বখাটে কাটিং!

আহসান কবিরআহসান কবির
Published : 24 August 2019, 08:00 AM
Updated : 24 August 2019, 08:00 AM

গানের জগতে বিটলস তখন দুনিয়া কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে একবার জমজমাট কনসার্ট শেষ করার পর এক সাংবাদিক এসে জানতে চাইলো- আচ্ছা আপনারা কি নিয়মিত পরচুলা পরেন? বিটলস ব্যান্ডের সদস্যদের পক্ষ থেকে জন লেনন উত্তর দেন- না কখনোই পরচুলা ব্যবহার করি নি। যদি করতাম তাহলে আমাদের পরচুলাই হতো একমাত্র নকল চুল যেখানে আসল খুশকি রয়েছে!

'মাকানাস গোল্ড' ছাড়াও  অনেক বিখ্যাত ছবির অভিনেতা ওমর শরীফ এবং গ্রেগরি পেগের পরচুলার ভালো কালেকশন ছিল। জীবনে পরচুলা পরেন নি, তবে মাথা ন্যাড়া করে অভিনয়ে এসেও মানুষের বুকে স্থান করে নিয়েছিলেন আর্ন্তজাতিক মানের অন্তত দুজন অভিনেতা। এদের একজন কোজাক (এই সিরিয়ালটি একসময়ে বিটিভিতে প্রচারিত হতো) খ্যাত অভিনেতা টেলি স্যাভালাস, অন্যজন 'ডেথ রেজ' সহ অনেক জনপ্রিয় ছবির নায়ক ইয়োল ব্রাইনার।

এদেশের নায়ক নায়িকারা পরচুলা ছাড়া যেন একচুল নড়তেও পারেন না! ববিতা, জসীম, ওয়াসিম, সোহেল রানাকে ছবিতে কিংবা বাস্তবে পরচুলা ছাড়া খুব কমই দেখা গেছে।

এবার পরচুলার পরিবর্তে আসল চুলের আলোচনায় আসা যাক। আলোচনায় চুলের প্রসঙ্গ উঠে এলে অনেকে প্রসঙ্গ বদলে ফেলতে চান। বলেন- ভাই দয়া করে একেবারে নীচে নামবেন না! কারণ যখন মাথায় থাকে তখন সেটাকে আমরা বলি চুল। কিন্তু বুক, বগল কিংবা আরো নিচে নামলে সেটার কী রূপ বা নাম হয় আমরা সে প্রসঙ্গে আর না যাই। শুধু এইটুকু ভেবে আপ্লুত হই যে একেবারে আদিকাল থেকেই মানুষ তার চুলের প্রতি যত্নশীল ছিল। ক্লিওপেট্রার চুলের বিবরণ ও তার যত্ন-আত্তি নিয়ে বিস্তর লেখালেখি কিংবা ছবিও তৈরি হযেছে। রূপকথার গল্পে রাজকন্যা রুপানজেলের বড় চুলের বিবরণ আমরা পড়েছি যেটা নিয়ে অ্যানিমেটেড ছবিও হয়েছে। রুপানজেলকে জাদুকরী চুলের কারণে ছোটকালে চুরি করে নিয়ে যায় এক ডাইনি এবং ১৮ বছর এক সুউচ্চ মিনারে আটকে রাখে। এই ১৮ বছরে চুল অনেক বড় হয়ে যায় এবং ডাইনি এই চুল বেয়েই মিনারে উঠতো এবং নামতো। রাজকুমারীর চুলের পরশে রোগ শোক ভালো হয়ে যেত। শেষমেষ এক ভিনদেশি যুবক রাজকন্যার প্রেমে পড়ে এবং রাজকন্যাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় আর চুল কাটার কারণে মারা পড়ে ডাইনি। এই গল্পের অনুসরণে তেলের বিজ্ঞাপনেও আমরা দেখেছি ঘোড়ায় করে ছুটে আসতে থাকা রাজকুমার ঘোড়া থামিয়ে রাজকন্যার লম্বা চুলের প্রেমে পরে গেছে! কথায় আছে- পানিতে চুন আর তেলে চুল তাজা। অবশ্য চুল নিয়ে কবিরাও কম যান নি। জীবনানন্দের কবিতার সেই অমর লাইন নিশ্চয়ই সবার মনে আছে- চুল তার কবে কার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য!

বাংলার জনপ্রিয়তম দুই কবি রবীন্দ্রনাথ আর কাজী নজরুলের মাথায় চুলের আধিক্য ছিল। বলা যায় তাদের মাথায় চুলের বাহার ছিল! শামসুর রাহমান এর মতো নির্মলেন্দু গুণ কিংবা হেলাল হাফিজ এর চুলও মানুষের নজর কাড়ে। বাংলাদেশে একজন আছেন, আছেন বহুদেশের বহু মানুষ যারা চুল দিয়ে গাড়ি কিংবা ট্রাক টানতে পারেন, করতে পারেন আরো অনেক ভারি কাজ, চুলের জন্যই অনেকে করেছেন বিশ্বরেকর্ড। গানেও চুলের ব্যবহারের কমতি নেই। যেমন- তোমার চুল বাধা দেখতে দেখতে ভাঙ্গলো কাচের আয়না কিংবা মোর প্রিয়া হবে এসো রানী/দেব খোপায় তারার ফুল। বাংলা ছবির হিট গান হচ্ছে- খায়রুন লো,তোর লম্বা মাথার কেশ কিংবা কন্যার চিরল বিরল চুল,কন্যার কেশে জবা ফুল/সেই ফুল পানিতে ফেইলা কন্যা করলো ভুল/কন্যা ভুল করিস না/আমি ভুল করা কন্যার লগে কথা বলবো না!

চুলের রাজনৈতিক ব্যবহারও লক্ষ্যণীয়। পাকিস্তানের সাবেক একনায়ক জেনারেল জিয়াউল হককে নিয়ে কৌতুক ছড়িয়ে পড়েছিল এমন- জিয়াউল হক চুল কাটতে গেলেই নাপিত জিজ্ঞাসা করতো স্যার নির্বাচন কবে দিচ্ছেন? দু-তিনবার এমন প্রশ্ন করার পর একদিন ক্ষেপে গেলেন জিয়াউল হক। রেগে মেগে বললেন- যখনই চুল কাটতে আসি কেন জানতে চাস নির্বাচন কবে দিচ্ছি? নাপিত ভয়ে ভয়ে উত্তর দিল-যখনই নির্বাচনের কথা জানতে চাই তখনই আপনার চুল খাড়া হয়ে যায়। কাটতে কী যে সুবিধা হয়!

বাংলাদেশের প্রয়াত স্বৈরাচার এরশাদকে নিয়েও একই ধরনের কৌতুক ছিল। উত্তপ্ত আলোচনা ছিল খালেদা জিয়ার মেক আপ আর চুল ফুলানো ফাপানো নিয়ে। ২০১৩ সালে বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন (এই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি) নিয়ে শেখ হাসিনা বারবার বলতেন-সংবিধানের বাইরে তিনি একচুলও নড়বেন না! নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জন কীও 'চুল' ধরতে যেয়ে ধরা খেয়েছিলেন। ২০১৫ সালে জন কী এক ক্যাফেতে খেতে গিয়েছিলেন। এক খাদ্যপরিবেশিকার চুল ও বেণী দেখে ভালো লেগে যায় জন কীর। তিনি ঐ পরিবেশিকার চুল ধরে টান দেন, চুলে বিলি কেটে ফান করেন। এই ঘটনা জানাজানি হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় এবং জন কী ঐ খাদ্যপরিবেশিকার কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন।

আসলে চুল হচ্ছে এক ধরনের 'প্রোটিন তন্তু'। চামড়ার একেবারে বাইরের স্তরে এপিডারমাল সেলে অবস্থিত 'ফলিকল' থেকে কেরাটিন সমৃদ্ধ এই প্রোটিন তন্তু বের হতে থাকে যাকে আমরা চুল বলি। মানুষ লাখপতি হয় চুলে অর্থাৎ পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষের মাথায় কমপক্ষে একলাখ চুল থাকে এবং চুল প্রতিদিন বড় হয়। প্রতিদিন চুল পড়ে, বেশি পড়ে বুড়ো বয়সে। চুল অনেক কারণে পড়ে, তবু জিন বা বংশগত কারণে সবচেয়ে বেশি পড়ে। স্যার আইজাক নিউটন কিংবা আলবার্ট আইনস্টাইন আজীবন চুল নিয়ে ভাবার কোন সময়ই যেন পান নি। তবুও তাদের চুল ছিল দেখার মত। অন্যদিকে বিখ্যাত অভিনেতা অনুপম খের তার জীবনের একটা বড় সময় এবং টাকা পয়সা ব্যয় করেছেন যেটুকু চুল ছিল সেটুকু ধরে রাখার জন্য! ফলাফল ভালো হয় নি। সময়, টাকা পয়সা এবং চুল একই সাথে জলে গেছে! বাংলাদেশের বিখ্যাত অভিনেতা আবুল হায়াতকে এ ব্যাপারে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা যেতে পারে।

যাই হোক চুল বার বার আলোচনায় ফিরে আসে। ২০১৯ এর অগাস্ট মাসে মাগুরা সদর থানা পুলিশ এক নির্দেশ জারি করেছে। চুলে কেউ 'বখাটে কাটিং' দিতে পারবে না। কানের ওপর থেকে কয়েক ইঞ্চি একদম কম চুল আর মাথার ওপরের দিকে লম্বা চুল রাখার ফ্যাশনকে পুলিশ বলছে বখাটে কাটিং। চুলে এই কাটিং দিয়ে মোটর সাইকেল চালালে নাকি গতিবেগ বাড়ার সাথে সাথে চুল ওড়া শুরু করে। নিজেকে তখন নাকি নায়ক নায়ক মনে হয়! পুলিশ মাগুরার সেলুন মালিক ও নরসুন্দরদের (নাপিত) ডেকে বলে দিয়েছে যে কাউকে তারা যেন বখাটে কাটিং করে না দেন। ছেলেপেলেরা নাকি উদ্ভট ড্রেস পরে, চুলে বখাটে কাটিং দিয়ে দ্রুতগতিতে  মটর সাইকেল চালায় এবং বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে। এতে নাকি দুর্ঘটনাও বাড়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটা নিয়ে বেশ হৈচৈ হয়েছে। একজন মন্তব্য করেছেন- কমবয়সী ছেলেরা দেশ বিদেশের খেলোয়াড় বা অভিনেতাদের দেখে এমন ফ্যাশন করে।

চোরাকারবারি, মাদক ব্যবসায়ী, গুম, খুন সেসবের দিকে খেয়াল থাকেনা পুলিশের তাদের নজর থাকে চুলের দিকে। এখন সাধারণ মানুষ আর কমবয়সী ছেলেরা হেনস্তার মুখোমুখি হবে। একজন সরস মন্তব্য করেছেন এমন- সেনাবাহিনী ও পুলিশের চাকরিতে চুল ছোট রাখতে হয়। কানের ওপর তাদেরও চুল কম থাকে। সম্ভবত বড় চুল রাখতে না পারার বেদনা নিয়ে পুলিশ এখন সবার চুলই ছোট করতে বলছে।

মন বড় করার জন্য মাঝে মাঝে মাথার চুলও বড় রাখা দরকার। চুল বড় রাখা ভালো নাকি ছোট চুলই ভালো সেই বিতর্কে না যাই। না যাই চুলোচুলিতে। গলাগলি করে সবাই মিলে মিশে যেন আনন্দে বাঁচি। ছোট কালে আমি নিজেও একবার ছোট চুলের জন্য বেঁচে গিয়েছিলাম। নিয়ম আছে কিনা জানি না, এক সাইকেলে নাকি তিনজন চড়া যায় না। কলেজে উঠে তিনজন এক সাইকেলে চড়ার অপরাধে আমাদের পথ আটকে দাড়িয়েছিল সামরিক বাহিনীর লোকজন। দেশে তখন এরশাদের সামরিক শাসন চলছে। শাস্তি পেতে হয়নি আমাদের। কারণ আমি ক্যাডেট কলেজে পড়তাম, নিয়মিত বাটি ছাঁট দিতে হতো আমাকে। আমার মাথার চুল দেখে একই রকম চুল কাটিয়েদের সম্ভবত মায়া হয়েছিল! সে সময়ে কোন কোন মেয়েদের গায়ে আলকাতরা লাগিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। যাই হোক চুল নিয়ে চুলোচুলিতে না গিয়ে অনেকেরই  জানা একটা ঘটনা বলে বিদায় নেই।

মার্ক টোয়েন সেলুনে গেছেন চুল কাটাতে। নরসুন্দর তাকে জিজ্ঞাসা করলো- স্যার আজকে এই শহরে মার্ক টোয়েন আসতেছে। লেকচার দিব। যাইবেন? মার্ক টোয়েন বললেন যাবার ইচ্ছে আছে। নরসুন্দর বললো-টিকেট কাটছেন? না কাটলে কিন্তু দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে বক্তৃতা শুনতে হবে। মার্ক টোয়েন উত্তর দিলেন- এটাই দুর্ভাগ্য। যখনই ওই লোক বক্তৃতা দেন আমাকে বাধ্য হয়েই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়!

কার চুল উড়ছে, কার চুল দুলছে, কার চুল ফোলানো, কার চুল খাড়া থাকলে কাটতে সুবিধা হয় আমরা যেন সেইসব ভেবে চুলোচুলি না করি। আসুন গলাগলি করে আনন্দে বাঁচি।