উদ্ভাবনী মনোভাব ও সমন্বিত উদ্যোগ পারে মাতৃদুগ্ধ পান নিশ্চিত করতে

শেখ মজিবুল হকশেখ মজিবুল হক
Published : 6 August 2019, 03:08 PM
Updated : 6 August 2019, 03:08 PM

প্রতিবছরমাতৃদুগ্ধ পানে সচেতনতা বাড়াতে পালন করা হয় বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ। এ বছরও পয়লা অগাস্টথেকে ৭ অগাস্ট পর্যন্ত এ সপ্তাহ উদযাপিত হচ্ছে। এবারের স্লোগান হচ্ছে- শিশুকে মাতৃদুগ্ধ পান করাতে মাতা-পিতাকে উৎসাহিত করুন বা 'Enable ParentsEnable Breastfeeding'।

মূলত নিবিড়মাতৃদুগ্ধ পান নিশ্চিত করাই এর মূল উদ্দেশ্য।

মাতৃদুগ্ধপানের প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্যণীয় বিষয় হলোশিশুর জন্মের পরপরই শাল দুধ খাওয়ানো নিশ্চিত করা। বিশেষজ্ঞদের মতে শালদুধ শিশুরটিকা হিসেবে কাজ করে, এতে প্রচুর আমিষ ওভিটামিন আছে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং জন্মের পর প্রথম দুই তিনদিনশিশুর জন্য এটিই যথেষ্ঠ। এতগুলো গুণ থাকা সত্ত্বেও আমাদের মধ্যে অনেকেই মধু, মিছরি ও চিনির পানি দিয়ে নবজাতককে বরণ করি। যেটি সম্পূর্ণনিষিদ্ধ ও শিশুর জন্য ক্ষতিকর।

ইউনিসেফের গবেষণা তথ্য মতে, শিশুকে শালদুধ খাওয়ানোর হার শতকরা মাত্র ৫১ ভাগ, ভবিষ্যত প্রজন্মকে সুস্থ সবল দেখতে চাইলে যা শতভাগে উন্নীত করা প্রয়োজন। অন্যদিকে আমাদের দেশে সিজারের মাধ্যমে শিশু জন্ম দেওয়ার হার উদ্বেগজনকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে যার ফলে জন্মের পর পরই মায়ের প্রথম শালদুধ থেকে শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে। পাশাপাশি নিবিড় মাতৃদুগ্ধ পান নিশ্চিত করায় বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো শিশুর বয়স ১৮০ দিন বা ৬ মাস পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত শিশুকে শুধু বুকের দুধ পান করানো, এটিও বর্তমানে একটি চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে কর্মজীবী মায়েদের ক্ষেত্রে তা আরো প্রকট। নারী কর্মজীবীর সংখ্যা উত্তোরোতর বেড়ে চলেছে অথচ সে অনুযায়ী সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পাচ্ছেনা ফলে কর্মজীবীদের কর্মক্ষেত্র থেকে ঝরে পড়ার হারও ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সাল থেকে ২০১৪ সালে নিয়মিতভাবে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর হার শতকরা ৯০ শতাংশ থেকে কমে ৮৭ শতাংশে নেমে এসেছে। আমাদের দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য পোশাক কারখানায় বর্তমানে প্রায় শতকরা ৬৪ ভাগ নারী শ্রমিক কর্মরত আছেন (সিপিডি-র গবেষণা) যার সংখ্যা কয়েক বছর পূর্বে ছিল শতকরা ৮০ ভাগ।

পোশাককারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের বয়স ১৮ থেকে ৪৫ এর মধ্যে। এরা দেশের উৎপাদনশীলতাবৃদ্ধিতে অবদান রাখতে গিয়ে নিজেদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোকে বিসর্জন দিয়ে চলেছে। এতে শুধু কর্মীই নয় পাশাপাশিতাদের ভবিষ্যত প্রজন্মও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সন্তান জন্মের পরমাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে কাজে যোগ দিতে চাইলেও নারী শ্রমিকদেরপক্ষে তা সম্ভব হয়না। শ্রম আইন অনুযায়ী প্রত্যেক গর্ভবতী নারী শ্রমিক, সন্তান জন্ম দেওয়ার আগে ৮ সপ্তাহ এবং সন্তান জন্মদানের পরে ৮ সপ্তাহমোট ১৬ সপ্তাহ ছুটি ভোগ করতে পারেন [শ্রমআইন ২০০৬ ধারা ৪৬]। সন্তান জন্মদানের ৮সপ্তাহ বা দুই মাস পর কারখানার কাজে যোগ দেওয়া কতটা বাস্তবসম্মততা বিবেচনার বিষয়। আইন অনুযায়ী, কোনওকারখানায় ৪০ জন বা তার চেয়ে বেশি নারী শ্রমিক কাজ করলে তাদের৬ বছরের কম বয়সের শিশুদের রাখার জন্য কারখানার মালিক কারখানা অভ্যন্তরে ডে-কেয়ারবা শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের (ডে কেয়ার) ব্যবস্থা করবেন [শ্রমআইন ২০০৬ ধারা ৯৪]।ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ কারখানায়ই শিশু দিবাযত্ন কক্ষ আছে। কিন্তু এটি কতটা ২ মাস বয়সী শিশুদের রাখার উপযোগী, সচল ও শ্রমিক বান্ধব তা বিবেচ্য বিষয়।

আবার এটিওভাববার বিষয় যে, একটি পোশাক কারখানায় কতটা দিবাযত্নকেন্দ্র গড়ে তোলা ও মালিকের সম্পূর্ণ খরচে পরিচালনা করাসম্ভব। অধিকাংশ পোশাক কারখানায় শুধু একটি কক্ষে দিবাযত্নকেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে এবং তাতে করে ১০০০ এর নিচে শ্রমিক বিশিষ্ট কারখানায় সর্বোচ্চ ২০-৩০ জন শিশু এবং বড়কারখানাগুলোতে এর দ্বিগুন সংখ্যক শিশু রাখার ব্যবস্থা থাকতে পারে। ফলে আনুপাতিকহারে কম সংখ্যক 'মা' ই তাদের বাচ্চাদের শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে রাখার সুযোগ পায়। আইন অনুযায়ী ৬ বছরের কম বয়সেরশিশুদের রাখার জন্য শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র, ফলে এখানেও ২ মাসবয়সের শিশুর মায়েরা অনেকাংশে আইনের মারপেঁচে অবহেলিত। এছাড়া 'আগে আসলে আগে পাবেন' ভিত্তিতে মায়েদেরঅগ্রাধিকার দেওয়া হয়, ফলে অনেক মায়েরাইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দিবাযত্ন কেন্দ্রে বাচ্চাদের রাখার সুযোগ পান না। ফলে চাকরিরপ্রয়োজনে নারী শ্রমিকরা তাদের শিশুদের নিজ আবাসস্থলে নিকট আত্মীয়ের কাছে বা পরিচিতকারো কাছে রেখে আসে অথবা তার থেকে অনেক দূরে নিজগ্রামে দাদী-নানীর কাছে রেখে কাজে যোগ দেয়। ফলে নিবিড় মাতৃদুগ্ধপানথেকে শিশুরা অনেকাংশেই বঞ্চিত হচ্ছে।  

কেবল পোশাক শ্রমিকরাই নয় শহরের নিম্নআয়ভুক্ত এলাকায় বসবাসকারী ৬ মাসের কম বয়সী শিশুর মায়েরাযারা বিভিন্ন বাসাবাড়িতে ও কল-কারখানায় কাজ করেন তাদের ক্ষেত্রেও নিবিড়মাতৃদুগ্ধপান বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ উত্তরণে প্রয়োজন সবার সম্মিলিতপ্রয়াস। এই প্রয়াসের অংশীদার হতে হবেপ্রধানত সরকার, কারখানামালিক ওশ্রমিকদের। পাশাপাশি কমিউনিটিকেও এগিয়ে আসতে হবে কমিউনিটিভিত্তিক শিশু বিকাশকেন্দ্র সহ দিবাযত্ন কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য। পাশাপাশি শিশু বিকাশ ও দিবাযত্নকেন্দ্র পরিচালনার জন্য দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলায় সংশ্লিষ্টমহলকে এগিয়ে আসতে হবে। হাতে গোনা কয়েকটি এনজিও ও সরকার এ বিষয়ে উদ্যোগ নিলেও তাসীমিত যা পোশাক শ্রমিকদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না।শুধু আইন করে সকল সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, আইনের প্রয়োগের পাশাপাশি  সচেতনতা বৃদ্ধিও পর্যাপ্ত সুযোগ তৈরি করা এবং দক্ষ জনবলগড়ে তোলার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে বিনিয়োগ করারমানসিকতা ও উদ্ভাবনী চিন্তা চেতনা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে শ্রমজীবী মায়েদের সন্তানেরা প্রতিনিয়ত নানান অবহেলায় বেড়ে উঠায় ভবিষ্যত প্রজন্মমেধাহীন ও কর্মবিমুখ হয়ে পড়তে পারে। বিনিয়োগ ও সুযোগ সুবিধা বাড়লে নিবিড়মাতৃদুগ্ধপান নিশ্চিতের পাশাপাশি শিশু বিকাশ নিশ্চিত হবে।এভাবেই বুদ্ধিবৃত্তিক ও পুষ্টিসমৃদ্ধ ভবিষ্যত প্রজন্ম গড়ে তোলা সম্ভব।