বেসরকারি খাতে মিডওয়াইফারি শিক্ষা: কিছু প্রতিবন্ধকতা

Published : 20 August 2019, 02:30 PM
Updated : 20 August 2019, 02:30 PM

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সরকার এখন পর্যন্ত যতগুলো সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন, তারমধ্যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় মিডওয়াইফারি বা ধাত্রী পেশাটির প্রচলন নিসন্দেহে অন্যতম। কেবল মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে ফেলার লক্ষ্যটি পুরোপুরি অর্জন করতে না পারায় আমরা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের খুব কাছাকাছি পৌঁছানোর পরও স্বপ্নটি পূরণ করতে পারিনি। যদিও এসময়ে মাতৃমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে। কিন্তু পরবর্তী সময়ের গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, মৃত্যুহার কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি স্থবির হয়ে গেছে, এক্ষেত্রে যে হারে বাংলাদেশের উন্নতি হচ্ছিল এখন আর সেটি হচ্ছে না। গবেষণাটি বলছে ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের ভেতর মাতৃমৃত্যুর অনুপাত (এমএমআর) একেবারেই কমেনি।

মিডওয়াইফারির মতন একটি স্বতন্ত্র ধারার শিক্ষা এবং পেশার মূলধারায় অন্তর্ভূক্তি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় অত্যন্ত সফল পদক্ষেপ বলে আমরা মনে করি। দেশের যেসব দুর্গম প্রান্তে মায়েরা গর্ভকালীন এবং প্রসব পরবর্তী স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা পায় না তাদের জন্য মিডওয়াইফ হতে পারে ভরসার অপর নাম। আশার বিষয় হলো গত কয়েক বছরে, এই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।

আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে ৩৮টি সরকারি এবং ১৭টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ৩ বছরের ডিপ্লোমা কোর্স চালু করেছে। এখন পযর্ন্ত ২ হাজার ১৩১ জন প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফ লাইসেন্সিং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিল (বিএনএমসি) এর কাছ থেকে পেশাদার মিডওয়াইফ হবার লাইসেন্স পেয়েছে। এই লাইসেন্স প্রাপ্ত মিডওয়াইফদের প্রায় সবাই বর্তমানে সরকার বা বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছে।

আমাদের বুঝতে হবে, মিডওয়াইফারি পেশারপ্রসার ঘটাতেই কিন্তু বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের পাশে এসেদাঁড়িয়েছিল। দেশের দুর্গমতম প্রান্তেঅবস্থিত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি এর মধ্যেইমানসম্মত মিডওয়াইফারি শিক্ষার ব্যবস্থা করে খ্যাতিঅর্জন করেছে। এ পর্যন্ত৪৬১ লাইসেন্স প্রাপ্ত মিডওয়াইফ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষাসম্পন্ন করেছেন। সবচেয়েবড় কথা, সর্বশেষ জাতীয়লাইসেন্সিং পরীক্ষায় প্রথমস্থান অধিকার করা মিডওয়াইফএরকম একটি বেসরকারিশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই পড়ালেখা করেছে।

কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার, এইসব বেসরকারি উদ্যোগ নানান প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে এবং নিজেদেরঅস্তিত্ব রক্ষার জন্য সংগ্রামকরে যাচ্ছে। যতদিন অব্দি সরকারি ভাবে সমস্যাগুলোচিহ্নিত করে সমস্যারসমাধানের লক্ষে আন্তরিকনা হবে, ততদিন এসকল প্রতিবন্ধকতা যে তিমিরেরয়েছে ঠিক সেখানেইথেকে যাবে।

গত ফেব্রুয়ারিতে মিডওয়াইফদের যে লাইসেন্সিং পরীক্ষাটি হবার কথা ছিল সেটির ব্যাপারে একটি আপত্তি তুলে মামলা দায়ের করে হাই কোর্টের আদেশে তা স্থগিত করা হয়েছে। এতে করে ডিপ্লোমা শেষ করা ১ হাজার ২০৬ জন মিডওয়াইফের ভবিষ্যতে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তার কারণ তারা লাইসেন্স ছাড়া চাকরির আবেদন করতে পারবে না, আবার তাদের অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা ধরে রাখার জন্য হলেও নিজ উদ্যোগে মিডওয়াইফারির চর্চা করতে পারবে না। এ দেশের এই মহূর্তে তাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, অথচ এখন তারাই আইনি মারপ্যাচে পড়ে নিজেদের পেশা অবলম্বন করতে অক্ষম। এই অবস্থার একটি সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ভবিষ্যতে যারা এ পেশায় আসতে চায় তাদের উপরও পড়বে।

মিডওয়াইফারি বাংলাদেশেরজন্য তুলনামূলকভাবে নতুন পেশা। তাই দেশে এখনওএই  বিশেষ শিক্ষায় শিক্ষিত এবং পর্যাপ্তপ্রশিক্ষণ পাওয়া শিক্ষক মোটেই সহজলভ্য নয়। আমাদেরদেশে প্রচলিত নার্সিং শিক্ষা কার্যক্রমে মিডওয়াইফারির খুবই প্রাথমিককিছু বিষয় শেখানোহয়। এই নার্সদেরইমিডওয়াইফারিতে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে শিক্ষকহিসেবে কাজ চালিয়েনেওয়া হচ্ছে। শিক্ষকের এই অপ্রতুলতামোকাবেলা করতে কিছুপ্রতিষ্ঠান অবশ্য তাদের নিজস্ব প্রশিক্ষিত ডিপ্লোমা মিডওয়াইফদের জুনিয়র শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছে। কিন্তু সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ফলে তাদেরওশিক্ষকতায় ধরে রাখাযাচ্ছে না।

অথচ এই সমস্যার সমাধান আরো আগেই হয়ে যেতো যদি মিডওয়াইফারিতে বিএসসি কোর্স খোলার পাঠ্যসূচিটি সরকার চূড়ান্ত করে দিত। কেননা প্রাথমিকভাবে ধরে নেওয়া হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মিডিয়াইফারিতে স্নাতক কোর্স শুরু করতে পারলেই অল্প সময়ের মাঝে শিক্ষকের ঘাটতি মেটানো যাবে।

ইদানিং আমরা এটাও শুনতে পাচ্ছি যে সরকার ডিপ্লোমা মিডওয়াইফদের জন্য দুই বছরের বিএসসি কোর্স চালু করার কথা ভাবছে। কিন্তু ডিপ্লোমা মিডওয়াইফরা এইচএসসি পাশ করার পর তিন বছর নিবিড়ভাবে পড়াশোনা করে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। তাই তাদের দুই বছর নয় বরং এক বছরের মধ্যেই বিএসসি সম্পন্ন করার অনুমতি দেওয়া উচিত। এধরনের বিএসসি পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশেই প্রচলিত আছে এবং বাংলাদেশেরও উচিত হবে এ পথ অবলম্বন করা। এর বাইরেও, মিডওয়াইফারির উপর চার বছরের স্নাতক কোর্স শুরু করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উৎসাহিত করা উচিত। তার ফলে স্বাধীন পেশা হিসাবে মিডওয়াইফারি প্রতিষ্ঠিত হবে এবং শিক্ষক সংকটের যে সমস্যা বর্তমানে রয়েছে, সেটিও দূর হবে।

সরকারের তরফথেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, বেসরকারিশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ২৫ লাখটাকা আমানত, ৩০ হাজার স্কয়ার ফিট জায়গাএবং সকল শিক্ষার্থীরজন্য আবাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করে তারপরমিডওয়াইফারি ডিপ্লোমা কোর্স চালু করতেহবে। সরকারের এমন সিদ্ধান্তবেসরকারি মিডওয়াইফারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি স্রেফ বিমাতা সূলভ আচরণ। কেননা একই মানেরঅন্য কোনও কোর্সেরজন্য এত বড় অংকের প্রয়োজন পড়ে না।  এর ফলে অনেক বেসরকারিউদ্যোক্তাই পিছিয়ে যাবেন এবং মিডওয়াইফারিশিক্ষার উন্নয়নে সরকারের মহৎ উদ্যোগটিসার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উপরন্তু, বেসরকারি মিডওয়াইফারিপ্রতিষ্ঠানকে ভর্তুকি দেয়ার কথা সরকারেরএখনই বিবেচনা করা উচিত। কেননা বেসরকারি মিডওয়াইফারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং তাদেরআয়ের একমাত্র উৎস টিউশনফি। কিন্তু আমাদের দেশের সাধারণ মানুষেরআর্থিক সঙ্গতি বিবেচনা করলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বড় অংকেরটিউশন ফি আদায়করা সম্ভব নয়।

সর্বশেষ কিন্তঅত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ, সরকার গত বছরথেকে সরকারী ও বেসরকারিউভয় খাতের মিডওয়াইফারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য সম্মিলিতভর্তি পরীক্ষা নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি বেসরকারিপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি রীতিমত বৈষম্যমূলকআচরণ। সরকারেরনিজস্ব প্রতিষ্ঠানগুলো মিডওয়াইফারি শিক্ষায় ডিপ্লোমা কোর্স পরিচালনা করে বিনামূল্যে,ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে ভালো প্রার্থীরা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতে ভর্তি হয়। আর মেধাতালিকার নিচের দিকে ঠাইপাওয়া শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয় বেসরকারিপ্রতিষ্ঠানগুলোয়। তাই এক্ষেত্রেসরকারের উচিৎ হবেবেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরাসরি শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমতি দেওয়া।

বেসরকারী শিক্ষাখাত যদি গুণ ও মানে তাদেরসর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছুতে না পারে, সেক্ষেত্রে টেকসইউন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)অর্জনে সরকারের উদ্যোগগুলি ঝুঁকিতে পড়বে। মিডওয়াইফারিশিক্ষা কর্মসূচিকে শুধুএকারণেই এগিয়েনিয়ে যাওয়াটা জরুরি। মাতৃস্বাস্থ্য সংক্রান্ত এসডিজি অর্জন করতে হলেআরও হাজার হাজার প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফ বাংলাদেশের প্রয়োজন। সরকারকে তাই নিজউদ্যোগে এগিয়ে এসে বেসরকারিখাতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে থেকে সকলবাধা বিপত্তি এবং প্রতিবন্ধকতাদূর করতে হবে।