‘মওদুদ একটা শয়তান!’

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 19 August 2019, 01:39 PM
Updated : 19 August 2019, 01:39 PM

শয়তান হলো একটি চরিত্র যাকে বিভিন্ন ধর্ম দুষ্ট বা খারাপ প্রকৃতির, একই সঙ্গে ক্ষমতাশালী, স্রষ্টার এবং মানবজাতির শত্রু বলে চিহ্নিত করেছে। সাধারণভাবে ধরা হয় যে শয়তান বিপথগামী, অবিশ্বাসী এবং অন্যান্যদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। শয়তান শব্দটি গ্রিক ভাষার, 'দিয়াবলস' থেকে এসেছে যার শাব্দিক অর্থ হল অপবাদদানকারী অথবা অভিশপ্ত ব্যক্তি।

আরবি ভাষায় ‎ এর মানে 'বিপথে', 'দূরবর্তী', বা মাঝে মাঝে 'শয়তান' এবং হিব্রু ভাষায় সতন (লাতিনে সাতান) মানে 'শত্রু' বা 'দুশমন'। ইব্রাহিমীয় ধর্ম [২][৩] গ্রন্থসমূহে শয়তান হলো একটি চরিত্র যে মানবজাতির মধ্যে মন্দ, প্রতারণা এবং প্রলোভন এনেছে, এবং মানবজাতিকে বিপথগামী করেছে। কোরান, বাইবেল ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থ মতে, ইবলিশ নামে জিন পথভ্রষ্ট হয়ে শয়তানে পরিণত হয়েছে যে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে পথভ্রষ্ট করার ক্ষমতা রাখে এবং চেষ্টা করে। এই জিন আদিতে সৃষ্টিকর্তার অনুগত ছিল। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার আদেশ প্রতিপালনে অস্বীকার করে সে শয়তানে পরিণত হয়। সে মিথ্যা ও পাপের পথে মানবজাতিকে প্রলুব্ধ করে চলেছে। হিব্রু বাইবেল এবং নিউ টেস্টামেন্ট অনুযায়ী, শয়তান প্রাথমিকভাবে একটি ফরিয়াদি, বিরুদ্ধ শক্তি, একটি সন্দেহাতীতভাবে অমঙ্গলকামনাকারী সত্তা।

আদিপুস্তকে শয়তানের সরাসরি উল্লেখ না থাকলেও তাকে ইডেনের বাগানের সর্প হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মধ্যযুগে খ্রিস্টান ধর্মতত্বে শয়তান শুধুমাত্র একটি অলৌকিক সত্তা হিসেবেই বিদ্যমান ছিল। আধুনিক যুগের শুরুর দিকে দৈব আছর ও ডাইনিবিদ্যার প্রসারের কারণে শয়তান চরিত্রটি নতুন এক অস্তিত্ব লাভ করে। আলোকিত যুগে শয়তানের অস্তিত্বের বিষয়টিই অস্বীকার করা হয়, তথাপি আমেরিকা ও তদসংলগ্ন অঞ্চলগুলোতে শয়তানের বিশ্বাস আরও শক্ত অবস্থান লাভ করে।

এ ছাড়া চলতি কথায় শয়তান বলা হয় তাদের যারা কুচক্রী, যাদের মধ্যে কোনোসদগুণ নেই! বদমতলব দ্বারা যারা চালিত হন।

কৃষিমন্ত্রীড. আব্দুর রাজ্জাক বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদকে 'শয়তান' হিসেবেচিহ্নিত করেছেন। কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, 'আইনমন্ত্রীথাকার পরও ব্যারিস্টার মওদুদ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেননি। মওদুদ একটা শয়তান। ব্যারিস্টার মওদুদরা আদর্শিক শয়তান। এসব শয়তানের কারণে দেশ বারবার পিছিয়ে গেছে।'

তিনিআরও বলেন, 'সঠিক ইতিহাস জানা দরকার। সঠিক ইতিহাস না জানলে জাতি বিভ্রান্ত হয়। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত একটানা সামরিক শাসকদের দ্বারা দেশ পরিচালিত হয়েছে। বিএনপি যতবার ক্ষমতায় এসেছে, ততবারই তারা ৭৫-এর খুনি ও ৭১-এর পরাজিত শক্তির স্বার্থ বাস্তবায়ন করেছে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত।'

ব্যারিস্টার মওদুদ সম্পর্কে কৃষিমন্ত্রীরমন্তব্য শুনে মনে পড়ছে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের একটি লেখার কথা। এই লেখায় তিনিওব্যারিস্টার মওদুদকে নিয়ে কঠোর মন্তব্য করেছিলেন।

তিনি লিখেছিলেন: "… খালেদা জিয়াকে আমি দুবার দেখেছি, দুবারই একই জায়গায় : বাইরে-বিপ্লবী, ভেতরে-স্বৈরতন্ত্রের অনুচর একটি সাপ্তাহিকের ইংরেজি নববর্ষের পানোৎসবে। খালেদা জিয়াকে দেখার মধ্যে বিশেষ সুখ আছে। ওই উৎসবটি ছিল সুপরিকল্পিত, তাতে জড়ো করা হতো দেশের গুরুত্বপূর্ণ দেবতা ও দানবদের; তাতে একনায়কের সারমেয় আর গণতন্ত্রের বাঘেরা পরম বান্ধবের মতো গল্প করতে করতে পান করতো। সেখানে খালেদা জিয়াও আসতো। সে এলে হঠাৎ ময়লা হয়ে উঠতো ছোটো-বড়ো পর্দার নানা রঙ করা রূপসীরা, তাদের কারো মুখে ছুলি বা ব্রণের দাগ স্পষ্ট হয়ে উঠতো, কাউকে মনে হতো অত্যন্ত খর্ব। তাদের চারপাশের ভিড় ক'মে যেতো। তখন সারা প্রাঙ্গণে এক জায়গায়ই দেখা যেত সৌন্দর্য। তবে ওই সৌন্দর্যকে ঘিরে থাকতো কয়েকটি কলঙ্ক, কয়েকটি সুবিধাবাদী প্রহরী পাহারা দিত তাকে; ওই দৃশ্য দেখে আমার বিউটি ও বিস্টের কথা মনে পড়তো। খালেদাকে ঘিরে থাকত যারা, তারা আগে থেকেই ছিল দেশের কলঙ্ক, পরে আরো কলঙ্কিত হয়। তারা এমনভাবে তার চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকতো, মনে হতো তারা দাঁড়িয়ে নেই, দাঁড়াতে পারছে না, তারা প'ড়ে আছে খালেদার স্যান্ডলের নীচের ঘাস ও মাটির অনেক নীচে।

একবারআমি খালেদাকে একটি গল্প শোনাতে চাই। তখন চারপাশে ভীষণ সাড়া পড়ে যায়, যেন একটা মহাদুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, যা ঘটলে পৃথিবী খানখান হয়ে যাবে, মানুষের কোনো ভবিষ্যৎ থাকবে না, বা বাঙলাদেশে গণতন্ত্রের সমস্ত সম্ভাবনা চিরকালের জন্যে নষ্ট হয়ে যাবে। সে মুহূর্তেই আমি বুঝতে পারি আমাদের চারপাশ গণতন্ত্রের জন্যে কতো অনুপযুক্ত ও অপ্রস্তুত, প্রভু ও অনুচরের সম্পর্ক ছাড়া তারা আর কোনো সম্পর্কের কথা ভাবতেও পারে না। সেখানেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে তার চারপাশের লোকেরা তাকেও উত্তীর্ণ করেছে একনায়কের স্তরে, যাকে শুধু তোশামোদ করা যায়, যার সাথে স্বাভাবিক গল্প করা যায় না। আমি খালেদাকে বলি, 'আপনার সাথে আমরা কিছু কথা বলবো; তবে আপনার এ-লোকজনেরা একটু দূরে গেলে ভালো হয়।' খালেদা জানতে চায়, 'কেনো', আমি তাকে জানাই তাকে একটি গল্প শোনাবো তার চারপাশের লোকগুলো সম্পর্কে, এবং ওই গল্পের একটি চরিত্রের নাম জিয়াউর রহমান। আমি সেদিন গল্পটি বলতে পারিনি, কেননা খুব উত্তেজিত হয়ে লাফালাফি শুরু করে মওদুদ নামে খালেদার একটি প্রহরী, যাকে আমি দূরে গিয়ে দাঁড়াতে বলেছিলাম। গল্পটি খালেদা সেদিন শুনলে তার পাশের মওদুদজাতীয়দের ভার তাকে বইতে হতো না।…"

"…গল্পটিসেদিন বলতে পারি নি, কিন্তু গল্পটির আবেদন আজো ফুরোয় নি। গল্পটি শুনেছি আমি ভেতর থেকে, গল্পটি বানানো নয় বলেই আমিবিশ্বাস করি। গল্পটি জিয়া ও একজন চিকিৎসক-রাজনীতিকের। জিয়া একদিন চিকিৎসককে ডেকে বললো, 'বড়ো ডাক্তার দেখে আপনাকে আনলাম, দলের দায়িত্ব দিলাম, কিন্তু কিছু করতে পারছেন না কেন?' চিকিৎসকবললো, 'স্যার, পারবো কীভাবে? আপনি যে আমাকে কোথায়আনলেন!' জিয়া জানতে চাইলো, 'কেন?' ডাক্তার বললো, 'যখন ডাক্তার ছিলাম, তখন আমার কাছে যারা আসতো তারা সবাই সত্য কথা বলতো; আর এখন আমারকাছে যারা আসে তারা সবাই মিথ্যা কথা বলে। কাজেই পারবো কী করে?' গল্পটিসেদিন শুনলে গল্পটির ফল হাতেহাতে পেতোখালেদা। ওই উৎসবের কয়েকদিন পরেই খালেদার পা থেকে এরশাদেরপায়ের নীচে চলে যায় মওদুদ; একজনের পা থেকে নিজেকেস্থানান্তরিত করে আরেকজনের পায়ে । যারা পদামৃতপায়ীতারা রসালো পা চাটতেই পছন্দকরে, যে-পায়ে রসনেই বা রসের সম্ভাবনানেই, সে-পায়ের সেবায়তারা জিভ বেশিদিন ক্ষয় করে না । ওইবিপ্লবী পানোৎসবে পরের বছরও আবার দেখা যায় খালেদা ও মওদুদকে ।তবে তখন অবস্থান বদলে গেছে তাদের; খালেদা একদিকে, তাকে ঘিরে কয়েকটি প্রহরী, তবে গত বছরের উত্তেজিতটেরিয়ারটি নেই । এবার সেঅন্যদিকে, হাতে হুইস্কির পাত্র, এবং তাকে ঘিরে তার টেরিয়ারেরা …" (বাঙলাদেশি গণতন্ত্রের প্রথম ও শেষ দান:গরিব গ্রহের সবচেয়ে রূপসী প্রধানমন্ত্রী, মাতাল তরণী হুমায়ুন আজাদ)।

হুমায়ুন আজাদের লেখায় কিছু নাটকীয়তা আছে হয়তো,কিন্তু ব্যারিস্টার সাহেবের যে চরিত্র তিনি এঁকেছেন, তা কি মিথ্যে? ব্যারিস্টার মওদুদেরমতো 'ডেড হর্স'কে নিয়ে কৃষিমন্ত্রী মহোদয় হঠাৎ কেন ক্ষেপলেন, তা কিন্তু বোধগম্য নয়।তবে রাজনীতিতে কিন্তু 'শয়তান' শুধু মওদুদ একাই নয়, আরও অনেক আছে। এমনকি ক্ষমতাসীন দলেওএমন চরিত্র বিরল নয়!

পরিশেষে শিল্পী আব্দুল জব্বারের গাওয়া'সাধু শয়তান' নামে এক পুরানো সিনেমার একটি গানের কলি ধার করে বলতে চাই, 'সাধুআর শয়তানে যে ভাই দুনিয়ারচলেছে লড়াই।/কে সাধু কে শয়তান কিছুবলা যা না/দেখে শুনেতাই করো না যাচাই!'