‘হালাল’ নাইট ক্লাব: কী চান যুবরাজ সালমান?

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 12 August 2019, 11:57 AM
Updated : 12 August 2019, 11:57 AM

২০১৭ সালের ২১ জুন বাদশাহ সালমান তার ভাইয়ের ছেলে মোহাম্মদ বিন নায়েফকে সরিয়ে তার ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমানকে প্রধান যুবরাজ ঘোষণা করবার পর একটা অস্থিরতার তৈরি হয়েছে সৌদি সমাজে। এ অস্থিরতার প্রভাব পড়েছে মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশেও। যুবরাজ হলেও তিনিই হয়ে উঠেছেন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। অনেকের ধারণা, সালমান আসলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছেন। খুব সম্ভবত তিনি তার বাবাকে বাধ্য করেছেন তাকে যুবরাজ ঘোষণা করবার জন্য। উল্লেখ্য যে, এর আগে ২০১৫ সালে তিনি দেশটির এবং আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।

বর্তমানে মাত্র ৩৩ বছর বয়সী সালমান যুবরাজ হয়ে এমন কিছু পরিবর্তনের সূচনা সৌদি সমাজে করেছেন, যেটা কিছুদিন আগেও ভাবা যেত না। একটা পরিবর্তনের রেশ কাটতে না কাটতেই আরেকটা পরিবর্তনের সূচনা করছেন তিনি। এ পরিবর্তনের সর্বশেষ ধারাবাহিকতা হল জেদ্দাতে নাইট ক্লাব খোলা, যেটিকে সৌদি কর্তৃপক্ষ 'হালাল' বলে দাবি করেছেন। তারা এ যুক্তিতে একে হালাল বলেছেন যে, এখানে মদ্যজাতীয় কিছু পরিবেশন করা হবে না। যদিও অন্যান্য নাইট ক্লাবের মত সঙ্গীত, নৃত্য ইত্যাদি হবে; তবে, এসব কিছুকে তারা হারাম মনে করছেন না।

উল্লেখ্য যে, সমস্ত মুসলিম বিশ্বে যে বিষয়টা কম বেশি দেখা যায় সেটা হল, এক শ্রেণির ব্যবসায়ী এবং শাসকদের ইসলামী প্রত্যয় ব্যবহার করে, ইসলাম যেসব বিষয়কে নিষিদ্ধ করেছে, সেসব বিষয়কে ব্যবসায়িক এবং রাজনৈতিক স্বার্থে, রাষ্ট্র এবং সমাজে জায়েজ করা। উদাহারণস্বরূপ বলা যায়, সুদ নির্ভর আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার সাথে ইসলামী শব্দ যোগ করা, তুরস্কে 'হালাল সেক্স টয়' এর দোকান চালু করা ইত্যাদি।

বাংলাদেশে এর সর্ব সাম্প্রতিকতম উদাহারণ হল পুরোটাই সুদ নির্ভর ক্রেডিট কার্ডকে 'হালাল ক্রেডিট কার্ড' হিসাবে একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক কর্তৃক চালু করা। বেশ কয়েক বছর আগে একটি প্রতিষ্ঠিত গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ কর্তৃক 'হালাল বিয়ার' চালু করবার উদ্যোগ আমরা দেখেছিলাম। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেও বাংলাদেশসহ বিভিন্ন মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রে আমরা দেখেছি সামরিক শাসক, স্বৈরশাসকদের ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে তাদের অবৈধ শাসনকে বৈধতা দিতে। সৌদি রাজতন্ত্রই হচ্ছে এর অন্যতম একটা বড় উদাহারণ।

 শিয়া, সুন্নিসহ সব মাজহাবেই, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে দিক নির্দেশনা রয়েছে, তার কোথায়ও রাজতন্ত্রের কথা বলা নেই। অর্থাৎ, ইসলামের কোন ব্যাখ্যা দিয়েই রাজতন্ত্রকে জায়েজ করা যায় না। অথচ, সৌদ পরিবার এখানে শুধু ইসলাম ব্যবহার করে তাদের শাসনকে জায়েজ করেই ক্ষান্ত হয়নি, এর পাশাপাশি পুরো আরব ভূমির নামকরণও এ পরিবারের নামে সৌদি আরব করেছে। পৃথিবীতে আর কোন রাষ্ট্র দেখা যায় না, যে রাষ্ট্রের নামকরণ একটি পরিবারের নামে।

এতদসত্ত্বেও 'ইসলামপন্থা' ও মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী দলগুলো এবং সাধারণ মুসলমানদের একটি বড় অংশকে, সৌদি রাজপরিবার এবং তাদের কার্যকলাপ নিয়ে কখনোই সমালোচনা করতে দেখা যায় নাই। তারা অন্তর থেকেই এটা বিশ্বাস করতে চান যে, সৌদি রাজপরিবার হচ্ছে ইসলামের 'রক্ষক' এবং ধর্মসম্মতভাবেই তারা দেশ পরিচালনা করছে। বিশেষত পাক-ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের একটা বড় অংশ নিজেরা রক্ষণশীল জীবন যাপন না করলেও তারা চান যে সৌদি জনসাধারণ- বিশেষত, সেখানকার নারী সমাজ যেন খুব রক্ষণশীল জীবন যাপন করে। তারা মুসলিম নারীদের রক্ষণশীলতা ভাঙবার যেকোন প্রচেষ্টাকেই ইসলাম ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক মনে করেন।

কিন্তু যুবরাজ সালমান যখন সৌদি নারী সমাজের সেই রক্ষণশীলতাকেই উপড়ে ফেলতে চাচ্ছেন, তখন স্বভাবতই সেটি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের অনেক মুসলমানের মাঝে এক ধরনের মনোজাগতিক সংকট তৈরি করেছে।যুবরাজের নানাবিধ পদক্ষেপ তাদেরকে এক ধরনের অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে অনেকের কাছেই মনে হচ্ছে, এতদিন ধরে চলে আসা রক্ষণশীল সৌদি সমাজের পুরো খোলনলচেই হয়ত তিনি বদলে ফেলতে চাচ্ছেন। ফলে, যে প্রশ্নটা সৌদি আরবসহ মুসলিম বিশ্বের অনেককে ভাবিত করে তুলছে সেটা হল- আসলে কী চাচ্ছেন যুবরাজ সালমান?

সালমান নাইট ক্লাব খুললেও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে আবার খবর বেরিয়েছে, খোলবার কিছুক্ষণ পরই আইনগত জটিলতা দেখিয়ে সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কঠিন সেন্সরশিপ এর দেশ সৌদি আরবে সংবাদের সত্যতা যাচাই করা অনেকটাই অসম্ভব। তবে এ সংবাদটি সত্য ধরে যে বিষয়টা বিশ্লেষকরা বলছেন সেটা হল, সালমান আসলে এ ক্লাবটিকে 'টেস্ট কেস' হিসেবে নিয়েছেন। তিনি দেখতে চেয়েছেন, সৌদি সমাজ পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি গ্রহণের জন্য কতটা প্রস্তুত। এ ধরনের 'পরীক্ষা' তিনি আরো চালাচ্ছেন পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ থেকে বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পীদের এনে নানা শহরে কনসার্টের আয়োজন করে। এ সমস্ত কনসার্টে একই সাথে নারী পুরুষরা অংশগ্রহণ করছেন, যেটা আগে সৌদি সমাজে দেখা যায়নি।  

তবে, সালমান যেটা বুঝতে পারছেন না সেটা হল, সৌদি আরবের মত স্বৈরতান্ত্রিক দেশগুলিতে জনগণের মনোভাব বুঝবার পথ তারা নিজেরাই বন্ধ করে রেখেছেন। সৌদি আরবে সালমানের বিরোধিতা করা মানেই হল 'সন্ত্রাসী'। এরকম একটা রাষ্ট্রে জনগণ সব সময় শাসকদের ইচ্ছা অনুযায়ী মতামত ব্যক্ত করবে এটাই স্বাভাবিক। ফলে, সৌদি সমাজের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের সালমানের সংস্কার কর্মসূচির প্রতি সমর্থন স্বতঃস্ফূর্ত, নাকি রাজ পরিবারের প্রতি অনুগত্য প্রদর্শনের কৌশলগত অবস্থান, তা নিরূপণ করা মুশকিল। তবে বাইরে থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, সমাজের একটা বড় অংশ নানা পরিবর্তনকে স্বাগত জানালেও, ধর্মীয় নেতৃত্বসহ (প্রচলিত ভাষায় আলেম সমাজ) সমাজের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ, ক্লাব খোলাসহ নারীদের ক্রমান্বয়ে সমানাধিকার এবং সমসুযোগ দেওয়ার লক্ষ্যে যে সংস্কার, তার বিরোধী।

অল্প বয়সেই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল বিষয়ে বিস্ময়কর রকম পারঙ্গম সালমান যে বিষয়টা বুঝতে পেরেছেন সেটা হল, তার পরিবর্তন প্রয়াসের প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে উঠবেন এ আলেম সমাজই। বাদশাহ ফয়সালের সংস্কার প্রয়াসের বিরুদ্ধেও প্রথম প্রতিরোধ আসে তাদের কাছ থেকেই। সালমান বুঝতে পেরেছেন, গণতন্ত্রহীনতার ফলে রাজনৈতিক দল এবং সে অর্থে সিভিল সোসাইটি গড়ে না উঠবার ফলে, আলেমরাই একমাত্র সংগঠিত প্রতিষ্ঠান, যা তার ক্ষমতার ভিত্তিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। এর ফলে এ প্রতিষ্ঠানটিকে তিনি ভেঙ্গে দিয়ে নিজের করতলগত করতে চাচ্ছেন।বস্তুত, আগামী দিনগুলিতে তিনি তার সংস্কার কর্মসূচিসহ টিকে থাকতে পারবেন কিনা, তার পুরোটাই নির্ভর করছে কতটা সফলতার সাথে তিনি এ প্রতিষ্ঠানটিকে হস্তগত করতে পারবেন তার উপর।

 এ হস্তগত করবার প্রক্রিয়া হিসাবে তিনি দুটো পথ নিয়েছেন। এর একটি হল নানাবিধ সুবিধা দিয়ে আলেম সমাজকে কিনে নেয়া। একাজে তিনি অনেকটা সফলও হয়েছেন। অনেককে যে কিনে নিতে পেরেছেন তার প্রমাণ হল, সালমানের সংস্কারের সমর্থনে নানা আলেমের বিভিন্ন সময়ে ফতোয়া বা বিবৃতি। আর যাদেরকে তার মনে হয়েছে কেনা যাবে না- এরকম কয়েক হাজার আলেমকে তিনি বন্দি করেছেন। এর মাঝে কাবা শরীফের ইমামও রয়েছেন বলে অনেক সংবাদ মাধ্যমে খবর বের হয়েছে।  

আলেমদের বড় অংশটির কারণে বর্তমানে যেমন সালমানকে নানা কিছু ভেবে চিনতে এগুতে হচ্ছে, তেমনই করতে হয়েছিল বাদশাহ ফয়সালকেও। ফয়সলই সৌদি সমাজে প্রথম পাশ্চাত্যকরণ প্রক্রিয়া শুরু করেন, যাকে পশ্চিমের ধারায় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা আধুনিকীকরণ বলেন। তবে এটাও সত্য যে, একটা সময় পর প্রাচ্যে বিজ্ঞানসহ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক উন্নয়নের ধারাটা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল বা শাসক শ্রেণি স্তব্ধ করে দিয়েছিল। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত প্রাচ্য ঠিক সেই অর্থে আধুনিকীরণের বিকল্প রূপকল্প বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করতে পারেনি। যার ফলে, প্রাচ্যের দেশগুলি বর্তমানে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি থেকে সমাজ সংস্কার বা বিকাশের মডেল হিসাবে কোন না কোন ভাবে পাশ্চাত্যকে অনুকরণ বা অনুসরণ করবার চেষ্টা করে আসছে।

বস্তুত মুসলিম জাতীয়তাবাদিরাও এর ব্যতিক্রম নন। তারাও পাশ্চাত্যের আধুনিকীরণ রূপকল্পকেই অনুসরণ করতে চান বা করেন, এবং পাশ্চাত্যের জীবনধারাকেই আদর্শ মানেন। কিন্তু, এসবের  সাথে তারা কিছু ইসলামিক রেটোরিক এবং প্রত্যয়ও ব্যবহার করতে চান। চর্চার মাঝে না  থেকে রেটোরিক এবং প্রত্যয় ব্যবহারের মাঝেই ইসলামীকরণ প্রক্রিয়া সীমাবদ্ধ রাখতে আগ্রহী তারা। তবে 'ইসলামপন্থী'দের সাথে সুসম্পর্ক রেখেই তারা রাজনীতি করতে চান, তা তারা ক্ষমতায় বা বাইরে, যেখানেই থাকুন।

উপমহাদেশের ক্ষেত্রে উদাহারণস্বরূপ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আইয়ুব খান, জিয়াউর রহমান, হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ প্রমুখ হলেন মুসলিম জাতীয়তাবাদী, যারা নিজ নিজ সমাজ অনেকটা পাশ্চাত্যের ধাঁচে আধুনিকীরণ করতে চেয়েছিলেন সাথে ইসলামিক রেটোরিক এবং প্রত্যয় ব্যবহার করে। কিন্তু, তারা রাষ্ট্র ব্যবস্থার আধুনিকীরণ চাননি। কেননা, তাহলে রাষ্ট্রকে পাশ্চাত্যের মত উদারনৈতিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তুলতে হবে, যা তাদের ক্ষমতা কাঠামোকেই চ্যালেঞ্জ করে বসবে।

মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের মত 'ইসলামপন্থী'রা শুধু রেটোরিক এবং প্রত্যয়ের ব্যবহার নিয়ে সন্তুষ্ট নন। তারা যে বিষয়টা চান সেটা হল, সমাজের সর্বস্তরের মানুষ ধর্মের মৌলিক নিয়ম কানুন, রীতি নীতি মেনে চলবে। পাশাপাশি নারী পুরুষের, বিশেষত নারীর পোশাকের বিষয়টা তাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ।একটা রাষ্ট্র কতটা ইসলামিক বা ইসলামিক নয় সেটা তাদের কাছে পরিমাপের অন্যতম মানদণ্ড হচ্ছে নারীর পোশাক এবং সমাজে তার রক্ষণশীল গতিশীলতা। তাদের কাছে সৌদি নারীদের অনুকরণে পোশাক মানে হল দেশটি বেশি ইসলামিক। এর বিপরীতে স্থানীয় সংস্কৃতিজাত বা পাশ্চাত্যের অনুকরণে পোশাকের প্রাধান্যের মানে হচ্ছে সে রাষ্ট্রটি কম ইসলামিক। সালমান 'ইসলামপন্থা'র রাজনীতির এ মূলটিকে ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি ইতিমধ্যে  রক্ষণশীল গতিশীলতার বিপরীতে নারীদের মাঝে পাশ্চাত্যের গতিশীলতা আনবার জন্য পদক্ষেপ নিয়ে, ক্রমান্বয়ে নারীর পোশাকের ব্যাপারে পাশ্চাত্যের উদারপন্থার দিকে হাঁটবেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন।

এত কিছুর পরেও বিশেষত, কয়েক হাজার আলেমকে গ্রেপ্তার করবার পরেও উপমহাদেশের 'ইসলামপন্থী' দলগুলো এর বিপরীতে কোন বিক্ষোভ, এমনকি একটা বিবৃতি পর্যন্ত দিতে পারেনি। 'ইসলামপন্থা' এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মূল সংকট হলো তাদের কাছে শত্রু সব সময়ই বহিস্থ অর্থাৎ অমুসলিমরা। ফলে, কোন মুসলিম রাষ্ট্র বা শাসক ধর্মের কাঠামোর মধ্যে থেকে যদি এমন কিছু করে, যা মুসলমানদের স্বার্থের পরিপন্থী হয়, তখন 'ইসলামপন্থী' এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদী দলগুলোর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প থাকে না।

'ইসলামপন্থী'দের পথে সালমান  হাঁটবেন না এটি পরিষ্কার। বিভিন্ন 'ইসলামপন্থী' দল এবং সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলোকে সৌদি আরবের পৃষ্ঠপোষকতা করবার যে দীর্ঘ অভিযোগ,সেখান থেকে তিনি বেরিয়ে আসতে চাইছেন। তাহলে প্রশ্ন হল, সালমান কি মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের পথে হাঁটবেন, না তিনি আরো সামনে যেতে চাচ্ছেন? অর্থাৎ, ধর্মীয় রেটোরিক এবং প্রত্যয় ইত্যাদির ব্যবহার থেকেও তিনি দেশকে বের করে আনতে চাইছেন?

একজন দক্ষ রাজনৈতিক, যিনি তার জনগণের নাড়ির স্পন্দন বুঝতে সক্ষম, তার দূরবর্তী লক্ষ্য যাই থাকুক, এই মুহূর্তে তিনি ধর্মীয় রেটোরিক এবং প্রত্যয়ের ব্যবহার থেকে দেশকে বের করে আনবেন না, এটা পরিষ্কার। তিনি তার সংস্কারের প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে যেটা করছেন সেটা হল, মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের মত ধর্মকে চর্চার জায়গা থেকে বের করে এনে, রেটোরিক এবং প্রত্যয়ের ব্যবহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ করতে। তিনি ধর্মকে নারীর অগ্রযাত্রার প্রধান প্রতিবন্ধক ভাবছেন। তাই, তিনি এর চর্চার ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ করে নারীকে সামনে এগিয়ে নিতে চাচ্ছেন। তার এ যাত্রায় কিছুদিন আগের তুলনায় নারীদের প্রাপ্তিও অকল্পনীয়।

নারীরা সেখানে এখন ড্রাইভ করতে পারছেন, যেটা কিছুদিন আগেও ভাবা যেত না। সারা দুনিয়ার গাড়ি কোম্পানিগুলি সৌদি আরবে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে নারীদের কাছে গাড়ি বিক্রি করবার জন্য। নারীরা নিয়োগ পাচ্ছেন বাণিজ্যিক বিমানের পাইলট হিসাবে। অচিরেই হয়ত নিয়োগ পাবেন কেবিন ক্রু হিসেবে। তারা এখন পুরুষদের সাথে স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখতে পারছেন, যা তাদের বহুদিনের দাবি ছিল। সালমান ১৯৮০ সালে বন্ধ হওয়া (যা বাদশাহ ফয়সাল চালু করেছিলেন) সিনেমা হলগুলি খুলে দিয়েছেন। যেখানে নারীরা একই সাথে পুরুষদের সাথে সিনেমা দেখতে পারছেন।

এর মধ্যেই তিনি আবার একটি নারী বান্ধব রাজকীয় ফরমান জারি করেছেন।এ ফরমান বলে এখন থেকে ২১ বছরের বেশি বয়সী যে কোন নারী বাবা, স্বামী বা অন্য কোনো পুরুষ আত্মীয়ের অনুমতি ছাড়াই পাসপোর্ট এবং বিদেশযাত্রার আবেদন করতে পারবেন। দীর্ঘদিন যাবত এটিও নারীদের দাবি ছিল, যাতে তারা একা একা অন্য দেশের নারীদের মত বিদেশ ভ্রমণ করতে পারেন। অর্থাৎ,দেখা যাচ্ছে, আধুনিক সৌদি ইতিহাসের সবচেয়ে নিষ্ঠুর, ধূর্ত, ম্যাকিয়াভেলিয়ান রাজতান্ত্রিক, স্বৈরশাসক হচ্ছেন সবচেয়ে নারী বান্ধব। তার হাত দিয়েই সৌদি আরবে নারীর অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে।  

এ  ধূর্ত, রাজতান্ত্রিক স্বৈরশাসক শুধু নিজের দেশেই নয়, এমনকি বাইরেও তার প্রতিপক্ষের অস্তিত্ব রাখতে চান না। সালমান তার বিরুদ্ধে ন্যূনতম সমালোচনাও নির্মূল করতে চান। যার ফলে হল সাংবাদিক আদনান খাশুগজিকে তুরস্কে নির্মমভাবে হত্যা করা, যেটা সৌদি আরব আগে কখনো করেনি বা করতে পারেনি।

দেশের অভ্যন্তরে সংখ্যালঘু শিয়াদের সালমান যেমন কঠোরভাবে কোণঠাসা করেছেন, তেমনি ইরানের প্রভাব ঠেকাবার জন্য ইয়েমেনে প্রতিনিয়ত তিনি নির্মমভাবে হত্যা করে চলেছেন নিরীহ, নারী, পুরুষ, শিশু যার প্রায় সবাই মুসলমান। মিয়ানমার সরকারের হাতে গত এক দশকে যত রোহিঙ্গা মুসলমান নিহত হয়েছেন, তার চেয়ে অনেক গুণ মুসলমান ইয়েমেনে নিহত হয়েছেন সালমানের নেতৃত্বে সৌদি হামলায়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসাবে তিনি তার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এ হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন।   

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তিনি দেশকে সরিয়ে আনছেন সাবেকী অবস্থান থেকে। শুধু মার্কিন নির্ভরতা থেকে দেশকে বের করে এনে রাশিয়া, চীনের সাথে বাড়াচ্ছেন বাণিজ্যিক এবং সামরিক সম্পর্ক। আবার একই সাথে মার্কিন সৈন্যদের ফিরিয়ে আনছেন সৌদি ভূমিতে। চীন মুসলিম প্রধান উইগর জনগোষ্ঠীর উপর যে নিপীড়ণ চালাচ্ছে, তার সমর্থন দিয়ে রাশিয়ার সাথে সালমান শক্তভাবে দাঁড়িয়েছেন চীনের পক্ষে। পাকিস্তানের বিপরীতে ভারতের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্ক অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে এখন উষ্ণ। বিশ্ব রাজনীতিতে ঐতিহাসিকভাবেই সৌদি আরব তার প্রধান শত্রু মনে করে ইরানকে। এ ইরানের প্রভাব রোধ করবার জন্য সালমান বেছে নিয়েছেন ইসরায়োলকে। মধ্যপ্রাচ্যে এখন সৌদি ইসরায়েল স্বার্থ এবং নীতি, কৌশল অনেকটাই কাছাকাছি।

কিন্তু প্রশ্ন হল, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নীতি, কৌশলের পরিবর্তন এবং সমাজে সংস্কার সাধনের যে প্রক্রিয়া সালমান শুরু করেছেন তাতে তিনি সফল হবেন কিনা। এর পূর্বে মুসলিম প্রধান দেশগুলির অনেক রাষ্ট্রনায়কই নানাবিধ সংস্কার কর্মসূচি শুরু করে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। আফগানিস্তানের বাদশাহ আমানুল্লাহ খান নারীমুক্তি মাথায় রেখে যে সংস্কার শুরু করেছিলেন তার প্রতিক্রিয়ায় চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে কমিউনিস্ট শাসকদের চাপিয়ে দেওয়া সংস্কার উদ্যোগও ব্যর্থ হয়েছিল, যার ফলে সেখানে উত্থান ঘটেছে 'ইসলামপন্থী' তালেবান সংগঠনের।

ইরানের শাহের আধুনিকীরণ প্রক্রিয়ার ফল হল 'শিয়া ইসলামী বিপ্লব' যা দেশকে নিয়ে যায় রক্ষণশীল ধারায়। তুরস্কে দীর্ঘ সময়ের আধুনিকায়ন এবং সেক্যুলার শাসন 'ইসলামপন্থা'র রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে শক্ত অবস্থানে।উল্লেখ্য যে, বিশ্ব ইতিহাসে তুরস্কের মত সেক্যুলার কোন পাশ্চাত্যের রাষ্ট্র বা সোভিয়েত ইউনিয়নও হতে পারেনি। আতাতুর্ক তুরস্কের সেক্যুলারিজমকে অনেকটাই নাস্তিকতার কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিলেন। এসমস্ত রাষ্ট্রনায়কদের পাশাপাশি সফল হতে পারেন নাই এমনকি সালমানের পূর্বসুরী বাদশাহ ফয়সলও। 

ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যাবে মুসলিম প্রধান দেশগুলির জনগণ সাধারণত যেকোন সামাজিক সংস্কারের বিরোধী, সেটা পরিবার পরিকল্পনা থেকে বড় সমাজ সংস্কার, যাই হোক না কেন। পরিবর্তনের অনাকাঙ্ক্ষা প্রায় সব মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রের জনগণের বৈশিষ্ট্য। অধিকাংশ মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রগুলোর সামাজিক সংস্কার বা পরিবর্তনগুলো এসেছে অনেকটা উপর থেকে চাপিয়ে দিয়ে। মধ্য এশিয়ার দেশ কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান ইত্যাদিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে সোভিয়েত কমিউনিস্ট শাসক কর্তৃক উপর থেকে চাপিয়ে, বল প্রয়োগ করে। এতে তারা সফলও হয়েছিলেন। এখন প্রশ্ন হল, চাপিয়ে দেওয়া সংস্কার করে সেসময় কমিউনিস্ট শাসকরা সফল হয়েছিলেন, কিন্তু সালমান হবেন কি?

সত্তর দশকে মনে করা হয়েছিল মুসলিম প্রধান দেশগুলি বোধহয় পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির ধারাতেই ক্রমান্বয়ে পথ চলবে। কিন্তু সত্তর দশকের শেষে ইরানের 'ইসলামী বিপ্লব' এবং 'ইসলামপন্থা'র রাজনীতির ব্যাপক উত্থানে এ ধারায় ছেদ ঘটে। তবে বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগে আবার একটা উল্টো স্রোতের ধারা শুরু হয়েছে। নানাবিধ কারণে 'ইসলামপন্থা'র রাজনীতি কোণঠাসা অবস্থানে ধাবমান। ইরানের নারীরা হিজাব খুলে ফেলবার আন্দোলন করছেন, যা সরকারের উপর একটা বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। একই সাথে সরকারবিরোধী এক বিশাল ক্ষোভ ধূমায়িত হচ্ছে সেখানে।

কিছুটা 'ইসলামপন্থা'র পথে হেঁটে তুরস্কের জনগণ আগের মত পুরোপুরি সেক্যুলারিজমে ফিরে যাবে কিনা সে ভাবনা শুরু করেছে। এর সবকিছুই সালমানের জন্য ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করেছে। এর সাথে রয়েছে দেশের মধ্যে পরিবর্তন আকাঙ্ক্ষী এক বিশাল যুব এবং নারী সমাজ। আর সালমানের সংস্কারের বিরোধী হিসাবে রয়েছেন আলেম সমাজ এবং প্রবীণ জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ।

তবে, সালমান সফল হবেন- কি হবেন না, সেটা বলার সময় এখনো আসেনি। তিনি যদি সফল না হন, তাকে ফয়সলের মত করুণ পরিণতি বরণ করতে হতে পারে। আর তিনি যদি সফল হন, তাহলে হালাল তকমা ব্যতিরেকেই আমরা সৌদি আরবের বিভিন্ন শহরে নাইট ক্লাব দেখতে পাব।