বাংলা ও বাঙালি (তিন)

হাসান মাহমুদহাসান মাহমুদ
Published : 26 Dec 2011, 06:28 PM
Updated : 19 August 2019, 12:05 PM

(বিস্মৃতিপ্রবণ জাতিকে শেকড়ের ইঙ্গিত)

মা- – – সী !!!!

ছুটে চলেছে সৈয়দ। দিল্লীরসম্রাটের গোপন প্রতিনিধি।

কখনো আলো, কখনো অন্ধকার। ধূলি-ধূসরিত প্রান্তর, শস্যশ্যামল বসতি, গহন বন। প্রাণ হাতে ঘড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটছেন তিনি বাংলার দিকে। শত শত মাইল পথ কিন্তু বিশ্রামের অবকাশ নেই কারণ ওদিকে বাংলার দিকে ছুটছে জোয়ানপুরের নবাবের লোকেরাও। কে আগে পৌঁছোয়, এই একটি মাত্র সুতোর ওপরে ঝুলছে সুবিশাল ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ। গল্প নয়। আমাদেরই পূর্বপুরুষের অসাধারণ ইতিহাস।

বিদ্রোহী জোয়ানপুরের সাথে লড়ছেন দিল্লীশ্বর সুলতান। জয় পরাজয়ের সাথে জীবন, মান-সম্মান, মসনদ অনেক কিছুই জড়িত। শুরু হবার পর চব্বিশটা বছর কেটে গেছে, যুদ্ধ চলছেই। দু'দলই হন্যে হয়ে খুঁজছে একটা কিছু যা দিয়ে অন্তহীন যুদ্ধটা বিজয়ে শেষ হবে।

বিস্ফোরণ হলো একটা। বাংলায়। ফিরে তাকাল ভারতবর্ষ। চমকে তাকালেন ভারত সম্রাট, তাকালেন জোয়ানপুরের নবাব। পাওয়া গেছে! বহু সামরিক প্রতিভায় ঝিকমিক বিশাল ভারতবর্ষে দোর্দণ্ড মার্তণ্ডপ্রতাপে জ্বলে উঠেছে কে ও? শক্তির, সম্ভারের, সমরনীতির সমস্ত হিসেব পায়ে দ'লে উঠে দাঁড়িয়েছে এ কোন কালাপাহাড়! চির বিজয়ের গর্বতিলক খচিত এই তো সেই উদ্ধতললাট! একেই তো চাই! ছুটল জোয়ানপুরের দূত, ছুটলেন ভারতসম্রাটের দূত সৈয়দ।

বাংলার চিরকালের রাজশাহী, মান্দা এলাকা। সেখানেই জন্মেছিল জেদী ছেলেটা। কালাচাঁদ রায়, ডাকনাম রাজু। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ, ছোটখাটো জমিদারবংশ। মা-মাসী মিলে কত আদরে বড় করেছে বাপহারা কন্দর্পকান্তি ছেলেটাকে। মা'র চেয়ে মাসীই যেন পিতৃহারা বালকের বেশী আদরের আশ্রয়। চলনে বলনে গঠনে রঙ্গে রূপে, শাস্ত্রজ্ঞানে, অস্ত্রশিক্ষায় অতি অসাধারণ সুকণ্ঠ সেই তরুণ বাংলার অধিপতি বুরবক শাহ-এর দরবারে চাকরি নিয়েই তরতর করে উঠে গেল উপরে। তারপরে এল সেই বাঁক। যেখানে ঘটনা ঘটে। টলমল করে ওঠে জীবনের পা। বিধবা মিসেস সিম্পসনকে বুকে জড়িয়ে অবহেলায় অর্ধ-পৃথিবীর সিংহাসন ত্যাগ করে যান ইংল্যাণ্ডের সম্রাট অষ্টম এডওয়ার্ড। সুবিশাল চীন সাম্রাজ্য পায়ে ঠেলে নামহীন পতিতাকে নিয়ে গ্রামে সুখী জীবন কাটান সম্রাট শু-চি।

প্রতি সকালে নদীতে স্নানসেরে "সুকণ্ঠে স্তোত্র আবৃত্তি করিতে করিতে" রাজপ্রাদাসের পাশ দিয়ে ঘরে ফেরে সুদর্শনকালাচাঁদ। জানে না, ঠিক তখনই রাজপ্রাসাদের বাতায়নে, গবাক্ষে নির্ভুল এসে দাঁড়ায় কেউ।দেবলোকে নৃত্যছন্দে মনোহর পেখম তুলে ধরে কার্তিকের ময়ূর, অতনু শরবিদ্ধা হন রাজকন্যা।খবর চলে গেল রাজা-রাণীর কানে। খুশিই হলেন তাঁরা। কালাচাঁদের তুলনা নেই। তাছাড়া, যোগ্যহিন্দু পাত্র ইসলাম গ্রহণ করে রাজপরিবারে বিয়ে করছে এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে।

ঘটল সেটাই যা আগে ঘটেনি। বিয়ের প্রস্তাবে কালাচাঁদের খুশি এবং কৃতজ্ঞ হাসি আশা করেছিলেন বঙ্গেশ্বর বুরবক শাহ। উল্টে বঙ্গেশ্বরের মুখের ওপর তেলেবেগুনে ফেটে পড়ল দৃঢ়চেতা জেদী কালাচাঁদ। রাজ্য, রাজকন্যার লোভ দেখিয়ে ধর্মত্যাগ? কি ভেবেছেন রাজা নিজেকে? অপমানে কালো হয়ে গেল বঙ্গেশ্বরের মুখ। ক্রোধে ক্ষিপ্ত বুরবক শাহ জনসমক্ষে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে দিলেন। প্রস্তুত করা হলো মৃত্যুবেদী। প্রস্তুত হলো ঘাতক, প্রস্তুত হলো কালাচাঁদও। থমকে গেল সময়। ঠিক তখনই হাহাকারে ছুটে এলেন রাজকন্যা। দেহ পেতে দিলেন ঘাতকের খড়গের নিচে। স্তম্ভিত চেয়ে রইল কালাচাঁদ।

"ফুলশরের আঘাতে ধর্মবেদীবিদীর্ণ হইল, কালাচাঁদ বিবাহে সম্মত হইলেন।"

বিয়ের পরই ধর্মীয় স্টীমরোলারের সামনে পড়ে গেল কালাচাঁদ। কত পণ্ডিত-মহাপণ্ডিতের কাছে ধর্ণা দিল, সবাই কুকুরেরমতো তাড়িয়ে দিল। দিশেহারা কালাচাঁদ ছুটে গেল উড়িষ্যায় বিখ্যাত জগন্নাথ মন্দিরে। মুখেরওপর দরজা বন্ধ হলো, ভালোবাসার আশ্রয় হলো না জগৎ নাথের কাছে। জেদী কালাচাঁদ মন্দিরেরদ্বারে অনশন করে পড়ে রইল সাত-সাতটা দিন। অনাহারক্লিষ্ট সেই দুর্বল শরীরটাকে টেনে হিঁচড়েগলাধাক্কা দিয়ে মন্দিরের চৌহদ্দি থেকে বের করে দিল পণ্ডিত পাণ্ডার দল।

তারপর।

শরবিদ্ধ ক্রৌঞ্চমিথুনে ভারত-ত্রাস ভয়ংকর মহাদস্যু রত্নাকর হয়েছিলেন মহাঋষি বাল্মিকী। এখানে হারিয়ে গেল কালাচাঁদ রায়, প্রতিশোধের রক্তচক্ষু মেলে উঠে দাঁড়াল ভয়াবহ কালাপাহাড়। 'হিন্দু' শব্দটাকে শেকড় থেকে উপড়ে ফেলবে সে। এ নামে না থাকবে কোনো মূর্তি, না থাকবে মন্দির আর পণ্ডিত-পাণ্ডা। রাজ্যবিস্তারের আশায় সৈন্য দিলেন বুরবক শাহ। এরপর ফুটে উঠল একদিকে উন্মাদ ধর্মবিকার অন্যদিকে ক্রমাগত বিজয়ের অসাধারণ সামরিক প্রতিভা। কালাচাঁদ ততদিনে মুসলমান হয়ে নাম নিয়েছে মুহম্মদ ফরমুলি। সে বজ্র প্রথমেই ভেঙে পড়ল উড়িষ্যার সেনাবাহিনী ও জগন্নাথ মন্দিরের ওপর। পুরুত-পাণ্ডার ওপর। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল সবকিছু। এরপরের কাহিনী ক্রুদ্ধ এক কালবৈশাখীর সামনে একের পর এক রাজ্য ও সেনাবাহিনীর উড়ে যাবার কাহিনী। হিন্দুর বিরুদ্ধে বল্গাহীন সৈন্যদল আর তার অলৌকিক প্রতিভাবান সেনাপতি। আতংকিত জনগণের মুখে মুখে কালাচাঁদ হয়ে গেল কালাপাহাড়। খবর পৌঁছে গেল ভারতবর্ষের প্রান্তে প্রান্তে- জোয়ানপুরের রাজার কাছে, দিল্লীশ্বরের কাছে। ছুটল জোয়ানপুরের দূত, ছুটলেন সৈয়দ। জোয়ানপুরের ওপর টেক্কা মেরে চিরবিজয়ের বরপুত্রকে বগলদাবা করে সম্রাটের সামনে হাজির করলেন সৈয়দ।

পত্রপাঠ জোয়ানপুর যুদ্ধেসেনাপতির পদ, পত্রপাঠ পরাজিত জোয়ানপুর। অবিশ্বাসের চোখে তখন বাঙালির দিকে তাকিয়ে আছেপুরো ভারতবর্ষ।

"জোয়ানপুর হইতে আসিবার মুখেতিনি সেই প্রদেশের নিকটবর্তী সমস্ত দেবতা ও দেবমন্দির ভগ্ন করিয়াছিলেন"। ফেরার পথেকাছেই পড়ল মন্দির নগর কাশী। আর যায় কোথায়। হিংস্র নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল কালাপাহাড়।"পাণ্ডারা ত্রাহি ত্রহি ডাক ছাড়িল…".. রক্তস্রোতে ভেসে গেল মন্দির নগরআর হিন্দু জনসাধারণ। আর তারপর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। স্বপ্ন নয়, গল্প নয়। রক্তাক্তছিন্নভিন্ন কাপড়ে চীৎকার করতে করতে পাগলিনীর মতো ছুটে আসছে স্খলিত বসনা নারী।

ভারত-ত্রাস মহাবিদ্রোহীকালাপাহাড় উঠে দাঁড়াল বিদ্যুতাহতের মতো। কম্পিত কণ্ঠে চীৎকার করে উঠতে চাইল – "মা-সী"!!!!!!!!!!!!!!

আশৈশব বালকের সেই চিরনির্ভয়নির্ভর, সে আশ্রয় হাহাকারে ভেঙে পড়ল চোখের সামনে। হাতের বিষ ঢেলে দিল গলায়। কয়েকটাতীব্র মোচড় খেয়ে স্থির হয়ে গেল দেহ। আদরের রাজুর সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিত লাঞ্ছিত আদরেরমাসীর দেহ। দু'হাতে মুখ ঢাকা বিশাল কালাপাহাড়ের কম্পিত শরীর তখন যেন একের পর এক বিস্ফোরণেরধাক্কায় ছিন্নভিন্ন হয়ে মহাশূন্যে উৎক্ষিপ্ত হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে।

মরণ-ছোবলে ঘুরে দাঁড়িয়েছেসাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত কালনাগ, তার মনিবের ওপরেই।

নিস্তব্ধ নিঝুম রাত, নিস্পন্দনীরব। সব-রকম অত্যাচার বন্ধ করবার অপ্রত্যাশিত আদেশে বিস্মিত বিহ্বল সেনাবাহিনী। সবারঅলক্ষ্যে নিশ্চুপে তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল কেউ। আকাশ থেকে তারারা দেখল, সাগর গিরি অরণ্যানীসবাই দেখল, আসমুদ্র হিমাচল ভারতবর্ষের বিস্ময়, চির অপরাজিত তৎকালীন সর্বশ্রেষ্ঠ সমরবিদ,রাজশাহীর মান্দা এলাকার ছেলেটা ভারসাম্যহীন উদভ্রান্ত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে……হেঁটে যাচ্ছে…অন্ধকারে একা ….. গন্তব্যহীন……..

এরপর তাকে আর কখনো দেখেনি কেউ, জীবিত বা মৃত॥