সব ভাষা বেঁচে থাক প্রফুল্ল মুখে

Published : 18 August 2019, 08:57 AM
Updated : 18 August 2019, 08:57 AM

আমি চাকমা ভাষায় দুই লাইন কবিতা লিখেছিলাম। লাইনদুটো হলো এরকম : হেই মিলাউয়া, এদু আনা চা' না হি দৌল লার/আমাদেচ্ছান পানির বুগদ ন' মাদি ঘুম যার।

অনেক আগে, লেখালেখির শুরুতে 'রাঙামাটির বাতি' নামের একটি কবিতা লিখেছিলাম। সে  কবিতার মাঝখানে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম এই দুটি লাইন। তারপর ব্রাকেটে এর অনুবাদও দিয়েছিলাম। বাংলা অনুবাদটা ছিল এরকম : এই যে মেয়ে এদিক আসো , দেখো কী সুন্দর/আমার দেশটা পানির বুকে নিদ্রাতে বিভোর।

অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, দুটি লাইন আমার নিজের লেখা হলেও চাকমা অংশটাকে বাংলায় আনতে গিয়ে চাকমা লাইনদুটোর মূল সুর ও ব্যঞ্জনাকে বাংলা লাইনদুটোতে একটুও যেন ধরতে পারিনি। অথচ দুইটি অংশের লেখক একজনই। অনুবাদের লাইন দুটোতেও একই ভাব, একই অর্থ। অথচ ব্যঞ্জনায় তা সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে গেছে। মূলকে অনুবাদ সামান্যতম 'আত্মস্থ'ও করতে পারেনি।

এতে আমার একটা উপলব্ধি হলো। বুঝতে পারলাম,প্রতিটি ভাষার, সে ছোট হোক আর বড় হোক, নিজস্ব একটা বৈশিষ্ট্য আছে, একটা স্বাতন্ত্র্যআছে। কোনো ভাষাই কোনো ভাষার চেয়ে কোনো অংশেই ছোট কিংবা বড় হতে পারে না। সব মানুষই সমানএবং গুরুত্বপূর্ণ হলে সব মানুষের আত্মপ্রকাশের মাধ্যম যে ভাষা, সে ভাষাও ছোট কিংবাবড় হতে পারে না। মানুষের প্রতি যেমন মানুষের সম্মান দেখানোটা জরুরি, যে কোনো ভাষাভাষীএকজন মানুষকেও ভিন্ন ভাষার প্রতি সমান শ্রদ্ধা ও মমতা দেখানো দরকার। একটা রাষ্ট্রেপ্রতিটি ভাষাই সমান মনোযোগের দাবিদার। তার ব্যত্যয় হলে কী ঘটে, সেটা ৫২-র ইতিহাস স্মরণকরলেই যথেষ্ট।

একজন মানুষ তার আজন্ম পরিচিত ভাষাতেই প্রধানত কথা বলে। কাজের খাতিরে তাকে হয়তো ভিন্ন ভাষাও রপ্ত করতে হয়। কিন্তু তার আজন্ম পরিচিত ভাষা তথা মাতৃভাষা তার ভেতরে অনুক্ষণ ক্রিয়াশীল থাকে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ  ১৭ ভাষায় লিখতে পড়তে পারতেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি বাংলাভাষী একজন মানুষ ছিলেন। বায়ান্নর ভাষাভিত্তিক টালমাটাল সময়ে তিনি বাংলাভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। অত বড় একজন বহুভাষাবিদ পণ্ডিতও শেষ পর্যন্ত মাতৃভাষার জন্যে লড়াইয়ে শামিল হয়েছিলেন।

মাতৃভাষা মানুষের মনের কতটা গভীরে প্রোথিত,সেটা বোঝার জন্যে গোপাল ভাঁড় আর সে উড়িয়া পণ্ডিতের গল্প স্মরণ করা যায়। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রেরদরবারে একবার একজন বহুভাষাবিদ পণ্ডিত এলেন। পণ্ডিত একেকবার একেক ভাষায় কথা বলেন। কখনোহিন্দি, কখনো উর্দু, কখনো ফারসি…এমনকী মাঝে মধ্যে ইংরেজিতেও। কেউই বুঝতে পারছে নাপণ্ডিতের মাতৃভাষা কী?

শেষে গোপাল বললেন, দু'দিন সময় দিলে তিনি ওই পণ্ডিতের মাতৃভাষা কী, তা বের করতে পারবেন।কৃষ্ণচন্দ্র বললেন, তথাস্তু।

পরদিন পণ্ডিতের দরবারে আসার সময় হলে গোপাল তার আসার পথে ঘাপটি মেরে রইলেন। ব্যস্তসমস্ত পণ্ডিত দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে যেই না গোপালের কাছাকাছি হলেন, গোপাল আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে তার পায়ের সাথে ল্যাং মারার মতো করে একটা পা লাগিয়ে দিলেন।  অপ্রস্তুত পণ্ডিত পড়লেন হুমড়ি খেয়ে। সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল গালাগাল: ষড়া অন্ধা!

গোপাল তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে পণ্ডিতকে উঠে দাঁড়াতেসাহায্য করলেন। তারপর তাকে দরবারে নিয়ে গিয়ে কৃষ্ণচন্দ্রকে বললেন, মহারাজ, আমাদের পণ্ডিতেরমাতৃভাষা উড়িয়া। ‍তিনি উড়িষ্যার লোক।

মহারাজ ব্যাখ্যা জানতে চাইলে গোপাল বললেন,মানুষ তার একান্ত আবেগ কিংবা অনুভূতি নিজের অজান্তেই তার মাতৃভাষাতে প্রকাশ করে ফেলে।

গল্পটা হাসির, কিন্তু এর তাৎপর্য হাসির নয়।নব্বই বছরের একজন বুড়ো যেমন ব্যথা পেলে 'মা রে' বলে কাতর ধ্বনি করে ওঠে, তেমনি একজনমানুষের একান্ত আবেগটুকুও তার মাতৃভাষাতেই সবচেয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশিত হয়। আসলেমানুষের ভাষা জন্মগত ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যেরওপর নিভর্র করে বিভিন্ন আবেগ সৃষ্টিতে সহায়তা করে। অথার্ৎ ভাষা আবেগীয় অঞ্চলের স্নায়ুগুলোকেপ্রভাবিত করতে পারে। 'ষড়া অন্ধা' বা 'শালা অন্ধ' একজন মানুষের তাৎক্ষণিক হতাশা বা বেদনাপ্রকাশের অকৃত্রিম শব্দাবলি মাত্র।

প্রত্যেক ভাষারইস্বতন্ত্র  এবং একান্ত নিজস্ব জোর বা ব্যঞ্জনারয়েছে। এটা ঠিক, সব ভাষার অক্ষর এবং শব্দ সংখ্যা সমান নয়। সমান নয় শব্দসমূহের দ্ব্যর্থবোধকতাও।আবার সব ভাষার উৎপত্তিগত সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটও ভিন্ন। সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে মনে হতে পারে যে মানুষেরভাষিক দক্ষতার উন্নতির ছাপ তার আশেপাশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে, তার হাতিয়ারে, সরঞ্জামে,শিল্পে, ইত্যাদিতে পড়েছে। আসলেই প্রায় ৪০ হাজার বছর আগে মানুষের হাতিয়ার ও সরঞ্জামেরবৈচিত্র্য এবং মানে এক ধরনের ব্যাপক উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। এই উন্নতির ধারায় সব মানুষসমানভাবে সম্পৃক্ত হতে পারেনি। ভৌগোলিক কিংবা ভূপ্রাকৃতিক আনুকূল্য এবং প্রতিকূলতামানুষের শারীরিক সামর্থ্যে যেমন ভিন্নতা সৃষ্টি করেছে, তেমনি মানসিক বা বৌদ্ধিক ক্ষেত্রেওপার্থক্য এনেছে। ভাষার সমৃদ্ধি কিংবা সীমাবদ্ধতাও নির্ভর করেছে এর ওপর।

শুরুতে চাকমাভাষার একটা কবিতার লাইনকে মূলের মতো করে বাংলায় অনুবাদ করতে গিয়ে অতৃপ্তির কথা বলেছিলাম।এটা একটা ক্ষুদ্র পরিসরের উদাহরণ। তবে অনুবাদের ক্ষেত্রে পৃথিবীর বড় বড় কাজগুলোও সেএকই অতৃপ্তিতে ভরা।

মোঘল আমলের কবি আমির খসরুর ফারসি ভাষায় লেখা একটি লাইন : 'আগর ফিরদাউস বর রুয়ে যমিনাস্ত/হামিনাস্ত হামিনাস্ত হামিনাস্ত'

এটার বাংলা করা হয়েছে এভাবে : স্বর্গ যদি ধরাধামে কোথাও থেকে থাকে/এইখানে তা, এইখানে তা, এইখানে তা।'

মূলের সঙ্গেঅনুবাদের পার্থক্য বোঝার জন্যে কানের ওপর নির্ভর করলেই হবে। সবার আগে কানই বলেদেবে শুনতে কোনটা বেশি সুন্দর। অথচ একদমই অর্থানুগ অনুবাদ। ভাবানুগও। তবু কোথায়যেন একটা ফাঁক থেকে যায়। এর কারণ হলো প্রত্যেকটি ভাষার নিজ নিজ বিকাশ, প্রকাশ আরবিস্তারক্ষমতার স্বাতন্ত্র্য। মানুষের নৃতাত্ত্বিক চরিত্রের মতো মনে হয়ভাষাতাত্ত্বিক চরিত্রও আছে।

ভাষাতাত্ত্বিকচরিত্র কথাটাকে একটু জটিল করেই না হয় বোঝার চেষ্টা করা যাক। ভাষাতাত্ত্বিক চরিত্রমানে মূলত দ্যোতনা বা ব্যঞ্জনাই।

দার্শনিকদেরিদা মনে করেন, 'কোনো একটি ভাষাব্যবস্থার আওতাধীন ভাষাচিহ্নের দেশ-কালকেন্দ্রিকতুলনামূলক অবস্থান বিশ্লেষণই মানুষকে জীবন ও জগৎসম্পর্কিত অর্থ প্রদান করে এবং এঅবস্থায় পরিবর্তনশীল দ্যোতকের ক্রিয়া থাকে মুখ্য। অহংকেন্দ্রিক মানবিক উপলব্ধি,অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের দ্বৈততাকে কেন্দ্র করে তৈরি করে এক অতীন্দ্রিয় অধিতাত্ত্বিকজগৎ এবং এর ফলে অহংকে কেন্দ্র করে ভাষাচিহ্নের দ্যোতনা দেশ-কালকেন্দ্রিক বিভিন্নদ্যোতক সৃষ্টির মাধ্যমে অসীমের দিকেই প্রবহমান থাকে। বিশেষভাবে লিখিত ভাষার বেলায়ভাষার এই মুক্তক্রীড়া সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা সম্ভব। ভাষার মুক্তিক্রীড়ারপ্রেক্ষাপটে কাজ করে দেশ ও কালকেন্দ্রিক যতিভেদ। দার্শনিক জাক লাকাঁর তত্ত্বঅনুযায়ী ভাষাচিহ্নের অর্থ বিভিন্ন দ্যোতকের সম্মিলিত ক্রিয়ার ফলেই উপলব্ধি করাসম্ভব। আর দ্যোতিতের উপস্থিতি থাকে কেবল দ্যোতকের কারণ হিসেবে। সস্যুর দ্যোতক ওদ্যোতিতকে পৃথকভাবে শনাক্ত করলেও, লাকাঁ শুধু দ্যোতকের মাঝেই কিছু বিভক্তিরেখাটানতে চান; যার ফলে, ভাষাচিহ্নের বিপরীতে অবস্থানরত দ্যোতক বিভিন্ন মাত্রা নিয়েমানুষের অবচেতনে বিভিন্ন অর্থ বা দ্যোতনা আনতে পারে।'

এইযে দ্যোতনার বিভিন্নতা, এই বিভিন্নতার কারণেই এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদেমূলভাষার দ্যোতনা বা ব্যঞ্জনা অন্য ভাষায় সঠিকভাবে ধরা দেয় না।

তাহলেকী হবে? অনুবাদ কি হবে না? অনুবাদ হবে। ভাষায় ভাষায় মেলবন্ধন রচিত হবে অনুবাদেরমাধ্যমে। এক ভাষার সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, সমাজ-রাষ্ট্রনীতি প্রকাশিত হবে অন্যভাষাভাষী মানুষের কাছে। মানুষের অর্জিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের অধিকার সব মানুষেরই। মহৎসাহিত্য পড়ার, মহৎ সঙ্গীত শোনার উত্তরাধিকার কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠীর নয়। বিটোফেনউপভোগ করার অধিকার জার্মানদের একচ্ছত্র নয়, তেমনি বাংলার ভাটিয়ালি, জারি, সারিতেওকান পেতে দেয়ার অধিকার আছে জার্মানদেরও।

কিন্তুকথা হলো, বাঁচিয়ে রাখতে হবে সব ভাষাকে। আর্থ-সামাজিক কারণে জনগোষ্ঠীর মতো তাদেরভাষাও পিছিয়ে পড়তে পারে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে আনার চেষ্টা করা যেমনঅগ্রসরমান জনগোষ্ঠীর দায়িত্ব, তেমনি ক্রম বিলীয়মান ভাষাগুলোকেও সংরক্ষণ, চর্চা ওপরিচর্যার মাধ্যমে সজীব রাখতে হবে।

মনেরাখতে হবে, ভাষা মরে গেলে একটা জনগোষ্ঠীও মরে যায়। আর মানুষ হারায় তার একটা অংশকে।

ভাষা মরে যায় নানা কারণে। সব চেয়ে বড় কারণটা হলো অর্থনৈতিক। একটি পরাক্রান্ত ভাষার সংস্পর্শে এলে তুলনামূলক দুর্বল ভাষাটি অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়ে যায়। কারণ সে ভাষাভাষী লোকগুলো জীবিকার প্রয়োজনে সবল ভাষাভাষী লোকদের সংস্পর্শে থাকে, পেশাগত প্রয়োজনে সবলদের ভাষা রপ্ত করে। এভাবে শুরু হয় নিজের ভাষার প্রতি অনিচ্ছাকৃত অনীহা। একসময় দেখা যায়, নিজের ভাষাটি তার মন থেকে, মস্তিষ্ক থেকে ধীরে মরে গেছে। অর্থাৎ ভাষাটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পৃথিবীতে ভাষার মৃত্যু সম্ভবত এভাবেই ঘটে থাকে।

কিন্তু এমনটা হতে দেয়া উচিত হবে না। প্রতিটি ভাষাই হবে বিশ্ব ঐতিহ্য। প্রতিটি ভাষাকেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ভূপ্রাকৃতিক কারণে মানুষের বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, তেমনি একই কারণে তার ভাষিক স্বাতন্ত্র্যও। প্রাণীকূলে সবচেয়ে সৃজনশীল প্রাণী মানুষের ভাষাগত বৈচিত্র্যকেও তাই মানবসংস্কৃতি তথা বিশ্বসংস্কৃতি হিসেবে টিকিয়ে রাখতে হবে। একটি ভাষা হারিয়ে যাওয়া মানে শেষ পর্যন্ত একটা মানবিক জনগোষ্ঠীর অবলুপ্তি ঘটা।