শুধু মাতম, শুধু কোলাহল, শান্তি কোথায়?

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 20 August 2019, 09:53 AM
Updated : 20 August 2019, 09:53 AM

বেদনাকে মাতম করে তোলায় আমাদের জুড়ি মেলা ভার। আজকের লেখাটি আমি জাতির জনককে মনে করে লিখছি। কেন তাঁকে শুধু একটি বিশেষ দিনে শোকাবহভাবে স্মরণ করতে হবে? তিনি কি পাড়ায় মহল্লায় কিছু নামধারী নেতা আর মুখচেনা মানুষের সম্পদ? আজ যে কাঙালি ভোজ বা খিচুড়ি বিতরণ তাও আমার কেমন কেমন লাগে। দেশ এগুচ্ছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের জয়রথে। তিনি যে সবসময় তাঁর কথায় দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের কথা বলেন তা কি অসত্য? আজ দেশে মানুষের মুখের গ্রাস, পরনের কাপড় আর মাথার ওপর একটি চাল প্রায় নিশ্চিত। এ কথা বলছি না সবার তা আছে। কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে মানুষ আগের মত অভাব অনটন বা সংকটে নাই। সে দেশে সে সমাজে কেন গরীব খাওয়ানোর এই উৎসাহ? বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদিনে যদি পাঁচজন দরিদ্র মানুষকে কাজ দেয়া বা সারাজীবনের সংকট মোচনের কোন উদ্যেগ দেখতাম মন জুড়াতো। তা কিন্তু নাই। 

বলছিলাম আমাদের শংকার কথা। দেশ জুড়ে এত বঙ্গবন্ধু ভক্ত আর অনুরাগী এতবছর কোথায় ছিলেন? আমরা ইতিহাসের হাত ধরে বড় হয়ে ওঠা মানুষ। পঁচাত্তর আমাদের চোখে এখনো ভেসে আসে। সেই নিষ্ঠুর সময়ে বঙ্গবন্ধুর জন্য কারা কেঁদেছিলেন আর কারা ঝুঁকি নিয়েছিলেন তাও আমরা দেখেছি। যখন সামরিক শাসন বিএনপি ও এরশাদ মিলে এ দেশকে মুক্তিযুদ্ধ ভুলিয়ে তাদের মনপছন্দের বাংলাস্তান করতে চেয়েছিল তখন কিন্তু রাজনীতির বাইরে সুধীজন বঙ্গবন্ধু পরিষদ আর সাধারণ মানুষই জনককে বাঁচিয়ে রেখেছিল। আজ তারা হয় উধাও নয়তো অন্তরালে। কেন এমন হলো? কিভাবে সম্ভব হলো তা? 
রাজনৈতিক লেখাগুলোর দোষ বা ত্রুটি হলো এগুলো একপেশে। কোন না কোন দল বা শক্তির দিকে মুখ ফেরানো থাকে এদের। তাই সত্য বোঝা যায় না। আমরা তাই দেখেও দেখি না। বা দেখলেও বলি না।  এত বঙ্গবন্ধুপ্রেমিকে আমার সন্দেহ হয়। কারণ আমরা যেভাবে প্রচার প্রসার দেখছি সেভাবে কিন্তু তার আদর্শের অনুসরণ দেখি না। আজকাল তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে কোট করাটা ফ্যাশানে পরিণত হয়েছে। পড়ুক বা না পড়ুক কয়েক ছত্র মুখস্থ কিংবা মনে রাখলেই হয়। অথচ এই বইয়ের আগাগোড়া পড়লে বোঝা সম্ভব একজন মানুষ কিভাবে পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠেন। তাঁর জীবনের কত ওঠাপড়া তাঁকে ঋদ্ধ করে তোলে। এখন তেমন ত্যাগ আর মানুষকে ভালোবাসার কোন নজীর আছে কোথাও? 

মোটামুটিভাবে দেশ এখন আওয়ামীময়। কিন্তু হররোজ কি দেখছি আমরা? যেসব তর্ক পাকিস্তান আমলে মীমাংসিত কিংবা উত্তর পেয়ে গেছে সেগুলো আবার মাথা চাড়া দিচ্ছে। আমাদের প্রাণময় কবি দুজন। রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল। নজরুল ইসলাম মোটামুটিভাবে বিস্মৃতির আড়ালে এখন। জন্ম মৃত্যু বা বিশেষ কারণ ছাড়া তাঁকে কেউ মনে রাখে না। রবীন্দ্রনাথ গানে জেগে আছেন। এটাও অনেকের পছন্দ না। ঢালাও বিরোধিতা টিকবে না জেনে আসল জায়গায় হাত দেয় তারা। মাঝে মাঝে রব তোলে। সে পুরানো পাকি কায়দা। জাতীয় সঙ্গীত বদলাতে হবে। আগেই বলেছি যেহেতু দেশে আর কোন শক্তি বা দল নাই তাই এসব অপ দাবীও আসছে আওয়ামী ব্যানারে। বড় বড় নেতাদের ছবি ঝুলিয়ে। কেউ কিন্তু কোন প্রতিবাদ করেন না। হতে পারে এত ছোট বিষয়ে তাঁরা মাথা ঘামান না। অথবা এসব ঘটনা তাঁদের কাছে পৌঁছায় না। কিন্তু আমরা জানি মৌনতাই নাকি সম্মতির লক্ষণ। ফলে আমরা চাই তাঁরা প্রতিবাদ করুক। তাঁরা এসব ঘটনার পেছনে থাকা মানুষগুলোকে খুঁজে বের করে শাস্তি দিক। তাঁরা তা করেন না। যেমন তাঁরা তাদের ভাষণ বা কথায় বঙ্গবন্ধুর মত বারবার রবীন্দ্রনাথকে টেনে আনতেও পারেন না। এমন করতে হলেতো আত্মস্থ করতে হবে জানতে হবে। সে সময় তাদের কোথায়? সব মিলিয়ে এক নৈরাজ্যকর উন্নয়নমুখী আমরা। কথাটা বলতে না পারলেই ভালো হতো। কিন্তু বাস্তবতা কি বলে? একশ পার্সেন্ট বেড়েছে সাম্প্রদায়িকতা। মুখে মুখে যত কিছুই বলা হোক অন্তরে আমরা আরো বেশী হিন্দু বেশী বেশী মুসলমান বা অন্য কিছু হয়ে আছি। উদারতার ডালপালা ছেঁটে দেয়া হচ্ছে বলে সংস্কৃতিও মাথা তুলতে পারছে না। একসময় এই সংস্কৃতিই আমাদের পথ দেখিয়েছে। রাজনীতিকে গাইড করেছে। কিন্তু সেই তেজ আজ কোথায়? স্তাবকতার বড় দোষ সে ঘাড় গর্দান বিকিয়ে দেয়। মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলে। ঠিক তাই হয়েছে এখন।

প্রমাণ চাই? দেখুন কেউ কারো বিপদে সামনে আসে না। সেদিন আমাদের সিডনির মূল কেন্দ্রে এক উম্মাদ নেমেছিল ছুরি হাতে। উদ্দেশ্য মানুষ মারা। এক দু'জন আহত নিহত হয়েছে বটে। সাধারণ মানুষই তাড়া করে তাকে ধরেছিলো। সে ধরার ভিডিও দেখেছি আমি। ঘাতক যতটা বেপরোয়া তাকে ধরার ব্যাপারে ততটাই উদ্যমী ছিলো মানুষ। তারা ঘটনার ছবি তুলে আপলোড করেনি। একজনকে আক্রান্ত হতে দেখে তারিয়ে তারিয়ে তা ভিডিও করেনি। কাজের কাজ করেছে। আমরা কি তা করি? কোন একটি দূর্ঘটনা ঘটার আগেই বসে পড়ি ফেইসবুকে কি লিখবো তা নিয়ে। আজকাল ভালো করে কেউ ক্রিকেটও দেখে না। খেলা শুরুর পরপর যেভাবে বিশেষজ্ঞ মতামত আর মন্তব্য দিতে থাকে খেলোয়াড়দের কোচরাও পড়লে টাশকি খেতে বাধ্য। এমন এক সমাজে জাতির জনককে মূল্যায়ন দূরে থাক তাঁকে ধারণ করারও কোন চেষ্টা নাই।

কি দেশ তিনি চেয়েছিলেন কেমন দেশ কেমন জাতি তিনি চেয়েছিলেন সে বিষয়ে নূন্যতম জ্ঞান থাকলেও আমরা মাতম দেখতাম না। বরং আমরা দেখতাম তারা সাম্প্রদায়িকতা, সহিংসতা, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, লুটপাট নিয়ে কথা বলতেন। আমাদের ঘরের সমস্যা নিয়ে কোনো রমণী আমেরিকান প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত দৌঁড়ুতে পারতো না। পাশের আরেকটি দেশ তাদের গায়ের জোরে শরণার্থী ঠেলে দিয়ে আমাদের স্পর্শকাতরতাকে উস্কে দিতে পারতো না। এতবড় রোহিঙ্গা সমস্যাকে আমরা বললাম ধর্মীয় মানবতা। যার জের টানতে না পেরে এখন বলছি বিশ্ব বিবেক জাগছে না। কোথায় আমাদের সেই বজ্রকন্ঠ বা তর্জনী? কেন আমরা নিজেদের কথা পর্যন্ত ঠিকমত বলতে পারি না? 

এসব প্রশ্ন যতদিন উত্তর খুঁজে ফিরবে ততদিন আমরা সবকিছু নিয়ে হৈ চৈ করবো বটে লাভের লাভ কিছুই হবে না। বাংলাদেশ তার জন্ম চেতনা, নেতৃত্ব সবকিছু থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে। টাকাপয়সা বা বিত্তবৈভবে বাড়লেও চিত্তের সংকট বাড়ছে। বাড়ছে মন ও ভালোবাসার অভাব। এমন জাতি বঙ্গবন্ধু চাননি। চাইলে তিনি আবেগমথিত হয়ে রবীন্দ্রনাথকে বলতেন না দেখে যান আপনার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে। আজ আমরা যে ছবি দেখছি যে অনাচার অত্যাচার সংশয় জীবনহানি অর্থগ্রাস আর অশান্তি দেখছি তাতে কি মনে হয় আমরা মানুষ হয়েছি?

একা শেখ হাসিনাই গুণ টানছেন। দেশকে এগিয়ে দিতে চাইছেন সাথে সাধারণ মানুষ আর মানুষের মেধা ও শ্রম। মাঝখানের জায়গাটা বড় ফাঁকা সেটাই ভয়ের। অথচ আমরা সকলে চাই বাংলাদেশ জেগে উঠুক আপন মহিমায়।