অধঃপতন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে

বিনয় দত্ত
Published : 18 Sept 2019, 09:42 AM
Updated : 18 Sept 2019, 09:42 AM

১.

আবুল মনসুর আহমদের 'হুযুর কেবলা' গল্পটা অনেকেরই জানা। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর 'লালশালু' উপন্যাসটি এখনো পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল মাইলফলক। আচ্ছা, আহমদ ছফা'র 'সূর্য তুমি সাথী' উপন্যাসটি সবাই নিশ্চয় পড়েছেন। হঠাৎ এই গল্প বা উপন্যাসের কথা কেন বললাম? কারণ আমি যে বিষয় নিয়ে লিখতে বসেছি সেই বিষয় সম্পর্কে অনেক আগে বলে গেছেন আবুল মনসুর আহমদ, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ এবং আহমদ ছফাসহ অন্যান্য সাহিত্যিকরা। এই তিনটি গল্প বা উপন্যাস সবারই জানা। এইসব গল্প-উপন্যাসের চরিত্রের কথা আমাদের সবারই মনে আছে।

আচ্ছা,আপনাদের নিশ্চয়ই সিলেটের মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের ছাতকছড়া গ্রামের নূরজাহানের কথামনে আছে? যে নূরজাহানকে জনসন্মুখে ১০১টি পাথর ছুঁড়ে নির্যাতন করা হয়েছিল। তখনকিন্তু সমাজে প্রতিবাদ হয়নি। দিনাজপুরের ইয়াসমিনের কথা মনে আছে? পুলিশের হেফাজতেইয়াসমিনকে নির্যাতন ও ধর্ষণ করা হয়েছিল। চট্টগ্রামের রাউজান থানার সীমা চৌধুরীরকথা মনে আছে? যে সীমা চৌধুরী পুলিশি হেফাজতে ধর্ষণ করা হয়। ওইসময়ও প্রতিবাদ হয়নি।ওদের কথা মনে নেই তো? কোনো অসুবিধা নেই।

আচ্ছা, তাসলিমা বেগম রেনুর কথা মনে আছে? যে রেনুকে উত্তর বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে ছেলেধরা গুজব ছড়িয়ে দিনে-দুপুরে গণপিটুনিতে মেরে ফেলা হয়েছে। রেনুর দুই শিশুসন্তান মাহি ও তুবা এখনো তাদের মা'কে খুঁজে ফেরে। রেনুর হত্যাকাণ্ডটা বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য ঘটনা। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর এইরকম বীভৎস ঘটনা আর ঘটেনি। একটা জলজ্যান্ত নারীকে পিটিয়ে মেরে ফেলল! আমি কোনোভাবেই এই ঘটনা মাথা থেকে সরাতে পারছি না। আমার বার বার মনে হয়েছে, ওইদিন ওই জায়গায় একটি লোকও কি ছিল না, যিনি কিনা রেনুকে প্রাণে বাঁচাতে পারতো। হয়তো ছিল না। ছিল না বলেই রেনুকে প্রাণ দিতে হয়েছে। কতটা অধঃপতন এই সমাজে নেমেছে! কতটা মূল্যবোধ হারিয়েছি আমরা, একজন নারীকে পিটিয়ে মেরে ফেললাম। যে বা যারা রেনুকে মেরেছেন, তারা নিজেদের বাচ্চার হাত ধরে ওইদিন বাসায় ফিরেছেন। রাতে ঘুম হয়েছে আপনাদের?

রেনুরগলায় জোর ছিল না। রেনুকে যারা অপবাদ দিয়েছিল তাদের গলায় জোর ছিল। কঠিন জোর। রেনুরপ্রতিবাদ, প্রতিরোধ করার মত শক্তি ছিল না। কিন্তু রেনুকে যারা মেরেছিল তাদের মধ্যেক্রোধ ছিল, হিংসা ছিল, ভয়ানক আক্রোশ ছিল। কোথা থেকে আসে এতো ক্রোধ, হিংসা, ঘৃণা?তবে কি সত্যি আমরা আরবের মতো বর্বর জাতিতে পরিণত হয়ে যাচ্ছি? তবে কি আমাদের মধ্যেআর কোনো মূল্যবোধ অবশিষ্ট থাকলো না?

রেনুর মতো একইরকম জোর কম ছিল এমদাদের। আবুল মনসুর আহমদের 'হুযুর কেবলা' গল্পের চরিত্র এমদাদ। অপরদিকে পীরের ছিল অসম্ভব শক্তি। পীরের পরনারীর প্রতি লোভ হয়েছিল। সেই লোভ, লালসার বলি হল, কলিমন। কলিমন দেখতে-শুনতে ভালো ছিল। সেই কলিমনকে জোর করে তালাক দিয়ে অন্যত্র বিয়ে করতে বাধ্য করল এই পীর সাহেব। পীর সাহেবের বিরুদ্ধে কারো কিছু বলার ক্ষমতা নেই, কারণ তিনি পীর। মোল্লাতন্ত্র ও লেবাসধারী ধর্মব্যবসায়ীদের চরিত্র তুলে ধরা এবং নারীদের ইচ্ছেমতো বলি করার অসাধারণ উপাখ্যান হল আবুল মনসুর আহমদের 'হুযুর কেবলা' গল্পটি।

'লালশালু' বা 'সূর্য তুমি সাথী' এই দুটি উপন্যাসে আরো বিশদভাবে তা তুলে ধরা হয়েছে। এইখানে ধর্মকে কেন্দ্র করে একশ্রেণির মানুষের বাজে মনোবাসনা পূরণ করার নির্মোহ আখ্যান ফুটে উঠেছে। এইসব গল্প বা উপন্যাসের কাহিনী কাল্পনিক হলেও তা আমাদের মধ্য থেকে উঠে এসেছে। এইসব চরিত্রে আমরা নিজেরাই উঠে আসছি প্রতিনিয়ত।

সমাজেকোনো ঘটনা বা অঘটন বা কোনো ইস্যু নিয়ে আলোচনা শুরু হলে আমি লক্ষ্য করেছি একশ্রেণিরমানুষ সবসময় নারীদের দোষ দেয়া শুরু করেন বা তাদের দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ আঙুল তুলেন।বিষয়টা অনেক বড় আলোচনার। তবে আমি সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করছি।

ওয়াজমাহফিল নিয়ে সরকারের একটা নজরদারি আছে। এইটা আমরা সবাই জানি। আর এই কারণেইনির্বাচনের সময় ওয়াজ মাহফিল বন্ধ করা হয়েছিল। কারণ ওয়াজ মাহফিলে উসকানীমূলকবক্তব্য ছড়াতে পারে বা ওয়াজে বিদ্রুপাত্মক তীর্যক কথা বেশি বলা হয়। সবচেয়ে অবাককরার মতো বিষয়, ওয়াজে নারীদের কটাক্ষ করে সবচেয়ে বেশি কথা বলা হয়। এই পুরো মতামতটাআমার নয়, বেসরকারি একটি টেলিভিশন এবং নিউজ পোর্টালের প্রতিবেদনে এইটা সরাসরি উঠেআসে।

যেহেতু ধর্মীয় বক্তারা সমাজে সম্মানীয় এবং তাদের গ্রহণযোগ্যতা সাধারণ মানুষের কাছে বেশি। সবার কাছে না থাকলেও অন্তত যারা ওয়াজ শোনেন তাদের কাছে বেশি। তাই তারা যখন ঘন ঘন মানুষকে বলে যে, নারীরা খারাপ, একজন নারী এই কাজ করেছে অতএব সে ঘৃণিত, একজন নারী রাতে বাসায় ফিরে সে অস্পৃশ্য, একজন নারী এই পোশাক পরে তাই সে খারাপ ইত্যাদি। তখন স্বাভাবিকভাবেই যেকোনো অল্পজ্ঞানসম্পন্ন মানুষেরই নারীর প্রতি আক্রোশ বেড়ে যায়। এইটা একটা মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। এই আক্রোশের পরিমাণটা এতো প্রকট আকার ধারণ করে যে, যেকোনো মুহূর্তে তারা নারীদের উপর আক্রোশ মিটাতে হামলে পড়ে। শুধু যে হামলে পড়ে তা নয়, নিজেদের রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা সবই উগরে দেয় তখন। এজন্য আমাদের সমাজব্যবস্থা দায়ী, দায়ী আমাদের রাজনৈতিক অস্থিরতা, দায়ী আমাদের প্রশাসনসহ গোটা শিক্ষাব্যবস্থা।

২.

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নোয়াখালীর সুবর্ণচরের ওই বীভৎস ধর্ষণের কথা আমাদের সবারই মনে আছে। সেই ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনের কি বিচার হয়েছে? ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে মারার প্রধান ষড়যন্ত্রকারী ছিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা। তার কি বিচার আদৌ হবে? বা ওসি মোয়াজ্জেমকে যেভাবে বাঁচানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা গিয়েছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। বিচার নিয়ে জনমনে সংশয় থাকার কারণে কোমলমতি শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক মহিলা পর্যন্ত ধর্ষিত হচ্ছেন।

'শিশু অধিকার সংরক্ষণে ২০১৮-এর পরিস্থিতি' শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে সারা দেশে ২৮প্রতিবন্ধী শিশুসহ ৫৭১ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৯৪ শিশু গণধর্ষণেরশিকার হয়েছে। ৬ শিশু ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে। এদিকে একই বছরে ৮১২ শিশু বিভিন্নধরনের যৌন নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে।

সম্প্রতিঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আরো ভয়ানক। যে মাদ্রাসায় অভিভাবকরা শিশুদের পড়াশোনার জন্য পাঠানসেই মাদ্রাসায় নিরাপদভাবে শিশুদের ধর্ষণ করছে মাদ্রাসার শিক্ষক। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লারবায়তুল হুদা ক্যাডেট মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মাওলানা আল-আমিন ১২ শিশু ছাত্রীকেধর্ষণের কথা স্বীকার করেছে। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আবুলখায়ের বেলালী ৮ শিশুকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছে। রাজধানীর দক্ষিণখানের একটিমসজিদের ইমাম ইদ্রিস আহম্মেদ ৫ নারীকে ধর্ষণ এবং ১০ থেকে ১২ ছাত্রকে বলাৎকার করারকথা স্বীকার করেছে। কি ভয়ানক এই ঘটনাগুলো। এগুলোর বিচার না হলে সমাজে ধর্ষণ আরোবাড়বে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালের জানুয়ারি-জুন মাস পর্যন্ত ৬৩০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। শুধু যে নারী শিশু ধর্ষিত হচ্ছে তা নয়। বেসরকারি একটি নিউজ পোর্টালের গবেষণা থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত ১০ জন ছেলেশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২০১৮ সালে ছেলেশিশু ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ১৩। এই যে বিচারহীনতা। এইসব বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে সাধারণ জনগণের আইনের প্রতি আস্থা কমে গিয়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আমাদের অবশ্যই ফিরে আসা উচিত।

৩.

বিচারহীনতা, ভয়ানক অর্থনৈতিক বৈষম্যের পর দুর্নীতি ডালপালা ছড়িয়ে সব গ্রাস করে নিচ্ছে। দুর্নীতি এখন রন্ধ্রে রন্ধ্রে। পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের দুর্নীতির ঘটনা এখন সবারই জানা। এই প্রকল্পের আবাসিক ভবনের জন্য ১৬৯ কোটি টাকার কেনাকাটায় পদে পদে দুর্নীতি হয়েছে। সকল গণমাধ্যম এইসব দুর্নীতির কথা ঢালাওভাবে প্রচার করেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) তথ্যানুয়ায়ী, দুর্নীতির ধারণা সূচকে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়েছে।

ছোট একটি দেশে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের বসতি। তাতে যদি এইভাবে দুর্নীতি হয় তাহলে মানুষ কোথায় যাবে? এই ১৬৯ কোটি টাকা কার? সরকারের? না, এই টাকা জনগণের। গত দশবছর ধরে বর্তমান সরকারই ক্ষমতায় আছে। এক্ষেত্রে কারো উপর দোষারোপ করার কোনো সুযোগ নেই। এই দুর্নীতির দায় বর্তমান সরকারের উপর বর্তায়।

খাদ্যেভেজাল এবং নকল ওষুধে বাজার এখন সয়লাব। কার্বাইড, ফরমালিন, সিসা, টেক্সটাইলকালার সহ কি নেই আমাদের খাবারের মধ্যে! উপাদানগুলো শুনে মনে হচ্ছে এইসব বুঝিখাদ্যকে সঠিক পুষ্টিগুণ দেয়। আর দুধে অ্যান্টিবায়োটিক, ডিটারজেন্ট, সিসা মেশানোর কথা বাদই দিলাম। গবেষণায় দুধেভেজালের তথ্য প্রকাশের জন্য অধ্যাপক আ ব ম ফারুকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাওআমরা জেনেছি গণমাধ্যমের বদৌলতে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০০ সালে দেশে প্রথমবার ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়। ওই বছর ৫ হাজার ৫৫১ জন আক্রান্ত এবং ৯৩ জনের মৃত্যু হয়। তখন ঢাকাকেন্দ্রিক ছিল এ রোগটি। এরপর সারা দেশে ছড়িয়েছে। ২০১৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ৮১ হাজারেরও বেশি রোগী। তাদের দুর্দশা সহ্য করা যাচ্ছে না। হাসপাতালে এখন বেড পাওয়া যাচ্ছে না চিকিৎসার জন্য। ভয়ানক এই পরিস্থিত তৈরির কারণ কি?

মশা মারার জন্য ৫০ কোটি টাকার বেশি খরচ করেছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। এর মধ্যে উত্তর সিটি কর্পোরেশন ২৩ কোটি এবং দক্ষিণ সিটি সাড়ে ২৮ কোটি টাকা খরচ করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মশা কমেনি। বরং মশার কারণে ভয়াবহ সংকটে পড়েছে ঢাকাবাসী। মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু জ্বরে একের পর এক ঘটছে প্রাণহানি। এরমধ্যে মশার ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সবমহলে। এই তথ্য শুধু রাজধানী ঢাকার। রাজধানীতেই এই অবস্থা তাহলে গোটা দেশের অবস্থা কি? যেখানে আমরা দুই কোটি মানুষকে ডেঙ্গুর হাত থেকে মুক্তি দিতে পারছি না সেখানে কিভাবে মানুষের আস্থা অর্জন করবো। শুধু উন্নয়নের গল্প বলে কি জনগণের মন ভোলানো যাবে?