হুমায়ূননামা : স্বল্প পরিচয়ে যতটুকু জানা

সেলিনা হোসেন
Published : 25 July 2012, 12:05 PM
Updated : 25 July 2012, 12:05 PM

হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ বলতে গেলে খুব কম ছিল। তবে পরিচয়টা অনেক আগেই হয়েছিল। বয়সে আমরা কাছাকাছি। উনার ১৯৪৮-য়ে জন্ম। এর এক বছর আগে আমার জন্ম। আমাদের পরিচয় হয়েছে মূলত ১৯৭২ সালেই। তার লেখা নন্দিত নরকে প্রকাশ হয়েছিল সে বছর। তিনি বাংলা একাডেমিতে আসতেন তখন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে পড়েন। আমি ততদিনে মাস্টার্স শেষ করে যোগ দিয়েছি একাডেমিতে। ফলে দুজনের দেখা-সাক্ষাত হত মাঝে মাঝে। একেবারে হালকা-পাতলা চশমা-পরা এক তরুণ। চুপচাপ টাইপের। তবে ভালো লিখেন বলে পরিচিতি পেয়েছেন এর মধ্যেই।

হুমায়ূনকে আলোয় নিয়ে আসেন মূলত প্রয়াত লেখক আহমদ ছফা। নন্দিত নরকে বইটির জন্য তাকে প্রকাশক খুঁজে দিয়েছেন ছফা ভাই। হুমায়ূনকে সব রকম সহযোগিতাও দিয়েছেন। একজন তরুণ লেখকের উঠে আসার জন্য তখন দরকার ছিল এ রকম একজন বড় সাহিত্যিকের সহযোগিতা। হুমায়ূনের বইটি পড়ে আহমদ ছফা বুঝেছিলেন যে এই তরুণকে সহযোগিতা করলে তিনি অনেকদূর যাবেন। এখন বোঝা যায়, স্পষ্টভাষী লেখক-সমালোচক আহমদ ছফা বাংলা সাহিত্যের জন্য উপকারই করেছেন। তার ওইদিনের সাহায্যের ফলে আমরা আজকের হুমায়ূনকে পেয়েছি যিনি বাঙালি মধ্যবিত্তের হাসি-কান্নার কথা লিখে জনপ্রিয় হয়েছেন।

বইটার মুখবন্ধ লিখে দিয়েছিলেন প্রয়াত ড. আহমদ শরীফ। তিনিও স্পষ্টভাষী লেখক-সমালোচক হিসেবে সুপরিচিত। তার মুখবন্ধটি বইয়ের ওজন বাড়িয়েছে। প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন শিল্পী কাইয়ূম চৌধুরী। সব মিলিয়ে হুমায়ূন বড়মাপের লেখক-শিল্পীদের সহযোগিতা পেয়েছিলেন প্রথম বইতেই। বাংলা সাহিত্যের জন্য এটা ফলদায়ক হয়েছে।

ব্যক্তি হুমায়ূনকে এরপর দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে, সাহিত্যিক হিসেবে বিভিন্ন আলোচনায়, বইমেলাতে। কথা হয়েছে নানা বিষয়ে। তবে আমাদের যোগাযোগটা বেশ আনুষ্ঠানিক বলা যায়। তাই তার গুণাবলীর বিচার করার ক্ষমতা আমার নেই। তবে যতটুকু দেখেছি তাতে তাকে হাসিখুশি ও বন্ধুসুলভ বলেই মনে হয়েছে আমার।

পাঠকের কতটা কাছের তিনি সেটা একবার দেখেছি রাজশাহীতে। আমাদের দুজনকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সংগঠন গল্পপাঠের আসরে দাওয়াত দিয়েছিল। তার বইগুলোর বিপুল পাঠক-প্রিয়তার কারণে দেখলাম বিশেষত তরুণ ভক্তরা তার কাছে খুব ভিড় করছেন। আর হুমায়ূন আহমেদের রসবোধের গল্প অনেক শুনেছি। সেটা বিশেষ করে দেখেছি তার বড় মেয়ে নোভার বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে। বিডিআর দরবার হলে আয়োজনটা হয়েছিল। সেটাই সম্ভবত শেষ প্রোগ্রাম যেখানে আমাদের দেখা হয়েছে।

ব্যক্তি হুমায়ূনের সঙ্গে আমার স্মৃতি আসলে এটুকুই। তবে তার লেখালেখির সঙ্গে আমার পরিচয় একেবারে কম নয়। তার শুরুর দিককার উপন্যাস নন্দিত নরকে এবং শঙ্খনীল কারাগার আগ্রহ নিয়ে পড়েছি। ভালো লেগেছে। বই দুটো বাংলা সাহিত্যের মূল্যবান রচনা বলে স্বীকৃতি পেয়েছে আগেই। এর পথ ধরে আশির দশকের শুরুতে হুমায়ূন বাংলা একাডেমি পুরস্কারও পেয়েছেন।

তবে বেশিরভাগ সময় তিনি জনপ্রিয় সাহিত্য লিখতেন বলে তার বই আমার তেমন পড়া হয়নি। আমি বেছে বেছে তার লেখা ভালো ও প্রশংসিত বইগুলো পড়ার চেষ্টা করেছি। তার লেখার চলমান ধারা সম্পর্কে জানার আগ্রহ থেকেই পড়া। ভালো লেগেছে বাদশাহ নামদার । মোগল সাম্রাজ্যের কথা নিয়েই গল্প। ভালো একটি কাজ হয়েছে। আরেকটি বই জোছনা ও জননীর গল্প আমাকে আকৃষ্ট করেছে। এটিও তার প্রশংসনীয় একটি কাজ।

হুমায়ূন আহমেদের লেখা নিয়ে একটা বিতর্ক বা আলোচনা সবসময়ই আছে। সেটা চলবে অনেকদিন। তিনি কালজয়ী সাহিত্য রচনা করতে পেরেছেন কি পারেননি সে বিচার সময়ের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। তবে পাঠকরা তো বিচিত্র ধরনের বই পড়েন। রহস্য বা রোমাঞ্চোপন্যাস পড়তে ভালোবাসেন যে পাঠকরা তাদের তৃষ্ণা মিটিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। আমার কথা হচ্ছে মানুষ তবুও বই পড়ুক। বিশেষ করে তরুণরা হুমায়ূনের বইয়ে ডুবে থাকছে সেখানে তাদের ভালোলাগার কিছু থাকছে বলেই। ক্ষতি কী তাতে? হুমায়ূন আহমেদ স্বতন্ত্র একটি ধারায় লিখেছেন। সেই ধারায় কি নতুন কোনও লেখক লিখবেন? লিখতে পারেন। যদি তেমন কেউ না লিখেন তবে এই ধারাটির মৃত্যু হবে। আমি চাই এই ধারাটি টিকে থাকুক। যারা হুমায়ূন পড়েছে সেই পাঠকদের মৃত্যু না ঘটুক।

হুমায়ূন আহমেদ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন শোনার পরও তেমন উদ্বেগ কাজ করেনি আমার মধ্যে। কারণ আমি শুনলাম বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত চিকিৎসা যে দেশে পাওয়া যায় সেখানেই চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। প্রাণঘাতী ক্যান্সার নিয়েও চৌদ্দ বছর বেঁচে ছিলেন শহীদজননী জাহানারা ইমাম। তার চিকিৎসাও চলত যুক্তরাষ্ট্রে। তাই হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল, তিনি জাহানারা ইমামের চেয়েও বেশিদিন বেঁচে থাকবেন। কারণ সময়টা তো আরও এগিয়েছে। ক্যান্সারের চিকিৎসায় এর মধ্যে নিশ্চয়ই অনেক অগ্রগতি হয়েছে।

আমার ধারণাটা শেষ পর্যন্ত সত্য হল না। হুমায়ূন আহমেদ থাকলেন না। বাংলা সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল তারা খসে পড়লেন। লাখো পাঠকের ভালোবাসা নিয়ে টিকে থাকবেন তিনি। আরও অনেক অনেক দিন তার সাহিত্যকর্ম-সিনেমা-গান আলোচনায় থাকবে। কোনটি কতটুকু ভালো কী মন্দ সে বিচার এখন সময়ের হাতে। আমার শুধু মনে হয়েছে, এমন কিছু বয়স হয়নি তার। আরও কিছুদিন বেঁচে থেকে পাঠকদের মন রাঙিয়ে যেতে পারতেন।

সেটা যখন হল না তখন অশ্রসজল চোখে তাকে বিদায় জানাতেই হয়।