পদ্মা সেতু: চারিদিকে বাঁকা জল করিছে খেলা

Published : 23 Feb 2014, 10:46 AM
Updated : 20 July 2012, 12:51 PM

প্রস্তাবিত পদ্মা সেতুর নিচে যে জল বইছে সেটা কোন কারণে যাতে ঘোলা না হয়ে যায় তার দিকে খেয়াল রাখা দরকার। বিশ্ব ব্যাংক টাকা দিতে অস্বীকার করার পর এটা উন্নয়ন ছেড়ে রাজনৈতিক পরিসরে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশ নিজেই ব্রীজ বানাবে। সংগতভাবেই সরকার চারদিকে একটি জনসমর্থনের জোয়ার তৈরি করার চেষ্টা করছেন এবং অনেক মানুষই তাতে আগ্রহী অংশীদার হতে চান। তবে এটা জটিলতা মুক্ত নয় এবং প্রথম পর্যায়ের লক্ষণ দেখে অনেকেই চিন্তিত। টাকা সংগ্রহ আর চাঁদা সংগ্রহ উভয়ই নতুন প্রজন্মের মধ্যে সংকট যাতে তৈরি না করে সেই দিকে যথেষ্ট নজর রাখতে হবে শুরু থেকেই। আর এই উৎসাহের আয়ু দীর্ঘ নাও হতে পারে সেটাও মনে রাখা দরকার। বিশ্ব ব্যাংকের অভিযোগ যে তারা গোটা পদ্মা সেতু ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি করার একটি প্রস্তুতি ও প্রক্রিয়া খুঁজে পায়। তারা কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তোলে এবং তার প্রতিকার চায়। তাদের মতে বাংলাদেশ সরকার সেই ব্যাপারে কোন ভূমিকা রাখেনি এবং তাতে করে তাদের মনে হয়েছে যে সরকার পদ্মা সেতু সংক্রান্ত দুর্নীতি রোধ করার ব্যাপারে সিরিয়াস নয়। বিশ্ব ব্যাংক বলেনি যে দুর্নীতি হয়েছে। তারা বলেছে যে দুর্নীতি হতে পারে–এরকম যথেষ্ট লক্ষণ রয়েছে।

বাংলাদেশ সরকারের অভিমত হচ্ছে যে কোন টাকা যেখানে আদান প্রদানই হয়নি সেখানে দুর্নীতির প্রশ্ন ওঠে না।

কিন্তু বিশ্ব ব্যাংক দুর্নীতি হয়েছে এটা বলেনি। বলেছে যে হতে পারে তার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ রয়েছে। তাদের দাবি ছিল মন্ত্রীসহ ছয়জনকে সরাতে হবে যতদিন পর্যন্ত অনুসন্ধান চলবে এবং অনুসন্ধানের ওপর পরামর্শক ও পরিদর্শক হতে হবে আন্তর্জাতিক কোন ব্যক্তি।

বাংলাদেশ সরকার মন্ত্রীকে ও প্রকল্প প্রধানকে অন্যত্র বদলি করেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক কারও অধীনে তারা দুর্নীতি দমন কমিশন দ্বারা এই সব অনুসন্ধান করাবে না।

এই মতপার্থক্যের ভিত্তিতে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ হয়ে যায়। একটি উন্নয়ন প্রকল্প এখন একটি রাজনৈতিক সংকটে পরিনত হয়েছে। হয়ত সুযোগ বটে। সেতু হবে কি হবে না এটা আর এখন বিষয় নয়।

এখন প্রশ্ন হল কী ভাবে এই সেতু আমরা বানাতে পারবো দরকার হলে নিজের টাকায়। সবাই এটা মেনে নেয় যে বাংলাদেশে দুর্নীতি রয়েছে। এটা কোন নতুন বিষয় নয় এবং যারা অন্যটা ভাবেন তাদেরকে বলায় কিছু নেই। কিন্তু বিশ্ব ব্যাংক ক্ষেপলো কেন সেটাই বিবেচনার বিষয়। আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতা বা আমলারা–সেটা যে সরকারেই হোক–তারা ঘুষ খায়। পয়সা বানায়। এটা তাদের অধিকার বলেই তারা করে এবং আমরাও এটা মেনে নিয়েছি। যদি সেটাই না হতো তাহলে আমাদের দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরা অবশ্যই কিছু করতাম। আমরা করি না কারণ আমরা মেনে নিয়েছি বা গ্রহণ করেছি; বাস্তবতা হিসেবে দুর্নীতি আমাদের জাতীয় জীবনের অংশ। না হলে দুদক আসলেই সবল হতো, দুর্নীতিবাজ মানুষ লজ্জা পেত সমাজে এবং দুর্নীতি দমন রাজনৈতিক বিষয় হতো। যে ব্যবস্থা ৪০ বছর ধরে আমাদের জীবনে এত গভীরে স্থান করে নিয়েছে তাতে আমরা লজ্জা পাই না। সেই কারণেই বোঝা যায়না কেন সরকার এটা নিয়ে এত ধানাই-পানাই করলেন। বরং সরকার পদ্মা ব্রীজের জন্য একটা আলাদা দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করলেই ল্যাঠা চুকে যায়। এতে করে মহাজনের কথাও থাকে, আর জাতীয় দুর্নীতির ওপর কোন নেতিবাচক প্রভাব না পড়া নিশ্চিত করা যেত। আম ও ছালা উভয়ই থাকতো।

কথা হচ্ছে এই প্রকল্প থেকে যে "দুর্নীতির" হিস্যা সেটা থেকে দুর্নীতবাজদের বঞ্চিত করা ঠিক যায় কিনা। তাছাড়া দুর্নীতিবাজ মানেই দেশ প্রেমিক নয়, এটা ঠিক নয়। পদ্মা সেতুর জন্য এটা তারা করবে।

কিন্তু এটা ঠিক যে বিশ্ব ব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত ঠিক বোঝা যায় না। কেউ কেউ বিশেষ করে ধর্মপ্রাণ মুসলমান মানুষ বলছেন এটি একটি ইহুদী ষড়যন্ত্র। যাবার বেলায় প্রাক্তন ব্যাংক প্রধান জোলিক এই স্বাক্ষরটা করেন এবং তিনি একজন জু মানে ইহুদী। অতএব এটা একটি মুসলমানবিরোধী সিদ্ধান্ত।

আমি এটার সাথে একমত হতে পারছি না কারণ আমাদের অর্থাৎ বাঙালী মুসলমানকে ইহুদিরা মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের মত প্রায় হিন্দু জাতিগোষ্টী হিসেবেই দেখে। নিজেদের ছাড়া অন্য সব মুসলমানের চোখে আমরা ইসলাম পরীক্ষায় ভালো জিপিএ পাবো না।

কিন্তু রাগ বা ক্ষুব্ধতার ভূমিকার বিষয়টি এখন ক্রমশই বড় হয়ে উঠছে এবং চারদিকে প্রধানমন্ত্রীসহ সবাই আঙুল তুলেছে যার দিকে তার নাম অধ্যাপক ইউনূস এবং অনেকেই বলছেন যে তিনিই পদ্মা ব্রিজ আটকে দিয়েছেন। তার ইর্ষার কারণ হচ্ছে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ ওঠানো হয় এবং তাকে অপদস্থ করা হয়। তার প্রতিশোধ হিসেবে এই কাজ।

এটা জানা যে ক্লিন্টনদের দেশে মাইক্রো ক্রেডিট নিয়ে তাদের সন্তুষ্টি আছে এবং ক্লিন্টন দম্পতি এর বড় সমর্থক। বলা হচ্ছে তাদের মাধ্যমে টাকাটা আসবে এবং সেই কারণেই এই সিদ্ধান্ত।

মাপ করবেন, আপনারা বলছেন যে আপনারা জানতেন না যে ইউনূসের বন্ধু হিলারী এবং তিনি আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রি এবং বিশ্ব ব্যাংক আমেরিকানদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং তারা চাইলে যে কোন চাপ দিতে পারে ঋণ দেওয়া নিয়ে। এটা জানতেন না যে, শত্রুর পিছনে লাগতে গেলে তার শক্তি সম্পর্কে খবর নিতে হয়। যদি অনুসন্ধান করে চুরির প্রমাণ নিতেন তাহলে কথা ছিল, কিন্তু ইউনূসকে আক্রমণ করে হিলারীর রাগ সংগ্রহ করাটা খুব কি বুদ্ধিমানের কাজ হল? এতে কী প্রমাণ পেলেন? যদি ইউনূস এত সবল হয় তাহলে তার সাথে বন্ধুত্ব করে হিলারীর কাছে পূণর্বিবেচনার জন্য দূত হিসেবে পাঠান। আর যদি এতই ক্ষমতা থাকে তবে তাকে ব্যবহার করুন। দেশের স্বার্থে একবার তো তাকে ব্যাংকের প্রধান হিসেবে নিয়োগ করার প্রস্তাব করাই হয়েছে। এবার দালালী করতে বললে কী অসুবিধা?

অবশ্য এই বিষয়টাই যদি ঠিক হয়ে যায় তবে ব্যক্তিগত রাগ ও ইর্ষার চেয়ে দেশ বড়– এটা ইউনূসসহ সবার মনে রাখলে ভাল হয়।

শেষে আসে নিজের টাকায় পদ্মা সেতু করা যেটার প্রতি এই সময় যথেষ্ট জনসমর্থন তৈরি হয়েছে। এটা যদি করা সম্ভব হয় তাহলে খুব ভালো হয় এবং বিশ্ব ব্যাংক নিজেও এই ব্যাপারে সমর্থন দিয়েছে। হিসেব মতে জিডিপির প্রায় ৩% টাকায় এটা হয়ে যেতে পারে। এই সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে অনেক ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী। এটা খুবই ভালো কথা। নিজের টাকায় করাটাই ভাল। সমস্যা তৈরি হচ্ছে চাঁদাবাজী নিয়ে। এর মধ্যে একজনের প্রাণও গেছে তবে যখন এতবড় প্রকল্প হয় তাতে কয়েকটা প্রাণ তো যাবেই। এমনিতে প্রতিদিন কত লোক মরে।

তবে আমাদের একটা অসুবিধা আছে। আমরা কোন কিছুর প্রতি বেশী দিন আগ্রহ উত্তেজনা ধরে রাখতে পারি না। আজকে আমাদের যে উচ্ছ্বাস আছে সেটা দু'তিনবার চাঁদা চাওয়ার অভিজ্ঞতার পর কেমন থাকবে বলা যায় না। একাগ্রতা আমাদের জাতীয় চরিত্রে নেই। অভিজ্ঞতা বলে জাতীয় দুর্যোগের সময় আমরা যখন চাঁদা তুলি তখনও মানুষ বিরক্ত হয়। আর এটা অনেক বড় আয়োজন। কী হবে শেষ পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে না। তবে মাঠ পর্যায়ে সরাসরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্রাতিষ্ঠানিক মাধ্যমে টাকা যদি তুলতেই হয় তোলা উচিত।

তাছাড়া কালো টাকার বিশেষ বন্ড ছাড়া যেতে পারে যাতে করে নিশ্চিত মুনাফার জন্য কালো টাকার মালিকরা পদ্মা সেতুতে টাকা দেয়। চাঁদা তারা দিলে সেতু তাদের নামেও হতে পারে।

শেষ কথা হচ্ছে যদিও এখন এটা রাজনৈতিক বিষয় হয়ে গেছে এবং আওয়ামী লীগকে কিছু একটা করতেই হবে নির্বাচন পর্যন্ত। যেহেতু এটা তার নির্বাচনী ওয়াদা। যদি নাও হয় তবুও কত আর খারাপ হবে। বিদ্যুতের এত খারাপীর পরও আমরা আছি না?

আমরা হেরে যেতে পারি, আমরা মরবো না।

আফসান চৌধুরী : নির্বাহী সম্পাদক, বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম।