বাজেটে ধানসিঁড়ি নদীর বরাদ্দ কই?

আইরিন সুলতানাআইরিন সুলতানা
Published : 16 August 2019, 03:07 PM
Updated : 16 August 2019, 03:07 PM

কথা না কি বাতাসে থেকে যায়! এও শুনেছি, এক সময় বাতাসে ভেসে থাকা কথাদের পাকড়াও করার যন্ত্র আসবে। সে যন্ত্র আসতে কত দেরি তা পাঞ্জেরি হয়ত জানে, তবে  আট বছর আগের একটা প্রশ্নের উত্তর যখন এখন এসে ধ্বনিত হয়, তখন মনে হয় সত্যিই তবে কথা থেকে যায় বাতাসে।

ছোট কলেবরে ২০১১ সালে একটা  কলাম লিখেছিলাম। সমকাল ছেপেছিল। শিরোনামে একটাই প্রশ্ন – বুড়িগঙ্গা টেমস হলো না কেন?

প্রশ্নটা হতাশা থেকে করা। প্রশ্নটা নিরুপায় চাওয়া থেকে করা। প্রশ্নটা দারুণ চাওয়া থেকে করা। ওই কলামে লিখেছিলাম, "আজ যদি বুড়িগঙ্গা টেমস হতো, তবে 'লন্ডন আই' থেকে কত শত চোখ তাকিয়ে থাকত! আহ! আজ বুড়িগঙ্গা নীল হলে, পর্যটকরা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখত বুড়িগঙ্গার নীলচে স্ফটিক জল।"

বুড়িগঙ্গা টেমস হলো না কেন? দিনে দিনে বুড়িগঙ্গার জলে মিশে মিশে এই প্রশ্ন কালো কুচকুচে হতে থাকে।  আটটি বছর পার করে মেলে সেই প্রশ্নের উত্তর। আর সেই উত্তর খবর হয় একের অধিক পত্রিকায়।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বুড়িগঙ্গা টেমস হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, টেমস দেখতে লন্ডন যেতে হবে না আর, বুড়িগঙ্গা গেলেই টেমস দেখা যাবে।

মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরকারের একজন প্রতিনিধি হয়ে বুড়িগঙ্গাকে নিয়ে যে আশ্বাস জাগালেন, আশা করি সরকার সেই কথা রাখবে।

সমাজ ও সামাজিকের গুজবের ফাঁকেও গণমাধ্যমে একটা পজিটিভ নিউজ চোখে পড়ে ঠিক ঠিক। বিআইডিব্লউটিএ-র নদী উদ্ধার অভিযানে  আমিন-মোমিন গ্রুপের কবল থেকে তুরাগের পাড় উদ্ধার হয়েছিল কয়েক মাস আগেই। এরপর প্রায় ৫২ বিঘা এলাকায় তুরাগের একটি চ্যানেল খুলে গেছে। এর মধ্যে দিয়ে দেশের সব নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে হাই কোর্টের দেওয়া রায়কে যেন ভীষণ এক অভিবাদন জানালো বিআইডব্লিউটিএ। এজন্য এক নদী ধন্যবাদ বিআইডব্লিউটিএরও প্রাপ্য।

নদী পুনরুদ্ধারে মহাপরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এসবের পাশাপাশি নদী পাড় দখল স্থায়ীভাবে রোধে পাড় বাঁধাইসহ বৃক্ষরোপনের মত পরিকল্পনাও রয়েছে।  এই পরিকল্পনাবাস্তবায়নের প্রতিটা ধাপেই খরচ আছে; নদীর সীমানা নির্ধারণী খুঁটির খরচ, খনন খরচ,সৌন্দর্য বর্ধন খরচ। নদীর সংখ্যাও তো আর একটা-দুটো নয়; দেশ জুড়েনদী। তাহলেসব ধাপেই একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ বরাদ্দ মিলিয়ে নদীর জন্য মোটমাট বড় একটা বাজেট বরাদ্দকরতেই হয় সরকারকে। এবারতাহলে সম্পূরক প্রশ্নটা তোলাই যায়, জাতীয় বাজেটের কত শতাংশ বরাদ্দ নদীখাতে?

জীবনানন্দ দাশের কবিতারভাঁজে একটি নদী খুঁজে পাওয়া যায়। কবি মাতুলালয়েরপাশে ধানসিঁড়ি নদীটির প্রতি তার সকল মুগ্ধতা লিখে গেছেন কবিতায়। ভেবেছিলামনদীবিধৌত বাংলাদেশের অর্থনীতি-উন্নয়নে নদীর কথাও তেমন করে খুঁজে পাওয়া যাবে জাতীয় বাজেটে। যতটা প্রত্যাশা ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটের উপর ছিল, অর্থমন্ত্রী আহ ম মুস্তফা কামালের  'স্মার্ট' বাজেটঅবশ্য ততটা সম্ভাবনা নদীর ভেতর খুঁজে পায়নি।

বাজেট প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর পরই সংশ্লিষ্টদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশটাই এত বছরের প্রথা। এসব প্রতিক্রিয়াও প্রথাগত হয়েছে এই ক'বছরে। কেউ বলেন, গরীব মারার বাজেট। কেউ বাহবা দেন। কেউ চাহিদার পণ্যের দাম বাড়া-কমা নিয়ে পকেট বিছিয়ে বসেন। 

এসব কথার মধ্যেই 'আইনি সত্তা' পাওয়া নদীও বাজেট পরবর্তী প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলে ওঠে, বাজেটে নদীর জন্য বরাদ্দ কই?   

বাজেট প্রতিবেদনের সূচিপত্রে আঙ্গুল চালিয়ে ভাবছিলাম বিষয় থেকে নদী খুঁজে সরাসরি ওই পৃষ্ঠাটাই উল্টে পড়বো। পুরো সূচি আতিপাতি ঘেঁটেও যখন নদী শব্দটি পাওয়া গেল না, তখন বোঝা গেল রাষ্ট্রীয় বাজেটে নদী মূল বিষয় হয়ে ওঠেনি এখনো। সম্পূরক হিসেবে ব-দ্বীপ পরিকল্পনা, জলবায়ু-পরিবেশই ভরসা ছিল বাজেটে নদী খুঁজে পেতে।

একশ পাতা ছাড়িয়ে যাওয়া বাজেট প্রতিবেদন বার কয়েক পড়ে সারমর্ম দাঁড় করিয়ে বুঝলাম, নদীর  ভাঙ্গনের বাইরে নদী অর্থ যা তা হলো নদীর উপরে সেতু গড়া যায়। এই ধারণার অগ্রগতিও হয়েছে; এখন কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল হবে যাতায়াতের জন্য। নদী ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়টিও  আমলে আনা হয়েছে বাজেটে। কিন্তু যে দেশটির মাটি-জলবায়ু আর অর্থনীতিকে সিক্ত রাখে নদী, তার তত্ত্বাবধানে অর্থ বরাদ্দ নিয়ে কথা কেমন যেন উহ্যই রইল বাজেটে।

অর্থনীতিতে নতুন নতুন খাতের  সম্ভাবনা খোঁজা ও একে জাগিয়ে রাখায় সরকারের ভূমিকা সবসময়ই বড় পরিসরে। তবে নতুন সম্ভাবনায় মন দিতে গিয়ে আগের অর্থনৈতিক খাতটিকে দুর্বল হতে দিলে শেষমেষ কি অর্থনীতি সবল থাকবে? কৃষি নির্ভর অর্থনীতির বাংলাদেশে পোশাক শিল্প শক্তভাবে দাঁড়িয়েছে। তাই বলে কৃষকেরা ধান কাটার লোক না পেয়ে যদি আগামীতে ধান চাষ থেকেই সরে আসতে শুরু করে, তাহলে এই অর্থনীতিতে  'কুছ তো গারবার হ্যায়'!

একইভাবে পোশাকের পর বড় যে খাতটি অর্থনীতিতে অবদান রাখছে তা হলো তথ্যপ্রযুক্তি। তা বলে কি পোশাক শিল্পকে পেছনের দিকে ঠেলে দেবে নতুন এই অর্থনীতি? উত্তরটা 'না' হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।

নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদী এই দেশের অর্থনীতিতে বহমান ছিল। সময় বাঁচাতে যাতায়াতে নদী এখন প্রধান মাধ্যম না হলেও পর্যটন অথবা মালবাহী জাহাজ চলাচলে, বিদ্যুত উৎপাদনে, মৎস আহরণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও  নদী আবেদনময়ী। কৃষিখাতের খরচ বেড়ে যাওয়া শুরু হলো তখন থেকে যখন নদীপথ রুদ্ধ করে দেওয়া শুরু হলো। এই দেশের মাটির উর্বরাশক্তির কারণে কৃষিখাত আমাদের অর্থনীতিতে অন্যতম স্তম্ভ। দূরদর্শিতার অভাবে এই কৃষিখাত যতটুকু অবহেলিত, তা আবার শক্তিশালী করতে নদীকেও চাই।

কিন্তু বাজেট প্রতিবেদন পড়ে মনেই হয় না যে নদী অর্থনীতির একটি খাত; অর্থনীতির একটি স্তম্ভ। এমনকি মহাপরিকল্পনা নিয়ে শুনলেও মনে হয়, এটা শুধুই ব্যয়; এখানে আয়ের, কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা নেই।

নদীকে নিয়ে সকল উদ্যোগ আর পরিকল্পনায় সরকারের এখনকার তাবৎ ব্যয়কে মূলত বিনিয়োগ হিসেবে দেখাতে হবে। পাশাপাশি নদী অর্থনীতি আগামী কত বছরের মধ্যে চাঙ্গা হবে, সেই লক্ষ্যমাত্রার ঘোষণাও আসতে হবে সকল পরিকল্পনায়।    

জাতীয় বাজেট সংসদে তোলার আগেই শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি উঠেছিল। সংশ্লিষ্টরা স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, শিক্ষাখাতে মোট বরাদ্দের ২০ শতাংশ দেওয়া উচিৎ। দাবি ছিল জেন্ডার বাজেট বাড়ানোর। কিন্তু জাতীয় বাজেটে নদীখাতে কত বরাদ্দ হওয়া উচিৎ তেমন দাবি নদী বা পরিবেশকর্মীদের মধ্যে থেকে ছিল না।

বাজেটের পর যে সকল খাতে কম বরাদ্দ হয়েছে, সেই খাত সংশ্লিষ্টরা সমালোচনায় মুখর থাকেন এমন অবহেলার জন্য। কিন্তু জাতীয় বাজেট উত্থাপনের পর নদী ও পরিবেশকর্মীরা বাজেট থেকে নদীর জন্য কী প্রাপ্তি তা নিয়ে আলাপ তোলেন না। বাজেটে সোনালী অর্থনীতি আছে, সুনীল অর্থনীতি আছে। কিন্তু স্বীকৃতি পায়নি নদী অর্থনীতি।

নদী কেন বাজেটের মূল খাতে আসবে না? বাজেটে কেন গত বছরের নদীকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে বিনিয়োগ ও আয়ের খতিয়ান থাকবে না? বাজেটে কেন নদী অর্থনীতির বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় আগামী অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ উল্লেখ করা হবে না?

নদীকে নানা বিনিয়োগ, উদ্ভাবন ও স্টার্টআপের সঙ্গে নদীবান্ধবভাবে জুড়ে পরিকল্পনা ও প্রণোদনা দেওয়ার সময় এখন। সড়কের জন্য যদি রাইড শেয়ারিং অ্যাপ জীবনের অংশ হতে পারে, তবে নদীতেও লঞ্চ-জাহাজ বুকিং অ্যাপকে জনপ্রিয় করতে উদ্যোগী হতে হবে। নদীভিত্তিক পর্যটনকে এগুতে দিতে এন্ট্রাপ্রেনিউর ও স্টার্টআপ মডেলের প্রচারণা করতে হবে। নদীপথে বিলাসবহুল ক্রুজ চলাচলে বেসরকারি বিনিয়োগকে আহ্বান জানাতে হবে।

এসবের জন্য জাতীয় বাজেটে নদীখাতকে আলাদা জায়গা দেওয়ার পাশাপাশি  চাই বরাদ্দও। প্রয়োজনে নদীর নাম ধরে ধরে বরাদ্দ হোক। যেন বাজেটে বুড়িগঙ্গা অবহেলিত হলো না কি ধানসিঁড়ি নদী- তা বোধগম্য হয়।

জীবনানন্দ হয়ত এতদিনে আবার ফিরেই আসতেন। কিন্তু ধানসিঁড়িটি নদীটি কি ফেরার মত আছে আর? জীবনানন্দকে ফেরাতে বাজেটে অবহেলিত ধানসিঁড়ি নদীটি তাই জাতীয় বাজেট  'সমালোচনায়' সামিল হতেই পারে। আর তাতে সায় থাকবে খাল-বিল-হাওর-জলাশয়গুলোরও।