বাংলা ও বাঙালি (চার): জম্মু-কাশ্মীরসহ অখণ্ড স্বাধীন ভারত হয়েও হলো না কেন?

হাসান মাহমুদহাসান মাহমুদ
Published : 22 August 2019, 03:04 AM
Updated : 22 August 2019, 03:04 AM

(বিস্মৃতিপ্রবণ জাতিকে শেকড়ের ইঙ্গিত)

১৯৪৬ সাল।   অস্থির, চঞ্চল অখণ্ড ভারতবর্ষ। পরাধীনতার অন্ধকারে কেটে গেছে একশ নব্বই বছর।  যেন আলো বলে কোনকিছু ছিল না কোনদিন।  শতাব্দীর সেই অভিশপ্ত অচলায়তন ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে।  স্বাধীনতার জন্য কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের পেছনে চল্লিশ কোটি ভারতবাসী চাপের পর চাপ দিয়ে যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক চাপ শুরু হয়েছে বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই।  সেই সাথে যোগ হয়েছে  নেতাজি-র বজ্রাঘাত।  আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তিযোদ্ধাদের বন্দি রেখেও 'বিচার' করার সাহস হচ্ছে না ক্ষুদিরাম সূর্য সেনের বিচারকদের। হঠাৎ বাতাসে হাত থেকে খৈ উড়ে গেলে যেমন 'উড়ো খৈ গোবিন্দায় নমঃ' মন্ত্র পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ, ঠিক তেমনি হাত থেকে প্রায় ফসকে যাওয়া ভারতবর্ষকে স্বাধীন করে দেবার ইচ্ছেটা উদারতার সাথে প্রকাশ করেছেন ইংল্যাণ্ডের অ্যাটলি-মন্ত্রীসভা।

কিন্তু ইচ্ছে করলেই তো আর হলো না ! জিন্না সবুজ স্বাধীনতা চান তো কংগ্রেস চায় হলুদ। কংগ্রেস চারকোণা স্বাধীনতা চায়, তো জিন্না চান গোলাকার।  জিন্না পাকিস্তান চান তো, কংগ্রেস চায় অখণ্ড ভারত।  এইসব গোলক ধাঁধায় ল্যাজে-গোবরে হয়ে কিছুদিন আগে ব্যর্থ মিশন নিয়ে ফিরে গেছেন ক্রিপ্স্ সাহেব।  স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপ্স্, ইউরোপের চাণক্য। যুদ্ধের সময় সমস্ত ইউরোপ যখন হিটলারের ব্লিৎসক্রিগ আর প্যান্থারের আঘাতে পর্যুদস্ত,  প্রতিদিন নুয়ে আসছে চার্চিলের মেরুদণ্ড ঠিক তখনই মি. ক্রিপসকে রাষ্ট্রদূত করে পাঠানো হয়েছিল মস্কোতে। পারলে ওই লোকটাই পারবে,  যদি কোনওরকমে রাশিয়া আর জার্মানির মধ্যে যুদ্ধটা বাধানো যায়! নাহলে আর কোনও উপায় নেই হিটলারকে ঠেকানোর। পর্দার আড়ালে কী ঘটে গেল, জার্মানি রাশিয়া আক্রমণ করলো, মোড় ঘুরে গেল বিশ্বযুদ্ধের।  খুশিতে ফেটে পড়ল মিত্রশক্তি, ক্রিপ্স্ পেয়ে গেলেন ইংল্যাণ্ডের সর্বোচ্চ খেতাব 'নাইটস্। গতবারের ব্যর্থতায় অভিজ্ঞ স্যার ক্রিপ্স্ এবার এসেছেন স্যার প্যাথিক লরেন্স-এর ক্যাবিনেট মিশনের সদস্য হয়ে।

এরপর এল সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত।  প্রথমে বিশ্বাস হতে চায় না। বারবার চোখ রগড়ে খবরের কাগজ পড়ছে সবাই, বারবার স্টেশন বদল করে রেডিও শুনছে।   না, কোনো ভুল নেই।   ক্যাবিনেট মিশন সফল হয়েছে।   মেনে নিয়েছে কংগ্রেস মুসলিম লীগ দু'দলই।  অভূতপূর্ব খেলা দেখিয়েছেন রাজনীতির জাদুকর স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপ্স্।   কংগ্রেসকে বলেছেন- "অখণ্ড স্বাধীন ভারত চাও? এই রইল তোমার অখণ্ড ভারতের  স্বাধীনতা।" জিন্নাকে বলেছেন- "স্বাধীন পাকিস্তান চাও তো ? এই রইল তোমার স্বাধীন পাকিস্তানের রূপরেখা।" মেনে নিয়েছে কংগ্রেস, মেনে নিয়েছে মুসলিম লীগ।  এ কি হলো ? কেমন করে হল ? অখণ্ড  ভারত আর স্বাধীন পাকিস্তান একই সাথে হয় কি করে ?  নিশ্চয়ই হয়, নইলে কংগ্রেস মুসলিম লীগের বাঘা বাঘা নেতারা এটা মেনে নিল কি করে ?

মেনে নিল কারণ ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবটার মধ্যে দু দ'লের ম্যানিফেস্টোই মোটামুটি মিল খায়।প্রস্তাবটা হলো, জোন এ, বি এবং সি- এই তিনটে অঞ্চলে ভাগ হয়ে স্বাধীন হবে ভারতবর্ষ। জোন এ, বি ও সি হলো মোটামুটি বর্তমান পাকিস্তান (জম্মু-কাশ্মীর সহ), ভারত ও বাংলাদেশ। স্বভাবতই পূর্ব পশ্চিমে মুসলমান হবে মেজরিটি। নিজেদের সম্পদের ওপর এই জোনগুলোর থাকবে অখণ্ড অধিকার, কেন্দ্র শুধু সামরিক, যোগাযোগ এবং পররাষ্ট্র নীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। দশ বছর এভাবে চলার পর কোনো জোন যদি আলাদা হয়ে নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র চায়, তবে তা করার অধিকার তাদের থাকবে। 

বিস্ময়ের ঘোর কাটতে, বিশ্বাস হতে সময় লাগল। তারপর আনন্দে যেন ফেটে পড়ল ভারতবর্ষ। স্বাধীনতা! এত বছরের এত শহীদের রক্ত দিয়ে কেনা সেই পরম, চরম, সেই মোক্ষ ! সহস্র লেখক, কবি দার্শনিকের স্বপ্ন, কত সন্তানহারা পিতামাতার, মাতৃহীন এতিমের অশ্রু! কত নুরুল দীন, রশীদ আলী, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, শাহনেওয়াজ, ডান্ডি খান, ভগৎ সিং, কত তিতুমীর, সুভাষ বোস, মঙ্গল পাণ্ডে, টিপু সুলতানের আত্মদানে গড়া সেই উজ্জ্বল সূর্য। কত প্রীতিলতা, বীনা দাস, যতীন মাঝি, কনকলতা, ফুলেশ্বরী, জয়দুর্গা দেবী চৌধুরানী, শিবচন্দ্র রায়, ভবানী পাঠক, ফকির মজনু শাহ, উধম সিং, আলীমুদ্দীন, দিরাজী নারায়ন কৃপানাথ, ইসরাইল খাঁ, মুসা শাহ, কত মাতঙ্গিনী হাজরার রক্তস্রোত। কত ফাঁসি, কত আন্দামান, অন্ধকার টর্চার চেম্বারের কত মর্মভেদী আর্তনাদ। তার চির অবসান হবে এবার! অর্ধেক গোলার্ধ ওপার হতে সাদারা এসে দেশটাকে ছিঁড়ে খাবে না আর, "ডিভাইড অ্যাণ্ড রুল"-এর বিষাক্ত খেলা হবে বন্ধ, সাদাদের ক্লাবের দরজায় ঝোলানো থাকবে না 'ভারতীয় এবং কুকুরের প্রবেশ নিষেধ'।

অলক্ষ্যে অট্টহাসি হাসছে নিয়তি। কেউ জানে না ক'দিন পরই হিসাবের কড়ি বাঘে খেয়ে যাবে। চিরদিনের মত বদলে যাবে গোটা ভারতবর্ষ উপমহাদেশের অধিবাসীদের রাজনৈতিক ভাগ্য একটি মাত্র লোকের একটি মাত্র কথার আঘাতে।

অবধারিতভাবে ঘটে গেল ঘটনাটা। কেবিনেট মিশন গৃহীত হয়েছিল ১৯৪৬ সালের ২৪ মে কংগ্রেস দ্বারা, এবং ২৫ জুন মুসলিম লীগ দ্বারা। ১০ জুলাই বোম্বেতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে কংগ্রেস প্রেসিডেণ্ট নেহেরু বলে ফেললেন, "কংগ্রেস কেবিনেট প্ল্যান গ্রহণ করিয়াছে বটে কিন্তু সার্বভৌম গণ-পরিষদ কংগ্রেসের মত মানিয়া চলিতে বাধ্য নয়"। 

বলে কি !  থ' হয়ে গেল ভারতবর্ষের মুসলমান।  পার্লামেন্টে ওরাই যে মেজরিটি !  তবে ?  তবে কি হিন্দুরা মেজরিটির জোরে সংসদে ইচ্ছেমত আইন পাশ করবে?  উম্মুখ হয়ে তাকাল সবাই জিন্নার দিকে। ওদিকে ব্যতিব্যস্ত চিৎকার শুরু করেছেন আবুল কালাম আজাদসহ কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ – নেহেরু যা বলেছেন তা তার ব্যক্তিগত মত মাত্র – ওটা কংগ্রেসের পলিসি নয়। কিন্তু আর পেছন ফিরে তাকালেন না বিক্ষুব্ধ জিন্না। লীগের বিশেষ অধিবেশন শেষে তিনি ঘোষণা করলেন- "পাকিস্তান অর্জনের জন্য মুসলিম জাতির প্রত্যক্ষ সংগ্রামের সময় এসেছে"। তিনি আরো ঘোষণা করলেন ১৬ অগাস্ট পালন করা হবে "প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস"। সর্বোচ্চ নেতার মুখে 'প্রত্যক্ষ' ও 'সংগ্রাম' শব্দ দুটো মারাত্মক, এর বিশদ ব্যাখ্যা না করলে কেয়ামত হয়ে যেতে পারে। কেয়ামত  হয়ে গেলও। আবেগাপ্লুত ক্ষুব্ধ ভারতীয় মুসলমানকে জিন্না পরিষ্কার করে বললেন না 'প্রত্যক্ষ সংগ্রাম' আসলে কী এবং কিভাবে সেটা করা হবে। এবার এল খাঁড়ার ঘা। কোটি কোটি মুসলমানের প্রচণ্ড রুদ্ধ আবেগ যখন প্রকাশের পথ খুঁজছে তখন খাজা নাজিমুদ্দীন কলকাতায় ১৬ অগাস্ট মুসলিম ইনস্টিটিউটের সভায় ঘোষণা করলেন, উদ্ধৃতি- "আমাদের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম ইংরাজের বিরুদ্ধে নয়, হিন্দুর বিরুদ্ধে।"

নিজের দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতার মুখে এহেন উস্কানিমূলক সাম্প্রদায়িক ঘোষণা শুনে বাংলার হিন্দুরা স্বভাবতই প্রথমে শংকিত এবং পরে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠল। সেই দিনই সেই সভা শেষে হবার আগেই কেয়ামত হয়ে  কলকাতায় এবং পরে বাংলা বিহারে সর্বনাশা নেমে এল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ভারত স্বাধীন হবার কথা ছিল ১৯৪৮ সালে, দাঙ্গার ভয়াবহতায় বিচলিত অ্যাটলি মন্ত্রীসভা এক বছর আগেই ১৯৪৭ সালে ভারত ছাড়ার ঘোষণা দিলেন।     

লক্ষ আর্তনাদ হাহাকারে, হাজার হাজার রক্তস্রোতে ভাসতে থাকল ভারতবর্ষ, বিশেষ করে বাংলা।  রক্তের স্রোতে ভেসে গেল কেবিনেট মিশন, আসমুদ্র হিমাচল অখণ্ড স্বাধীন ভারত শূন্যে মিলিয়ে গেল চিরকালের জন্য।