বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যা বিব্রতকর

মো. আসাদুজ্জামান মিয়া
Published : 19 Sept 2019, 09:32 AM
Updated : 19 Sept 2019, 09:32 AM

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ দুই নেতার পদত্যাগ (অব্যাহতি)। যা সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনের সবচেয়ে আলোচিত খবর। এরকমটা যে হতে পারে তা কেউ কল্পনাও করেনি। অনেকটা স্রোতের বিপরীতের ঘটনার মতো। এক সপ্তাহের মধ্যে দায়িত্বের চরম চূড়া থেকে একেবারে সাধারণদের কাতারে। তবে কেন হঠাৎ করে এত কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হলো তা একমাত্র দলের সভানেত্রীই ভালো বলতে পারবেন। কারণ তিনি প্রায় সবই জানেন এবং বোঝেন। হয়তো অনেক সময় কিছু বলেন না, ক্ষমা করে দেন। কিন্তু এবার তিনি তার সিদ্ধান্তে অনড়। কোনো তদবির নয়, কোনো ক্ষমা নয়। তবে উনার এই সিদ্ধান্ত কি শুধুই সিদ্ধান্ত নাকি একটি কঠিন সর্তক বার্তা। তাদের জন্য যারা দলের বড় দায়িত্বে থেকে আওয়ামী লীগের সুনাম বিনষ্ট করছেন কিংবা যারা আওয়ামী লীগের সাইনবোর্ড লাগিয়ে সরকারের বড় বড় চেয়ারে বসে বিভিন্ন অন্যায়-অপকর্ম এবং দুর্নীতির সাথে আপোষ করছেন। তবে উনার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণ হয় যে, যারা দলের বড় দায়িত্বে থেকে কিংবা সরকারের বড় চেয়ারে বসে ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন এবং নিজেকে অসাধারণ ভাবছেন তারা যেকোন সময় সাধারণ হয়ে যেতে পারেন। নেত্রীর এরকম একটা সিদ্ধান্তই তাদের জন্য যথেষ্ট।

যাইহোক ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দুই নেতার পদত্যাগ বা অব্যাহতির বিষয়ে অনেক কিছুই শোনা গেছে যেমনঃ তাদের চাঁদাবাজি, দলের সিনিয়র নেতাদেরকে অসম্মান, মাদক সেবন, ঘুম থেকে দেরীতে ওঠা, সাংগঠনিক কাজে গাফলতি ইত্যাদি। এসবের কতটুকু সত্য বা মিথ্যা জানি না তবে সংগঠনের সর্বোচ্চ নেতৃত্বে থেকে এসব অভিযোগের খবর প্রকাশ সত্যিই অনাকাঙ্খিত। তবে কারণ যাই হোক না কেন, একটা বিষয় খুব খারাপ শোনা গেছে (পত্রপত্রিকায় যা খবর এসেছে) তা হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে ছাত্রলীগ ও উপাচার্যের মধ্যে পারস্পারিক অভিযোগ সম্বলিত কথাবার্তা। অনেকটা কাদা ছোড়াছুড়ির মতো। অভিযোগ আছে, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক নাকি জাবি উপার্চাযের কাছে ক্যাম্পাস উন্নয়ন প্রকল্পের ১,৪৪৫ কোটি টাকার ৪-৬% টাকা চাঁদা দাবি করেছিল। এই অভিযোগের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক দলীয় সভানেত্রী (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী) বরাবর খোলা চিঠি লিখেছেন যেখানে তিনি জাবি উপার্চায ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বলেছেন যে তারা (জাবি উপার্চায ও তার পরিবারের সদস্য) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগকে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা প্রদান করেছেন যাতে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ উন্নয়ন প্রকল্পে বাধা হয়ে না দাঁড়ায় (পরে অবশ্য ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক এটা শোনা কথার ভিত্তিতে বলেছেন বলে মিডিয়াকে জানিয়েছেন)। অপরদিকে জাবি'র উপার্চায এ ব্যাপারে সরকার দলীয় এই ছাত্র সংগঠনটির দিকে সরাসরি চ্যালঞ্জে ছুড়ে দিয়েছেন এবং বলেছেন যে ছাত্রলীগ মিথ্যাচার করেছে, তার বিরুদ্ধে একটি গল্প ফেঁদেছে। আবার এর প্রেক্ষিতে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক জাবি উপার্চাযকে পাল্টা চ্যালঞ্জে ছুড়ে দিয়ে বলেছে যে, জাবি উপার্চায পারলে প্রমাণ করুক যে তারা চাঁদা (৪-৬%) দাবি করেছিল। এসব অভিযোগ, পাল্টা-অভিযোগ, পারস্পারিক চ্যালেঞ্জ ছোড়াছুড়ির খবরাখবর সব ধরনের মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচার হচ্ছে। তবে ঘটনা যাই হোক না কেন পাবলিকলি টাকা পয়সার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে এসব কথাবার্তা খুবই বিব্রতকর শোনায়। ইতিমধ্যে জাবি'র চাঁদা চাওয়া প্রসঙ্গে কিছু ফোঁনালাপ ভাইরাল হয়েছে (জানি না এগুলো এডিটিং করে বানানো কিনা) যেখানে ছাত্রনেতাদের টাকা পয়সার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে নিঃসংকোচে কথা বলতে শোনা গেছে। আবার এসব নিয়ে শিক্ষকের সাথেও আলাপ করেছেন। তাদের এসব কথাবার্তায় অনেক কিছুই বেরিয়ে এসেছে। দেশের প্রথম সারির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই চিত্র আমাদেরকে সত্যিই হতাশ করে। দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালগুলোতেও উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে শত শত কোটি টাকার প্রজেক্ট চলছে। কোথায় কি হচ্ছে বা হবে কে জানে? মিডিয়ায় প্রকাশ পেলেই কেবল আমরা তা জানতে পারি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সুবাদে যতটুকু জেনেছি, ক্যাম্পাসে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ যেসব ঠিকাদাররা পান তারা ক্যাম্পাস ছাত্র সংসদ বা ছাত্রসংগঠনকে ছাত্রদের কল্যাণে কিছু (১% এর মতো) টাকাপয়সা প্রদান করে থাকেন, তবে সেটা পারস্পারিক বোঝাপড়ার মাধম্যেই হয়। এটা নাকি খুব পুরোনো কালচার(!)। এটা নিয়ে সেরকম হৈচৈ হয় না বা যত্রতত্র অতোটা আলোচনা শুনি না। বিশ্ববিদ্যালয়ে টাকা পয়সার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে পাবলিকলি উন্মুক্ত আলোচনা শুনতে সত্যিই খারাপ লাগে। কানে কেমন বাজে। সুশীল থেকে সাধারণ মানুষও এসব শুনে বিব্রত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়েগুলো হলো মুক্ত চিন্তা ও চর্চার শ্রেষ্ঠ স্থান যেখানে ছাত্র-শিক্ষকরা স্ব-স্ব মেধার বিকাশে স্বচেষ্ট থাকেন এবং দেশ-জাতি গঠনে প্রত্যক্ষ পরোক্ষ ভুমিকা রাখেন। যদি বিশ্ববিদ্যালয়েগুলোতে টাকাপয়সার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে এরকম প্র্যাক্টিস (রীতি) চলতে থাকে আর এগুলো এরকম উন্মুক্ত আলোচনায় আসে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার যতটুকু পরিবেশ বর্তমানে যা আছে তাও ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়েগুলো অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে সাধারণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। বিশ্ববিদ্যালয় তথা আমাদের সমস্ত অগ্রযাত্রা ম্লান হয়ে যাবে।

বাস্তবতা হলো, বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে গেলে প্রশাসন ও ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে একটা সমন্বয় থাকা দরকার। যা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে সাহায্য করে। তবে এই সমন্বয়ের নামে এখন অনেক কিছুই হয়। এটাকে কাজে লাগিয়ে যে যেভাবে পারছে সুবিধা নিয়ে নিচ্ছে। যেনো বিশ্ববিদ্যালয় চুলোয় যাক। আর এসব আমরা অবলীলায় মেনে নিচ্ছি, নিয়েছি এবং হয়তো আরো নেবো। মনে রাখা প্রয়োজন, ছাত্রনেতারা যত ক্ষমতাধরই হোক না কেনো তাদের বড় পরিচয় তারা ছাত্র। তাদের ভুল-ত্রুটি শুধরে দেওয়া শিক্ষকদের দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে (যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের শিক্ষকদের নৈতিকতাই এখন প্রশ্নবিদ্ধ)। প্রত্যাশা করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নে ছাত্রসংগঠনগুলো গঠনমূলক ভূমিকা রাখবে, নিজেরা কোনো নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হবে না বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো অনিয়ম-অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার থাকবে এবং প্রয়োজনে শক্ত প্রতিবাদ জানাবে। কারণ তারাই পারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সকল অন্যায়-অনিয়ম রুখে দিতে। তাদের চিন্তা-চেতনা যেন সুদূরপ্রসারী হয়। তাদের রাজনীতিতে যেন ভিশন থাকে। আমরা যেন তাদেরকে নিয়ে গর্ববোধ করতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিব্রতকর কোনো পরিস্থিতির কারণ যেন অন্তত তারা না হয়।