কীভাবে পারে বাংলাদেশ?

শহিদ শেখ
Published : 17 Sept 2019, 02:00 PM
Updated : 17 Sept 2019, 02:00 PM

যখন সুপরিকল্পিতঅর্থনৈতিক পরিকল্পনা কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনে ব্যর্থ হয়, তখন পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকরাপ্রায়ই একটি বুলিসর্বস্ব তুলনা করেন: "বাংলাদেশ পারলে, আমরা কেন পারব না?" সম্প্রতিকর আহরণ অভিযানে হতাশ হয়ে অর্থ উপদেষ্টাও যে একইরকম তুলনা করেছেন, তাতে অবাক হওয়ারকিছু নেই।

সাদা চোখে প্রবৃদ্ধিরএ বৈষম্য ধাঁধাঁর মতো। কারণ, উভয় দেশের উন্নয়ন অগ্রাধিকার ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার চর্চাএকই রকম। দুটি দেশই জ্বালানি ঘাটতিতে এবং অশিল্পোন্নত অবস্থায় রয়েছে। শাসন ব্যবস্থারদিক থেকে দেখলে উভয় দেশেই দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার অভিজ্ঞতা, রাজনীতিতেচরম মেরুকরণ, সরকারি খাতে দুর্নীতি এবং স্বজনতোষী পুঁজিবাদ (ক্রোনি ক্যাপিটালিজম) আছে।

তাছাড়া স্বল্প করআহরণের হার এবং রাষ্ট্রীয় পরিষেবা সরবরাহের অপ্রতুলতার দিক থেকেও দুই দেশের মধ্যেসামঞ্জস্য আছে। তবুও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে অনেক দূর এগিয়েছে।

এটা কীভাবে সম্ভবহলো? কিছু পার্থক্যতো আছেই, যেমন বিচক্ষণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা। জিডিপির ১৪ শতাংশবিদেশি ঋণ বাংলাদেশকে নিজের আয় থেকে উন্নয়ন অর্থায়নের বড় পরিসর তৈরি করে দেয়। পাশাপাশি৪০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয় বাণিজ্য ভারসাম্যকে নিয়ন্ত্রণযোগ্য রেখেছে,  যার ফলে মুদ্রার স্থায়িত্ব বেড়েছে এবং দেশি-বিদেশিবিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

মানবসম্পদ উন্নয়নেঅগ্রাধিকার আরেকটি দিক।শিক্ষার কথাই ধরা যাক, এ খাতে বাজেটের ১৮ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়াহয়, যার প্রায় অর্ধেক পায় প্রাথমিক শিক্ষা। সরকার প্রতিবছর স্কুল শিক্ষার্থীদের মধ্যেবিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক (এবছর ৩৫ কোটি) বিতরণ করে। বেশিরভাগ সরকারি বিদ্যালয়গুলিতেসহ-শিক্ষা চালু, তারা ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক চর্চায় জোর দিয়ে থাকে। ফলে প্রতিবছর বিশ্ববাজারেরজন্য উপযুক্ত কর্মী বাহিনী তৈরিতে প্রয়োজনীয় বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ এবং লিঙ্গও ধর্মসহিষ্ণু একঝাঁক তরুণের উত্থান ঘটে।

মাও জে দং বলেছিলেন,'দিগন্তের অর্ধেক নারীদের হাতে'। বাংলাদেশে তার বাণীই প্রতিধ্বনিত হয়েছে। সেখানে পোশাকশিল্পে কাজের সুযোগ পেয়েছে লাখ লাখ নারী, যাদের অনেকেই পারিবারের একমাত্র উপার্জনকারী।তারা সমাজে প্রচলিত লৈঙ্গিক ভূমিকাকে উলটপালট করে দিয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলি নারীদেরঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাক্ষরতা অর্জনের শর্ত দিয়েছে; অনেক কোম্পানি গ্রামে গ্রাহক সেবাদিতে এবং কৃষিভিত্তিক জ্ঞান প্রচারে সাইকেল ও মটরসাইকেল চালক নারীদের নিয়োগ করছে। এসবেরফলে লিঙ্গ বৈষম্যহীন কাজের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।

এই সামাজিক পরিবর্তনগুলিবাংলাদেশের জন্ম নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টায় (পাকিস্তানের ২০ কোটি ৫০ লাখের তুলনায় ১৬কোটি) ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এর ফলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসেছে এবং গণটিকা কর্মসূচিরমতো সামাজিক খাতে মাথাপিছু ব্যয়ের সুযোগ বেড়েছে। তবে এতো উদ্যোগও প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হতে পারতো না, যদি বাংলাদেশ তার প্রতিষ্ঠাতার 'ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির' প্রতিশ্রুতিথেকে বিচ্যুত হতো। অসাংবিধানিক ব্যবস্থার প্রচারকারী দলগুলিকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতারসুযোগ বন্ধ করা হয়েছে এবং রাজনৈতিক মঞ্চকে ব্যবহার করে সামাজিক ও মানবিক উন্নয়ন কর্মসূচিও বৈদেশিক নীতির বিরুদ্ধে ধর্মীয় গোঁড়ামির প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এর ফলে জাতীয় বিষয়গুলিতেজনসাধারণের মধ্যে আধ্যাত্মিকতার পরিবর্তে একটি নাগরিক মনোভঙ্গি সৃষ্টি হয়েছে।

সরকারের সক্রিয়পরিচর্যায় বেড়ে উঠা বৈষম্যহীন শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংহতির সংমিশ্রণ দক্ষিণ এশিয়ারদেশগুলির মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য সবচেয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক দেশ হিসেবে বাংলাদেশকেপ্রতিষ্ঠা করেছে।

পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটেদেখলে ধর্মীয় মৌলবাদীদের রাজনীতে জায়গা না দেওয়ার গুরুত্ব সহজেই বুঝা যায়, যেখানেসরকার প্রায়ই সংস্কারের বিরুদ্ধে উগ্রবাদকে ব্যবহারকারী এসব ধর্মীয় গোষ্ঠীর দাবিরমুখে পিছু হটে। উপরন্তু বৈরি বৈদেশিক নীতি অনুসরণের জন্য তাদের চাপ পাকিস্তানে বিনিয়োগপ্রবাহ ও দেশের সাংবিধানিক-সামাজিক ভিত্তির স্থায়িত্ব রক্ষায় অনিশ্চয়তা তৈরি করে।

২০০৯ সেনাবাহিনীক্ষমতা নিতে রাজি না হওয়ায় যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে তা বাংলাদেশের সাম্প্রতিকঅর্থনৈতিক অগ্রগতির পেছনে অবদান রেখেছে বলে অনেকে মনে করেন।কিন্তু তা ঠিক না। এই ভিত্তিনিহিত পুরনো প্রশাসনিক স্থায়িত্বে, যেটা ১৯৯০-এর দশকে দেখা গেছে। তখন রাজনৈতিক অস্থিরতারমধ্যেও দেশের জন্য উপযোগী সামাজিক, অর্থনৈতিক ও বৈদেশিক নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে ক্ষমতাকেন্দ্রগুলির অবস্থান ছিল অভিন্ন।

অবশ্যই রাজনৈতিকমেরুকরণ হ্রাসের লক্ষ্যে ২০০৭ সালে একটি অসাংবিধানিক হস্তক্ষেপের অভিজ্ঞতা হয়েছিল বাংলাদেশের।তবে সে লক্ষ্য কার্যকর না হলেও তা দেশের জন্য দুটি সন্ধিক্ষণ তৈরি করে।

এক. নোবেল বিজয়ীরনেতৃত্বে একটি টেকনোক্র্যাট সরকার বসানোর প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে পুরো রাজনৈতিক মহলেরঐক্যবদ্ধ অবস্থান। দুই. এরপর পদ্মাসেতু প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংক ঋণের প্রতিশ্রুতিপ্রত্যাহার করে নিলে দেশীয়ভাবে তহবিল জোগানের উদ্যোগ জাতীয় আত্মবিশ্বাস এবং গণতান্ত্রিক সংস্থাগুলিতেমানুষের আস্থা বাড়িয়ে তোলে।

বাংলাদেশ রোহিঙ্গাশরণার্থীদের আগমনকে প্যান-ইসলামিক ইস্যু হিসাবে কাজে লাগাতে দেয়নি; চরমপন্থিরা যাতেদেশের ভেতরে এবং সীমান্ত পেরিয়ে উগ্রবাদী কর্মকাণ্ড চালাতে না পারে তার জন্য আগেভাগেইবেসামরিক বাহিনী মোতায়েন করেছে। এরফলে গুরুতর অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা থেকে রক্ষাহয়েছে।উপরন্তু বাংলাদেশ সরকার বিদেশি বেসরকারি বিনিয়োগ রক্ষায় বাড়তি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাওনিয়েছে।

'বাংলাদেশ কেন পারে'তা বিশ্লেষণ করতে গেলেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর প্রচেষ্টার সমর্থনে রাজনৈতিক পদক্ষেপেরগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ধরা পড়বে। দ্রুত কোনও সমাধান নেই। বরং বহুমুখী কর্মতৎপরতা; মৌলবাদও জঙ্গিবাদ নির্মূল; ধর্মীয় উদারতা ও সাংস্কৃতিক সহিষ্ণুতা; নির্বাচিত সরকারের অর্থনৈতিকও বৈদেশিক নীতির ধারাবাহিকতা; নারীদের বৃহৎ প্রতিনিধিত্বসহ ক্রমবর্ধমান শিক্ষিত কর্মীবাহিনী; অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও প্রতিবেশিদের সঙ্গে বিদ্বেষমুক্ত সম্পর্কের মধ্য দিয়েইএটা অর্জন সম্ভব।এ ধরনের পদক্ষেপ দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগের জন্য স্থিতিশীল ও আকর্ষণীয়পরিবেশ তৈরি করে, যা থেকে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়।

আর্নল্ড টয়োনবি জাতিরাষ্ট্রগুলোকে দুভাগে ভাগ করেছেন: একদিকে অতীতে অনুপ্রেরণাসন্ধানী, অন্যদিকে ভবিষ্যতমুখী। পাকিস্তানে দুই টাকার মুদ্রায় সপ্তদশ শতাব্দীর বাদশাহী মসজিদের চিত্র আঁকা, অন্যদিকে বাংলাদেশের দুই টাকার মুদ্রায় আছে বই হাতে ছেলে-মেয়ের ছবি, দুটি চিত্র দুটি দেশের ভিন্নমুখী অর্থনৈতিক পথ নির্দেশ করে।

(নিবন্ধটি পাকিস্তানের দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনালে প্রকাশিত হয়েছে। লেখক পাকিস্তানের উন্নয়ন পরামর্শক। তিনি সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বাংলাদেশের সামাজিক দ্রুত রূপান্তরকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন।)

অনুবাদ: হুসাইন আহমদ