আলিফ লাইলা-৬: গবেষণাহীনতায় কে বাঁচিতে চায়?

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 13 August 2019, 12:40 PM
Updated : 13 August 2019, 12:40 PM

[পূর্বকথা: অনেক অনেকদিন আগের কথা। হিন্দুস্তানে শাহরিয়ার নামে এক বদমেজাজি বাদশাহ ছিলেন। তিনি তার তথাকথিত চরিত্রহীনা এক বেগমের পরকীয়ার যারপরনাই নারাজ হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, প্রতি রাতে তিনি এক যুবতীকে নিকাহ-এ-মুতা করে ভোর হলেই এক রাতের সেই বেগমকে কতল করাবেন। শত শত যুবতী কন্যা কয়েক বৎসরে বেঘোরে ইন্তেকাল ফরমালে ক্ষুরধার বুদ্ধিমতী উজিরকন্যা শেহেরজাদি স্বজাতির প্রতি করুণাপরবশ হয়ে বোন দিনারজাদির সঙ্গে সল্লা করে স্বপ্রবৃত্ত হয়ে নিকাহ করেন বাদশা শাহরিয়ারকে। জীবনের শেষ রাতে শেহেরজাদির আবদার রাখতে বাসরঘরে ডেকে আনা হয় দিনারজাদিকে। রাত গভীর হলে পূর্বপরিকল্পনামাফিক ছোটবোন দিনারজাদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং নিয়ে একেকটি সওয়াল পুছতে থাকেন আর বড়বোন শেহেরজাদিও কালবিলম্ব না সেই সব সওয়ালের জওয়াব দিতে শুরু করেন। কিন্তু ভোরের আজান শোনা মাত্র জওয়াব বন্ধ করে নকশি লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েন দুই বোন। সওয়াল-জওয়াব শুনতে শুনতে বাদশাহ মজা পাচ্ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংকিং-এর ব্যাপারে বাদশাহের বিশেষ আগ্রহও ছিল বৈকি। সুতরাং পর পর পাঁচ দিন মৃত্যুদ- বাতিল হয় শেহেরজাদির। আজ সেই সওয়াল-জওয়াবের ষষ্ঠ রাত্রি]

'প্রিয় দিদি শেহেরজাদি! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত কলেজের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে তুমি গত রাতে যে অনেকগুলো মন্তব্য করেছিলে, তার মধ্যে অল্প কয়েকটি নিয়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে খোমাকিতাব কিংবা ফেসবুকে। শিক্ষার্থীরা তাদের তথাকথিত ধর্মঘটের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় দরজায় যে তালা লাগিয়েছিল, তুমি নাকি সেই তালার দাম বাড়িয়ে বলেছো। আন্দোলনকারীরা দুপুরে বিরানি খেয়েছে বলে উল্লেখ করেছো তুমি, কিন্তু অনেক আন্দোলনকারী নাকি বিরানির কোনো প্যাকেট চোখেই দেখেনি। যে শিশির ভট্টাচার্য্য তোমার কথাগুলো বিডিনিউজে প্রকাশ করেছে, সেই বেচারা অধ্যাপককে বেশুমার গালাগালি করেছে খোমাকিতাবিরা। এমনকি অধ্যাপক হিসেবে তার যোগ্যতা নিয়েও তারা প্রশ্ন তুলেছে।'

বোন দিনারজাদি! ওই মন্তব্যগুলো আমি কমবেশি পড়ে দেখেছি। গঠনমূলক কিংবা ধ্বংসসূচক কোনো সমালোচনাই বাঙালি করতে জানে না, শেখেনি, কখনও শেখানো হয়নি তাদের। বাঙালি জানে, শিখেছে, গালাগালি ও খিস্তিখেউর করতে এবং তাই তারা করছে, তাদের বাপদাদাদের মতো। অতীতে এটা তাদের বংশগত রোগ ছিল, ইদানিং (হয়তো ইয়াদিস মশার মতো কোনো রোগবাহী পতঙ্গের কারণে) সেই রোগ সংক্রামক হয়ে উঠেছে। তালার দাম ৫০০-এর বদলে না হয় ১০০ টাকাই হলো। এই অর্থতো কাউকে না কাউকে পরিশোধ করতে হয়েছে। শিক্ষার্থীরা বলে থাকে, তারা গরীব। গরীবই যদি হবে, তবে এত এত তালা কেনার পয়সাই বা তারা পায় কোথায় এবং সেই তালা ওরা নষ্টই বা করে কেন? এদের তালা ভাঙার কথা ভেবেই বোধ হয় কবিগুরু গীত রচনা করেছিলেন: 'ভেঙে মোর ঘরের তালা, নিয়ে যাবি কোন শালা!'

আমি তোমাকে বলেছিলাম, যে বা যারা এই টাকা দিয়েছে, তারা অবশ্যই তথাকঠিত ধর্মঘট সংঘঠনের সঙ্গে জড়িত। লক্ষ্য করো দিনারজাদি, আমার তালাসংক্রান্ত এই মূল মন্তব্যটির প্রতিবাদ কিন্তু কেউ করেনি। সবাই তালার দাম নিয়ে হৈচৈ করছে। আমি চাঁদ দেখাচ্ছি, ওরা বোকার মতো আমার আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে সমালোচনা করছে, আঙ্গুল মোটা নাকি চিকন, সুশ্রী নাকি বিশ্রী? বাঙালিরা এই করে আসছে বংশানুক্রমে। এদের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করো না। আমরা আরবরাও অবশ্য ওদের চেয়ে উন্নততর প্রাণী নই, যদিও ভাব দেখাতে ও বেহুদা হৈচৈ করতে আমাদেরও জুড়ি নেই।

শোনো বোন দিনারজাদি, মানুষীর মতো ছাগলীরও দুধের বাঁট দুটি (বাঁটের সংখ্যার কারণেই মানুষকে 'ছাগল' বলে গালি দেওয়া হয় না তো!)। ভাটি অঞ্চলের অতিপ্রজতায় তিনটি বাচ্চা যদি হয়েই যায় কোনো ছাগীর, তবে তিন নম্বর বাচ্চাটির ভাগ্যে দুধ নাও জুটতে পারে। তার মানে কি এই যে ছাগীর বাঁটে দুধ ছিল না, কোনো ছাগশিশুই দুগ্ধপান করেনি, কিংবা বাচ্চাটা ছাগলই নয়? বিরানির ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। ধর্মঘটীদের মধ্যে 'বীর' যারা, 'বিরানী' তাদের ভোগেই লেগেছে, কারণ শাস্ত্রে লিখেছে: 'বীরভোগ্যা বসুন্ধরা'। যারা 'ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা', তারা ভর দুপুরে খালিপেটে চিৎকার করেছে: 'মানি না, মানবো না!' কী মানো না, কী মানবে না? 'জানি না, জানি না!' কিন্তু 'উপাচার্যের অনুপস্থিতিতেই কেন তথাকথিত ধর্মঘটটি শুরু হয়েছিল এবং তার পুনরাগমনের অব্যবহিত পরেই আন্দোলনটি কেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল?'Ñ আমার এই মিলিয়ন দিনার প্রশ্নের কোনো উত্তর কি তুমি খোমাকিতাবে কোথাও দেখেছো, প্রিয় দিনারজাদি?

'কুজনে কুযশ করে সুযশ ঢাকিয়া। সুজনে সুযশ গায় কুযশ নাশিয়া।' থাক বোন, এসব ফালতু প্যাঁচাল। র‌্যাংকিং-এর প্রসঙ্গে আসি, কারণ অবান্তর আলাপে রাত কাটিয়ে দিলে বাদশাহ রাগ করতে পারেন। বাদশা রেগে যাওয়া মানে আমি আলীবাবার গলাটি 'সিসিম ফাঁক' হবার সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়া। তার চেয়ে বরং যুক্তির মশাল হাতে দস্যুদের অন্ধকার রত্নগুহায় ঢুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিঙে না আসার কারণ-মণিগুলো একে একে খুঁজে বের করা যাক।

'গবেষণাহীনতায় কে বাঁচিতে চায়?' অন্য কোনো জাতি না চাইতে পারে, বাঙালিরা চায়। জাপানে বায়োকেমিস্ট্রিতে পিএইচডি ও পোস্টডক করে দেশে ফিরেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বছর পাঁচেক আগে। স্বপ্ন ছিল, দেশে গবেষণা করবেন। কিন্তু পারলেন না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণাগারে গবেষক পদে আবেদন করলেন। আবেদন গ্রাহ্য হলো। চলে গেলেন, ঢাবির চাকুরি ছেড়ে দিলেন এবং শিকাগোতে স্থায়ী হলেন।

'আপনি কি ঢাবিতে থেকে গবেষণা করতে পারতেন না?' জিগ্যেস করেছিলাম তাকে। 'না পারতাম না। 'প্রথমত, বাংলাদেশে কোনো ল্যাব নেই।' 'সায়েন্স ল্যাবরেটরি?' বোকার মতো বললাম আমি। হা হা হা। দমফাটা হাসিতে ফেটে পড়লেন আমার প্রাক্তন সহকর্মী। 'একে যদি 'ল্যাব' বলেন, তবে ল্যাব কাকে বলে আপনি জানেন না! এই প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করেন, তারা কাগজে-কলমে সার্টিফিকেটধারী বিজ্ঞানী বটে, কিন্তু কাজে-কর্মে তারা সব 'ল্যাবেন্ডিস'। এই প্রতিষ্ঠানের কতজন বিজ্ঞানী গত দশ বছরে কোনো পিয়ার-রিভিউড জার্নালে তাদের গবেষণাকর্ম প্রকাশ করেছেন? 'সায়েন্স ল্যাবোরেটরি' নামক প্রতিষ্ঠানটা ঢাকা শহরের বুকের উপর খামাকা বিশাল এক জায়গা দখল করে থাকা এক মহান জাতীয় অপচয়ের নাম।

আমেরিকায় আমি যে ল্যাবে কাজ করি সেখানে সবচেয়ে কমদামী অনুবীক্ষণ যন্ত্রটির দাম কয়েক কোটি টাকা। বাংলাদেশের কোন ল্যাবে আছে এমন যন্ত্র? আমি মাসে ত্রিশ দিন, সপ্তাহে সাত দিন, প্রতি দিন কমবেশি আট ঘণ্টা অনুবীক্ষণ যন্ত্রে চোখ লাগিয়ে বসে থাকি। বসে থাকতে আমার ভালো লাগে, বসে থাকতেই আমি চাই। আমাকে প্রতি সপ্তাহে আমার প্রকল্প-প্রধানের কাছে রিপোর্ট করতে হয়, কী নিয়ে আমি গবেষণা করছি, গবেষণার ফলাফল কী। তিনিও সারাক্ষণ ব্যস্ত। তার নিজের গবেষণার কতদূর কী অগ্রগতি হলো, আমাকে তিনি নিয়মিত অবহিত করেন। বছরে কয়েকটা প্রকাশনা করতে না পারলে আমার চাকরি থাকবে না। এই পরিশ্রম বাংলাদেশের কোনো তথাকথিত বিজ্ঞানী করবেন না!

বাংলাদেশে কেউ কাজ করতে চায় না, সবাই ফোকটে নাম কামাতে চায়, নেতা হতে চায়। আমলা-মন্ত্রীদের তোষামোদ করে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্তাকর্তা হওয়া যায়, তবে কোন দুঃখে অনুবীক্ষণে চোখ লাগিয়ে বসে থাকবেন আমাদের গবেষক-অধ্যাপকেরা?' 'কিন্তু আপনার বিভাগের ওমুক অধ্যাপক, লড়াকু কিন্তু অবিমৃশ্যকারী বামপন্থী এক নেতা, যিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যর্থ উপাচার্যও ছিলেন, তিনিতো শুনেছি জাপানে অনেক গবেষণা করেছেন!' নাছোড়বান্দা আমি প্রতিবাদ করলাম। 'এক সময় করেছেন, সেটা ঠিক। কিন্তু আর করছেন না, তাওতো অনেকদিন হয়ে গেলো। গবেষণা জিনিসটায় সারা জীবন লেগে থাকতে হয়। আপনি কিছুদিন গবেষণা করলেন, তারপর (সত্যেন বোসের মতো) নাম কামিয়ে সারা জীবন আর কোনো গবেষণা করলেন না। গরম গরম বক্তৃতা দিলেন, রাজনীতি করলেন, ডিন-উপাচার্য হলেন… আপনার মতো মৌসুমি গবেষক-অধ্যাপক দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং- এ আসবে না।

'কিন্তু সরকার কিংবা বিশ্বব্যাংকতো কোটি কোটি টাকা দিচ্ছে যন্ত্রপাতি কেনার জন্যে। সে টাকা দিয়ে ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা যায় না?' জিগ্যেস করলাম আমি। সহকর্মী জবাব দিলেন: 'ল্যাব মানে তো শুধু যন্ত্রপাতি নয়, ল্যাব মানে গবেষক, গবেষণার মানসিকতা, গবেষকদের পুরো একটি কমিউনিটি। কমিউনিটি যদি না থাকে, তবে যন্ত্রপাতি ব্যবহার না হতে হতে মরিচা ধরে জংবাহাদুরে পরিণত হবে। কোটি টাকা জলে যাবে। সব অবশ্য জলে যাবে না। কিছু থেকে যাবে পকেটে। 'কুসুমে কুসুমে চরণচিহ্ন দিয়ে যাও!' না লিখে রবীন্দ্রনাথ লিখতেই পারতেন: 'পকেটে পকেটে চুরির চিহ্ন দিয়ে যাও!' আমাকে যদি সরকার ল্যাবের জন্যে ২০ কোটি টাকা দিত, আমি সেই টাকা থেকে ১০ কোটি টাকা সুরুৎ করে সরিয়ে ফেলতাম, কারণ এটাই বাংলাদেশে দস্তুর। এই টাকা না সরালে আমাকেই সরে যেতে হতো, পদ থেকে, কিংবা হয়তো দুনিয়া থেকেই। বছর কয়েক আগে জাপানে আমার গবেষণা-পরিচালক আমাকে জিগ্যেস করেছিলেন: 'কী তোমাদের দেশে নাকি গবেষণা করতে পদে পদে ঘুস দিতে হয়? গবেষক নাকি তহবিল তছরুপ করে?' আমি তো শুনে অবাক! 'ঘরের কথা পরে জানলো ক্যামনে!'

১০ কোটি টাকা সরিয়ে সব টাকা কি আমি নিজে খেতাম? না, আমার উপরে নিচে সবাই এর ভাগ পেতো, ঠিক যেমন কোনো কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে হয়, যেখানকার নিয়োগ-পদায়নের ঘুসের টাকা নাকি এক নম্বর, পৌনে এক নম্বরের পেটেও যায়। উত্তরবঙ্গের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে শুনেছি, কিছু দিন আগেও ৩০ লাখ টাকায় একেকটি প্রভাষক পদ বিক্রি হতো। এ টাকাও কি ভাগাভাগি হয়নি উচ্চ-নি¤œ-মধ্য পর্যায়ে? ঘুসের, দুর্নীতির টাকা ভাগ করে নেবার কারণ, উপনিষদে বলেছে: 'তেন ত্যাক্তেন ভুঞ্জিথা!' অর্থাৎ 'ওটাকে ত্যাগ করে করে ভোগ করতে হয়!' সবাইকে দিয়ে থুয়ে হারাম খাবে, যাতে তোমার একার গুনাহ না হয়! দোজখের মতো মজার জায়গায় একা যাওয়া কি ঠিক, বাওয়া!'

'কিন্তু পাটের জিন, ইলিশের ভূত! এগুলোতো শুনেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই আবিষ্কৃত হয়েছে!' ঢাবি কিংবা বাংলাদেশকে গবেষণাবান্ধব প্রমাণ করার শেষ চেষ্টা করলাম আমি, কিংবা হতাশার নদীতে ডুবতে ডুবতে খড়কুটো ধরে ভেসে থাকতে চাইলাম। 'এইসব জিনভূত আবিষ্কারের মতো ল্যাব কিংবা পরিবেশ বাংলাদেশে নেই, ছিল না কখনও। এই গবেষণাগুলো হয়েছে আসলে আমেরিকায়। বেশ বড়সড় একটি দল গবেষণা করেছে সেখানকার কোনো ল্যাবে। যিনি আবিষ্কার করেছেন বলে বলে আপনারা আদেখলা আহ্লাদে আটখানা হন তিনি সেই গবেষক দলের একজন নগণ্য সদস্য ছিলেন মাত্র। ঘটনাটা এর বেশি কিছু নয়।'

'বড় কোনো আবিষ্কার কখনও কেউ একা করে না। বড় আবিষ্কার হওয়ার জন্য বড় একটা গবেষক কমিউনিটি লাগে। সমাজটাকে গবেষণা-প্রবণ হতে হয়। বিজ্ঞানও অনেকটা ধর্মের মতোই। হজরত মুহম্মদ (স.) কওমের উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ধর্মচর্চা করতে একটি 'কওম' লাগে, সব কিছু একা একা করা যায় না। ধর্মে অবশ্য অনেক কিছুই একা করা যায়, কিন্তু সাহিত্যচর্চা, বিজ্ঞানচর্চা কখনও একা করা যায় না। এর জন্য সাহিত্যিক কিংবা বিজ্ঞানীদের একটি কওম অপরিহার্য। একটি বিজ্ঞানী 'কওমিউনিটি' কিংবা 'কমিউিনিটি অব সায়িেন্টস্ট' ছাড়া কোনো দেশে কিংবা সমাজে বিজ্ঞানচর্চা অ-স-ম্ভ-ব। আমি যদি নতুন একটা কিছু আবিষ্কার করি, সেই আবিষ্কারের স্বীকৃতি দেবে আমার বিজ্ঞানী কমিউনিটি। আমি ভুল করছি কি ঠিক করছি, সেটা নির্ধারণ করবে তারাই, অর্থাৎ আমার পয়িাররা, মানে আমার সমগোত্রীয়রা, মেন্টররা। এ জন্যেইতো পিয়ার-রিভিউড জার্নালে লেখা প্রকাশ করতে হয়। রিভিউ না করে কোনো লেখা প্রকাশ করা যায় না। বাংলাদেশে এ রকম কোনো জার্নালই নেই। যা কিছু আছে, সব 'পেয়ার-রিভিউড'।' এর মানে হচ্ছে, তুমি আমার পেয়ারের লোক, তাই তোমার লেখাটা রিভিউ ছাড়াই ছাপিয়ে দিলাম আমার, আমাদের পত্রিকায়। আমার, আমাদের উপরে কথা বলবে, কার মাথায় কটা ঘাড়! মুঘলে আজম ছবিতে মধুবালা অভিনীত (লতার?) সেই বিখ্যাত গানটি: 'পেয়ার কিয়াতো ডর না ক্যা! পেয়ার কিয়াতো চুরি নেহি কি, পেয়ার কিয়াআআআ'? বাংলাদেশের কোনো জার্নালে লেখা ছাপিয়ে সেই লেখা প্রদর্শন করে 'অধ্যাপক পোস্টমে প্রমোশন লেনা ঔর চোরি করনে মে কোই ফারাক হ্যায় ক্যা?'

বাংলাদেশে সেই বিজ্ঞান কমিউনিটি কোথায়? যা আছে সেতো 'বিগ গান' (আমেরিকান ইংরেজিতে এর অর্থ নাকি 'বৃহদাকার পুং জননেন্দ্রিয়!) কমিউনিটি। কে বিজ্ঞানচর্চা করে এই পোড়া দেশে? তথাকথিত বিজ্ঞানীরা সব দলবাজি আর গলাবাজিতে ব্যস্ত। নাম বলে কি শত্রু হবো? তুমি দিনারজাদি যদি গবেষণা করতে যাও, তবে তোমার কাজের কোনো স্বীকৃতিতো ওরা দেবেই না, বরং চেষ্টা করবে কীভাবে তোমার পেছনের ইয়েতে বাঁশ দেয়া যায়। তবে কোনো আবিষ্কার যদি সরকারের অর্জনের ঝুলিতে ঢোকানোর সম্ভাবনা থাকে, সেক্ষেত্রে সেই আবিষ্কার নিয়ে এক আধটু লোকদেখানো হৈচৈ হতে দেখেছি বটে, যেমনটা হয়েছে, ঐযে আমেরিকা-প্রবাসী অধ্যাপক বললেন, পাট-ইলিশের জিনভূতের বেলায়।'

'রোম একদিনে তৈরি হয়নি!' – এটা আমাদের দেশের প্রবাদবাক্য নয়। রোম যারা বানিয়েছিল, সেই ইওরোপের প্রবাদবাক্য। গবেষণা একদিনে হয় না। গবেষকও আকাশ থেকে পড়ে না। বিজ্ঞানে আকাশ থেকে কোনো বাণী আসে না। আমরা বাঙালিদের কাজই হচ্ছে সব কিছুকে বিকৃত করা। এমনকি ঐশী বাণীকেও আমরা রেহাই দিই না। ধর্মে বলা হয়েছে: 'জ্ঞান-অর্জন ফরজ।' আমরা সেটাকে বানিয়ে দিলাম: 'জ্ঞান-অর্জন করিতে চীন পর্যন্ত যাও!' শুধু তাই নয়, চীনাদের দেশে গিয়ে চীনাদের সামনে আমরা এই বানানো কথা সগর্বে শুনিয়ে এলাম। যে চীনারা দিনরাত ভাত খায়, তারা কি জানে না, কত ধানে কত চাল? যে জাতির দৃষ্টিতে নকল-বিশারদ চীনই হচ্ছে জ্ঞানের দূরতম এবং উন্নততম উৎস, সে জাতি কী গবেষণা করবে!

মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় থেকে শিক্ষার্থীদের যুক্তিবাদী করে তোলার বিকল্প নেই। যুক্তিবাদী বলতে আমি নাস্তিক বোঝাচ্ছি না। আমি শেহেরজাদি ব্যক্তিগতভাবে ধর্মে বিশ্বাসী। এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, সামাজিক ব্যাপারও বটে। যাদের সঙ্গে আমি থাকি, তাদের থেকে আলাদা হতে চাওয়াটা সহজ কাজ নয়। মহাপুরুষেরা এ বিষয়ে সফল হয়ে থাকেন। আমরা সাধারণ মানুষের অত মানসিক, সাংগঠনিক শক্তি কোথায়? বিজ্ঞানে বিশ্বাসের কোনো স্থান নেই, আর ধর্মে বিশ্বাস ছাড়া কোনো কথাই নেই। বিজ্ঞানী হিসেবে আমি শতভাগ সন্দেহবাদী। বিশ্বাসই যদি করবো, তবে গবেষণা করবো কী করে? বিশ্বাস মানে হচ্ছে, সত্য কী মিথ্যা এখনও যা নিশ্চিত হয়নি। মানব-সভ্যতার ইতিহাসে কোনো বিশ্বাস এ পর্যন্ত সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি। আমি যদি বিশ্বাস-প্রবণ হই, তবে আমি গবেষণা করবো কী করে?

ধর্ম আর বিজ্ঞানকে মেশানোর প্রয়োজন নেই আপাতত। এ দুটো বিষয়ের প্রকৃতি এতটাই বিপরীতধর্মী যে দুটোকে মেশাতে গেলে কোনোটাই ঠিকঠাকমতো পালন করা যাবে না। বাংলাদেশে বিজ্ঞান অনুষদ কিংবা প্রকৌশল বিদ্যায়তনগুলো মৌলবাদের আখড়া হয়ে উঠেছে গত পঞ্চাশ বছরে, কারণ তারা বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের গোঁজামিল দেয়, ধর্মকে বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ করতে চায়। ফলে তারা টুকটাক প্রযুক্তি শিখে উঠতে পারলেও বৈজ্ঞানিক মানসিকতা অর্জন করতে পারে না। বেশির ভাগ বিজ্ঞান ¯œাতক, বিজ্ঞানের শিক্ষক 'বিজ্ঞান' কাকে বলে তাই জানে না। বাংলাদেশে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিকে সমার্থক মনে করা হয়।

আমেরিকা-প্রবাসী গবেষক বলেছিলেন: 'স্কুল-কলেজের ল্যাবগুলোর কী অবস্থা একটু খোঁজ নিন। বেশির ভাগ স্কুল-কলেজে আগে যে ল্যাব ছিল গত চল্লিশ বছরে সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন ল্যাব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। স্কুল লাইব্রেরিগুলোতো আগেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের তথাকথিত 'প্র্যাকটিকাল' পরীক্ষায় কোনো প্র্যাকটিস নেই, আছে শুধু 'টিকল' মানে কাতুকুতু। কাতুকুতু দিয়ে গবেষক তৈরি হয় না। বিজ্ঞান মজার বিষয়, কিন্তু হাসির বিষয় নয়। এই বিজ্ঞানবিমুখ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবার পেছনে আশির দশকে বিশ্বব্যাপী মৌলবাদের উত্থানের যোগ আছে কিনা গবেষণা ছাড়া বলা সম্ভব নয়।'

আমি শেহেরজাদি ছাড়ার পাত্র নই। 'একটা সমাধানতো অন্তত বাৎলান। বাংলাদেশে পয়সার অভাব নেই। বাঙালিরা চায় তাদের গর্বের বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং-এ আসুক। 'সরকার গবেষণা কিংবা শিক্ষার ব্যাপারে আন্তরিক নয়' Ñ এই অপবাদ কেউ দেবে না। এই গোলক-ধাঁধা থেকে বের হবার কোনো পথ খোলা নেই Ñ এমন কি হতে পারে? গবেষক-অধ্যাপক নরম হলেন। 'বছর পাঁচেকের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে একটা ল্যাব স্থাপন করে দেখা যেতে পারে, এই ধরুন, সায়েন্স ল্যাবের ভিতরেই। এসব ল্যাবে বিদেশ থেকে (বাঙালি বা অন্য জাতির) গবেষণা-পরিচালক এনে দেখা যেতে পারে, ফলাফল কী দাঁড়ায়, অর্থাৎ পিয়ার-রিভিউড জার্নালে কটা গবেষণা-নির্ভর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তবে সেখানেও সমস্যা আছে। যেমন ধরুন, প্রাণরসায়ন গবেষণার জন্যে এমন কিছু উপাদান বিদেশ থেকে আমদানি করতেই হয় যেগুলো এক বা দুই দিনের বেশি সংরক্ষিত পরিবেশ ছাড়া রাখা যায় না। অর্ধশিক্ষিত কাস্টমস অফিসাররা কি আমার এই সমস্যা বুঝবে। আমি যদি ঘুস না দিই (এবং ঘুস দিতে হলে আমাকে চুরি করতে হবে!) তবে সেতো নিয়মমোতাবেক ফাইল ক্লিয়ার করতে লাগিয়ে দেবে সপ্তাহ কিংবা মাস। ততদিনে আমার ক্যামিক্যাল 'পঁচে এমন গোবর' হবে যে সেগুলো ভারতে পাঠানো ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না।'

'হঠাৎ ভারতের প্রসঙ্গ কেন?' জিগ্যেস করলাম আমি। 'কারণ ভারতে গোবর-গোমূত্রের অনেক চাহিদা। দূরদর্শনে দেখেননি, গরুর মুত্রদ্বার থেকে নিঃসৃত তরল-বর্জ্য গেলাসে গরমাগরম সংগ্রহ করে হরিদ্বারের গঙ্গাজল সমতুল্য ভেবে পান করছেন বিজেপির একেকজন সাংসদ এবং পাঞ্জাবির হাতায় ঠোঁট মুছে ঘ্যাড়াৎ করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলছেন: 'দুগ্ধকে লিয়ে নেহি, মুত্রকে লিয়ে গো-পালন কিজিয়ে!' পশ্চিমবঙ্গে ঘাটতি আছে বলে উত্তর ভারত থেকে প্রতিদিন সকালে নাকি বিমানযোগে গোমূত্র আমদানি করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ কেন এই বাজারটা ধরছে না?

সত্যিইতো! পাশের দেশ ভারত যখন বিজ্ঞানের উন্নতির এমন চরম শিখরে পৌঁছেছে, তখন বাংলাদেশেও গবেষণা-পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার কোনো কারণ নেই! উন্নয়ন একটি আঞ্চলিক ফেনোমেননও নয় কি? বাংলাদেশকে ঘিরে আছে যে বিশাল ভারত, দিনরাত প্রভাবিত করছে বহু দূরের যে মুমীন পাকিস্তান Ñ সেখানকার জনগণের বিজ্ঞানসম্মত জীবনচর্যার প্রভাব বাঙালিদের উপরও কমবেশি পড়ছে বৈকি! (জীবনানন্দের ভাষায়) 'আরো দূর অন্ধকারে' রয়েছে যে আরবদেশ, সেখানেও কোনো গবেষণা হয় না, কারণ আরবদেশেও উষ্ট্রমুত্র পবিত্রবারি হিসেবে পান করা হয় বলে শুনেছি। 'ওষ্ঠমুত্র' যেহেতু হয় না, সেহেতু উষ্ট্রমুত্রই সই। উট বলে কি মানুষ না!

প্রিয় দিনারজাদি! একটা গল্প খুঁজছিলাম আজকের বাহাস শেষ করার জন্যে। গল্পের বদলে পেয়ে গেলাম একটা সত্যি ঘটনা, আন্তর্জালে। মেঘ না চাইতেই জল। কীসের জল বুঝবেন একটু পরেই। খুরশীদ নামে এক পাকিস্তানি নাগরিক সৌদি আরবে উটের মুত্র বোতলজাত করে বিক্রি করতো। ২০১৫ সালে সৌদি পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। খুরশীদের অপরাধ: উটের মুত্রের বদলে বোতলে পাওয়া গিয়েছিল মনুষ্যমুত্র, তার নিজের এবং আরও অনেকের। হায়! পবিত্র মুত্রেও ভেজাল। ভারতেও 'গোমুত্র' নামে কী বোতলজাত হচ্ছে কে জানে!

[বাদশা ও দিনারজাদি আজও অট্টহাসি হাসতে গিয়ে ঢোক গিলে নিলেন হাসিটা। হাসিটা তিতা লাগলো মুখে, দুজনেরই মনটা ভরে গেল দুঃখে, বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, গবেষণার করুণ ভবিষ্যতের কথা ভেবে, কারণ গবেষণাহীন উন্নয়ন কোনো বিচারেই প্রকৃত উন্নয়ন নয়। যাইহোক, ইতিমধ্যে পূবের আকাশে সুবেহ-সাদিকের চিহ্ন ফুটে উঠলে এবং ভোরের আযানও শোনা গেলে আগের পাঁচ রাত্রির মতোই চুপ করে গেলেন শেহেরজাদি। ফজরের নামাজ পড়ে দুই বোন নকশি-লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন। বাদশা শাহরিয়ারও বেরিয়ে গেলেন প্রাসাদের মসজিদে ফজরের নামাজ আদায় করতে এবং অতঃপর রাজকার্যে। বাদশা গত পাঁচ রাত্রিতে বুঝে গেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিংঙে না আসার আরও অনেক কারণ জমা আছে শেহেরজাদির অভিজ্ঞতা ও বিশ্লেষণের ঝুড়িতে। জ্ঞানতৃষ্ণা প্রবলতর হয়ে উঠছে বলে বাদশা শাহরিয়ার শেহেরজাদির মৃত্যুদ- সপ্তম দিন পর্যন্ত মুলতবি করলেন।]