বাংলা ও বাঙালি (দুই)

হাসান মাহমুদহাসান মাহমুদ
Published : 6 August 2019, 09:33 AM
Updated : 6 August 2019, 09:33 AM

(বিস্মৃতিপ্রবণ জাতিকে শেকড়ের ইঙ্গিত)

এ নহে তোমার !!

আজ থেকে প্রায় দু'হাজার তিনশো ছে'চল্লিশ বছর আগের কথা।

বাংলা থেকে হাজার মাইল দূরে "পঞ্চ আব" (আব মানে পানি) অর্থাৎ পঞ্চনদীর দেশ পাঞ্জাবের ঝিলাম নদীর ধারে এসে দাঁড়িয়েছেন সুদূর গ্রীসের বিশ্বজয়ী সম্রাট। কোথায় কত দূরে সেই গ্রীস! সেখান থেকে শুরু করে কত রাজ্য কত দেশ, ইরান, আফগানিস্থান পার হয়ে পাঞ্জাব। অমিত শক্তিশালী তাঁর বাহিনী পর্য্যুদস্ত করেছে ছোটবড় বহু রাজ্যের সেনাবাহিনীকে, কিংবদন্তীর নায়ক বিশাল পারস্য সাম্রাজ্যের দুর্ধর্ষ সম্রাট দারায়ূস পর্যন্ত দাঁড়াতে পারেনি তাঁর সামনে। সম্রাটের চোখে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন। স্বপ্নটা তাঁকে মানায়। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বাহিনীর অধিকারী তিনি, সর্বশ্রেষ্ঠ যুদ্ধ বিশারদ তাঁর সেনাপতি। বারবার প্রমাণ হয়েছে সেটা।

ঝিলমিল করছে ঝিলামের ঢেউ। ওই দেখা যায় ঝিলামের ওপারে ভারতের মূল ভূখণ্ড। আর মাত্র কটা দিন। তারপরেই গোটা ভারতবর্ষ তাঁর হয়ে যাবে। সেই সাথে পূর্ব-ভারতে গঙ্গার সেই জগদ্বিখ্যাত বদ্বীপ, সেই চির সবুজ সুজলা সুফলা দেশটি। দেবার জন্য তৈরি হয়েই আছে যে মাটি। আম খেয়ে আঁটিটা ছুড়ে ফেললে পরদিন দেখা যাবে নধর দু'টি ছোট্ট সবুজ পাতা। আশ্চর্য, এমন মাটিও আছে দুনিয়ায়!

খবর এল, নদীর ওপারে বিপক্ষ দলের সেনাবাহিনী এসে হাজির হয়েছে। তাতো হবেই! নিজের রাজ্য কি সহজে ছাড়তে চায় কেউ? মনে মনে তৈরি হয়ে গেলেন সম্রাট, তৈরি হয়ে গেল ঝিলামও। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম দুটো শক্তি তার এধারে ওধারে। যুদ্ধ শুরু হলে পানির চেয়ে বেশি রক্ত বয়ে যাবে ঝিলাম দিয়ে। কিন্তু সেনাপতির মুখ গম্ভীর কেন? গম্ভীর এজন্য যে বিপক্ষ দলের শক্তির খবর এসেছে। এবং সে শক্তিটা কল্পনা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

"ক'হাজার ওরা ?" প্রশ্ন করলেন সম্রাট।

"দু'শো, সম্রাট।"

"মাত্র দু'শো ?"

"দু'শোটা এক হাজার, সম্রাট। অর্থাৎ দু'লক্ষ।"

কপালে ভাঁজ পড়ল সম্রাটের।

"আরো আছে, সম্রাট। দু'দশ নয়, কুড়ি হাজার অশ্বের একটা সুসজ্জিত বাহিনী আছে।"

ভাঁজ পড়া কপাল নিয়ে ভুরু কুঁচকে গেল সম্রাটের। কু-ড়ি হা-জা-র ঘোড়ার অশ্ববাহিনী!

"আরো আছে, সম্রাট। কমপক্ষে তিন হাজার হাতির আলাদা একটা স্বয়ংসম্পুর্ণ গজ-বাহিনী আছে।"

হোয়াট??

চমকে উঠে তখত থেকে দাঁড়িয়ে পড়লেন সম্রাট। ততক্ষণে তাঁর ভাঁজপড়া কপাল ও কুঞ্চিত চোখের সাথে চোয়াল ঝুলে পড়ে মুখ হা হয়ে গেছে। অবিশ্বাস্য, অবিশ্বাস্য! দু'চারশো নয় তিন তিন হাজার হাতির যুদ্ধবাহিনী! দু লক্ষ পদাতিক, কুড়ি হাজার ঘোড়ার অশ্ববাহিনী, তিন হাজার হাতীর গজবাহিনী, এগুলোর দৈনিক ম্যানেজমেন্ট-এর জটিলতাই তো কল্পনার বাইরে! এরকম একটা শক্তি নিয়ে লোকটা ভারতবর্ষে বসে করছেটা কি? সমস্ত পৃথিবী তো ওরই জয় করার কথা! সম্রাটের মনে হলো পুরো হিমালয় পর্বতটা উঠে এসে তাঁর সামনে পথরোধ করে দাঁড়িয়ে গেছে। সারা জীবনে অসংখ্য যুদ্ধের অপরাজিত যোদ্ধা তিনি, অজেয় তাঁর গর্বিত সেনাবাহিনী পরাজয় কাকে বলে আজও জানে না। কিন্তু হিমালয়ের সাথে কি যুদ্ধ করা যায় ? ব্যাকুল হয়ে তাকালেন তিনি যুদ্ধ বিশারদ সেনাপতির দিকে।

'পরিষ্কার আত্মহত্যা করা হবে সম্রাট। যে কোনো হিসেবেই"। জানালেন অভিজ্ঞ যুদ্ধ বিশারদ, রণনিপুণ সেনাপতি।

গল্প মনে হচ্ছে? রূপকথা? বুঝি রূপকথা সৃষ্টি করার ক্ষমতাই ছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের। দিগ্বিজয়ী সাইক্লোন ঠেকিয়ে দেবার ক্ষমতা ছিল। রূপকথা নয়, বাস্তব। বিদেশি ঐতিহাসিকদের সপ্রশংস লেখনীর ইতিহাস। সেই লেখনীর দিকে তাকানো যাক একবার।

"ধননন্দ গঙ্গারিডি জাতির রাজা ছিলেন। আলেকজান্ডারের বিপক্ষে তাঁর বাহিনীতে প্রায় দু'লক্ষ পদাতিক, বিশ হাজার অশ্বারোহী এবং তিন থেকে চার হাজার যুদ্ধহস্তী ছিল"।

"ভারতবর্ষের সমুদয় জাতির মধ্যে গঙ্গারিডিই সর্বশ্রেষ্ঠ। এই গঙ্গারিডির রাজার বিশাল হস্তীবাহিনীর কথা জানিতে পারিয়া আলেকজান্ডার তাহার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হইলেন না"।

ফিরে গেলেন সম্রাট, কিন্তু তাতে আমাদের কি? কোথাকার এক "গঙ্গারিডি জাতির রাজা" ঝিলাম পর্যন্ত বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি হলেনই বা ! "অপরিসীম শক্তির অধিকারী" হলেনই বা, তাতে আমাদের বাঙালিদের কি আসে যায় ?

আবার তাকানো যাক বিশ্ববরেণ্য ঐতিহাসিকদের দিকে।

"গঙ্গা নদীর মোহনায় সমুদয় এলাকা জুড়িয়া গঙ্গারিডিদের রাজ্য"।

"গঙ্গারিডি সাম্রাজ্যের ভিতর দিয়া গঙ্গা নদীর শেষ অংশ প্রবাহিত হইয়াছে"।

মিলে গেল না হিসেবটা?

(পাঞ্জাবের নদীটা বিয়াস না ঝিলাম এ নিয়ে মতভেদ আছে)

(চলবে)….