কাশ্মীর: ৩৭০ ধারা নিয়ে দীর্ঘ চক্রান্ত

গৌতম রায়
Published : 11 August 2019, 03:47 PM
Updated : 11 August 2019, 03:47 PM

ব্রিটিশঔপনিবেশিক শাসকদের শ্রেণিস্বার্থের তাগিদের ভেতরেই  লুকিয়ে আছে কাশ্মীর সমস্যার মূল বিষয়গুলো। ১৯৩৫সালের ভারত শাসন আইন আমাদের দেশের প্রশাসনিক এবং সেই সময়ের প্রচলিত ঔপনিবেশিক  সাংবিধানিক ব্যবস্থার পরিবর্তন নিয়ে আসে। সেইপরিবর্তনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল- ব্রিটিশ শাসিত অঞ্চলগুলোতে আগের তুলনায়অনেক বেশি সংখ্যক মানুষের হাতে ভোটাধিকার তুলে দেওয়ার একটা লোকদেখানো প্রচেষ্টা।

এই বিষয়টিব্রিটিশ কিন্তু স্বেচ্ছায় করেনি। সেই সময়ের জাতীয় আন্দোলন ব্রিটিশকে বাধ্যকরেছিল ১৯৩৫  সালের ভারত শাসন আইনেভারতবাসীর হাতে ক্ষমতার খানিকটা অংশ তুলে দিতে। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে ব্রিটিশশাসিত ভারতের অন্যান্য দেশীয় রাজ্যগুলির মধ্যে একটি ফেডারেশন তৈরির প্রস্তাব দেওয়াহয়েছিল ।

সেপ্রস্তাবে ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত হতে ইচ্ছুক যে সমস্ত দেশীয় রাজ্য, তাদেরকে একটা instrument ofaccession আওতায় আনার কথা বলা হয়েছিল।

সেই দলিলেইফেডারেশনের অন্তর্ভুক্তির প্রধান শর্তগুলি উল্লেখ থাকার কথা ছিল। এই শর্তগুলিকিন্তু ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের মূল অংশে উল্লেখ ছিল না। ব্রিটিশ সরকার এই বিষয়েএকটি খসড়া দলিল তৈরি করেছিল।

গোটাপ্রক্রিয়াটি যখন চলতে থাকে তারই মাঝে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ফলে এইফেডারেশন তৈরির প্রক্রিয়াটা শেষ অব্দি আর ফলপ্রসূ হয়নি। এরপর আসে ১৯৪৭ সাল। ক্ষমতাহস্তান্তর পর্ব। 'ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স অ্যাক্ট' অনুযায়ী দুটি স্বাধীনসার্বভৌম দেশ ভারত এবং পাকিস্তানের জন্ম হয়। আমাদের দেশ ভারতবর্ষের নিজস্বসংবিধান গৃহীত না হওয়ার সময়কাল পর্যন্ত ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনকে অন্তর্বর্তী সংবিধান হিসেবে ব্যবহার করার কথা ইন্ডিয়ানইন্ডিপেন্ডেন্স আইনে পরিষ্কারভাবে বলা হয়।

১৯৪৭ সালের১৫ অগাস্ট, অর্থাৎ ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় থেকে১৯৫০ সালের ২৫ জানুয়ারি মধ্যরাত পর্যন্ত সময়কাল ভারত শাসিত হয়েছিল এই ১৯৩৫ সালেরভারত শাসন আইন অনুযায়ী। সেই সময় সেটিকেই ভারতবর্ষের সংবিধান হিসেবে গণ্য করা হতো।

আমাদের মনেরাখা দরকার যে, দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তিরক্ষেত্রে এই ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের যে পরিকাঠামো ছিল, সেটিই কিন্তু ব্যবহার করা হয়েছিল। সর্দার  বল্লভভাই প্যাটেলকে রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িকশক্তি দেশীয় রাজ্যবর্গকে ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করার যে কৃতিত্বের ভাগীদারকরেন,মজার কথা হল, সেই তথাকথিত কৃতিত্বের ভিত্তি কিন্তু সর্দার প্যাটেল তৈরি করেননি। স্বাধীনভারতবর্ষের মানুষের তৈরি করা আইনের ধারাতেও  দেশীয় রাজ্যগুলির অন্তর্ভুক্তিহয়নি। হয়েছিল ব্রিটিশের তৈরি করা আইনের বলে।

ভারতেরস্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে কাশ্মীরের পূর্বে এক ভয়াবহপ্রজা বিদ্রোহ হয়।  পাশাপাশি ঘটে আফ্রিদি দখলদারদেরআগ্রাসন। এইসব ঘটনায়  কাশ্মীরের ডোকরা রাজাহরি সিং ভয়ঙ্কর বিপন্ন বোধ করেন। সেই বিপন্নতার ভেতর থেকেই তিনি শেষ পর্যন্ত ভারতরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। হরি সিংকে এই ভারতভুক্তিরচুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করার ক্ষেত্রে শেখ আবদুল্লাহর নেতৃত্বে কাশ্মীরেরমানুষের জানকবুল লড়াইয়ের একটা ঐতিহাসিক অবদান ছিল।

চুক্তিতেস্বাক্ষরের সাথে সাথেই হরি সিং ভারতবর্ষের শেষ ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেনকেএকটি চিঠি লিখে কাশ্মীরের জননেতা শেখ আব্দুল্লাহকে সে রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী পদেনিয়োগ করার কথা বলেন। সেই নিয়োগ কার্যকরী হওয়ায় জম্মু-কাশ্মীরের প্রশাসনেরদায়-দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় শেখ আব্দুল্লাহ নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার হাতে। হরিসিং এই  সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশকরেছিলেন।

মাউন্টব্যাটেনতার পাশাপাশি জনমতের ভিত্তিতে কাশ্মীরের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের চূড়ান্তসমাধান করার কথা  বলেছিলেন।

ক্ষমতাহস্তান্তর সংক্রান্ত আইনটির মূল ভিত্তি অনুসারে কাশ্মীরের হিন্দু ডোকরা রাজবংশের রাজাহরি সিং ভারতভুক্তির যে দলিলে স্বাক্ষর করেন, সেখানে কাশ্মীরের সুরক্ষা, বিদেশনীতি এবংযোগাযোগ ব্যবস্থা- এই তিনটি বিষয়ে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ভারত রাষ্ট্রের সংসদেরউপরে কিন্তু ন্যস্ত ছিল ।

হরি সিং এরস্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী কাশ্মীরের সাংবিধানিক সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ থাকার কথাবলা হয়েছিল। অর্থাৎ,  রাজনৈতিক হিন্দুরা যে কাশ্মীরের জন্য পৃথক সংবিধান ইত্যাদিশব্দগুলো ব্যবহার করে থাকেন, এগুলির কোনো মূলগতভিত্তি না থাকলেও, তাদেরই কার্যতঅভিন্নহৃদয় বন্ধু, তথাকথিত হিন্দুস্বার্থরক্ষাকারী রাজা হরি সিং ভারতভুক্তির যে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন, সেখানে তিনি স্পষ্টত কাশ্মীরের পৃথক সাংবিধানিকসার্বভৌমত্বের কথা বলেছিলেন।

কাশ্মীরেরপৃথক সাংবিধানিক সার্বভৌমত্ব ভারতবর্ষের অন্য অংশের কোনো নেতাদের আরোপিত কোনোবিষয় নয়, বা দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিতজওহরলাল নেহরু কিংবা শেখ  আবদুল্লাহ আরোপিতকোনো শর্ত নয়। এটি একেবারেই কাশ্মীরের হিন্দু রাজা হরি সিং এর আরোপিত শর্ত। হরিসিং ভারতভুক্তির যে দলিলে স্বাক্ষর করেছিলেন, সেখানেই আগামী দিনে কাশ্মীর ভূখণ্ডে ভারতবর্ষের সংবিধান কিভাবে, কতোখানি কাজ করবে, সেই বিষয়টি ভারতবর্ষ এবং কাশ্মীরের পারষ্পারিক আলাপ-আলোচনার ভেতর দিয়ে ঠিককরার কথা খুব পরিষ্কারভাবেই বলা হয়েছিল।

নয়াদিল্লিএবং শ্রীনগরের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ভেতরেও এ বিষয়টি নিয়ে ১৯৪৯ সালের মধ্যবর্তীসময় পর্যন্ত কয়েক মাস ধরে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা চলেছিল। ১৯৪৯ সালের ১৫  এবং ১৬ মে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাইপ্যাটেলের সঙ্গে তারই বাড়িতে দুই পক্ষের ভিতরে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা হয়েছিল।১৯৪৯ সালের ১৮ মে পণ্ডিত নেহরু একটি দীর্ঘ চিঠি লেখেন শেখ আবদুল্লাহকে। সেই চিঠিতেনেহরু লেখেন-

" …it has been the settled policyof the government of india, which on manyoccasions has been stated both by sardar patel and me, that the constitution ofJammu and Kashmir stateis a matter for determination by the people of the state represented in aConnstituent Assembly convened for the purpose……

jammu and kashmir state now standsacceded to the indian union in respect of three subjects, nameley ForeignAffairs, Defence and Communication. It will be for the Cinstituent Assembly ofthe State, when cinvened, to determine in what other subjects the state mayaccede …"

পণ্ডিতনেহরুর চিঠি থেকে এটা স্পষ্ট যে, সেই সময় কেন্দ্রীয়সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল- মহারাজা হরি সিংয়ের ভারতভুক্তির চুক্তিতে উল্লেখিত তিনটিবিষয় ছাড়া অন্যান্য প্রত্যেকটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চূড়ান্ত অধিকার কিন্তুজম্মু-কাশ্মীরের নির্বাচিত গণপরিষদের। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, এইসব আলাপ-আলোচনা সিদ্ধান্ত যখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভানিচ্ছে তখন কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্য।  নেহরুর অবস্থান সর্দার প্যাটেলের অবস্থান কিংবাশেখ আব্দুল্লাহ অবস্থান অথবা মহারাজা হরি সিং এর অবস্থান কোনো কিছুই সেই সময়কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগে উৎসাহীকরেনি।

১৯৪৯ সালেরনভেম্বরে ভারতবর্ষের সংবিধানে রাজনৈতিক ঐকমত্য কয়েকটি বিধিবদ্ধ রূপ হিসেবে নিয়েআসা হয়েছিল  চূড়ান্ত ভাবনা হয়ে। ৩৭০ধারায় ভারতীয় সংবিধানের কোন কোন বিষয় কাশ্মীরে প্রযোজ্য হবে তা নিয়ে একটাচাপানউতোর কিন্তু প্রথম থেকেই ছিল। যার জেরে কাশ্মীরের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গেদিল্লির প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা চলে ।

এই আলাপ-আলোচনা১৯৫২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলেছিল। ইতিমধ্যে কিন্তু প্যাটেল লোকান্তরিত হন। এইআলাপ আলোচনার ভিত্তিতেই ১৯৫২ সালের জুলাই মাসে স্বাক্ষরিত হয়েছিল দিল্লি চুক্তি।এ দিল্লি চুক্তি কাশ্মীরের সাংবিধানিক সার্বভৌমত্বের পরিবর্তে আংশিক স্বায়ত্তশাসনের  একটি রূপরেখা তৈরি করেছিল। কাশ্মীরের পৃথকসাংবিধানিক সার্বভৌমত্বের যে অভিযোগে রাজনৈতিক হিন্দুরা ভারতের প্রথমপ্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরুকে অভিযুক্ত করে থাকে, প্রকৃতপক্ষে কাশ্মীরের নিজস্ব সাংবিধানিক সার্বভৌমত্বের সেই রূপদাতা ছিলেনসেখানকার হিন্দু রাজা হরি সিং, যার চিন্তাভাবনাইত্যাদির সঙ্গে আজকের আরএসএস ও তার রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির চিন্তাভাবনার সাযুজ্যবেশি।

মজার কথাহল, এই হরি সিং-কে আশ্রয় করে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের নানা সমস্যাকে ঘিরে এক ধরনেররাজনৈতিক হিন্দু ভাবাবেগ আরএসএস, সেই সময়ের জনসঙ্ঘবা আজকের  বিজেপি তৈরি করতে করে। যদিও তাদেররাজনৈতিক ভিত্তি ও আদর্শগত চেতনার অন্যতম উদগাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জননী। লেডি যোগমায়া দেবী তার কনিষ্ঠ পুত্র উমাপ্রসাদমুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে হিমালয়ে তীর্থ ভ্রমণকালে, কাশ্মীরের রাজ পরিবারের মুখোমুখি পড়ে গেলেও তাদের  সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় পর্যন্ত করতে অস্বীকারকরেছিলেন।

কাশ্মীরেরহিন্দু রাজা, হিন্দু ঐক্যমত্যের তাগিদে লেডিযোগমায়া দেবীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের চেষ্টা করলেও পুত্র শ্যামাপ্রসাদেরমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে এই হরি সিং-কে এবং তার সহযোগীদের সন্দেহেরউর্ধ্বে লেডি যোগমায়া দেবী কখনো রাখেননি। তাই তিনি হিমালয় ভ্রমণ কালে কাশ্মীররাজ পরিবারের সৌজন্য সাক্ষাতের আহ্বান ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বর্তমান নিবন্ধকার রেডি যোগমায়া দেবীজীবনের এ ঘটনাবলি উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কাছে শুনেছেন। উমাপ্রসাদ তার ভ্রমণসংক্রান্ত গ্রন্থেও এই ঘটনা লিখে গিয়েছেন।

জম্মু-কাশ্মীরেরসাধারণ মানুষদের ভারতীয় নাগরিকত্ব এবং সেইসব মানুষদের বিশেষ অধিকার আরসুযোগসুবিধের বিষয়গুলো কিন্তু হরি সিংয়ের ভারতভুক্তির চুক্তির মধ্যে সেভাবেআলোচিত  হয়নি। হরি সিংয়ের ভারতভুক্তিরচুক্তির সময় কাল থেকে দিল্লি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সময়কালের ভেতরে এইপ্রশ্নগুলি নানাভাবে জম্মু-কাশ্মীরের মানুষদের ভেতরে ওঠায়, নানা ধরনের রাজনৈতিক, সামাজিক আন্দোলন দেখা দেওয়ার প্রেক্ষিতেই এই প্রসঙ্গগুলো দিল্লি চুক্তিতেপ্রধান আলোচ্য বিষয় হিসেবে স্থান পেয়েছিল ।

দিল্লিচুক্তি সম্পাদিত হওয়ার সময় পণ্ডিত নেহরুর যে সমস্ত ব্যক্তিগত নোট পাওয়া যায় এবংদিল্লি চুক্তি সংক্রান্ত যে ভাষণ তিনি সংসদে দিয়েছিলেন, তার থেকে এটা খুব পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারা যায় যে, জম্মু-কাশ্মীরের মানুষদের ভারতীয় নাগরিকত্ব, সেই সব মানুষদের বিশেষ অধিকার এবং সুযোগ সুবিধার বিষয়গুলিসেই সময়ে পণ্ডিত নেহরুসহ তার সতীর্থদের কাছে যেমন বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল, তেমনি গুরুত্ব পেয়েছিল কাশ্মীরের রাজনৈতিক নেতৃত্বেরকাছেও।

এই যেজম্মু-কাশ্মীরের নাগরিকদের বিশেষ অধিকার সংক্রান্ত বিষয়টি নিয়ে হিন্দুত্ববাদীরাপণ্ডিত নেহরুকে ঘিরে নানা ধরনের অপপ্রচার করে থাকেন, তার প্রেক্ষিতে বলতে হয় জম্মু-কাশ্মীরে কোনো বাইরের মানুষ জমি বা সম্পত্তিকেনার ক্ষেত্রে যে বিধি-নিষেধের আওতায় আছে সেই বিধি নিষেধ কিন্তু লাগু হয়েছিলউনিশ শতকের প্রথমভাগে। সেটি লাগু করেছিলেন হিন্দুরা। হিন্দু ডোগড়া শাসকরা তাদেরশাসন প্রতিষ্ঠার একদম প্রথম যুগে, বিশ শতকের প্রথমসময় থেকেই কাশ্মীরে বংশানুক্রমিক প্রজা এই বিষয়টি নিয়ে এসেছিলেন। সেখানকারহিন্দুরা যাদের বদান্যতাতেই একটা সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিভাষা হিসেবে বিষয়টি উঠেআসতে শুরু করে।

জম্মু-কাশ্মীরেরসরকারি চাকরিতে পাঞ্জাবি হিন্দুদের নিয়োগের প্রতিবাদে 'কাশ্মীর হলো কেবল কাশ্মীরিদের'-এই যে দৃষ্টিভঙ্গি এবং এ দৃষ্টিভঙ্গিকে ঘিরে একটা বৃহৎ আন্দোলন বিশ শতকের গোড়াতে কাশ্মীরজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই আন্দোলনের প্রধান দাবি ছিল, কাশ্মীরের সব সরকারি চাকরি কাশ্মীরিদের জন্য সংরক্ষিত করতেহবে। কাশ্মীরের ডোগড়া রাজারা ১৯১৩  সালথেকে ১৯৩২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এই  সম্পর্কেবেশ কিছু আইন তৈরি করেছিলেন।

ব্রিটিশঔপনিবেশিক শাসকদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তৈরি এইসব আইনের ভিতরে  বিশেষ উল্লেখযোগ্য ১৯২৭ সালের 'হেরিডিটারি রিস্টেট সাবজেক্ট অর্ডার'। এই আইনের ভেতর দিয়েই সরকারি চাকরি, জমি এবং সম্পত্তির মালিকানার ক্ষেত্রে বংশানুক্রমিকপ্রজাদের একচ্ছত্র অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। দিল্লি চুক্তির সময় কিন্তুভারতের মূল ভূখণ্ডের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং কাশ্মীরের রাজনৈতিক নেতারা প্রত্যেকেইসেরাজ্যের এই ঐতিহাসিক সামাজিক প্রেক্ষাপটকে মাথায় রেখে তার ধারাবাহিকতা রক্ষারপক্ষে সওয়াল করেছিলেন ।

রাজা হরিসিং যে আইন তৈরি করেছিলেন, কাশ্মীরেরমানুষদের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে সেই আইনের ধারাবাহিকতার প্রতি আস্থা প্রকাশকরেছিলেন শেখ আব্দুল্লাহ বা তার সহযোগীরা, আর ভারতের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থানকারী সেইসময়ের নেতৃত্ব সেইদাবিটিতেই তাদের সম্মতি জ্ঞাপন করেছিলেন। তাই কাশ্মীরের মানুষদের জন্য বিশেষঅধিকার নেহেরু তার ব্যক্তিগত স্বার্থে দিয়েছিলেন বলে রাজনৈতিক হিন্দুরা যে দাবিকরেন, সেটি সম্পূর্ণ অসত্য এবং ভিত্তিহীন।

কাশ্মীরে নির্বাচিতগণপরিষদ গঠন হওয়ার পর ১৯৫৬  সালের নভেম্বরমাসে জম্মু-কাশ্মীরের সংবিধানে স্থায়ী বাসিন্দার একটা আইনসম্মত পরিভাষা তৈরি করাহয়। সেই পরিভাষাতে ১৯৫৪ সালের ১৪ মে বা তার আগে যেসব মানুষজনেরা জম্মু-কাশ্মীরেরপ্রজা হিসেবে বিবেচিত ছিলেন কিংবা যারা তার আগের দশ বছরে বা তার বেশি সময় ধরেজম্মু-কাশ্মীরে অবস্থান করছেন এবং আইন অনুসারে স্থাবর – সম্পত্তির অধিকারী হয়েছেন, তারাই কেবল মাত্র স্থায়ী বাসিন্দার স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।

তারপরেওজম্মু-কাশ্মীরের আইনসভা স্থায়ী বাসিন্দাদের বিশেষ অধিকার এবং সুযোগ সুবিধার দিকগুলিচিহ্নিত করে একাধিক আইন অনুমোদন করেছিল। এইসব আইনের দ্বারা সরকারি চাকরি, জম্মু-কাশ্মীরের বিভিন্ন নির্বাচনে ভোটাধিকার, সরকারি কলেজে লেখাপড়ার করার সুযোগ সুবিধা, সরকারি বৃত্তি পাওয়ার সুযোগ ইত্যাদি স্থানীয় বাসিন্দাদেরজন্য সংরক্ষিত করা হয়।

জম্মু-কাশ্মীরেস্থাবর সম্পত্তির উপর অধিকার কায়েম করার বিষয়ে অস্থায়ী বাসিন্দাদের উপরে নানাধরনের বিধিনিষেধ আরোপিত হয়। এই ধরনের বিধিনিষেধ ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যে বলবৎআছে। এই ধরনের বিধিনিষেধ যে কেবল জম্মু-কাশ্মীরের জন্য আলাদা করে কিছু করা হয়েছেতেমনটি নয়।

জম্মু-কাশ্মীরেরমানুষদের বিশেষ অধিকার নিয়ে রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িকদের আপত্তির ক্ষেত্রেদুটি প্রধান বিষয় ছিল। রাষ্ট্রপতি দেশের সংবিধানকে এড়িয়ে সংবিধান সংশোধন করতেপারেন না। সংবিধানের ৩৭০ নম্বর ধারাটি-তে প্রতিষ্ঠিত করবার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকোনো অবস্থাতেই সংবিধানের ৩৬৮ নম্বর ধারাটি উপেক্ষা করতে পারেন না ।

সংবিধানেরএই ৩৬৮ নম্বর ধারাটি সংসদকে সংবিধান সংশোধনের অধিকার দিয়েছে। দ্বিতীয় বিষয় হল, জম্মু কাশ্মীরের জন্য ৩৫-এ ধারাটি বৈষম্যমূলক। সংবিধানেরএকটি মূলভিত্তি দ্বারা সংবিধানের ১৪ ধারা, সেই অনুযায়ী আইনের চোখে সকলের সমতার অধিকারকে এই ৩৫-এ ধারা সম্পূর্ণভাবেবিনষ্ট করছে ।

মজার কথাহল,সংবিধানের ৩৭০ নম্বর ধারাতে জম্মু-কাশ্মীরে ভারতবর্ষেরসংবিধান প্রয়োগের ক্ষেত্রে এক্সেপশন এবং মডিফিকেশনের বাস্তবতার বিষয়টিকেমুক্তকণ্ঠ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। এক্ষেত্রে কিন্তু কোনো রকম শর্ত আরোপ করা হয়নিএবং সাংবিধানিক নির্দেশিকার ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে যে সংশ্লিষ্ট আইনগুলি জারিকরতে হবে তাও খুব পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছিল।

রাজনৈতিক হিন্দুসাম্প্রদায়িক শক্তি একটিবারের জন্য বলছেন না, ভারতীয় সংবিধানের ৩৬৮ নম্বর ধারায়কাশ্মীর সংক্রান্ত বক্তব্য কিন্তু খুব পরিষ্কারভাবে রয়েছে। তাই সংবিধানের ৩৭০ধারা এবং ৩৫-এ ধারা, যেগুলিকে বিজেপিকার্যত গায়ের জোরে বাতিল করল, সেগুলি সাংবিধানিকবৈধতা নিয়ে তারা যে প্রশ্ন তোলেন, সেই প্রশ্নের পিছনে আদৌ কোনও যুক্তি নেই। বিজেপি ঘণিষ্ঠ সংগঠন 'উই দিসিটিজেন্স' এ সম্পর্কে সেই মামলাগুলি করেছিল- যেগুলো দেশের শীর্ষ আদালত, সুপ্রিম কোর্ট দু-দুবার তা খারিজ করে দিয়েছে।

১৯৬১ সালে এইবিষয়ক একটি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক ডিভিশন বেঞ্চস্পষ্টভাবে জানিয়েছিল যে, সংবিধানের ৩৭০ ধারারবিষয়ে মডিফিকেশন শব্দটিকে ব্যাপক অর্থে আমাদের উপলব্ধিতে আনতে হবে। সুপ্রিম কোর্টসেই মামলায় খুব পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছিল যে, সাংবিধানিক নির্দেশিকার মাধ্যমে জম্মু-কাশ্মীরে প্রযোজ্য যে কোনো আইনে মূলপরিবর্তন করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির আছে। এ বিষয়ে দ্বিতীয় আরেকটি খুব উল্লেখযোগ্যমামলা হল ১৯৬৯ সালে সম্পত প্রকাশ বনাম জম্মু-কাশ্মীর সরকার মামলা।

এই মামলায়অত্যন্ত স্পষ্টভাবে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিলেন যে, ভারতের সংবিধানের ৩৬৮ ধারা সরাসরি জম্মু-কাশ্মীরের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যাবে না। সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশিকা অনুযায়ী ভারতীয় সংবিধানের কোনো সংশোধিত অংশ জম্মু-কাশ্মীরেপ্রয়োগ করতে গেলে তা করতে হবে ৩৭০ ধারা অনুযায়ী। সাংবিধানিক নির্দেশিকা অনুসারীকোনো অঞ্চল বা জনগোষ্ঠীকে  যদি বিশেষঅধিকার দেওয়া হয়, তাহলে কি মৌলিকঅধিকারের  ক্ষেত্রে ভারসাম্য বিনষ্ট হয়না।

কাশ্মীরিদেরযে কাশ্মীরিওয়াতের  স্রোত বিশ শতকেরগোড়ায় কাশ্মীরি জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছিল, যার জেরে ১৯২৭  সালে 'হেরিডিটারি স্টেটসাবজেক্ট অর্ডার' তৈরি হয়েছিল, তার প্রেক্ষিতকেযদি আমরা অস্বীকার করি, তাহলে কিন্তুবাস্তব থেকে আমরা দূরে সরে যাব। আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা ১৯০৮ সালে বিরসা মুন্ডাউলগুলানের পরে ব্রিটিশ সরকার তৈরি করেছিল ছোটনাগপুর টেনান্সি অ্যাক্ট ।

এই আইনঅনুযায়ী আজও পূর্ব ভারতের একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আদিবাসী জমি বিক্রি ওহস্তান্তরের উপরে কঠোর আইনি বিধিনিষেধ আছে। আদিবাসী জমিও আদিবাসীদের বিক্রি করা বাহস্তান্তর করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে, এমন কি স্বাধীনতার পরেও এই ছোটনাগপুর টেনান্সি অ্যাক্ট একটাবড় ভূমিকা পালন করে চলেছে ।

কথাঅস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, আজকের ঝাড়খন্ডেবিভিন্ন মাইনিং কর্পোরেশনগুলির যে জমি ক্ষুধা, সেই ক্ষুধাকে প্রতিহত করতে এই  আইনএকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। এই আইনটি একটি ভৌগলিক অঞ্চলেঅবস্থানকারী একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর মানুষকে কিছু বিশেষ অধিকার দিয়েছে। সেইঅধিকারের ভিতর দিয়ে ওই মানুষদের মৌলিক অধিকারকে কিন্তু প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সেইআইনের যদি বৈধতা থাকতে পারে, তাহলে কেন ভারতীয়সংবিধানের ৩৫-এ ধারা বৈধতাকে ঘিরে প্রশ্ন তোলা হয়েছে এবং সেই প্রশ্নের ভিত্তিতেসংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সেই আইন কে বাতিল করা হয়েছে?

১৯৬২  সালে ভারতীয় সংসদে নাগাল্যান্ড বিষয়ক একটিসংবিধান সংশোধনী অনুমোদিত হয়। সংবিধানের ৩৭১ এ ধারাতে নাগাল্যান্ডের ক্ষেত্রেবিশেষ কিছু সুবিধা দেওয়া আছে। এই তালিকার ১-এ ৪ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এইধারাটি কেবলমাত্র ধর্মীয় আচার কিংবা সামাজিক প্রথাসিদ্ধ আইনের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধনয়। জমিজমা এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার বিষয়ক যাবতীয় আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ওনাগাল্যান্ড আইনসভার হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে।

এমন বিশেষ রক্ষাকবচ কিন্তু ভারতবর্ষের আর অন্য কোন রাজ্যের নেই। একই কথা প্রযোজ্য মিজোরাম বিষয়ক ভারতীয় সংবিধানের ৩৭১ জি ধারা সম্পর্কেও। এছাড়াও বিশেষ আইন আসাম, মনিপুর, অন্ধ্রপ্রদেশ, সিকিম, অরুণাচল প্রদেশ, গোয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে। এগুলি হল ৩৭১  বি,  সি,  ডি, এফ, এইচ এবং আই ধারা ।

ভারতের মতোবৈচিত্র্যময় একটি দেশে কেন্দ্রিভূত ক্ষমতার জোরে কেন্দ্রিয় সরকার জমি, জীবিকা, প্রাকৃতিক সম্পদ, ভাষা, সংস্কৃতিরক্ষেত্রে যে ধরনের কেন্দ্রিভূত ক্ষমতার মোহময় আচরণ করে তাতে ভারতীয় সংস্কৃতিরবৈচিত্র্য, যেটা চিরন্তন ভারতবর্ষের সবথেকেগুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, তা অনেক সময়সংকটের মধ্যে পড়তে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রীয়কাঠামোয় তাই এই ধরনের বিষয় কেন্দ্র-রাজ্য ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে একটিবিশেষ পদক্ষেপ হিসেবেই কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পুনর্বিন্যাস নিয়ে গঠিত সারকারিয়াকমিশন বিবেচনার রেখেছিল।

কাশ্মীরেরসাধারণ মানুষের ভেতরে আপামর ভারতবাসী সম্পর্কে ভালোবাসা, ভালো লাগার বিষয়টি ঘিরে একটা চাপানউতোর শুরু হয় ১৯৪৯সালে। জাতীয় কংগ্রেস এবং ন্যাশনাল কনফারেন্সের দীর্ঘ আলোচনার ভিত্তিতে সংবিধানের৩৭০ ধারার  বয়ান তৈরি হয়েছিল ।

আইনের মূলঅংশে উল্লেখিত ছিল 'গভর্নমেন্ট অব দ্য স্টেট'  এই শব্দগুলো। এটির পরিভাষা নিয়ে জাতীয়কংগ্রেসের নেতৃত্ব এবং ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতৃত্বের ভিতরে মতবিরোধ শুরু হয়। সেইমতবিরোধের প্রেক্ষিতে এই 'গভর্নমেন্ট অব দ্য স্টেট' শব্দটির একটি স্পষ্ট পরিভাষাসেখানে দেওয়া হয়েছিল, যে পরিভাষাটিকংগ্রেস এবং ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতৃত্ব ঐক্যমতের ভিত্তিতে ঠিক করেছিলেন।

দেখা গেল,ভারতের গণপরিষদের যখন এটি পেশ করা হচ্ছে, তখন কাশ্মীরের নেতৃত্বের সঙ্গে কোনোরকম আলাপ-আলোচনা ছাড়াই সংশ্লিষ্ট খসড়াআইনটিতে ঐক্যমতের ভিত্তিতে ঠিক করা অংশটির মুসাবিদাতে একটা বড় রকমের পরিবর্তন আনাহয়েছে। এই পরিবর্তনটি করেছিলেন আইনটির খসড়া লেখার  দায়িত্বে যিনি ছিলেন সেই ব্যক্তি। তিনি হলেনসেই সময়ের বিশিষ্ট আইনজীবী স্যার এন জি আয়াঙ্গার।

ন্যাশনাল কনফারেন্স এবং জাতীয় কংগ্রেসের নেতাদের ঐক্যমতের ভিত্তিতে তৈরি করা বয়ানে 'অ্যাপয়েন্টেড' শব্দটি ছিল। আর গণপরিষদে পেশ করা বিলটিতে বলা হলো অন্য  শব্দ- অর্ডারড।

খোলা চোখে দুটি শব্দ আপাত নিরীহ মনে হবে,  কিন্তু দুই দলের নেতৃত্বে স্থির করা পরিভাষা থেকে সরে গিয়ে  পরিবর্তিত পরিভাষা অনুযায়ী এর অর্থ দাঁড়িয়েছিল, ১৯৪৮  সালে কাশ্মীরে ক্ষমতাসীন শেখ আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভাকে সুনির্দিষ্ট করা হয়েছিল,  যার অর্থ দাঁড়ায় কাশ্মীরে গণপরিষদ তৈরির আগে শেখ আব্দুল্লাহের ওই মন্ত্রিসভায় কোন বড় রদবদল করা যাবে না।

এটিকে ওইপরিভাষাজনিত শব্দের জাদুকরী মায়ায় একটা আইনি লেবেল লাগিয়ে নেওয়া হয়েছিল। সেইসঙ্গে ৩৭০  ধারার একটি অস্থায়ী চরিত্রসেখানে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল। আর পরিবর্তিত পরিভাষায় ক্ষমতাসীন যে কোনো রাজ্যসরকারকেই ৩৭০ ধারা প্রয়োগের ক্ষেত্রে গভর্নমেন্ট অব দ্য স্টেট বলার খুব সুস্পষ্টসংস্থান রাখা হয়েছিল।

এ ঘটনা শেখআব্দুল্লাহসহ গণপরিষদের কাশ্মীরি সদস্যদের ভেতরে প্রচণ্ড ক্ষোভ সৃষ্টি করে। ১৯৫৪ সালেযে ৩৫ এ ধারা সংক্রান্ত নির্দেশ, সেখান থেকে ২০১৮সাল পর্যন্ত ৩৭০ ধারা প্রয়োগ করে ৪৭টিরও বেশি সাংবিধানিক নির্দেশ জারি করাহয়েছিল।

১৯৮৬ সালেরাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় সংবিধানের ২৪৯ ধারা সংক্রান্ত একটিসাংবিধানিক নাম নির্দেশকে ঘিরে এক ভয়াবহ সাংবিধানিক সংকট জম্মু-কাশ্মীরে তৈরিহয়েছিল। সেই সময়ে রাজ্যপাল শাসিত জম্মু-কাশ্মীরে রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি হিসেবেএই নির্দেশে সম্মতি দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় সরকার মনোনীত রাজ্যপাল জগমোহন।

সেই সম্মতিছিল সংবিধানের ৩৭০ ধারা অনুযায়ী সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক। এখন ভাবলে সত্যি আশ্চর্যলাগে এই যে, পরবর্তীকালে বিজেপি নেতা এবং অটলবিহারী বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার সদস্য জগমোহন রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বকালেকংগ্রেসের আস্থাভাজন রাজ্যপাল হিসেবে কর্মরত থেকে কি প্রকৃতপক্ষে আরএসএস-বিজেপির সুবিধাহয় তেমন নির্দেশিকা জারি করে সংবিধানের ৩৭০ ধারা অবলুপ্তির জন্য ভবিষ্যতে বিজেপিরপথ খুলে রেখে গেছিলেন? অপরিণত রাজনীতিকরাজীব গান্ধীর অপরিণামদর্শী রাজনীতির মাসুলই কি অবশেষে কাশ্মীরকে গুনতে হলো, যার জেরে গোটা ভারতবর্ষে সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায় একটা গভীর সংকটের মধ্যেপড়ল। আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতবর্ষের অবস্থান ঘিরেও  নানা ধরনের প্রশ্ন ওঠার সুযোগ তৈরি হলো। বিশেষকরে এই ৩৭০ ধারার অবলুপ্তিকে কেন্দ্র করে আরএসএস-বিজেপির সব থেকে কাঙ্ক্ষিতমেরুকরণের রাজনীতি আরো অনেক বেশি দেশের সর্বস্তরে বিস্তার লাভের সুযোগ করে নিল।