মন্ত্রীদের যত বাহুল্য কথা

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 9 August 2019, 01:28 PM
Updated : 9 August 2019, 01:28 PM

বছরসাতেক আগে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবংআওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, 'আমাদের পানিতে বিষ। বাতাসে বিষ। পলিটিশিয়ানদের মুখেও বিষ। দিন যতই যাচ্ছে, ততই আমাদের মুখের বিষ তীব্র হচ্ছে।' (সমকাল, ৪ এপ্রিল ২০১২)। এখানেই তিনিথেমে থাকেননি। প্রখ্যাত কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন, 'শরীরের শক্তি কমতে থাকলে মুখের বিষ বাড়ে।'

সম্প্রতিমন্ত্রী-এমপি-মেয়রসহ বিভিন্ন বিশিষ্ট্যজন যেভাবে 'মুখের বিষ' ছড়াচ্ছেন, তাতে প্রশ্নদেখা দিয়েছে, আমাদের সমাজও রাজনীতির মানুষগুলোর 'শরীরের শক্তি' সত্যিই কী কমছে? আর তাই 'মুখেরবিষ' বাড়ছে? নাকি তাদের মগজের শক্তি কমছে?

প্রাণঘাতী ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে যখন হাজার হাজার মানুষ ধুঁকছে তখন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য বললেন, দেশ উন্নত হচ্ছে বলেই বাংলাদেশে এই রোগ দেখা দিয়েছে। তার ভাষ্যমতে, ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস ইজিপ্টি 'এলিট শ্রেণির' মশা এবং তা বাংলাদেশ ছাড়াও সিঙ্গাপুর, ব্যাংককের মতো শহরে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ এখন উন্নত দেশ হতে যাচ্ছে। তাই এখন দেশে ডেঙ্গু এসেছে। মানুষের যত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে তত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

স্বপন ভট্টাচার্য্যর কথায় আবারও সমালোচনারসৃষ্টি হয়েছে। অনেকে বলছেন, কোনো ইতিবাচক কাজের দৃষ্টান্ত স্থাপনে ব্যর্থ মন্ত্রীরাকেন এমন সব বেহুদা মন্তব্য করছেন? কেন মানুষের ক্ষোভকে উস্কে দিচ্ছেন? আক্রান্ত মানুষসেবা চায়, সুশ্রূষা চায়, প্রতিকার ও সান্ত্বনা চায়। কিন্তু সে সবের ধারে কাছে না গিয়েযুক্তি ও কাণ্ডজ্ঞানহীন বিভিন্ন মন্তব্য করে মন্ত্রীরা নিজেরাই নিজেদের ভিলেনে পরিণতকরছেন। মানুষের মনকে বিষিয়ে দিচ্ছেন।

এ বছর বর্ষা মৌসুম শুরুর পর গত জুনের প্রথম দিকে ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। এরপর দুই মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৯০ জনের বেশি। ডেঙ্গু এত ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ার জন্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকে দায়ী করছেন অনেকে। অনেকে সরকারেরগাফিলতিকেও দায়ী করছেন। দুই মেয়র ওস্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিও উঠেছে। ডেঙ্গু-আক্রান্ত অসহায়, হতাশ, ক্ষুব্ধ মানুষের পাশেদাঁড়ানোর বদলে নানা ধরনের চটুল মন্তব্য করে নেতামন্ত্রীরা যেন আক্রান্ত মানুষেরসঙ্গে তামাশায় লিপ্ত হয়েছেন। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।

এর আগে ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশারবংশবিস্তার নিয়ে এক মন্তব্যের জন্য সমালোচিত হয়েছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদমালেক। তিনি বলেছিলেন, "সামহাউ উই কুড নট ম্যানেজ কন্ট্রোল দা মসকুইটো পপুলেশন।যেভাবে রোহিঙ্গা পপুলেশন বাড়ে.. আমাদের দেশে এসে। সেভাবে মসকিটু পপুলেশন বেড়েযাচ্ছে। .. প্রডাকশন যদি কম হত, এডিস মশা কম হত। মানুষ আক্রান্ত মশার কামড় কমখেত, ডেঙ্গু কম হত।"

সরকারের মন্ত্রী-এমপিরাই শুধু নয়,কাণ্ডজ্ঞনহীন মন্তব্য করার ক্ষেত্রে দেশের বিরোধী দলও পিছিয়ে নেই। বিএনপির জ্যেষ্ঠযুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, আওয়ামী লীগ ১৯৯৭ সালে মারণঘাতি ডেঙ্গুজ্বর আমদানি করেছে। তখন থেকে এই এডিস মশা ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাপকভাবে।

দায়িত্বশীলব্যক্তিদের এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা আমাদের পুরো দেশটাকেই যেন এক 'পাগলা-গারদে'পরিণত করেছে। অনেকে বলতেপারেন, কথায়কী হয়?এ কথারজবাবটা বোধহয়সহজ নয়।কথায় অনেককিছু হয়।হতে পারে।আবার নাওহতে পারে।মূল ব্যাপারহলো—কোনকথা, কেমনকথা, কেবলছেন, কাকেবলছেন! ভাবুকরাবলে থাকেন,'কথা শতধারায়বয়'।

আসলেবেশি কথা বললেওকিন্তু সমস্যাহয় না,যদি সেটাকাজের কথাহয়। আবারঅকাজের কথাবা বাজেকথা কমবললেও তাঅনেকের কাছেসহনীয় মনেহয় না।পৃথিবীতে এমনওমানুষ আছেযারা হয়তোএকদিন নাখেয়ে থাকতেপারবে কিন্তুকথা ছাড়াথাকতে পারবেবলে মনেহয় না!একদিক থেকেদেখলে আসলেকথাই মানুষকেবাঁচিয়ে রাখে।সুখের কথাযদি আমরাকাউকে নাবলি সেসুখের মূল্যকি? আবারযখন দুঃখআসে তখনকারো মুখেরদুটো কথাইবাঁচার আশাজাগায়। কথাইঅনেক সময়আনন্দ, আবারকথাই দুঃখ।কথার কারণেইভুল বোঝাবুঝিরসৃষ্টি হয়,আবার কথাদিয়েই তাভাঙানো হয়।কথাই মানুষকেবড় করে,কথাই আবারমানুষকে নিচেনামায়। কথাতেইসত্য প্রকাশপায় আবারমিথ্যাও কথারমাধ্যমেই আসে।সবটা আসলেনির্ভর করেআমাদের মর্জিরওপর। আমরাকোন কথামুখ দিয়েবলার জন্যেবেছে নেব।আর কোনকথাটা এড়িয়েচলব।

অনেকে কম কথা বলেন, কাজ বেশি করেন। কেউ কথা বেশি বলেন, কাজ কম করেন। অনেকে যতটুকু বলেন, ততটুকু করেন। কেউ আবার না করেও বলেন। আর কেউ না বলেও করেন। এই কথা ও কাজের ক্ষেত্রে কে ভালো কে মন্দ, তা সবাই জানেন। তারপরও একটা মান বা স্ট্যান্ডার্ড বোধহয় আমাদের চারপাশ থেকেই বোঝার আছে।

কমকথা বলেযে কাজকরে যায়,তার কাজইতাকে মানুষেরকাছে স্মরণীয়করে রাখে।কথার মানুষআর কাজেরমানুষ একনয়। অনেকেনিভৃতচারী, কেবলকাজই করেযান। আপাতদৃষ্টিতেতাদের কেউঅনেকটা অবহেলিতকিংবা তারসময়ে তেমনদাম পাননা। কিন্তুমৃত্যুর পরঠিকই তারকাজ তাকেঅবিস্মরণীয় করেরাখে। কাজকরলে তাবলা দরকার,তাতে হয়তোমানুষ বুঝতেপারে। কাজনা করেবলাটা নিশ্চয়ইসমীচীন নয়।অল্প করেবেশি বলাওউচিত নয়।

অন্যসব আদর্শের সঙ্গে পরিমিত ভাষণের জন্য বিখ্যাত হয়ে রয়েছেন মহাত্মাগান্ধী, যিনিছিলেন ভারতবর্ষেরএক মহানব্যক্তি। তিনিচাইলে নিজেরজীবনকেও ত্যাগকরতে পারতেন,কিন্তু কোনোঅবস্থাতেই সত্যকেত্যাগ করতেপারতেন না।রাজনীতির মধ্যেতিনি জীবনসত্যকেইখুঁজে ফিরেছিলেন,রাজনীতি ছিলতাঁর কাছেধর্মবোধেরই একটিরূপ। ধর্মেরস্পিরিটটাকেই রাজনীতিরকাজে লাগিয়েছিলেনমহাত্মা।

'আমারজীবনই আমারবাণী' বা'আমার জীবনএকটি খোলাবই'—এমনকথা মহাত্মাগান্ধী বলতেপারতেন, এযুগের মানুষকি সেইসবসত্য-জীবনাচরণঅংশতও পারেন?হয়ত কেউ-কেউপারেন, আমরাহয়ত তাদেরখবর জানিনা। বলাবাহুল্যযাঁর জীবনখোলা বই,তাঁর পক্ষেদুর্নীতি করামোটে সম্ভবনয়। সত্যেরএকটা সরলচেহারাও থাকে,যার অবিরলউদ্ভাস ছিলমহাত্মার চরিত্রে।কিন্তু আমাদেরচারদিকের চেনাচরিত্রগুলোর মধ্যেকি সারল্যবা সত্যবাদিতাআছে? যিনিযা বলেন,তা করারচেষ্টা করেন?আর যাপারেন না,তার জন্যঅকপটে ক্ষমাভিক্ষাকরেন? প্রতিশ্রুতিদেওয়া অনেকনেতার জন্যইখুব সহজ।কিন্তু সেইপ্রতিশ্রুতি পূরণেতিনি যদিব্যর্থ হন,তাহলে মানুষেরকাছে ক্ষমাচাওয়ার দৃষ্টান্তআমাদের সমাজেআছে কি?ক্ষমা চাওয়ারমধ্যে একজনব্যক্তির সারল্যও অকপাট্যপ্রকাশ পায়।এর ফলেতাঁর বিশ্বাসযোগ্যতাবাড়ে।

কিন্তুআমাদের নেতানেত্রীরাবেশিরভাগ ক্ষেত্রেইপ্রতিশ্রুতি ভঙ্গেরজন্য তাদেরমধ্যে কোনোখেদ বাঅনুশোচনা কখনওদেখা যায়না। কথাপরিণত হচ্ছে'কথার কথায়'।যা রাখানা-রাখারকোনো দায়নেই। কিনিজের কাছে,কী অন্যেরকাছে। 

কথাদিলে কথারাখতে হয়,এটা মূল্যবোধ,কথায় কাজহয়, এটাওমূল্যবোধ। দাগাখেয়েও মানুষকথাতেই ভরসারাখে। এরকারণ কী?কারণ কথায়বিশ্বাস নারাখলে গরিবতার আহত-মলিনজীবনটাকে সামনেরদিকে ঠেলেঠেলে নিয়েযেতে পারেনা। কথাবলতে হবে।কথা বলতেদিতে হবে।কথা যেনবিশ্বাসযোগ্য ওযৌক্তিক হয়,সেদিকটাও খেয়াললাখতে হবে।কথা যেনমানুষের মুখশ্রীহয়, মুখোশনয়। পরিশেষেকবির ভাষায়নিবেদন: 'সবাইশুধু কথাবলে/কাজকরে নাকেউ/মিটিংসিটিং চারিদিকে/কথারকেবল ঢেউ।/টকশোতেহয় নানানকথা/দেয়উপদেশ হাজার/কেমনকরে হাঁটতেহবে/করতেহবে বাজার/কথারমেলা, কথারখেলা/কথারকত রং/কথায়কথায় বাড়ছেশুধু/কথারুদেরঢং।/সবকিছুতাই 'কথারকথা'/হচ্ছেবুঝি আজ/কথাছেড়ে আসুনসবাই/করিনিজের কাজ—জাহিদরহমান, কথারকথা)।

পুনশ্চ: কয়েকদিন আগে আমার এক সাংবাদিকবন্ধু প্রস্তাব করেছিলেন: মনুষ্য বর্জ্যের মতো মানুষের মুখনিঃসৃত বাণীগুলো ঠেকানোর জন্য মুখের কনডম আবিষ্কার জরুরি।

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর 'এডিস মশার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের প্রজনন ক্ষমতা'র তুলনা, 'ডেঙ্গুর ভয়াবহতা ছেলেধরা গুজবের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে একসূত্রে গাঁথা' বলে মেয়র সাঈদ খোকনের মন্তব্যের পর তিনি ওই প্রস্তাব রেখেছিলেন। ডেঙ্গু নিয়ে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য ও বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বক্তব্য শোনার পর এখন মনে হচ্ছে: এডিস মশা দমনের সর্বাত্মক অভিযানের পাশাপাশি নেতানেত্রীদের বাহুল্য কথা ঠেকানোর 'কন্ডম' আবিস্কারও সমান জরুরি।