প্রসঙ্গ: বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
Published : 5 August 2019, 07:17 AM
Updated : 5 August 2019, 07:17 AM

বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত নিয়ে আমার বিস্ময় আজন্ম লালিত। কেন আমাদের জাতীয় সংগীত এমন প্রেমময় সুর ও ভাষায় রচিত! কেন অন্যান্য দেশের জাতীয় সংগীতের মত জাত্যাভিমানের কথা নয়, শাসকের মহত্ব বন্দনা নয়! কেন রাজা ও রাজন্যবর্গের শৌর্যবীর্যের কথা নয়, যুদ্ধ জয়ের কথা নয়! কেন শাসকের শক্তি, রণ কৌশল, সাম্রাজ্য বিস্তার বা রাজা-রাজধিরাজ ক্ষমতা ও শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে নিখুঁত বাণী নয়, আধিপত্যের জয়গান নয়! কেন সহজ সরল গভীর দার্শনিক বোধে ঋদ্ধ এ সংগীত প্রেম ও ভালবাসা রসে ভরপুর!

এ প্রেম প্রকৃতির প্রেম। ভিন্ন অর্থে মাতৃ প্রেম। দেশ মাতৃস্বরূপা তাই মাতৃবন্দনা গানটির প্রাণ। প্রকৃতির খেয়ালে জন্ম নেয়া মানুষ প্রকৃতি থেকে তার বেঁচে থাকার রসদ জোগাড় করে। হোক সে শারীরিক ক্ষুধার অথবা মানসিক ক্ষুধার খাদ্য। তাই প্রকৃতি মাতৃস্বরূপ।

যে বাতাস তাকে বাঁচিয়ে রাখে, যে আকাশ তাকে স্বপ্নচারী করে, সে আকাশ-বাতাস মানবের হৃদয়ে প্রাণে প্রেম ভালবাসা সুরেলা বাঁশি বাজায়।

ছয় ঋতুর বাংলাদেশে অঘ্রাণের সোনালী ধানের অপূর্ব শোভা যে চিত্রময়তা বাঙালির মানসপটে এঁকে দেয়, মধুমাসে যে সুমিষ্ট ঘ্রাণে প্রাণ ভরে যায়, রৌদ্র ছায়ার লুকোচুরি মায়াবী ঘোর লাগিয়ে দেয়, আবার নদীর কূল যেন মায়ের মমতা ভরা আঁচল এবং সেই মা'র কষ্টে আমরা সন্তানরা নয়ন জলে ভাসি।

এ সঙ্গীত কবির অবিশ্বাস্য রচনা। প্রকৃতিকে মাতৃজ্ঞান করে একটি দেশের জাতীয় সংগীত হতে পারে তাতো আমাদের কল্পনাতীত। শক্তি আধিপত্য বা ঘৃণা নয়, ভালবাসা প্রেম ও প্রকৃতির সাথে মানবের আত্মিক সম্পর্ক আমাদের জাতীয় সংগীতের মূল সুর। আমরা এরকম একটি জাতীয় সংগীতের জন্য গৌরববোধ করি। আজ যখন বিশ্ব পরিবেশ হুমকির সম্মুখীন- যখন আমরা বৃক্ষ নদী জলাধার ধ্বংস করে পৃথিবীকে এক মহাপ্রলয়ের মুখোমুখি করে ফেলেছি- তখন মনে হচ্ছে , আহা আমরা যদি কবিগুরুর প্রকৃতিকে মাতৃ জ্ঞান করে এর সাথে সহাবস্থানের সংস্কৃতির চর্চা করতাম, তাহলে হয়তো পৃথিবীকে এক নিরাপদ বাসস্থান হিসাবে রক্ষা করতে পারতাম।

সাদামাটা চিন্তায় এই সংগীত তো আমাদের জাতীয় সংগীতের নিমিত্তে রচিত হয়নি। এ গানটি রচিত হয়েছে বঙ্গভঙ্গরদ আন্দোলনের সময়। ১৯০৫ সালে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে সারা বংলায় বঙ্গভঙ্গরদ আন্দোলন শুরু হয়। ১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' গানটি রচনা ও সুরারোপ করেন। এছাড়া 'আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি' গানটি একই সময়ে রচিত হয়। ১৯০৫-১৯০৬ বাঙালির ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। ১৯০৬ এ শুরু হয় স্বদেশী আন্দোলন। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে 'জয়বাংলা' শ্লোগানটি প্রথম উচ্চারিত হয়।

কি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কালে জয়বাংলা শ্লোগান এবং আমার সোনার বাংলা গান জাতীয় স্বীকৃতি পায়। জয়বাংলা মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান ও আমার সোনার বাংলা- জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পায়। কিন্তু এরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস রয়েছে।

১৯৪৮-১৯৫২ ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে পূর্ব বাংলার বাঙালিরা ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতিসত্ত্বার প্রশ্নটি সামনে নিয়ে আসে। এ সময়ে 'আমার সোনার বাংলা' গানটির চর্চা দেশভাগ পূর্বকালের চেয়ে অনেক বেশি হতে থাকে।

প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সানজিদা খাতুনের ভাষ্যমতে, ১৯৫৬ সালে ঢাকায় পাকিস্তান গণ পরিষদের অধিবেশন বসেছিল। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত গণপরিষদ সদস্যদের সম্মানে কার্জন হলে আয়োজন করা হয়েছিল সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। উদ্যোক্তা ছিলেন গণ পরিষদ সদস্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সানজিদা খাতুনকে 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' গানটি গাইতে অনুরোধ করেছিলেন এবং সানজিদা খাতুন পুরো গানটি গেয়েছিলেন।

এখানে স্মরণ হয় যে, ১৯৫৬-৫৭ সালে পূর্ব বাংলার নাম পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তান করার প্রস্তাব করলে তরুণ সাংসদ শেখ মুজিবুর রহমান গণপরিষদের সদস্য হিসাবে করাচিতে পাকিস্তান  অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে এর তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং বলেন যে, "যদি পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করতে হয় তবে পূর্ব পাকিস্তান নয়, পূর্ববাংলার নাম 'বাংলাদেশ' রাখা হোক।"

এই প্রথম রাজনৈতিকভাবে 'বাংলাদেশ' নামটি সামনে চলে আসে। ১৯৬০ পরবর্তী বছরগুলোর আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে এই গান এক মহা উদ্দীপক হিসাবে প্রায় সকল জনসভা ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক সভায় পরিবেশিত হতো। অবশ্য সাথে আরো গান সম্মিলিতভাবে গাইতো জনতা। তারমধ্যে 'ধনে ধান্যে পুষ্পেভরা' গানটি, 'আমার সোনার বাংলা'-র পাশাপাশি জনপ্রিয়তা লাভ করে। গ্রামে-গঞ্জে যাত্রাপালায় যাত্রা শুরুর আগে হ্যাজাকের আলোয় যাত্রার সকল পাত্র-পাত্রী 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি' গানটি ও 'ধনে ধান্যে পুষ্পেভরা' গানটি দর্শকের সামনে পরিবেশন করতেন। বাঙালি কিশোর ও যুবক হিসাবে সেই হীরন্ময় সময়ের অভিজ্ঞতা নেয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।

৬৯'র গণঅভ্যুত্থানে এই দেশাত্মবোধক গানগুলো আন্দোলন সংগ্রামের মূল শক্তি হয়ে ওঠে।

১৯৭০ এ নির্বাচনের প্রতিটি জনসভায় এ গানটি নিয়মিত গাওয়া হতো। ১৯৭১'র অসহযোগ ও মুক্তিযুদ্ধে এই গানটি বাঙালির মানস গঠনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৭১ এর ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হয়।

তারপর মুক্তিযুদ্ধের কালে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতি সকালে এ গানটি গেয়ে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করার ব্রত নিতেন। কত হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা মুখে 'জয়বাংলা' আর বুকে আমার সোনার বাংলা'র অবিনাশী সুর, হাতে অস্ত্র নিয়ে দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করতে লড়াই করেছে, জীবন দিয়েছে। তাই আমার সোনার বাংলা জাতীয় সংগীতটি শুধু সংগীত নয়, মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত রণাঙ্গণে জীবন মৃত্যুর লড়াইয়ের সন্ধিক্ষণে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এক তুলনাহীন প্রেরণা। দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা।

১৯৭০ এ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় শিল্পী জাহিদুর রহিম, কলিম শরাফী, আব্দুল আহাদ এবং সানজিদা খাতুনের আয়োজনে ছায়ানটের পরিবেশনায় এ গানটি রের্কড করা হয়। এর আগে ১৯৬৯ জহির রায়হান গানটি 'জীবন থেকে নেয়া' চলচ্চিত্রে দৃশ্যায়ন করেন, যা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে এক নতুন মাত্র যোগ করেন।

পুরো গানটি পরিপূর্ণ,মায়ের প্রতি সন্তানের ভালবাসার নিবেদনে। আমরাতো প্রকৃতির সন্তান । বাংলা মা আমাদের মাতৃস্বরূপা । তাই মায়ের প্রতি সন্তানের আবেগ মথিত ভালোবাসা প্রকাশিত এই সঙ্গীতে।ভক্তিরসে জারিত এই অপূর্ব সঙ্গীতটি।

প্রেম ভালবাসার অসাধারণ সাবলাইম-টি এই গানটিকে পৃথিবীর অন্য সব দেশের জাতীয় সঙ্গীত থেকে আলাদা করেছে। এটি তুলনাহীন একটি জাতীয় সঙ্গীত।

এই গানটি রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সত্যিকার স্পিরিট ধারণ করে। শান্তি ও সৌহার্দ্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র ছিল। আর সোনার বাংলা ছিল অলিখিত দৃশ্যকাব্য, যা দখলমুক্ত করতে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন, ২ লাখ নারী ধর্ষিত হয়েছেন।

আমাদের জাতীয় সঙ্গীত বিশ্বের তাবৎ জাতীয় সংগীতের মাঝে সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিশ্বনন্দিত।আমরা গর্বিত এরকম এক জাতীয় সংগীতের গৌরবদীপ্ত উত্তরাধিকার হতে পেরে।

পৃথিবীর সকল মানুষ সুখি হোক। শান্তি বর্ষিত হোক সকলের পরে।

জয় বাংলা । জয় বঙ্গবন্ধু।