বিয়ার গ্রিলস হয়ে বেঁঁচে থাকা ডেঙ্গু উপদ্রুত নগরে

এম এম খালেকুজ্জামানএম এম খালেকুজ্জামান
Published : 16 August 2019, 02:05 PM
Updated : 16 August 2019, 02:05 PM

সেলিব্রেটি লেখিকা অরুন্ধতী রায়ের 'দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস' এর আদলে ঢাকাকে এখন 'দ্য সিটি অব ফিয়ার' বললে খুব কম বলা হয় কি? সর্বব্যাপী দুর্নীতি, শিশু ধর্ষণ, খাদ্যে-দুধে অ্যান্টিবায়োটিক/ভেজাল, পদ্মা সেতুর জন্য মানুষের মাথা ইত্যাদি ইস্যুও পেছনে পড়ে গেছে ডেঙ্গু রাজ কায়েম করায়। সর্বব্যাপী ডেঙ্গকেকে আর কেবল ঢাকায় আটকে রাখা যায়নি মানুষকে বাহন করে ছেয়ে গেছে বাংলাদেশের সব জেলা শহর।

ঢাকাই ছবির নায়ক থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অনেক নেতাই সিলভেস্টার স্ট্যালোনের এর মতো 'র‌্যাম্বো' স্টাইলে পিঠে ফগার মেশিন পেঁচিয়ে নিয়ে টিভি ক্যামেরার সামনে মশা নিধনের পোজ দিচ্ছেন। আলতো ভঙ্গিতে ঝাড়ু হাতে পড়ে থাকা ঝরাপাতা পরিষ্কারের ছবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভরে গেছে, আমাদের এ বেদনা বিধুরতায় একে এক ধরনের কমিক রিলিফ হিসেবে দেখতে পারি। ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রম অনেক জোরদার হয়েছে বৈকি, কিন্তু হাসপাতালগুলোর রেজিস্ট্রার খাতা ভরে গেছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীতে, হাসপাতালের মেঝেতেও এখন মশারি টানিয়ে রোগী সংকুলান করা যাচ্ছে না।

ডেঙ্গু পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। রোগীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, মৃতের তালিকাও বড় হচ্ছে। এ পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্তের সুনির্দিষ্ট হিসেব এখনো পাওয়া যায়নি। সরকার যে হিসেব দিচ্ছে তার সাথে গণমাধ্যমে আসা খবরের হিসেবের বিস্তর ফারাক।

বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির বিষয়টি যখন বহুল আলোচিত, ঠিক তখনই বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির অন্যতম নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় রোগব্যাধি বৃদ্ধি পাবে এমন আশঙ্কা নিয়ে অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণা আছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের ১০ জুন তারিখে How Dengue, a Deadly Mosquito-Borne Disease, Could Spread in a Warming World

শিরোনামে কেন্ড্রা পিয়ের্ফ ও নাডজা পপভিচ যৌথভাবে লেখা কলামে লিখেছেন- বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, ইয়েলো ফিভার, রিফট ভ্যালি ফিভার ও এলিফ্যান্টিয়াসিস নামক রোগগুলো বৃদ্ধি পাবে। এসব রোগ মশাকে বাহক হিসেবে ব্যবহার করে ছড়ায়।

ইতিহাস বলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বেশি পরিলক্ষিত হয়।পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বছর ৫ থেকে ৫০ কোটি মানুষ বিশ্বের ১১১টি দেশে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এমন একটি রোগ এখন রাজধানীকে ছাড়িয়ে গোটা দেশকে ঘিরে ধরেছে। হাজার হাজার মানুষ যখন একটি রোগে আক্রান্ত হয় তখন কি তাকে মহামারী না বলে পারা যায়? আজকের এই মহামারী কিন্তু দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভুত নিয়মহীনতার ফসল। চাইলেও কি তা এক নিমিষে সমাধান করা সম্ভব? অনিরাপদ আর ভয়াবহ এক অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করছে।
দেশ ভাগের এক দশক পরেই এই অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার জ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল মহামারী আকারে । সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে ১৯৫৮ ইং থেকে ডিডিটি স্প্রে করা হয় ।এর ফলে মশা, তেলাপোকামুক্ত হয়েছিল গোটা অঞ্চল। এখনকার পরিস্থিতিও এমন কিনা ভেবে দেখা দরকার।

শতাব্দী প্রাচীন ধুলো পড়া- 'দ্য এপিডেমিক ডিজিজেস এ্যাক্ট ১৮৯৭, এই আইন সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন ২০১৮ (২০১৮ সনের ৬১ নং আইন) দ্বারা রদ করা হয়েছে। এই আইনের ২৪ নম্বর ধারায় শাস্তির কথা বলা আছে-

"ধারা ২৪। (১) যদি কোনো ব্যক্তি সংক্রামক জীবাণুর বিস্তার ঘটান বা বিস্তার ঘটিতে সহায়তা করেন, বা জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও অপর কোনো ব্যক্তি সংক্রমিত ব্যক্তি বা স্থাপনার সংস্পর্শে আসিবার সময় সংক্রমণের ঝুঁকির বিষয়টি তাহার নিকট গোপন করেন তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।

(২) যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনূর্ধ্ব ৬ (ছয়) মাস কারাদন্ডে, বা অনূর্ধ্ব ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদন্ডে, বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন।" যদিও এমন অনেক আইন-দন্ডের খড়গের কথা আমরা জানি।কিন্তু প্রতিকার মিলছে কই?

মশা নিধনের দাপ্তরিক দায় সিটি করপোরেশনের । কিন্তু সিটি করপোরেশন মশা নিধন আর দৈনন্দিন আবর্জনা পরিষ্কারের কাজকে গুলিয়ে ফেলেছে মনে হয়। প্রথমত যে কীটনাশক দিয়ে মশা নিধনের কাজ হচ্ছে তা কত ভাগ কার্যকরী তা নিয়ে অস্পষ্টতা আছে (এই তর্ক আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে)। তার ওপর যে সব কর্মীরা ফগিং মেশিন নিয়ে মশা মারছে তারা জানেন কিনা কিংবা জানানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে কিনা ডেঙ্গু রোগ বিস্তারকারী মশার আবাসস্থল কোথায় আর কীটনাশকের মাত্রাই বা কি হবে!

এখন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার না করে অনেক দেশ জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার করে মশার বিস্তার রোধে সফলতা পেয়েছে এবং সফলভাবে এসব প্রযুক্তির ব্যবহার করে আসছে । কেমিক্যাল ব্যবহারের জটিলতা, মশার প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি ও পরিবেশগত বিপর্যয়কে বিবেচনায় নিয়ে প্রতীয়মান হয় যে এই প্রযুক্তিগুলো অনেকটা টেকসই।

মশাদের নামানো হবে 'যুদ্ধে'। মশাদের বিরুদ্ধে মশাদের নামিয়ে শেষ করা হবে মশাদের এমন এক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে গুগলের আরেক সংস্থা 'অ্যালফাবেট' । পুরুষ মশাদের শরীরে 'উবাকিয়া' প্রজাতির একটি ব্যাকটেরিয়া ঢুকিয়ে স্ত্রী মশাদের আকৃষ্ট করে মিলনে প্রলুব্ধ করতে হবে এতে নির্বীজিত (sterilized) ও সংগতিরহিত (incompitable) হয়ে পড়বে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার জীবাণু বহনকারী মশারা। গুগলের সংস্থা 'অ্যালফাবেট'-এর আরেকটি সায়েন্টিফিক ইউনিট 'ভেরিলি লাইফ সায়েন্স'-এর জীববিজ্ঞানীরা সম্প্রতি এ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন এবং নিরীক্ষাও চালিয়েছেন আমেরিকার সাউথ ক্যালিফোর্নিয়ার ফ্রেসনো কাউন্টিতে। এই ভাবেই গোটা বিশ্বে মশাবাহিত রোগগুলি নির্মূল করা যাবে বলে বিজ্ঞানীদের আশা।

জিন প্রযুক্তি ব্যবহার করেও মশা ও রোগ বিস্তার রোধে আমাদের দেশীয় বিজ্ঞানী ও গবেষকরাও দায়িত্ব নিয়ে কাজ করলে সাফল্য পাবেন এমন আশা বাড়াবাড়ি নয়। কারণ আমাদের দেশিয় জীব বিজ্ঞানী ও গবেষকরাই পাটের ক্ষতিকর ছত্রাকের জিনোম সিকোয়েন্স, ইলিশের জিনোম উদ্ভাবন করেছেন। এছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যেমন ডব্লিউএইচও, ইউএসডিএ ও সিডিসি ইত্যাদি মশার সফল নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন দেশকে টেকনিক্যাল ও আর্থিক সহযোগিতা করে আসছে , যা আমরা পেতে পারি।

'ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড' টিভি শো-তে বিয়ার গ্রিলসের সাপ, ব্যাঙ, কেঁচো খেয়ে ভয়ংকর বিপৎসংকুল পরিবেশে টিকে থাকার সারভাইবাল টিপস সাথে আমাদের স্থানীয় মাননীয়দের নসিহত মেনে নিম সাবান পায়ে গায়ে মেখে ফুল হাতা শার্ট প্যান্ট পরে মশারির আবরণে সুস্থ থাকার লড়াই চালিয়ে যেতে হবে সব নাগরিক বিয়ার গ্রিলসদের।