ডেঙ্গু জ্বর কি শুধুই ব্যাধি নাকি দেবালয়ে আগুন লাগার সংকেত?

উপমা মাহবুবউপমা মাহবুব
Published : 17 August 2019, 10:34 AM
Updated : 17 August 2019, 10:34 AM

সুন্দরবন ঘেঁষা উপজেলা মুন্সিগঞ্জ। একদম প্রান্তিক এই জনপদের মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে বাঁচে। তারা বড্ড গরীব। অথচ প্রকৃতির বৈরিতা যেন প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। ঘূর্ণিঝড় এখন বাসিন্দাদের নিত্যসঙ্গী। বছরে গড়ে একবার জ্বলোচ্ছাসে বাড়ি ছাড়তে হয়। নদীর ওপারে সুন্দরবন আর এপারে লোনাজলের চিংড়িঘের। চারপাশে এত জল কিন্তু সবটুকুই লোনা। মুন্সিগঞ্জের বয়োবৃদ্ধ আমেনা চাচী তাই প্রতিদিন বেশ খানিকটা পথ পায়ে হেঁটে গ্রামের সুপেয় পানির একমাত্র উৎস একটি পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করেন। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে যতটুকু পানি বহন করে আনেন তাতে পরিবারের চাহিদা মেটে না। অথচ এই কাজে দৈনিক সময় ব্যয় হয় দুই থেকে তিন ঘন্টা। তারপরও জীবন থেমে নেই। ভাঙ্গা আর গড়া এই দুই মিলিয়েই এই জনপদের মানুষের সংগ্রামী জীবন।

ঢাকাসহ সারাদেশে এখন এক মহা আতঙ্কের নাম ডেঙ্গু। ঢাকার হাসপাতালগুলোতে জায়গা নেই। প্রতিদিন নতুন নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছে। ডেঙ্গু জ্বরে মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। সব জায়গায় আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ডেঙ্গু । মজার ব্যাপার হলো ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবে আমরা মানে শহরের বাসিন্দারা ভীষণ রকমের বিস্মিত হয়েছি। ময়লা-আবর্জনায় আকন্ঠ ডুবে থাকার পরও এতদিন শহুরে জীবন ভালোই চলছিলো। কোথা থেকে, কেমন করে এই এক ডেঙ্গুরোগের আবির্ভাব ঘটলো আর তা এসির বাতাস খাওয়া ঘরের ভেতরেও ঢুকে গেল। নোংরাতো হয় বস্তির মানুষ। এতদিন আমরা ভেবে এসেছি ধনী মানুষের জন্য বাড়ি বানাতে কনস্ট্রাকশন সাইটে জমে থাকা পানি, দুই বাড়ির মাঝখানের ফাঁকে ময়লার স্তুপ, ছাদের টবে বা এসির জমে থাকা পানি ইত্যাদিতে যদি পরিবেশে দূষিত হয় তাতে আমার কী আসে যায়। এতে যদি রোগব্যাধি হয় তাহলে তা অন্যদের হবে। বিল্ডিং বাড়ির বাসিন্দাদের কারো কারো মনে তাই প্রশ্ন একটাই, ডেঙ্গু কেন আমার নিশ্চিত শান্তির জীবনে হামলা চালালো! বাহিরে যা হচ্ছে হোক। আমার ঘরের ভেতরতো ঝকঝকে পরিস্কার আছে।

ভাবছেন দুটো আলাদা আলাদা বিষয়কে কেন একসঙ্গে টেনে আনছি? এগুলোর মধ্যে যোগসূত্র কোথায়? আছে, অবশ্যই যোগসূত্র আছে, যার নাম– প্রকৃতি এবং পরিবেশ। উন্নত দেশের মানুষের মাত্রাতিরিক্ত ভোগবিলাসের কারণে বাতাসে সিএফসি গ্যাস বাড়ছে তাতে জলবায়ু পরিবর্তিত হয়ে বার বার জ্বলোচ্ছাসে ডুবছে হাজার হাজার মাইল দূরের সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দাদের ঘরবাড়ি। আবার এই বাংলাদেশে বসে একই মুন্সিগঞ্জের সমস্ত চাষযোগ্য জমিকে চিংড়িঘের বানিয়ে সেখানকার ভূউপরিস্থ এবং ভূগর্ভস্থ পানিকে লবণাক্ত করতে ভূমিকা রাখছেন এলাকার প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা। এসব দেখেও না দেখার ভান করে, নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করার চিন্তায় ডুবে আছি আমরা সাধারণ মানুষ। তাই উন্নত বিশ্বেও ভোগবাদি মানুষ, চিংড়িঘেরের মালিক এবং আমরা মানে আমজনতা, সবাই আসলে একই শ্রেণির মানুষ, যার নাম সুবিধাবাদি। যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের গায়ে এসে না পড়ে ততক্ষণ পর্যন্ত কোন সমস্যাকেই আমরা সমস্যা বলে মনে করি না। অন্যে কষ্ট পাচ্ছে তাতে আমার কী? আমিতো বেশ নিশ্চিত জীবনযাপন করছি। অথচ রাস্তায় যেখানে-সেখানে চিপসের প্যাকেট ফেলা, দুই বাড়ির মধ্যখানে ময়লার স্তুপ জমানো আর গাছ কাটা, নদী ভরাট করা বা এসি ও গাড়ি চালিয়ে বাতাস দূষণ করা সবকিছুই প্রকৃতি এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। কোনটা একটু বেশি ক্ষতি করে আর কোনটা একটু কম, একটুকুই পার্থক্য।

এই যে প্রকৃতি আর পরিবেশকে আমরা ধ্বংস করছি, এক সময় কি তার ফলাফল ভোগ করতে হবে না? অবশ্যই করতে হবে। প্রকৃতি ঠিকই প্রতিশোধ নেবে। ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব আমাদের সেই সংকেতই জানিয়ে দিচ্ছে। বাহিরে ময়লার স্তুপ আর পানি জমিয়ে নিজের ঘরে এসি চালিয়ে আপনি বেশিদিন নিরাপদে থাকতে পারবেন না। আজকে যদি এটা উপলব্ধি করে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে না পারেন তাহলে মনে রাখবেন আপনি নিজের হাতে আপনার সন্তানের ভবিষ্যতকে ঝুঁকিতে ফেলছেন। জলবায়ুর ক্ষতি করার ফলাফল পশ্চিমা বিশ্ব ঠিকই টের পেতে শুরু করেছে। সেখানকার অবহাওয়া উল্টা-পাল্টা আচরণ করছে। প্রতিবছর বিভিন্ন দেশে যেভাবে শীতের প্রকোপ ও তাপদাহ বাড়ছে, ঝড়-বৃষ্টি, বন্যা হচ্ছে, সেগুলো তারই আলামত।

মেয়েটার বয়স মাত্র ১৬ বছর। নাম তার গ্রেটা থানবার্গ। গতবছরের কথা, স্কুল বাদ দিয়ে একটানা তিন সপ্তাহ গ্রেটা বসে ছিলেন সুইডিশ পার্লামেন্টের সামনে। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল জলবায়ু সংকটের বিরুদ্ধে কেন যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো। তিনি তার কর্মকাণ্ডের কথা বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেন এবং জনমত তৈরি করতে থাকেন। পরবর্তীতে গ্রেটা 'ফ্রাই ডেস ফর দ্যা ফিউচার' নামে একটি সামাজিক আন্দোলন শুরু করেন। এর মাধ্যমে স্কুলে স্কুলে বিক্ষোভের আয়োজন করেন তিনি, যেটি এ বছরের ১৫ই মার্চ প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয়। এ দিন তার ডাকে সাড়া দিয়ে জার্মানি, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ ১০৫টি দেশের ১,৬৫৯টি স্থানে শিক্ষার্থীরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ ও মিছিল করে। (তথ্যসূত্র: রোর বাংলা) গ্রেটার সামাজিক আন্দোলন এতটাই সাড়া ফেলেছে যে এ বছর তাঁকে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। গ্রেটা এবং লক্ষ লক্ষ কিশোর-কিশোরী অজপাড়াগাঁয়ের বয়োবৃদ্ধ নারী আমেনা চাচীর হয়ে বিশ্বকে বায়ু সংকট নিয়ন্ত্রণে আনার আহবান জানাচ্ছে। তারা তাদের নিজেদের ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা চায়। আর আমরা কী চুপ করে বসে থাকবো? নাকি নিজেদের প্রকৃতি ও পরিবেশকে পরিষ্কার ও দূষণমুক্ত রাখতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে যতটুকু করা সম্ভব তা করতে উদ্যোগী হব? এই সিদ্ধান্ত আমাদেরকেই নিতে হবে। এবারে কোরবানী ঈদে যেভাবে প্রতিটি বাড়িতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা হয়েছে তেমনটা আগে কখনোই চোখে পড়েনি। ঈদের দিন সন্ধ্যায় ঘুরতে বের হয়ে ঢাকা শহরের কোথাও জমাটবাধা রক্ত বা মাংস কাটাকাটির দাগ দেখিনি। সারা শহরে ব্লিচিং পাউডারের গন্ধ। এক ডেঙ্গুর ভয়ে মানুষ নিজ দায়িত্বে সব আবর্জনা পরিষ্কার করেছে। আমি নিশ্চিত যে যারা বাড়ি গেছেন তাদের অনেকেই ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে, কমোডের ঢাকনা বন্ধ করে এবং জমা পানি ফেলে দিয়ে বাড়ি গেছেন। বাড়ি ফেরার পর তারা শুধু বাড়ির ভেতর নয় বরং আশপাশও আবার পরিষ্কার করবেন। তারমানে সরকারের উপর সব দায়িত্ব চাপিয়ে না দিয়ে চাইলে আমাদের শহরকে পরিষ্কার রাখতে আমরা নিজেরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারি।

আমাদের মনে রাখতে হবে জনপদে আগুন লাগলে দেবালয়ও রক্ষা পায় না। ডেঙ্গু সেই আগুনের সংকেত দিচ্ছে। তাই আসুন, আমরা নিজেদের ভালো থাকার গন্ডি থেকে একটু বের হয়ে আসি। আমি সুখে আছি তাই সারা পৃথিবীও সুখে আছে – এই মানসিকতা বর্জন করে নিজের এলাকা এবং আরও বৃহৎ পরিসরে সামগ্রিকভাবে পুরো দেশটাকে কেমন করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা যায়, এবং পরিবেশ ও প্রতিবেশকে রক্ষা করা যায় সে বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করি। ভুলে যাবেন না, আপনার পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর, বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যাওয়ার দায়িত্ব আপনার উপরও বর্তায়।