সিপিবি-র কৈফিয়ত

Published : 16 August 2019, 08:04 PM
Updated : 16 August 2019, 08:04 PM

মার্কসবাদের তাত্ত্বিক ভিত্তি হল সর্বহারার একনায়কতন্ত্র। মার্কস-এঙ্গেলসের কমিউনিস্ট ইশতেহারে স্পষ্ট করেই বলা আছে, 'বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে বিনাশ করে সর্বহারার একনায়কতন্ত্র কায়েম করতে হবে'। ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নে সেই একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, সমাজতন্ত্র যখন সাম্যবাদে উত্তীর্ণ হবে, তখন একটাই শ্রেণি থাকবে – সর্বহারা শ্রেণি। একটাই দল থাকবে – কমিউনিস্ট পার্টি।

কিন্তু শুক্রবার (৭ অগাস্ট) বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলামের এক ফেইসবুক পোস্ট দেখে মনে হল সমাজতন্ত্রের জন্য একদলীয় প্রথার বাইরেও কোন ভিন্ন ব্যবস্থা আছে।  

তিনি লিখেছেন- 

১৯৭৫ সালে সিপিবি 'একদলীয় ব্যবস্থা' তথা 'বাকশাল' গঠন না করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরামর্শ দিয়েছিল। তিনি পার্টির পরামর্শ গ্রহণ করেন নি। 

এমতাবস্থায়, 'বাকশাল' গঠিত হয়ে যাওয়ার পরে পার্টিকে প্রকাশ্যে 'বিলুপ্তির' ঘোষণা দিতে হলেও আসলে পার্টি বিলুপ্ত করা হয়নি। খুবই গোপনে, অনেকটা সংকুচিত আকারে, পার্টির অস্তিত্ব ও তার কাঠামো বহাল এবং সক্রিয় রাখা হয়েছিল। কিন্তু স্বাভাবিক কারণেই সেকথা প্রকাশ করা হয়নি। এমনকি অনেক পার্টি সদস্যকেও সে বিষয়টি অবগত করে ওঠা সম্ভব হয়নি। গোপনীয়তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ধীরে-ধীরে পার্টি কাঠামো সম্প্রসারিত করা হচ্ছিল। 

আমি কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছিলাম না। ঢাকা জেলা কমিটির ১৯/২০ জনের মধ্যে আমি সহ ১০/১২ জন এবং কমিটির বাইরে আরো সম্ভবতঃ ২০/২৫ জনকে নিয়ে গোপনে 'হার্ড কোর' কাঠামো বজায় রাখা হয়েছিল। বাকশাল গঠনের পর এগুলো কার্যকর হয়। ১৫ আগস্ট পর্যন্ত মাত্র ৩/৪ মাস এই অবস্থা বজায় ছিল। আমরা ৩/৪ জনের গ্রুপ করে ভাগহয়ে ১/২ বার বৈঠক করেছি। কেন্দীয় কমিটি ও অন্যান্য জেলা কাদেরকে নিয়ে ও কিভাবে সংগঠিত রাখা হয়েছিল তা আমার জানার কথা ছিল না।

এরকম একটা 'হার্ড কোর' আগাগোড়া গোপনে সংগঠিত ছিল বলেই ১৫ আগস্টের পর সব পার্টি সদস্যদেরকে তাই দ্রুত পার্টি কাঠামোতে সংগঠিত করা সম্ভব হয়েছিল।"

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সিপিবি সর্বহারার একনায়কতন্ত্র এবং একদলীয় শাসনের বদলে বহুদলীয় গণতন্ত্রর পথে এখন চলতে চায় স্বচ্ছন্দের সাথে। যদি শ্রমিক শ্রেণির একনায়কতন্ত্রই না থাকে, একদলীয় শাসনের বদলে যদি বুর্জোয়া গণতন্ত্রের বহুদলীয় ব্যবস্থাকেই মেনে নেওয়া হয়, সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বদলে যদি বাজার এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত উভয় অর্থনীতির কথা বলা হয়, তবে তার সঙ্গে মিশ্র অর্থনীতি এবং সোশাল ডেমোক্র্যাটদের চিন্তাভাবনার কোন পার্থক্য থাকে? অবশ্য সিপিবি বরাবরই শ্লোগান দেওয়ার সময় বিপ্লবের কথা বলে এবং সাংগঠনিক প্রশিক্ষণে দলীয় কর্মীদের শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্বের তত্ত্ব পড়ায়। কিন্তু দলগতভাবে তারা বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। 

বঙ্গবন্ধু বাকশাল কায়েম করেছিলেন একটা বৃহত্তর অর্থনৈতিক ভাবনা মাথায় রেখে। আওয়ামী লীগের সাথে এই বাকশালে নিজেদের বিলুপ্ত করেছিল সিপিবি ও ন্যাপ। সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নে বাকশাল ঠিক ছিল কিনা, কিংবা মুক্তিযুদ্ধের মূল যে আদর্শ ছিল সংসদীয় গণতন্ত্র তার সাথে বাকশাল যায় কিনা সেটা অন্য তর্ক। 

আজ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বললেন, তারা নাকি একদলীয় ব্যবস্থা না করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাই প্রকাশ্যে সিপিবি'র 'বিলুপ্তির' ঘোষণা দিয়েও গোপনে পার্টির কাঠামো রেখে দেয়া হয়েছিল। এতদিন পর এই কথায় অন্য কোন ভাবনা আসে। সিপিবি সভাপতির বক্তব্য নতুন প্রশ্ন সামনে এনেছে তার দল সম্পর্কেই। যেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি অপেক্ষায় ছিল কবে বঙ্গবন্ধু মারা যাবেন আর প্রকাশ্যে বাকশালে যোগ দিয়েও গোপনে থাকা পার্টিকে দ্রুত সামনে এনে রাজনীতি করা যাবে।  

প্রথম কথা হলো সমাজতন্ত্র নিজেই একদলীয় ব্যবস্থা, তাই বাকশালকে এক দলীয় বলে তাতে যোগ না দেয়ার যে কথা বলা হচ্ছে, সেখানে প্রমাণ হয় কম্যুনিস্ট দল হিসেবে সিপিবি-র দৃঢ়তার অভাব ছিল। ১৯৮০ সালে সিপিবি-র তৃতীয় কংগ্রেসে বাকশালে যোগদান বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছিল। ওই কংগ্রেসে সিপিবি দলীয়ভাবে এ ব্যাপারে তাদের আত্মমূল্যায়ন উপস্থাপন করেছিল। পার্টির কাগজপত্র দেখে এটাও বোঝা যায় যে সেই কংগ্রেসেও পরিষ্কার করা হয়নি বাকশালে যোগদান প্রশ্নে তারা কতটা বিতর্ক করেছিলেন বা করতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধুর সাথে। 

তাদের নিজেদের দলীয় সিদ্ধান্তে সিপিবি, ন্যাপসহ কয়েকটি দল নিজেদের পার্টি বিলুপ্ত করে বাকশালে গিয়েছিল। তাই যদি হয় তাহলে গোপনে দল টিকিয়ে রাখা হয়েছিল কেন? তারা কি ধরে নিয়েছিলেন যে বাকশাল মানুষ গ্রহণ করবেনা?  কমরেড ফরহাদ নেই, মনি সিংহ নেই। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এসব কথা তারা জীবিত থাকতে বলেননি, তারাও কখনও বলেননি। তবে দলের কেউ কেউ বলছেন তিনি নাকি বিষয়টা আগেও বলেছেন।  

মস্কোপন্থী সমাজতান্ত্রিক দল হিসেবে সিপিবি চলতো ক্রেমলিনের কথায়। সে হিসেবে অনেকেই বলেন, এমনকি খোদ সিপিবি-র ভেতরেই পোক্ত ধারণা আছে, বাকশাল গঠনের ক্ষেত্রে সোভিয়েত প্রভাব কাজ করেছে। সিপিবিকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল মস্কো থেকে- কোনভাবেই শেখ মুজিবকে ছাড়া যাবেনা। সেই বিবেচনায় সিপিবি বঙ্গবন্ধুকে পরামর্শ দিয়েছিল এবং বঙ্গবন্ধু সেই অনুযায়ী কাজটি করেননি। এই ধারণা কতটা এখন প্রমাণ করা যাবে সেটা একটা বড় বিষয়। 

বঙ্গবন্ধুর সরকারের প্রতিটি কাজের সাথে ছিল সিপিবি আর ন্যাপ। আজ এত বছর পর এসব কথা বললে কয়েকটি বিষয়ে প্রশ্ন আসে। কম্যুনিস্ট পার্টি তো বিপ্লবী দল, সেই বিবেচনায় দলীয় স্বাতন্ত্র বজায় রেখেই সে সময়ের ক্ষমতাসীনদের সাথে মিলে একটা মৈত্রী জোট করতে পারত এবং সেটা করতে গিয়ে নিশ্চয়ই নিজস্ব যুক্তিতে জোর দিতে পারত। সেটা যেহেতু পারেনি তাই এখন মুজাহিদুল ইসলামের এই বক্তব্য কেমন যেন কৈফিয়তের মত শোনায়। মনে হয় এই কৈফিয়ত তাদের কাছে পেশ করা হচ্ছে যারা বাকশাল প্রশ্নে ১৯৭৫-এর হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করতে চায়। 

সিপিবি সম্পর্কে এমনিতেই প্রচারণা আছে যে, সে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে না, সে স্বভাবে পরাশ্রিত। নতুন করে এই বক্তব্যের মাধ্যমে দল যে প্রবল, ইতিবাচক, প্রত্যয়ী রাজনীতি থেকে দূরে ছিল সিপিবি সভাপতি সেটিই যেন প্রকাশ করলেন আবার। 

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় ভূমিকা আছে এই দলের। প্রগতির আন্দোলনে অজস্র ত্যাগ আছে। গণমানুষের অনেক দাবি দাওয়ার সাথে থেকেছেও বারবার। তবুও সিপিবি আশ্চর্যজনকভাবে রাজনীতির এজেন্ডা স্থির করেনি কখনও। সে যেন দুর্বল, পরাশ্রিত, প্রতিক্রিয়াজীবী।  এই দল কেবল জবাব দিয়েছে, কেবল কৈফিয়ত খুঁজেছে। জনমানসে একটা ধারণা এই যে- সে স্বভাবে দুর্বল, কারণ তার আত্মপ্রত্যয় নেই। 

এ সংক্রান্ত খবর পড়তে ক্লিক করুন-