সিরাজুল আলম খান : ইতিহাসের এক ব্যর্থ খলনায়ক

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 31 August 2019, 09:54 AM
Updated : 31 August 2019, 09:54 AM

সময়টা সত্তরের দশকের মাঝামাঝি। ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলীর কিছু পরে জনপ্রিয় 'সাপ্তাহিক বিচিত্রা' তার প্রচ্ছদের শিরোনাম দেয়, 'সিরাজুল আলম খানঃ বাংলাদেশের রাজনীতির রহস্য পুরুষ'। তাতে লম্বা দাঁড়ি এবং চুলওয়ালা এক ব্যক্তির ছবি ছাপা হয়। অনেকটা যেন কার্ল মার্কস বা রাসপুটিনের মত দেখতে। এ ব্যক্তিটিকে বাংলাদেশের রাজনীতির একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। তিনি নেপথ্যে থাকেন। কিন্তু দেশের এমন কোন তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা নেই,  যাতে তিনি মূখ্য ভূমিকা পালন করেন না।

এ ব্যক্তিটি জনসম্মুখে আসেন না। বক্তৃতা, বিবৃতি দেন না; সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এ যান না। এমনকি, সাংবাদিকদের সাথে কথাও বলেন না। তিনি কোনো সংবাদপত্র বা ম্যাগাজিনে সাক্ষাৎকারও দেন না। কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্যও নন তিনি। আড়ালে থাকেন সব সময়। কেমন যেন রহস্যে ঘেরা মানুষ।  

রহস্যের প্রতি মানুষের একটা সহজাত আকর্ষণ রয়েছে। যা কিছু রহস্যময়, তাই যেন আকর্ষণীয়। বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের প্রিয় চরিত্র তখন মাসুদ রানা। ইতিমধ্যে কর্নেল তাহের নামে এক ব্যক্তির নেতৃত্বে ঘটে গেছে এক ব্যর্থ অভ্যুথান। এর পিছনেও নাকি এ রহস্যময় লম্বা চুল, দাঁড়িওয়ালা ব্যক্তিটি।

এর কিছু পূর্বে,  বিচিত্রা বছরের আলোচিত চরিত্র করে হাইকোর্ট মাজারের নুরা পাগলাকে। প্রচ্ছদে ছবি দেওয়া হয় নুরা পাগলার। লম্বা চুল, দাঁড়ি, হাতে গাঁজার কল্কি। লম্বা দাঁড়ি চুলের ব্যক্তির প্রতি বস্তুবাদী পাশ্চাত্যেই যেখানে জনমানসে আগ্রহের জায়গা তৈরি হয়; সেখানে ভাববাদ, ভক্তিবাদ, সুফিবাদ, লালন আর সহজিয়ার দেশ বাংলাদেশে তাঁদের তো একটা বাড়তি আবেদন থাকবেই।         

বলিভিয়ায় নিহত হওয়া চে পুঁজিবাদী, অপুঁজিবাদী সব দেশেই তখন প্রবল জনপ্রিয়। কিছুদিন পূর্বে নিহত হয়েছেন নকশাল আন্দোলনের জনক চারু মজুমদার। তারই ধারাবাহিকতায় অনেকটা একই রকমভাবে নিহত হয়েছেন চারু মজুমদারের ভাব শিষ্য সিরাজ শিকদার।

ঘটনাএখানেই থেমে থাকেনি। হত্যার মিছিলে সামিল হন কর্নেল তাহেরও। ব্যর্থ অভ্যুত্থানেরফলশ্রুতিতে গোপন বিচারের নামে হত্যা করা হয় তাঁকেও। তাঁদের সবার চাওয়া একই ছিল। সেটাহল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা।  

বিচিত্রা থেকে জানা গেল সিরাজুল আলম খানও সেটা চান। আরো জানা গেল, জাসদ গঠন করে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে দক্ষযজ্ঞ বাঁধিয়ে দেয়া ব্যক্তিটিও নাকি সিরাজুল আলম খান। ফলে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি পরিচিতি পেয়ে যান রহস্য পুরুষ হিসাবে। আর লম্বা চুল দাঁড়ির জন্য কাপালিক। তবে, তাঁর অনুসারী জাসদ নেতা কর্মীরা তাঁকে ডাকেন দাদা হিসাবে। 

৭ নভেম্বরের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর জিয়া বুঝতে পেরেছিলেন তাঁকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে জাসদকে ভেঙ্গে তছনছ করতে হবে। জিয়ার শাসনামলে জাসদের উপর নেমে আসে স্টিমরোলার। হাজার হাজার নেতাকর্মী এ সময় গ্রেফতার হন। সাথে দাদা সিরাজুল আলম খানও। তিনি সহ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব জেলে থাকা অবস্থাতেই জাসদ ভেঙ্গে হয় বাসদ। জিয়ার উদ্দেশ্য সফল হয়। তারপরের জাসদের ইতিহাস হল ক্রমশ নিঃশেষ থেকে নিঃশেষিত হওয়ার। একের পর এক ভাঙ্গন আসতে থাকে জাসদে।

সিরাজুল আলম খান ১৯৮১ সালে দীর্ঘ কারাভোগের পর মুক্তি পান। কারামুক্তির পরও তিনি একাকী, নিভৃত জীবন যাপন করতে থাকেন। এরপর রাজনৈতিক অঙ্গনে আর তিনি কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেননি। বরং, তাঁকে দেখা যায় রবের জাসদকে দিয়ে সামরিক শাসক এরশাদের তাঁবেদারি করতে। এরশাদ পতনের পর তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যান। সাধারণ মানুষ তাঁকে কখনোই তেমনভাবে চেনেনি, যারা তাঁর সম্পর্কে জানতেন, তাঁদের অনেকেই ইতিমধ্যে তাঁকে ভুলে যান।

আশির কাছাকাছি বয়সে সিরাজুল আলম খান আজ জীবন সায়াহ্নে উপনীত। শারীরিকভাবে তিনি অনেকটা অসুস্থ্য। জীবনের প্রান্তে এসে হঠাৎ করে তিনি তাঁর ভাব শিষ্য শামসুদ্দিন পেয়ারার অনুলিখনে 'আমি সিরাজুল আলম খান' শিরোনামে সম্প্রতি একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। এক প্রাক্তন সহকর্মী বইটি আমাকে পাঠিয়েছেন।

বইটি হাতে আসার পর প্রথমে যতটা উল্লসিত হয়েছিলাম, পড়া শেষ করে ততটাই হতাশ হয়েছি। বইটা পাবার পর ভেবেছিলাম ১৯৭১-৭৫ কালপর্বে তাঁর ভূমিকা কি ছিল সেটা হয়ত শেষ বয়সে অকপটে তিনি  জাতির সামনে তুলে ধরবেন। কিন্তু বইটিতে অত্যন্ত সুকৌশলে তিনি তাঁর ভূমিকা এড়িয়ে গেছেন। মাত্র কয়েক পাতায় এ কালপর্ব সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন, তাতে নতুন কিছু নেই। ইতিমধ্যে যে বিষয়গুলো আমরা জানি, সেগুলোই খুব দায়সারাভাবে, কয়েক পাতায় তিনি এখানে উল্লেখ করেছেন। এতে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেপথ্যে থেকে তিনি যে কলকাঠি নেড়েছেন, সেটা তিনি জাতির সামনে বলে যেতে চান না।  

বইটার মূল ফোকাস ১৯৬২-৭০ সময়কালে তাঁর ভূমিকা কি ছিল তার উপর। ১৯৬২ সালে সিরাজুল আলম খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের ছাত্র। বিশ্বব্যাপী তখন ঔপনিবেশিকবিরোধী জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সময়। তাঁর ছোঁয়া লাগে সিরাজুল আলম খানের মাঝেও। তিনি তখন ছাত্রলীগের সদস্য।অনেকটা তারুণ্যের ফ্যান্টাসি থেকেই যেন তখন তিনি আব্দুর রাজ্জাক এবং কাজী আরেফ আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে ছাত্রলীগের মাঝে গড়ে তুলেন 'নিউক্লিয়াস,' যার লক্ষ্য হবে দেশ স্বাধীন করা।  

এ নিউক্লিয়াসকে পরবর্তীতে তাঁরা 'স্বাধীন বাঙলা নিউক্লিয়াস' বলতে থাকেন, যাকে আবার একটা সময় পর 'বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স' বা বিএলএফ হিসাবে ডাকা হয়। এ বিএলএফের গেরিলা উইং হিসাবে ১৯৭১ সালে মেজর জেনারেল সুজান সিং উবানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ভারতের দেরাদুনে গড়ে তোলেন 'জয়বাংলা বাহিনী, 'যা সাধারণের কাছে 'মুজিব বাহিনী' নামে পরিচিত ছিল।

১৯৬২ সালে সিরাজুল আলম খানই যে প্রথম স্বাধীনতার কথা ভাবেননি এটা তাঁর বইয়েই উল্লখ আছে। এতে তিনি জানাচ্ছেন, ১৯৪৮ সালে তোয়াহা একটা প্রবন্ধে প্রথম দেশ স্বাধীন করবার কথা বলেন। পঞ্চাশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানী রাষ্ট্র কাঠামো টিকে থাকবে না। ১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলনে মাওলানা ভাসানী জাতীয় পর্যায়ের নেতা হিসাবে পাকিস্তানকে 'আসসালাম ওয়ালাইকুম' বলেন। বস্তুত ১৯৬২ সালের মধ্যেই, গণমানসে না হলেও, সমাজের খুব ক্ষুদ্র একটা অগ্রসর অংশের মাঝে স্বাধীনতার ধারণা জন্মলাভ করে গিয়েছিল।

ষাটের দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের তরুণ সমাজের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বিশ্বব্যাপী বাম রাজনীতির স্বর্ণ যুগের প্রভাবে বিপ্লবী চিন্তায় আক্রান্ত। সিরাজুল আলম খানও বাম সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। কিন্তু তিনি তাঁর বইতে স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন, বাম সাহিত্য তাঁকে টানেনি। ইউরোপে জন্ম লাভ করা মার্কসীয় চিন্তাধারা বরং তার কাছে পূর্ব পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে অবাস্তব মনে হয়েছে। বাম রাজনৈতিক দল এবং ছাত্র সংগঠনসমূহও বাংলার জনগণের মনন এবং জাতীয়তাবাদী চেতনা বুঝতে অক্ষম বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা দ্বারা। স্বাধীনতার পূর্বে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র এবং পুঁজিবাদী পথেই দেশের উন্নয়নের কথা ভাবত। শীতল যুদ্ধকালীন বিশ্বে আওয়ামী লীগকে তখন মার্কিন ঘেঁষা দল হিসাবেই মনে করা হত। সিরাজুল আলম খান সে পথেরই অনুসারী ছিলেন।

 আওয়ামী লীগের জাতীয়তাবাদী চিন্তা দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েই তিনি নিউক্লিয়াসের বিস্তার ঘটাবার উদ্যোগ নেন।  ১৯৭০-৭১ সাল নাগাদ এর সদস্য সংখ্যা কয়েক হাজারে দাঁড়ায়। সিরাজুল আলম খান একে গোপন সংগঠন হিসাবে দাবী করলেও এটি সে অর্থে গোপন সংগঠন ছিল না, যে অর্থে সেসময়কার বাম রাজনৈতিক দলগুলি ছিল। একটি বৈধ সংগঠনের মাঝে আরেকটি সংগঠন গোড়ে তুলে একে গোপন দাবী করবার বিষয়টি হাস্যকর। বরং, তিনি যে কাজটা ১৯৬২ সাল থেকে করেছেন সেটা হল ছাত্রলীগের মাঝে একটি শক্তিশালী, সুশৃঙ্খল উপদল গড়ে তোলা, যার নেতৃত্ব ছিল তাঁর হাতে। এ উপদলটিকে তিনি চেষ্টা করেছেন মূল সংগঠনের মাঝে গোপন রাখতে।  

এখন প্রশ্ন হল, এ উপদল গঠন করবার দরকার হল কেন? এটি প্রথমে বিপ্লবী রোমান্টিসিজম জাত হলেও সেই তরুণ বয়স থেকেই কি একই সাথে তিনি আওয়ামী রাজনীতির নেপথ্য নিয়ামক হয়ে উঠবার স্বপ্ন দেখছিলেন? তিনি কি তখন থেকেই ভাবতে শুরু করেছিলেন, দেশ স্বাধীন হলে তিনিই হয়ে উঠবেন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু?

উচ্চাভিলাষী সিরাজুল আলম খান রাজনীতির মাঠে নামার সাথে সাথে একটা বিষয় বুঝে গিয়েছিলেন যে, বঙ্গবন্ধু বা মাওলানা ভাসানীর মত নেতা হতে পারা তো দূরের কথা, তাঁর পক্ষে মণি সিংহ বা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের মত নেতা হওয়াও সম্ভব হবে না। তাই তিনি চিন্তা করেছিলেন ভিন্ন পথ ধরার, যাতে নেতা না হতে পারলেও পর্দার আড়ালে থেকে তিনি মূল নেতৃত্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। আর এ নিয়ন্ত্রক হবার স্বপ্নে বিভোর হয়েই তিনি স্বয়ং বঙ্গবন্ধুকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবার বিষয়টা ভাবতে থাকেন। বইটি অধ্যয়ন করলেই সিরাজুল আলম খানের এ চিন্তাধারা এবং এ সংক্রান্ত কার্যক্রম স্পষ্ট হয়ে ওঠে।  

নেপথ্যে থেকে নিয়ন্ত্রক হবার ধারণা কোন নেতার বা বিপ্লবীর থাকে না। বিশ্বের দেশে দেশে জাতীয়তাবাদী নেতাদের বাদ দিলেও; এমনকি, বড় বড় বিপ্লবীরাও কখনোই নেপথ্যে থাকেন নাই। লেনিন, মাও, ক্যাস্ট্রো, চে গুয়েভারা, হো চি মিন, আনোয়ার হোজ্জা থেকে শুরু করে চারু মজুমদার বা সিরাজ শিকদার কেউই নেপথ্যে থেকে রাজনীতি করেননি। রাজনীতির প্রয়োজনে তাঁরা আত্মগোপনে গিয়েছেন, কিন্তু নেপথ্যে কখনো চলে যাননি। গান্ধী, নেহেরু, বঙ্গবন্ধুর মত নেতারা কখনো আত্মগোপনেও যাননি। এর চেয়ে জেলে যাওয়াকে তাঁরা অধিক যৌক্তিক মনে করেছেন।

ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় নেপথ্যে থেকে নিয়ন্ত্রক হবার অভিপ্রায় আমরা পাই রাশিয়ার রাসপুটিনের মাঝে। তিনি পিছনে থেকে জারের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছিলেন এবং পরিণতিতে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। বইটিতে উল্লেখ না করলেও তাঁর কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করলে একটি বিষয় অত্যন্ত পরিস্কার হয়ে যায় যে, এ রাসপুটিন ছিলেন সিরাজুল আলম খানের আদর্শ। তাঁর মতো তিনিও চেয়েছিলেন সদ্য জন্ম নেয়া বাংলাদেশ নামক রিপাবলিকটির রাসপুটিন হয়ে উঠতে। এ সুদূর প্রসারী লক্ষ্যকে সামনে নিয়েই নিউক্লিয়াস গড়ে তুলবার পর তিনি স্বাধীনতার লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন। আর তাঁর জবানীতেই তিনি বলেছেন, ১৯৬৫ সালে তিনি সিদ্ধান্ত নেন নেপথ্যে চলে যাবার। কেন তিনি এ সিদ্ধান্ত নিলেন, এর ব্যাখ্যা তিনি বইয়ের কোথাও দেননি।

নিউক্লিয়াসকে বইটিতে এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে, যেটা পড়লে পাঠকের মনে হবে বঙ্গবন্ধুকে সামনে আইকন হিসাবে রেখে, সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে একমাত্র নিউক্লিয়াসের কার্যক্রমের ফলেই বুঝি ক্রমান্বয়ে পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্র তৈরি এবং মুক্তিযুদ্ধে নিউক্লিয়াস সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু ছাত্রলীগের অভ্যন্তরের একটি গোপন উপদল বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের মূল নিয়ামক, এটি ইতিহাসে বস্তুনিষ্ঠ দাবী নয়। ইতিহাসকে এভাবে বিশ্লেষণ করলে, তৎকালীন যেকোন গোপন দলও দাবী করতে পারে, তারাই নেপথ্যে থেকে গণ আন্দোলনগুলো সংগঠিত করেছিল। গণ আন্দোলনগুলোতে গোপন দল, সংগঠন, উপদলগুলোর অংশগ্রহণ থাকে। কিন্তু, গোপন উপদলের উপর নির্ভর করে দুনিয়ার কোথায়ও গণ আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি।

১৯৭১ সালে মুক্তি সংগ্রাম শুরু হলে সিরাজুল আলম খান এবং তাঁর নিউক্লিয়াসের সদস্যরা ভারত চলে যান। কিন্তু প্রবাসী সরকারের অধীনে মুক্তি বাহিনীতে যোগ না দিয়ে তাঁরা ভারতের উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ সহয়তায় কয়েক হাজার সদস্যের 'জয় বাংলা' বাহিনী গড়ে তোলেন। এ বাহিনীকে মুক্তি বাহিনীর চেয়ে উন্নত মানের সমরাস্ত্র এবং ট্রেনিং দেওয়া হয়।

সিরাজুল আলম খান দাবি করেছেন, এ বাহিনী গড়ে তুলবার আগে এ বিষয় বা অন্য কোনো কিছু নিয়ে ভারতের সাথে তাঁর কোনো যোগাযোগ হয়নি। তাঁর দাবিটি সত্য ধরে নিলেও যে প্রশ্নটি সামনে আসে সেটি হল, নিউক্লিয়াসের সদস্যরা সবাই আওয়ামী লীগের সদস্য হলেও, তাঁরা কেন প্রবাসী সরকারের অধীনে মুক্তি বাহিনীতে যোগ না দিয়ে আলাদা বাহিনী গড়ে তুললেন বা ভারতকে গড়ে তুলতে দিলেন। ভারত যে উদ্দেশ্যেই এ বাহিনী গড়ে তুলুক একটি বিষয় পরিস্কার, সিরাজুল আলম খান এ সুযোগটি নিয়েছেন এ ভেবে যে, এতে তিনি এ বাহিনীর সহযোগীতায় মুক্তিযুদ্ধের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় চলে যেতে পারবেন।

দেশ স্বাধীন হবার পর যখন তিনি দেখতে পেলেন যে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে তিনি অনেক দূরে চলে যাচ্ছেন, তখন চাপে রাখবার কৌশল হিসাবে বঙ্গবন্ধুকে তিনি জাতীয় সরকার গড়ে তুলতে বলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, জাতীয় সরকারের ধারণা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।  প্রাকারান্তরে এটি মূলত এক দলীয় শাসন।

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হল ছোট, বড়  সব দল নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সংবিধানের আওতায় ভূমিকা পালন করা। ভারত বা যুক্তরাষ্ট্রের মত আপাত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতে সঙ্কটকালীন সময়ে কখনোই জাতীয় সরকার গঠিত হয়নি। কিন্তু সিরাজুল আলম খান দেশ স্বাধীন হবার অব্যবহিত পর থেকেই বঙ্গবন্ধুকে জাতীয় সরকারের নামে এক দলীয় শাসনের দিকে নিয়ে যাবার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হবার পর বঙ্গবন্ধু সরকারকে বেকায়দায় ফেলবার জন্য তিনি 'বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের' শ্লোগান দিয়ে ছাত্রলীগে ভাঙ্গন ধরান এবং জাসদ গঠন করেন।

বইটিতে তিনি স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন, জাসদ গঠনের লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উৎখাত করা এবং জাসদের নেতৃত্বে 'জাতীয় সরকার' তথা একনায়কতান্ত্রিক শাসন কায়েম করা। এ সরকারের নেপথ্য গুরু হবেন সিরাজুল আলম খান। বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রভাব বিস্তারকারীর ভূমিকায় না থাকতে পেরে তিনি পরিকল্পনা করছিলেন, এ সরকারকে ফেলে দিয়ে নিজেই নেপথ্য থেকে দেশের সর্বেসর্বা হয়ে উঠবার।

এ লক্ষ্যে শুধু জাসদ গঠন করেই তিনি ক্ষান্ত হননি। দলটির 'অঙ্গসংগঠন' হিসাবে গড়ে তোলেন স্বেচ্ছাসেবক 'মিলিশিয়া' বাহিনী, যা জনগণের কাছে 'গণবাহিনী' নামে পরিচিত। এ গণবাহিনীর ঢাকা অঞ্চলের প্রধান ছিলেন হাসানুল হক ইনু। এ বাহিনীর মূল লক্ষ্য ছিল সারা দেশে বিশৃংখলা, অরাজকতা,  নৈরাজ্য সৃষ্টি করে বঙ্গবন্ধু সরকারের পতনের পথ তরান্বিত করা। এ বাহিনী সেসময় সারা দেশে ব্যাপক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। এসব কাজের জন্য 'প্রাপাগান্ডা উইং' হিসাবে তাঁরা প্রতিষ্ঠা করেন 'গণকণ্ঠ' পত্রিকা, যার সম্পাদক ছিলেন কবি আল মাহমুদ। এ পত্রিকা সেসময় মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক নেতিবাচক প্রচারণা চালায়। শেখ কামালের ব্যাংক ডাকাতির গল্প এরাই প্রথম চালু করে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, এক দিকে কর্নেল ফারুক, রশিদ এবং অপরদিকে সিরাজুল আলম খান, রব ও ইনুরা দুটো ভিন্ন প্লাটফরম থেকে একই লক্ষ্যে কাজ করছিলেন। ফারুক, রশিদরা সফল হয়েছিল, অপর গ্রুপটি হয়নি। ফারুক, রশিদরা মুসলিম জাতীয়াতাবাদের রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন। সে লক্ষ্য বাস্তবায়নের কথা মাথায় রেখেই তাঁরা ১৫ অগাস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করেন। অপরদিকে, রাজনৈতিক সুবিধার জন্য চরমতম আদর্শগত পথ ভ্রষ্টতার নজির স্থাপন করেন সিরাজুল আলম খান।

বামদের ভাষায় 'বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক' আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে এক লহমায় তিনি সেই বামদের—যাদের তিনি কিছুদিন আগেও সমালোচনা করেছেন— 'বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের' আদর্শের 'ধারক' হয়ে উঠেন। এবং সে আদর্শ বাস্তবায়নে হিটলারের ন্যাশনাল সোশালিস্ট পার্টির বাংলা অনুবাদ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল করে, দল গঠন করেন। আদর্শগত ডিগবাজি তাঁর এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। এরশাদ আমলে তাঁকে আবার দেখা যায় মুসলিম জাতীয়তাবাদী এরশাদের সাথে হাত মিলাতে। বইটিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, এরশাদের সাথে তিনি চারবার দেখা করেছেন এবং দাবি করেছেন, উপজেলা ব্যবস্থার ধারণা তাঁর থেকেই এরশাদ নিয়েছেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মার্কস তাঁর পূর্ববর্তী সমাজতান্ত্রিক চিন্তকদের চিন্তাধারা বাতিল করে নিজের চিন্তাধারাকে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য পূর্বোক্তদের চিন্তাধারাকে 'ইউটোপীয় সমাজতন্ত্র' (যার দূরবর্তী দুর্বল বাংলা হল কাল্পনিক সমাজতন্ত্র) আখ্যায়িত করে নিজের ধারণাকে 'বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র' বলে অভিহিত করেছেন। বাংলাদেশের সিপিবিসহ মার্কস পরবর্তী দুনিয়ার সমস্ত কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শই হল এই 'বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। কোনো বাম দলই তাদের সমাজতন্ত্র যে বৈজ্ঞানিক, এভাবে আলাদা করে উল্লেখ করে না।  কিন্তু, সিরাজুল আলম খান অত্যন্ত চতুরতার সাথে বাম রাজনৈতিক কর্মীদের মাঝে একটা কনফিউশন তৈরির লক্ষ্যে, সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না রেখে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক অসততার জায়গা থেকে, তাঁর কর্মী এবং অনুসারীদের সমাজতন্ত্রের আগে বৈজ্ঞানিক শ্লোগান দিতে বলেন।

১৫ অগাস্টের নির্মম ঘটনার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বাকশাল সরকারের অবসান ঘটবার পর সিরাজুল আলম খান সু্যোগ খুঁজতে থাকেন ক্ষমতা দখল করবার। এ সুযোগের ধারাবাহিকতায় তিনি কর্নেল তাহেরকে দিয়ে ৭ নভেম্বরের ব্যর্থ অভ্যুত্থান সংগঠিত করেন, যার ফলশ্রুতি হল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতায় আসা। এ অভ্যুত্থান পরিচালনা করবার জন্য তাহেরকে দিয়ে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে তিনি গঠন করেন 'বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা'। এ সংস্থার হাতে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন খালেদ মোশাররফ, মেজর হায়দারসহ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সেনাবাহিনীর অনেক প্রতিভাবান অফিসার এবং সৈনিক।

এদের লাশ যখন ক্যন্টনমেন্টে পড়ে ছিল তখন ইনুসহ জাসদের অনেক নেতাকর্মীকে ঢাকার রাস্তায় উল্লাস করতে দেখে গেছে অভ্যুত্থান সফল হয়েছে এটা ভেবে। অভ্যুত্থানের ক্ষেত্র তৈরি করবার জন্য জাসদ সে সময় ব্যাপক প্রচারণা চালায় খালেদ মোশাররফকে ভারতীয় চর আখ্যা দিয়ে।

৭ নভেম্বরের ঘটনার পর সামরিক শাসক এরশাদের সাথে হাত মিলানো ছাড়া সিরাজুল আলম খানের রাজনীতিতে আর কোন উল্লেখ করবার মত ভূমিকা নেই। বর্তমানে আসম রবসহ জাসদের ক্ষুদ্র একটা অনুসারী রাজনীতির এ ব্যর্থ খলনায়ককে গুরু মনে করেন। রব বইটির পরিশিষ্টে এক সাক্ষাৎকারে অকপটে বলেছেন, রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার সময় থেকে আজ পর্যন্ত দাদার নির্দেশের বাইরে এক পাও তিনি ফেলেন নাই এবং দাদা যতদিন বেঁচে থাকবেন, ততদিন তাঁর নির্দেশ মতই তিনি পরিচালিত হবেন।

সেই দাদার নির্দেশেই রবসহ সেদিন জাসদ কর্মীরা শ্লোগান দিয়েছিল, 'মুজিব, মণি, মোজাফফর, বাংলার মীর জাফর'। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর দলের সাথে বেঈমানী করে কারা বাংলার ইতিহাসে মীর জাফরের ভূমিকায় অভিনয় করেছিল, সেটি আজ জাতির কাছে পরিস্কার।

[পাদটীকা : দাদা সিরাজুল আলম খানের বাংলাদেশের রাসপুটিন হবার আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে যেয়ে জাসদের অনেক নেতা কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন, যা তাদের হিসাবে ৩০ হাজার। এ লক্ষ্যে তাঁরা অনেকের প্রাণ সংহারও করেছেন। পুরো বইটিতে জাতির কাছে না হোক, জাসদের নেতা কর্মীদের কাছে ক্ষমা চাওয়া বা অনুশোচনার বিষয় তো নেই-ই, এমনকি এত প্রাণ ঝরে পড়বার বিষয়টি একটি লাইনেও উল্লেখ নেই। এ ধরণের ক্ষমা না চাওয়া,  অনুশোচনা বিহীন জীবন আরেক জনের ক্ষেত্রে দেখা যায়। তিনি হলেন গোলাম আজম। ]