ভর দুপুরের চাঁদিফাটা রোদকে কুপিবাতির টিমটিমেআলো বলে চালিয়ে দেওয়ার তেলেসমাতি এই বঙ্গদেশের রাজনীতিতে— এক অর্থে— জায়েজই। সুতরাংদায়িত্বশীল বহু মানুষের মুখে সত্যের 'বিকল্প' সংস্করণ শুনে দেশবাসী অভ্যস্ত। কোনও কোনওক্ষেত্রে বিকারহীন বদনে সত্য অস্বীকার করতেও দেখা যায় কাউকে কাউকে।
তবু, তা সত্ত্বেও অন্তত মানবিক সংকটের মুহূর্তেমানুষ হর্তাকর্তাদের কাছে সহমর্মীর ব্যবহারই প্রত্যাশা করে। তাদের গাফিলতি-খামতিও কেউমনে রাখে না, যদি একটু পাশে দাঁড়ায়, দুটো ভালো কথা বলে।
কথায় চিড়ে ভেজে না সত্যি, কিন্তু কথা দিয়েইআবার অসাধ্যও সাধন করা যায়! ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রকোপের শিকার হাজার হাজার মানুষের মনেরক্ষত যেন আরও খুঁচিয়ে দগদগে করছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। একে তো ঝুঁকিপূর্ণ এই ব্যাধিতেপ্রাণহানির প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে লুকোচুরি করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, দেশব্যাপী অগণন মানুষেরভোগান্তির চিত্র চেপে যাওয়ার কোশেশ জারি ষোলো আনা ছাড়িয়ে আঠারো আনা। স্বাস্থ্যমন্ত্রীনিজেই সরকারি তথ্য-পরিসংখ্যান সটান অস্বীকার করছেন। কিন্তু প্রতিদিনই ডেঙ্গুতে আক্রান্তেরসংখ্যা বাড়ছে হু হু করে। যদিও তা প্রকৃত সংখ্যা নয়, অনুমিত হিসাব মাত্র। বাস্তবে পরিস্থিতিআরও ভয়াবহ। তবু স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দাবি, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে। অথচ ঢাকা দক্ষিণের (ডিএসসিসি)মেয়র বলছেন, আগামী সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলেতিনি আশা করছেন; তার আগে নয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ৭ অগাস্টের হিসেব অনুযায়ী, ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েহাসপাতালে ভর্তি হন ২ হাজার ৪২৮ জন। যা এক দিনে সর্বোচ্চআক্রান্তের রেকর্ড। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় এ সংখ্যা ছিল ২ হাজার৩৪৮।
ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। অথচ স্বাস্থ্যমন্ত্রী গত সোমবারও মানিকগঞ্জের এক অনুষ্ঠানে বললেন, 'পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো।'তার ভাষ্য, 'ডেঙ্গু না হলেও শুধু সন্দেহের বশেই এখন মানুষ টেস্ট করাচ্ছে। পরিসংখ্যানঅনুযায়ী আমরা বলতে পারি, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ধীরে ধীরে কমছে।'
প্রশ্ন হলো, পরিস্থিতির কতটা অবনতি হলে মানুষ সন্দেহের বশে গাঁটের টাকাকড়ি খরচা করেডেঙ্গু পরীক্ষা করাচ্ছে? আর কে অস্বীকার করবে, যেকোনও সেবা পাওয়ার ফাউ হিসেবে হ্যাপা-ঝঞ্ঝাটপোহানো আমাদের জাতীয় নিয়তি। ডেঙ্গু রোগীর চাপে জনারণ্যে পরিণত হওয়া হাসপাতালগুলোতেডেঙ্গু সনাক্তের পরীক্ষার জন্য কতটা পেরেশান হতে হচ্ছে ভুক্তভোগীদের, তানা হয় উহ্যই থাক।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী যতই বলুন 'প্যানিকড হবেননা', বিচলিত হওয়ার সব এন্তেজামই কিন্তু পাক্কা!প্রায় দুই দশক ধরে ডেঙ্গুর সঙ্গে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সিটি করপোরেশন এমন ওষুধআমদানি করেছে যে তাতে মশা মরে না, উল্টো মশার বাড়বৃদ্ধি মানুষের 'মৃত্যুঝুঁকি'কে আরওপোক্ত করেছে!
আক্রান্তের সংখ্যা, মৃত্যুর মিছিল, ওষুধেরঅকার্যকারিতা— সব ক্ষেত্রে রেকর্ড হবে, আর বলবেন 'প্যানিকড' হবেন না! মানুষ যদি 'হুদাই'আতঙ্কগ্রস্তও হয়, তাহলে তাদের ভরসা জোগানোর দায়িত্বও কিন্তুসরকারের।
ডেঙ্গুর এই 'প্রতিকারহীন' বাড়বাড়ন্তের মৌসুমেস্বাস্থ্যমন্ত্রী একের পর এক চমৎকারিত্ব স্থাপন করে চলেছেন। গত ২৬ জুলাই তিনি বললেন,'যেভাবে রোহিঙ্গা পপুলেশন বাড়ে আমাদের দেশে এসে, সেভাবে মসকিউটো পপুলেশন বেড়ে যাচ্ছে।'তার এই তুলনা, এককথায়, তুলনারহিত! কে কবে বলতে পেরেছেন জনগণের মুখ থেকে জবান ছিনিয়েনেওয়ার মতো এমন কথা?
এই 'অশ্রুতপূর্ব' বক্তব্য দিয়েই তিনি সপরিবার২৮ জুলাই গোপনে উড়ে যান মালয়েশিয়ায়। কেউ এই সফরের কারণ বলতে পারেন না, কবে ফিরবেন তাওকারো জানা নেই। ডেঙ্গুতে পর্যদুস্ত দেশবাসী দ্বিতীয় দফায় বাকরুদ্ধ।
তবে জনগণের প্রতি 'সদয়' হয়ে সফর কাটছাঁট করেস্বাস্থ্যমন্ত্রী দেশে ফিরেছেন। এতে অবশ্য ডেঙ্গুর ভয়াবহতার কোনও হেরফের ঘটেনি; ঘটারকথাও নয়। এ জন্য আগে থেকে যে পরিকল্পনা-প্রস্তুতির দরকার ছিল, তার ছিটেফোঁটা প্রতিফলনওদুই সিটি করপোরেশনের কাজকর্মে দেখা কি যায়? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও এ বিষয়ে কিছুমাত্রওয়াকিবহাল ছিল বলে বিশ্বাস করা কঠিন। 'মশক নিবারণী দপ্তর' নামের একটি সরকারি কার্যালয় থাকার কথা মানুষজানে কিনা, তাও কুইজের প্রশ্ন হতে পারে।
'ধমক' দিয়ে সাংবাদিককে সাময়িক চুপ করিয়ে দেওয়াযায় বটে, পরিসংখ্যান উপেক্ষা করে বিপদ তাড়ানোর উপায় নেই, বরং উল্টো বিপদ বাড়ার আশঙ্কাইপ্রবল করে।
মশা মারতে কামান দাগার কথা প্রচলিত আছে বটে,কিন্তু মুখে মুখে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের কথা এই প্রথম শোনা গেলো।
সন্তানহারা মা-বাবা জানেন, ডেঙ্গু কতটা ছিনিয়েনিয়েছে; স্ত্রীহারা স্বামী জানেন, ডেঙ্গু কী নিয়ে গেছে; স্বজনহারা মানুষ জানেন, ডেঙ্গুকতটা মার মেরেছে… এই মানুষগুলোর শোকের ভাগিদার না হন, অন্তত তাদের শোক করতে দিন!