এই রূপাচার্যের নাম খোন্দকার নাসিরউদ্দীন। তিনি এক ছাত্রীর সাথে যে ভাষায় কথা বলেছেন তা শুনলে আঁতকে উঠতে হয়। ভিসির ভাষ্য অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয় না খুললে মেয়েটা নাকি রাস্তা ঘাটে ঘুরে বেড়াত। বিশ্ববিদ্যালয়ে কী কাজ হয় সেটা ছাত্রীর বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে বলেছেন। এই ছাত্রীকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল যা আবার প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। এর আগে যেসব ছাত্ররা ভিসির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছে তাদের শাসানো হয়েছে, কারো কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এই রূপাচার্য আসলে কী রূপ দিতে চেয়েছেন? সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্য যদি ছাত্রলীগ বা যুবলীগের নেতারা শাস্তি পেতে পারেন তাহলে যারা সরকারের 'ভিন্ন ভাবমূর্তি' রূপ দিয়ে যাচ্ছেন তারা কেন শাস্তি পাবেন না?

তিন. ২০১৯ এর শুরুতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি এস এম ইমামুল হক আন্দোলনকারী কয়েকজন শিক্ষার্থীকে 'রাজাকারের বাচ্চা' বলে সম্বোধন করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই রূপাচার্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয় এবং ছুটিতে থাকাকালীন তার ভিসির মেয়াদ শেষ হয়।

চার. অডিও ফাঁস ও ভাইরাল এর এখানেই শেষ নয়। ২০১৬ এর ১৭ মার্চ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুলতানা রাজিয়া হলের তৃতীয় শ্রেণির এক নারী কর্মচারীর সঙ্গে উপাচার্যের গোপন কথোপকথনের কয়েকটি অডিও ফাঁস নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। ওই কর্মচারীকে তিনিই নিয়োগ দিয়েছিলেন। নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে ২০১৬ এর মার্চে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. রফিকুল হক। ২০১১ সালের অগাস্টে উপাচার্য হিসেবে চার বছরের জন্য নিয়োগ পান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের এই কৃষি প্রকৌশলী। এর সঙ্গে যুক্ত হয় তাঁর সময়ে ৩০৭ কর্মচারী নিয়োগ অনিয়মের বিষয়টি।

পাঁচ. একটি জনপ্রিয় পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী– নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) উপাচার্য মো. অহিদুজ্জামান চানের একাডেমিক কার্যক্রমের চেয়ে তাঁর সরকারঘনিষ্ঠতাই বেশি আলোচিত। তাঁর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক অনিয়ম, শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয় ইউজিসি।

গত ২৭ এপ্রিল ইউজিসির তদন্ত কমিটি সন্ত্রাসীদের মহড়ার কারণে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে পারেনি। জানতে চাইলে কমিটির আহ্বায়ক ও ইউজিসির সদস্য মো. আখতার হোসাইন এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু না বলে ওই সময়ে পত্রপত্রিকা দেখার পরামর্শ দেন। জানতে চাইলে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে জানান, কমিটি কমিশনকে জানিয়েছে যে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে পারেনি।

ছয়. ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল আরেক রূপাচার্যের। সেটা ছিল নাচানাচির ভিডিও। সে যাই হোক এই রূপাচার্যের নাম ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ। ভিসি হিসেবে নিয়োগ পাবার অন্যতম শর্তই ছিল নিয়মিত ক্যাম্পাসে উপস্থিত থাকা কিন্ত বছরের বেশিরভাগ সময়েই তিনি ক্যাম্পাসে উপস্থিত থাকতেন না। ২০১৮ সালে ২৯৫ দিনই তিনি ক্যাম্পাসে ছিলেন না। ২০১৭ সালে ১৩১ দিন ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত ছিলেন। এমন অনুপস্থিতির হার গত বছর এবং এই বছরেও অব্যাহত আছে। এছাড়া ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতি, ইউজিসির নির্দেশ অমান্য করে জনবল নিয়োগ, স্বজনপ্রীতি করে একাধিক লোক নিয়োগ, একসাথে অনেক পদ আঁকড়ে রাখা, উন্নয়ন কার্যক্রমে আর্থিক অনিয়মসহ আরও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এমনভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নীরবে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আনোয়ারুল আজিম আরিফ।

একালের রূপাচার্যরা এভাবে তাদের রূপ দেখিয়ে যাচ্ছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি ছিলেন রসায়নবিদ মফিজউদ্দীন আহমদ। ভিসি হবার আগেই তিনি বাড়ির কাজ শুরু করেছিলেন। ভিসি হবার পর তিনি কাজ বন্ধ রাখেন। কারণ এটা নিয়ে বিতর্ক উঠতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৭১ সালে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন এবং প্রবাসে থেকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য অনেক কাজ করেছিলেন। পরে তিনি রাষ্ট্রপতি হন। জাহাঙ্গীরনগরের আরেক ভিসি আমীরুল ইসলাম চৌধুরী অফিসের গাড়ি ব্যবহার করতেন না, আপ্যায়ন ও টেলিফোন বিল নিতেন না বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এমন উদাহরণ আরও আছে। এমন শিক্ষকেরা উপাচার্য ছিলেন। যারা আজ রূপাচার্য হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছেন তাদের কাছ থেকে সম্ভবত আর কিছু দেখার বাকি নেই!