তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্য ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উদ্দেশ্যমূলক প্রচার

স্বদেশ রায়
Published : 10 Sept 2019, 01:59 PM
Updated : 10 Sept 2019, 01:59 PM

একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক সময় জামায়াতে ইসলামী বা দেশ বিরোধীদের প্রচারণার সুরে সুর মিলিয়ে অনেকেই একই প্রচারণা চালিয়ে যায়। কয়েকদিন যাবৎ লক্ষ্য করছি, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদের একটি বক্তব্য নিয়ে বেশ ব্যঙ্গ বিদ্রুপ হচ্ছে। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দিয়েছিল বিএনপি। এটা নিয়ে নানান ধরনের ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করা হচ্ছে। সকলের বক্তব্য ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি কীভাবে পাসপোর্ট দেয়? যারা এই ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করছে তার অধিকাংশই তরুণ, এবং অনেকেরই ফেইসবুক প্রোফাইলে গেলে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় বোঝা যায়, তারা দেশ বিরোধী বা কেউ কেই বিএনপিসহ অন্য দলের সমর্থক। তাতে করে এটা তাদের উদ্দেশ্যমূলক প্রচার। এ ধরনের প্রচারণা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হচ্ছে দীর্ঘদিন যাবত নানান জনের বিরুদ্ধে, এমনকি অরাজনৈতিক ব্যক্তির বিরুদ্ধেও। তাই এটার যে আদৌ কোন গুরুত্ব আছে প্রথমে এমনটি মনে হয়নি। এর ভেতর একজন সাবেক জাসদ নেতা ও উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি আমার ইনবক্সে তথ্যমন্ত্রীর একটি বিকৃত ছবি পাঠান। সেখানে দেখা যাচ্ছে তিনি গাঁজায় দম দিয়ে এ কথা বলছেন। পাশাপাশি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ শিক্ষকও একই ছবিটি পাঠায়।
তরুণ ওই শিক্ষককে আধুনিক ও মুক্ত মনের হিসেবে জানি। সেও আমাকে অগ্রজের মত সম্মান করে।

তার কাছ থেকে এটা পাবার পরে তাকে ফোন করে সে কেন এটা পাঠালো জিজ্ঞেস করতেই সে উত্তর দেয়, দাদা মন্ত্রীদের এত দায়িত্বহীন কথাবার্তা বললে হয়? আমি তাকে বলি, দেখ, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ তরুণ। তাই অধিক বয়সের কারণে, তিনি ভুলে গিয়ে বা ভুলক্রমে কোন কথা বলবেন, এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। দুই নম্বর কথা হচ্ছে তিনি শিক্ষিত ও স্মার্ট, তিনি কোন ভুল তথ্য বলবেন, এমনও হঠাৎ করে তুমি ভাবলে কীভাবে? তাছাড়া তুমি যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তিনিও বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। ড. হাছান মাহমুদ সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো শুরু করার পরে দুজন প্রবীণ ও জ্ঞানী রাজনীতিককের সঙ্গে নানান আলাপ প্রসঙ্গে তার কথা ওঠে। এ দুজন হলেন মতিয়া চৌধুরী ও আবুল মাল আব্দুল মুহিত। আবুল মাল আব্দুল মুহিতের বইগুলো পড়ে তোমরা নিশ্চয়ই তাঁর জ্ঞানের পরিধি কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারো। আর মতিয়া চৌধুরীকে তোমরা একজন সফল রাজনীতিক, মন্ত্রী ও অগ্নিকন্যা হিসেবে জানো। তবে জেনে রেখ, সাহিত্যসহ সমাজের বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর পড়াশোনার পরিমান বিস্তীর্ণ। বিশেষ করে এই দুই জন সমাজ ও সমাজের পরিবর্তনটা অনেক বেশি বোঝেন। এঁরা দুজনই ড. হাছান মাহমুদের বর্তমান এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়া বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, এটা আমাদের রাজনীতিতেও সমাজে একটা শুভ পরিবর্তন। কারণ, রাজনীতিবিদরা যখন তাদের রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা নিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে যান তখন শিক্ষার্থীরা যে বিষয়টি তাদের কাছ থেকে জানতে পারে সেটাই 'রিয়েল লাইফ' শিক্ষা। যেমন একজন কর্মরত সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিষয়ের শিক্ষার্থীকে যে কথাগুলো বলবেন সেটা তার সাংবাদিকতা জীবনে যত কাজে লাগবে অন্যরা কিন্তু তেমনটি দিতে পারবেন না। যেমন- এমবিএ ক্লাসে এসে যখন সফল উদ্যোক্তারা তাদের 'রিয়েল লাইফ' অভিজ্ঞতা জানান সেটাই এমবিএর শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনে সব থেকে বেশি কাজে আসে।
উপরের কথাগুলো ওই শিক্ষককে বলার পরেও সে বলে, দাদা তারপরেও তো এটা সত্য, তথ্যমন্ত্রী এটা ভুল বলেছেন? বুঝতে পারি, তরুণ এই শিক্ষকটির অনেক বেশি তথ্য-গ্যাপ রয়েছে। আর অনেকেই ভুলে গেছেন কবে প্রথম কার আমলে রোহিঙ্গারা স্বাধীন বাংলাদেশে আসে এবং তখন কী ঘটেছিল। পাশাপাশি এটাও বুঝতে পারি, বর্তমান প্রজম্মের কাছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আদ্যোপান্ত ইতিহাস না থাকাতে এই প্রচারণা চালানো সম্ভব হচ্ছে। তাই তরুণ ওই শিক্ষকের ভুল ভাঙ্গানোর জন্য তাকে প্রশ্ন করি, তুমি কী জানো বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা কবে প্রথম এসেছিল? সে বলে, সঠিক বলতে পারবো না। তখন তাকে বলি, রোহিঙ্গারা কিছুটা অত্যাচারিত হয়ে- কিছুটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতে ইসলামীর প্ররোচনায় ও জিয়াউর রহমানের সহযোগিতায় ১৯৭৮ সালে প্রথম শরণার্থী হিসেবে এখানে আসে। দুই লাখের কিছু বেশি রোহিঙ্গা আসে। এখন প্রশ্ন করতে পারো জামায়াতে ইসলামীর প্ররোচনায় কীভাবে এসেছিল? ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামীর মত এই রোহিঙ্গারাও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী ছিল। তারা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। তারও একটা ইতিহাস আছে। ১৯৪৭ সালে তারা পাকিস্তানের অংশ হতে চেয়েছিল। তাই ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে নির্যাতিত হয়ে বা মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্যে যারা আরাকানে আশ্রয় নিতে গেছে তাদের অনেককে ধরে এনে বাংলাদেশে রাজকার-আলবদরদের হাতে তুলে দেয় এই রোহিঙ্গারা। আবার ১৬ ডিসেম্বরের পরে এই রাজাকার আলবদরদের অনেককেই তারা আশ্রয় দিয়ে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করে। তাছাড়া তাদের যে জঙ্গি সংগঠন আরসা- এর সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর রয়েছে গভীর যোগাযোগ। জিয়ার আমলে জামায়াতে ইসলামী কক্সবাজারসহ এই এলাকার ভূরাজনীতিতে পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেয়। অন্যদিকে জিয়াউর রহমানও মনে করেন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও উন্নত হবে। তাই জিয়াউর রহমান বর্ডার খুলে দেন।

জিয়াউর রহমানের আমলে অর্থাৎ ১৯৭৮ সালে ২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। জিয়াউর রহমান যেহেতু কোনও মানবিক কারণে তাদেরকে আশ্রয় দেননি , শুধু তার নিজের রাষ্ট্রক্ষমতার স্বার্থে আশ্রয় দিয়েছিলেন, তাই তিনি তাদের জন্যে কোন সত্যিকার ক্যাম্প সেখানে তৈরি করেননি। বর্তমান রোহিঙ্গাদের যেভাবে সব ধরনের সুবিধা দিয়ে- সত্যি অর্থে ভালোভাবে রাখা হয়েছে এর বিন্দুমাত্র জিয়াউর রহমান করেননি। শুধু তাই নয়, আমাদের ১৯৭১ সালে শরণার্থী ক্যাম্পে থাকার অভিজ্ঞতা আছে। বিশ্বের অন্যান্য শরনার্থী ক্যাম্পও দেখার অভিজ্ঞতা আছে। সে তুলনায় সত্যি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা সঠিক, রোহিঙ্গারা আরামে আছে। জিয়াউর রহমান তাদের জন্যে এগুলো কিছুই করেননি। তাই ওই সময়ে ২০ হাজার রোহিঙ্গা অপুষ্টি ও ডায়রিয়াতে মারা যায়। তাছাড়া ওই রোহিঙ্গাদের মূল নিয়ন্ত্রণ ছিল তখন জামায়াত নেতা যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর হাতে। এই যুদ্ধাপরাধীর অবৈধ অর্থর উৎসের একটি সে সময়ে সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ সৌদি আরব ভিত্তিক জঙ্গি অর্থদাতা সংগঠন রাবেতা আল ইসলামের তখন সেই ছিল ওখানকার প্রধান। এই যুদ্ধাপরাধী তখন ওই রোহিঙ্গাদের দেখিয়ে সৌদি আরব থেকে প্রচুর অর্থ আনে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের জন্যে ব্যয় করে তার সামান্যই বরং রোহিঙ্গাদের সে কক্সবাজার এলাকায় জমি কিনতে ও বাংলাদেশের ভোটার হতে সর্বোপরি বাংলাদেশের পাসপোর্ট দিতে সব ধরনের সহায়তা দেয়। এই সময়ে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের পাসপোর্ট পায়। পাশাপাশি জিয়াউর রহমানের সরকারও সেটার সুবিধা দেয়। তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সেই কথাই উল্লেখ করেছেন এবং তিনি সত্য তথ্যই জাতিকে দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ওই শিক্ষককে এই কথাগুলো বলার পরে সে বলে, তার এ ইতিহাস জানা ছিল না।

তখন তার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে আরো বলি, বর্তমানে খেয়াল করে দেখ, রোহিঙ্গাদের নেতা হিসেবে যে ব্যক্তিটি ট্রাম্পের কাছে গেল, পরবর্তীতে বেআইনি সমাবেশ করলো, এই ব্যক্তিটিও কিন্তু আগে আসা রোহিঙ্গাদের একজন। ২০১৭ সালের রোহিঙ্গাদের কেউ নয়। তাছাড়া ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে যে রোহিঙ্গারা এসেছিল এবং ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার সময়ে যে রোহিঙ্গারা এসেছিল সে সময়ের সঙ্গে ২০১৭তে আসা রোহিঙ্গা ম্যানেজমেন্টের পার্থক্য হলো, শেখ হাসিনা সরকার এই রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সর্বোচ্চ মানবিক ব্যবহার করছে। তাদের বেঁচে থাকার, সুস্থ থাকার সব ধরনের সহায়তা যেমন দিচ্ছে, পাশাপাশি এই সরকার তাদেরকে ক্যাম্প পিপল হিসেবে রাখার জন্য সর্বোচ্চ নিরাপত্তা-বেষ্টনীতে রেখেছে। অন্যদিকে, ১৯৭৮ সালে যে রোহিঙ্গারা আসে জিয়াউর রহমান সরকার তাদের কোন নিরাপত্তা বেষ্টনীতে রাখেনি। বরং জামায়াত নেতা , যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলী ও সরকারী কর্মচারী হলেও আরেক জামায়াত কর্মী তৎকালীন চট্টগ্রামের প্রশাসক পরবর্তীতে স্বরাষ্ট্র সচিব ওমর ফারুককে সাথে নিয়ে ওই এলাকার ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্যে তাদেরকে নানানভাবে পুর্নবাসিত করে। আর সেইসব রোহিঙ্গাদের সন্তান-সন্ততিরা অনেকেই আজ জামায়াত শিবির ও বিএনপি কর্মী। আর এর থেকে বোঝা যায়, আজ রোহিঙ্গারা যাতে দেশে ফিরে না যেতে পারে এজন্যে ১৯৭৮ সালে আসা রোহিঙ্গারা ও তাদের সন্তান সন্ততিরা যে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে এই আন্দোলন মূলত কারা করাচ্ছে। রোহিঙ্গরা যে সমাবেশ করলো তার অর্থ কোথা থেকে জোগান এসেছে? আর এই যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দলবদ্ধভাবে প্রচারণা চলছে এর অর্থও কোথা থেকে আসছে?

তাছাড়া অনেকেই জানেন, জামায়াত বিএনপির অর্থে কয়েকটি বিশেষ গ্রুপ আমেরিকা, পাকিস্তান, মালয়েশিয়ায় বসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ধরনের প্রচারণা চালাচ্ছে। আর বাস্তবতা হলো শুধু ওই শিক্ষক ও প্রাক্তন জাসদ নেতা নন, অনেকেই বিভ্রান্ত হচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এমন মিথ্যা প্রচারে।