এরশাদ এলেন, দেখলেন, কিন্তু…

Published : 6 August 2019, 10:01 AM
Updated : 6 August 2019, 10:01 AM

এরশাদ এলেন, দেখলেন, কিন্তু জয় করতে পারলেন না। প্রায় এক দশক ধরে দোর্দণ্ড প্রতাপে ক্ষমতায় থেকেও শেষ পর্যন্ত গদি ছাড়তে বাধ্য হলেন। তারপর জেলখানায় গিয়ে ঢুকলেন। অথচ একই পথ ধরে তার পূর্বসূরি জেনারেল জিয়া ক্ষমতা দখল করেছিলেন এবং মাত্র আড়াই তিন বছরের মধ্যে একটা রাজনৈতিক দল গঠন করে থিতু হয়ে বসেছিলেন। দলীয় কোন্দল মেটাতে গিয়ে সেনাবাহিনীর কিছু উচ্ছৃঙ্খল সদস্যের হাতে করুণভাবে নিহত না হলে টিকে যেতেন অনেক বছর। জিয়া তার নিজের সময়ে রাজনৈতিকভাবে অপ্রতিদ্বন্দ্বীই ছিলেন। সদ্য পুনরুত্থিত আওয়ামী লীগের পক্ষে তৎকালীন বাস্তবতায় সম্ভব হতো না তার পতন ঘটানো। কারণ তখন দেশ জুড়ে ছিল অ্যান্টি-আওয়ামী এবং অ্যান্টি-ইন্ডিয়া মনোভাবের প্রবল জোয়ার। মাত্র রাজনীতিতে আসা শেখ হাসিনার পক্ষে তখন সম্ভব হতো না জিয়ার প্রভাব বলয় থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করে নিয়ে নিজের পালে হাওয়া লাগানো। জিয়া বেঁচে থাকলে শেষ পর্যন্ত কী হতো, সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে এটা ধারণা করা যায়, তার বিদায়টা এরশাদের মতো লজ্জার বিদায় হতো না।

এরশাদের বিদায়টা কেন লজ্জার হলো? টানা নয় বছর ক্ষমতায় থেকেও কেন গণমানুষের নেতা হতে পারলেন না?  এর নানা রাজনৈতিক ব্যাখ্যা আছে। সবচেয়ে বড় ব্যাখ্যাটা হয়তো এটাই হতে পারে যে, এরশাদকে ক্ষমতায় থেকে গণমানুষের কাছে যেতে দুটি চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হয়েছিল। একটি আওয়ামী লীগ, আরেকটি বিএনপি থেকে। দুটি দলই ছিল জনপ্রিয়। এটা ছিল তার জন্যে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। ক্যান্টনমেন্টভিত্তিক চ্যালেঞ্জ জয় করে সামরিক ক্যু ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করার ব্যাপারে তিনি সাফল্য পেয়েছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সেরকম দক্ষতা দেখাতে পারেননি। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিপন্থীদের মনের ভেতর নিজেদের দল নিয়ে যে আবেগের দেয়াল গড়ে উঠেছিল, তা ভেদ করা এরশাদের পক্ষে  সম্ভব হয়নি। মুজিবপ্রেম এবং জিয়াপ্রেমের মতো এরশাদপ্রেম জাগানোর মতো ক্যারিশমা তার ছিল না। আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হিসেবে নিজেদের ইমেজ প্রতিষ্ঠিত করেছিল, বিএনপি অ্যান্টি-আওয়ামী ও অ্যান্টি-ইন্ডিয়াভিত্তিক একটি প্লাটফর্ম পেয়েছিল। কিন্তু এরশাদের দুর্ভাগ্য, মানুষকে তিনি তার ক্ষমতায় আসার এবং তাতে টিকে থাকার কোনো কার্যকারণ দেখাতে পারেননি। সে সময় একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ড. কামাল হোসেনকে হারিয়ে বিএনপির বিচারপতি সাত্তার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। মানুষ মেনেও নিয়েছে। তবে বুড়ো সাত্তার পরিস্থিতির সামাল দিতে পারছিলেন না। তবু মানুষ এতটা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেনি যে, সরকার পরিবর্তন চেয়েছিল।

কিন্তু ঠিক সে সময়ে এরশাদের সে হঠাৎ আগমন তথা সামরিক সরকার তারা আশা করেনি। অপ্রত্যাশিত এরশাদ তাই আওয়ামী-বিএনপি উভয় শিবিরের কাছেই ব্রাত্য ছিলেন। আর এই দুই বলয়ের মাঝে আরো যদি কোনো বলয় কিংবা ভাসমান কোনো বলয় থেকে থাকে, তাদের কাছে যাওয়ার মতো আদর্শ তিনি প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। ফলে তাকে রাজনীতির মাঠে মেরুদণ্ডহীন অচল ভবঘুরেদের নিয়েই নিজের রাজনৈতিক সংসার গড়ার চেষ্টা করতে হয়েছিল। কিন্তু তার সংসার ছিল শ্রীহীন দৈন্যদশার সংসার। জোড়াতালি দিয়ে গড়া সে সংসার দীর্ঘ নয় বছরেও সামান্য ভিত্তিভূমি পায়নি।

এটা এরশাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা। ব্যর্থতার অন্যান্য কারণও থাকতে পারে। সেগুলো হয়তো এর চেয়েও জোরালো। তবে সাধারণ চোখে এটাও একটা কারণ বটে।

তবে অজনপ্রিয় হওয়া আর ঘৃণিত হওয়া এক কথা নয়। অজনপ্রিয় মানুষ সবার কাছে পৌঁছাতে পারে না। আর যে লোক ঘৃণ্য, সে সবার কাছে পৌঁছেও সে ঘৃণাটাই পেয়ে থাকে।

কেউ কেউ বলে থাকেন, এরশাদের সময় ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছিল। রাস্তাঘাট ব্রিজ কালভার্ট তৈরি হয়েছিল বেশুমার। এটা নিশ্চয় মিথ্যে নয়। প্রতিটি দেশেই নিত্যনতুন উন্নতি হয়। সরকারগুলো বসে থাকে না, কিছু না কিছু করেই থাকে। এরশাদও করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার ১০ বছর পরে এরশাদ ক্ষমতায় এসেছিলেন। বিধ্বস্ত দেশটাকে সব সরকারই ধীরে ধীরে নিজেদের মতো করে গড়ে নেয়ার চেষ্টা করছিল্। এরশাদও তাই করেছেন। এটা কোনো  বড় ব্যাপার নয়।

নয়-দশ বছর ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও এরশাদ কেন লোকপ্রিয় হতে পারলেন না, সেটার নানা জবাব হয়তো দেয়া যায়। তবে রাজনীতি বাদ দিয়ে এরশাদের ব্যক্তিচরিত্র মানুষের শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারেনি।

এর কারণও সহজবোধ্য। এরশাদের আগের নেতাদের চরিত্রদোষ ছিল না। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর ধীরে প্রকাশ পেতে থাকে তার নারীসঙ্গপ্রিয়তার কথা। বাংলাদেশের মতো রক্ষণশীল সমাজের দেশের মানুষ একে সহজভাবে নিতে পারেনি। নেতাকে তারা নেতা হিসেবে দেখতেই আগ্রহী। লীলাখেলা বিলাসী নেতা তাদের ধারণার বাইরে। এরশাদ সম্ভবত প্রথম বাছাইতেই তাদের আগ্রহের বিষয় থেকে খারিজ হয়ে গিয়েছিলেন। অবশ্য এটা ঠিক, এরশাদ যদি অন্য বিষয়গুলোতে দৃঢ় চরিত্রের হতে পারতেন, তাহলে ঘৃণাটা এত প্রকট হয়ে উঠত না। মুজিব-জিয়ার প্রতি সব মানুষের অনুরাগ নেই। কিছু কিছু মানুষ এদের মতো নেতাকেও অপছন্দ করেন। কিন্তু ঘৃণা করেন, এটা বলা যাবে না।

এরশাদ অসত্য বলতেন, ভড়ং দেখাতেন, অভিনয় করতেন। ধর্মপালন থেকে কাব্যচর্চা পর্যন্ত এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে তার অনুপ্রবেশ ঘটেনি। ক্ষমতা দখল করেই তিনি বললেন, শিগগিরই জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে তিনি তার জায়গায় ফিরে যাবেন। অথচ তার প্রতিশ্রুতি তিনি রক্ষা করেননি।

রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেই এরশাদ জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে বলেন, ক্ষমতাসীনদের অযোগ্যতা, স্বজনপ্রীতি, সীমাহীন দুর্নীতি, আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতির কারণে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আমাকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিতে হয়েছে। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে বলেন, প্রশাসন থেকে ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, কর্তব্যে অবহেলা, সম্পদের অপচয় ইত্যাদি সব ধরনের অপরাধ দূর করতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা কোনদিন কোন রাজনৈতিক অভিলাষ ছিল না। আমি রাজনীতিবিদ নই, আমি একজন সৈনিক এবং সৈনিকের গর্ব নিয়েই জনগণের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে চাই।

কিন্তু এরশাদ তাঁর কথা রাখেননি। তিনি অবিলম্বে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেননি। বরং তার শাসনের নয় বছরের মধ্যে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার জন্যে তিনি তার পক্ষে সম্ভব সবকিছুই করেছেন।

এরশাদ নামাজ পড়া নিয়ে পর্যন্ত মশকরা করেছেন। নামাজ মুসলমানের জন্যে অবশ্য করণীয় একটা আচার। ছোটবড়, ধনি-দরিদ্র সবাইকে নামাজ পড়তে হয়। তবে ধর্মে নির্দেশ আছে লোক দেখানো নামাজ না পড়ানোর জন্যে। কিন্তু এরশাদ নামাজ পড়াকে লোক দেখানোর পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। এক এক জুম্মায় এক এক মসজিদে নামাজ পড়ার স্বপ্ন দেখার কথা বলতেন তিনি। মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে তিনি মুসল্লিদের সে স্বপ্নের গল্প বলতেন। বলতেন, রাতে তিনি স্বপ্ন দেখেছেন এই মসজিদে নামাজ পড়ছেন। তাই আজ জুমার নামাজটা এই মসজিদে পড়তে এসেছেন।

তিনি নামাজ পড়তেন আর সে নামাজের দৃশ্য ভিডিও করে টেলিভিশনে অনেকক্ষণ ধরে দেখানো হতো। মানুষকে চরম বিরক্তি নিয়ে দেখতে হতো তার ঠোঁট নাড়িয়ে দোয়া পড়া, ডানে বাঁয়ে সালাম ফেরানো এবং মোনাজাত করার দৃশ্য। ধর্ম নিয়ে এমন ভড়ং সাধারণ মানুষ ভালভাবে নেয়নি। এরশাদ বুঝতে চাননি, ধর্ম জিনিসটা নিবিড়তম আনুগত্য আর আন্তরিকতায় পালনের জিনিস, দেখিয়ে বেড়ানোর বিষয় নয়। মনে আছে, সেসময়টায় একজন একদিন ঠাট্টা করে বলেছিলেন, এরশাদকে কেয়ামতের দিন মুখে হিসেব দিতে হবে না। ওনার মসজিদে মসজিদে নামাজ পড়ার পড়ার ভিডিওগুলো চালিয়ে দিলেই হবে। আসলে এসব করতে গিয়ে এরশাদ নিজেকে জনগণের কাছে হাস্যাস্পদ করে তুলেছিলেন।

তিনি নিজের স্ত্রী রওশন এরশাদকে ক্ষমতার কাছাকাছি নিয়ে এসেছিলেন। তাকে বানিয়েছিলেন ফার্স্টলেডি। বাংলাদেশ, ভারত-পাকিস্তান, এমন কী এশিয়া মহাদেশের কোনো রাষ্ট্রেই এমন আজব পদবী কখনো ছিল না। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ধরনে এটা চালু করেছিলেন। জনগণকে টেলিভিশনে ফার্স্টলেডির সচিত্র খবরও দেখতে হতো। এরশাদ কবি ছিলেন না, কিন্তু নিজেকে কবি বানাবার নির্লজ্জ প্রচেষ্টা ছিল তার। দেশের প্রথম সারির পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতাতেই তার কবিতা ছাপা হতো বক্সাকারে। তিনি দেশের প্রধান কবিদেরও প্রধান হতে চেয়েছিলেন। একজন কবি নিরলস চেষ্টা আর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে কবি হয়ে ওঠেন। আর এরশাদ ক্ষমতায় থেকে নিজেকে প্রধান কবিদের চেয়ে ওপরে তুলে নিতে চেয়েছিলেন। এখানেই শেষ নয়, নিজের কবিখ্যাতিকে বিদেশেও প্রচার করার জন্যে তিনি রাষ্ট্রীয় খরচে এশীয় কবিতা উৎসব পর্যন্ত করেছিলেন। কবিতা ও সংস্কৃতিপ্রিয় মানুষ একে ঘৃণার সঙ্গে বর্জন করেছিলেন।

আসলে এরশাদ যা নন, তাই হতে চেয়েছিলেন। ফলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন রঙ্গ-রসিকতার গল্পের অন্যতম চরিত্র। তার এই চরিত্র চিত্রকর্মে ফুটিয়ে তুলেছিলেন পটুয়া কামরুল হাসান। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের কালে কবিতা পরিষদের প্রতিবাদী মঞ্চে বসে এঁকেছিলেন তার কার্টুন ছবি, যার ক্যাপশন ছিল : 'দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে'। এটা ছিলো এরশাদের চরিত্রের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিশ্লেষণ।

প্রেম-বিয়ে, সন্তানলাভ, রাষ্ট্রীয় অর্থ ও ক্ষমতার অনৈতিক ব্যবহারের বহু গল্প ছিলো তাকে নিয়ে। তিনি বিভিন্ন পীরের মাজারে যেতেন। পীরত্বকে উৎসাহিত করতেন নানাভাবে। পীরপ্রথা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পর্যন্ত অনানুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়ে গিয়েছিল প্রায়। সংশ্লিষ্ট কিছু মানুষ ছাড়া এরশাদের এসব কাজকর্মকে স্রেফ করুণার চোখে দেখেছেন আপামর মানুষ। বিশেষ করে শিক্ষিত নাগরিক সমাজে এরশাদ সামান্যতম আবেদনও জাগাতে পারেননি।

তবে বাংলাদেশের প্রশাসনিক ইতিহাসে এরশাদের একটা কাজ সবাই কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ রাখবে। সেটা হলো বাংলাদেশের রাজধানী Dacca কে তিনি Dhaka বানিয়েছিলেন।