বারো হাত শাড়ির তেরো হাত কেচ্ছা

আইরিন সুলতানাআইরিন সুলতানা
Published : 3 Sept 2019, 03:12 PM
Updated : 3 Sept 2019, 03:12 PM

সেই দিনের প্রথম আলো ফোটার পর থেকে ফেইসবুকে শাড়ি গোছাতে গোছাতে দিন শেষে মনে হল, শাড়ি নয় গো শাড়ি নয়, না না লুঙ্গিও নয়,  না গো না পাঞ্জাবিটাও নয়, যে পোশাকে পুরুষকে সাক্ষাৎ উত্তম কুমার লাগে, সেই ধুতি আমাদের সমাজ থেকে লাপাত্তা হয়েছে অগোচোরেই। বিড়বিড় করে বলেই ফেললাম, 'এ রকম একটা বনেদী পোশাককে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে বাঙালি পুরুষ সুবুদ্ধির পরিচয় দেয়নি'। অবশ্য দেবেই না কেমন করে? পুরুষকে নিজের দিকে তাকাতে মানা করে নিজে পুরুষের দিকে তাকিয়েও তা আর বলতে পারছে না নারীবাদ। তাতে করে বাঙালি পুরুষ যে ধুতিতেই সেরা সে কথা নটে গাছটিও জানল না।  

ল্যান্ডফোনের ক্রস কানেকশনে ভানু আর দুই বান্ধবী। একের আলাপের নাক কেটে অন্যের আলাপ চলছে। সুতরাং নাক গলাতেও বাকি থাকেনি কিছু। টেলিফোনে তখন দুই বান্ধবীর সরব কানাকানি- 'তুই ঠিকই বলেছিস, রত্নার মামা এমন ড্যাব ড্যাব করে সারাক্ষণ চেয়ে থাকে!' ফোঁড়নটা কাটতেই হলো ভানুকে- 'আপনারা যদি নাহি চাইয়া থাকেন তো রত্নার মামা যে সর্বক্ষণ তাকাইয়া থাকে তা দ্যাখেন ক্যামন করে!'

তাকাতেইহয় আসলে। কখনও চর্মচোখে। কখনও মনের চোখে।  নাতাকালে ব্রহ্মাণ্ড কী করে দেখবে গো মানব? না তাকালে কী করে জানবেনারী কেমন হয়? পুরুষ কেমন হয়? নাতাকালে ভুল ভাঙবে কী করে? মানুষ তাই দেখছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নারীকে দেখেছিলেন প্রেমিক চোখে। তারপর লিখেছিলেন- "শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী! / পুরুষ গড়েছে তোমা সৌন্দর্য সঞ্চারি / আপন অন্তর হতে। বসি কবিগণ /সোনার উপমা সূত্রে বুনিছে বসন।" কিন্তু দেখাদেখির বিভ্রাটে অপবাদ জুটেছিল বিদ্রোহী কবির। সে কথা লিখেছিলেন কবিতায় – "নর ভাবেআমি বড় নারী-ঘেঁষানারী ভাবেনারী বিদ্বেষী।"

নারীকে দেখে আর লিখে কবি-সাহিত্যিকরা অমর হয়ে গেলেন। কেবল সদ্য গত হওয়া শুক্রবার (৩০ অগাস্ট) সুবহে সাদেকে 'গালতি সে মিসটেক' করে ফেললেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। মিষ্টভাষী সায়ীদ স্যার হয়ত ভেবেছিলেন শাড়ি আর নারী মিলিয়ে একটা নির্দোষ ফিচারই তো! কিন্তু দুটোই যে বুমেরাং হবে, সে কথা কে আর বলেছিল কবে! ব্যস! মুখে মুখে রটে গেল স্যারের শাড়ি কাহিনী।

এ যেন শরতের আকাশের তলে ছাদে শুকাতে দেওয়া পত পত করে উড়তে থাকা নীল শাড়িটার আঁচল ছুঁয়ে দেখতে গিয়ে সাক্ষাৎ নারী কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে যাওয়া। যেমনি কান টানলে মাথা, তেমনি শাড়ি টানলেই তো নারী।     

শাড়ি নিয়ে বলতে গেলে তসলিমা নাসরিনের কথাও সামান্য বলতে হয়। তসলিমা নাসরিন একবার পুরুষদেরও শাড়ির মত সুন্দর পোশাকটি 'পরার' আহ্বান জানালে সবাই তাকে যা না তাই বললেন। ওদিকে সায়ীদ স্যার ফিচারের চূড়ায়  লিখলেন শাড়ি, ভেতরে লিখলেন নারী। ওমনি  'ফেইস' থেকে 'ফেইসে' ছড়াতে ছড়াতে নারী তো বটেই পুরুষও এবার শাড়ি 'পড়ে' ফেলল।

বাঘে ছুঁলে এক ঘা, আঠারো পুলিশে ছুঁলে; সোশাল মিডিয়া যদি একবার ধরে তো বিলক্ষণ শূলে। ফলেজীবনের ৮০ বসন্ত পার করে আসা আলোকিত মানুষটিকে এবার সবাই চিনল 'পুরুষ' হিসেবে।    

সায়ীদ স্যার হয়ত নারীর দেহের বিভঙ্গের কথা হেলাল হাফিজের মত করেই লিখতে চেয়েছিলেন। হয়ত নারী অবয়বের উপত্যকা-পর্বতকে নিয়ে  আল মাহমুদের মত কাব্যই করতে চেয়েছিলেন। ওরা সবাই যদি লিখতে পারেন তো আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ নয় কেন? কথা ঠিক কি না বলেন?  

তবে হাতের লেখাটা কি না বাড়ির কাজের খাতায় রুল দিয়ে মার্জিন টেনে দশবার করে লেখার মতই শেষমেশ। নইলে সায়ীদ স্যারের মনে যদিও গীতাঞ্জলি লেখার দারুণ ইচ্ছে, লিখতে গিয়ে হয়ে গেল কাসেম বিন আবু বাকারের 'ফুটন্ত গোলাপ'।  ওদিকে সামাজিকে ওর অনুবাদ গিয়ে ঠেকলো 'যৌনতায়'। সমস্যা স্যারের হাতের লেখায়, লোকে সামাজিকে বলল- সায়ীদ স্যারের চোখ খারাপ; তিনি নারীর দিকে তাকিয়ে উঁচু-নিচুই দেখেন।  

কেউকেউ যে বড্ড বেশি ছোঁক ছোঁক করেন না তা নয়। যে সব পুরুষের নারীর উঁচুনিচু নিয়েএকটু বেশিই হাহাকার, তাদের জন্য মঙ্গল দীপ জ্বেলে ঈশ্বরের কাছে চাওয়া, মানবেরপরের সংস্করণ গড়তে গিয়ে পুরুষকে তুমি এমন ল্যান্ডস্কেপ থেকে বঞ্চিত করো নাপ্রভু।   

প্রার্থনা শেষ হলে ফিরে আসি শাড়িতে-নারীতে। আকাশে চাঁদ উঠলে যদি পৃথিবী থেকে ক্ষুদ্র মানবচক্ষু তা দেখতে পারে, তো সামনে দাঁড়ানো নারীর দেহের চড়াই-উৎরাই না দেখার মত কি? টাইগার শ্রফের দিকে স্রেফ তাকিয়ে যদি কোনো নারী সিক্স-প্যাকের  ভাঁজগুলো ‍গুণে নিতে নাই পারে তো সে নারীর পর্যবেক্ষণ দুর্বল। কৈশোরে অদেখা মাসুদ রানার একটা অবয়ব কি নারীর মনেও জন্মায়নি বলছেন?

যাদেখা যায় খালি চোখে অথবা রেখেঢেকেও, তা আরো খানিক কল্পনা মিশিয়েলিখতে বাধা দেওয়া যায় কি? লেখার গুণে কোনোটা চটি, কোনোটা কালজয়ী। সায়ীদ স্যার চটি লেখেননি; দুর্ভাগ্য ওটাকালজয়ীও হয়নি। পরিণামে নারীবাদের রোষানলে পড়লেন সায়ীদ স্যার। সব মাছইবিষ্ঠা খায়, দোষ হয় টাকি মাছের। এক ‍পৃথিবী পুরুষের 'যৌনতার' ভার এই অশীতিপর 'পুরুষটির' মাথায় চাপিয়ে ফেইসবুক পাড়ায় নাকে খতদিয়ে ঘোরানো হলো তাকে। তাতে খানিক স্পষ্ট হলো নারীবাদ এখনপুরুষতন্ত্রের মতই মৌলবাদী হয়ে উঠছে। যেন নারীবাদ বলতে চাইছে, নারীর দিকে তাকিয়েও উঁচু-নিচু বৈচিত্র্য নয়, সমতল দেখতে ও লিখতেবাধ্য থাকবে পুরুষ।

সায়ীদ স্যার নানা ভাবেই লিখলেন, বাঙালি নারী মানেই ১২ হাত কাপড়ই তার একমাত্র পোশাক। আর কোনো পোশাক তাকে মানায় না। যে বলায় কোথাও ছিল তার যুগের সামাজিক গোঁড়ামির ছাপ। যেখানে পুরুষ ও সমাজ ঠিক করে দেয় নারীর পোশাক। কিন্তু আজকের নারী তো জীবনানন্দ দাশের 'চুল তার কবেকার  অন্ধকার বিদিশার নিশা' আওড়াতে আওড়াতে নীল রঙের চুল বাতাসে উড়িয়ে চলেছে। 'তোমার ঘন কালো চুলে হারিয়ে যায় মন' বলে বাঙালি নারীকে পটাতে গেলে গোলাপী চুলের মেয়েটি কি আর পটবে এ কালে? বেচারা জীবনানন্দের এসব জানার সুযোগ হল না, সায়ীদ স্যারও এসব না-ই জানতে পারেন, কিন্তু নারীবাদও যখন নারীকে জানে না, তখন সায়ীদ স্যারের 'শাড়ি' লেখার খুব একটা প্রতিবাদ হচ্ছে ভেবে ফেইসবুকে শাড়ি পরা নারীবাদের একের পর এক ছবি আসতে থাকে।

কেউ বললেন-  এমনি এমনি পরি, কেউ বললেন- নিজেকে দারুণ লাগে, কেউ বলছেন- স্বাচ্ছন্দ্য। সেই তো নথ খসালি তবে কেন লোক হাসালি?  প্রতিবাদে নেমে বাঙালি নারী বলতে পারলেন না যে- তাকে বিকিনিতেও মানায়, টিশার্টে গরমে আরাম লাগে, জিনসে শীত কম লাগে, স্কার্টে ফুরফুরে লাগে!

এদেশে পুরুষ সহজেই পুরুষ, কিন্তু নারী ৩৬৫ দিনে ৩৬৬খানা শাড়ি পরে তবেই নারী। সমাজ নারীকে ক্রমাগত 'নারী'হওয়ার চ্যালেঞ্জ ছোড়ে। নারীও নারী হওয়ার যাবতীয় শর্ত পূরণ করতেঝাঁপিয়ে পড়ে। এসব আর কবে বুঝবে নারী? বড় হও নারী, তোমাকে কিনে দেবরঙিন শাড়ি, যার আঁচলে পুরুষ আর সমাজ খেলা করে।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার ইদানিং শাড়ি নিয়ে গবেষণা করছেন কিনা জানা নেই। তিনি কি লেখাটা নিজে নিজে বিজনে বসে লিখে ভোরের প্রথম আলো ফুটতেই ডাকে পাঠিয়েছিলেন? নাকি তাকে শাড়ির বাজারে এসে মার্কেটিং করতে ফরমায়েশ করেছিল কেউ? তাও জানা নেই। তবে কিছু একটা ভুল তথ্য স্যারকে দেওয়া হলেও হতে পারে।

ওই ফিচারের শুরুতেই একটি রিকশা পেইন্টিং দিয়ে এক রকম সিদ্ধান্ত টেনে দেওয়া হয়েছে রিকশার পেছনের আঁকায় শাড়ি নিত্য বিষয়। রিকশার পেছনে সাধারণত বিরাট বিরাট মুখ-চোখ আঁকা থাকে। নয়তো বাঘ, হাঁস, হরিণ থাকে। নয়তো পৃথিবীর বৃহত্তম গোলাপটি আঁকা থাকে। শাড়ির নান্দনিকতা তুলে ধরা রিকশা আর্টের বৈশিষ্ট্য ছিল কবে? মনের মধ্যে কে যেন বলে ওঠে, শাড়ির পেইন্টিং দেওয়া এই রিকশার চালক সায়ীদ স্যার নন, অন্য কেউ!

অবশ্য স্যারের লেখার একেবারে শেষ লাইন পড়ে আমারও যে  নারীবাদ জাগেনি তা নয়। সায়ীদ স্যারের লেখার শেষ লাইন পড়ে এই প্রথম জানলাম যে বাঙালির নারীর শাড়ি এরমধ্যে বিলুপ্তি ঘটেছে। শেষে এসে শাড়ির বিলুপ্তির জন্য নারীকে দায়ী করে যেন দুয়ো দিলেন তিনি।  যদিও শাড়ির বাজারে কেনাবেচা থেকে নারীর আলমারিতে – কোথাও শাড়ির অনাদর নেই। শাড়ির শরীরে পকেট জুড়ে তো শাড়ি নিয়ে বিপ্লব ঘটে গেল দেশে। বিক্রি হচ্ছে না বলে শাড়ি বিক্রেতারা ক্ষোভে রাস্তায় শাড়ি বিছিয়ে প্রতিবাদ শুরু করেছেন- এমন ঘটনাও  নেই। তাই থমকেছি এখানেই; কবে, কোথা থেকে, কীসের ভিত্তিতে এই তথ্য প্রতিষ্ঠা পেল যে শাড়ি ঝেঁটিয়ে বিদেয় হয়েছে?

সায়ীদ স্যারের লেখায় আরেক  অংশ পড়তে গিয়ে উচ্চতায় হোঁচট খেয়েছে নারী। গজ ফিতা হাতে নিয়ে স্যার লিখছেন ৫ ফুট ২-৩ ইঞ্চি গড় উচ্চতার নারীকে ১২ হাত শাড়িতে ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি দেখাবে।  'পাঁচ ফুট শরীরে বারো হাত শাড়ি' – নারীর উচ্চতা ‍দুই ইঞ্চি কম দেখিয়েও কেবল একটা রোমান্টিক সুরের কারণে  হায়দার হোসেনের গানটি নারীবাদের চোখ এড়ালেও ফেঁসে গেলেন সায়ীদ স্যার।

এখানটায় কাব্যের পুরোদস্তর অভাব থাকায় আঁতে ঘা লাগতেই পারে নারীর। কিন্তু তাও বা কেন? এশীয় নারী হিসেবে এ অঞ্চলের গড় উচ্চতা তো এমনি। দোষ যদি হয় তো তা স্যারের নয়,  হরলিকসের। সেই যে 'টলার' হবে বলেছিল! যুগ যুগ ধরে লালবাগের হাঁসমার্কা গন্ধরাজ নারকেল তেলে নারীর চুল আপাদমস্তক ছাড়িয়ে গেলেও হরলিকস কিন্তু তার দেওয়া কথাটি রাখেনি। দায় বাঁচাতে হরলিকস অবশ্য সমাজের দিকে আঙ্গুল তুলতে পারে। খেতে বসে মাছের মাথাটি, আস্ত ডিমটি, এক গ্লাস দুধ মেশানো হরলিকস তো খেতে মিলতো ওই পুরুষকেই। নারী এক থাল ভাত খেয়ে গায়ে-গতরে চোখ ঠিকরে বাড়লেও, বাড়েনি তাই উচ্চতায়। তাতেও বা কি এমন আফসোস! গতরের সামান্য উচ্চতা নিয়ে শাড়ি না পরেই (মানে জ্যাকেট-গ্লাভস এসব পরে) বাঙালি নারীটি তো এভারেস্টের উচ্চতায় গিয়ে পতাকা তুলেছে।     

কর্মজীবী নারীকে আবহাওয়া, বাস-ধুলা, লম্বা যাত্রা, অন্য জায়গায় গেলে টয়লেট সারা, পিরিয়ড ম্যানেজমেন্ট, সকাল সকাল দ্রুত তৈরি হওয়া, সহজে কাপড় ধোঁয়া, ড্রাইভিং, উবার-পাঠাও, ইয়োগা, হাইকিং, সুইমিং, স্লাইক্লিং এমন বহু কিছু মাথায় রেখে পোশাক পরতে হবে। পোশাকে নানা বৈচিত্র্য তো তাই চাই-ই।

হে নারী, যদি প্রিয় নজরুলও কভু গেয়ে ওঠে, 'পরোপরো চৈতালি সাজে কুসুমি শাড়ি/ আজ-ই তোমারি রূপেরও সাথে চাঁদেরও আড়ি', তুমি মৃদু হেসে এই মধ্য ভাদ্র মাসে নিজের যেটায় আ-রা-ম লাগে সেটাই পরো।