সচিবের বিলম্ব: শিশু হত্যার দায়

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 30 July 2019, 02:34 PM
Updated : 30 July 2019, 02:34 PM

কত ধরনের যে আপদ আছে দেশে!  সমাজে যে কত বড় বড় আপদের বসবাস। তার একটির নাম ভিআইপি। দেশে থাকতে চেয়ারের পেছনে তোয়ালে ঝোলানো নিয়ে কত কাণ্ড। আমি নিজেও তাতে অংশ নিয়েছি। লবিং করে ভয় দেখিয়ে খাইয়ে দাইয়ে দামী তোয়ালে ঝুলিয়ে মনে করতাম আমার কদর ঠেকায় কে? বিদেশে এসে দেখলাম একমাত্র সেলুন আর স্নানের ঘর ছাড়া আর কোথাও এর চল নাই। আপনি যদি উন্নত দেশে কোন অফিসে যান তোয়ালে দূরের কথা ভালো দামী চেয়ারও পাবেন না।

আমাদের কথিত ভিআইপিরা তোয়ালে মোড়ানো এক অন্ধকার জগতের বাসিন্দা।

এর আগেও আমাদের দেশে ভিআইপিরা অনেক মন্দ কাণ্ড ঘটিয়েছেন। আমাদের যৌবনে ছড়াকার বাপী শাহরিয়ারকে গাড়ি চাপা দিয়েছিল এরশাদের এক মন্ত্রীর ছেলে। নি:সন্দেহে মাতাল ড্রাইভার । কিন্তু বিচার হয়নি। তখন আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম। সে প্রতিবাদে জোরও ছিল। কিন্তু শক্তি ছিলনা রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে কিছু করার। মনে হয়েছিল একনায়ক এরশাদ মিলিটারি শাসন শেষে কোনদিন গণতন্ত্র এলে আমরা এসব আর দেখবো না। এমন খবর শুনতে হবে না। আসলে কি তাই? তারপর যতগুলো আমল এসেছে সব আমলেই এমন কাণ্ড হয়েছে। সম্প্রতি এমন একটা মন খারাপের খবর দেখলাম।

আমাদের দেশের একটি বাচ্চা ছেলে তার নাম তিতাস। একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল তার; তারপর কী হলো? তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ভালো ও উন্নত চিকিৎসার জন্য। রাত ৮টায় অ্যাম্বুলেন্সটি যখন কাঁঠালবাড়ি ১ নম্বর ফেরিঘাটে পৌঁছায় তখন কুমিল্লা নামে একটি ফেরি ওই ঘাটেই ছিল। কিন্তু সরকারের এটুআই প্রকল্পে দায়িত্বরত যুগ্ম সচিব আবদুস সবুর মণ্ডলের গাড়ি যাবে- এই নির্দেশনা থাকায় ফেরি ছাড়তে দেরি করে ঘাট কর্তৃপক্ষ।

শেষ পর্যন্ত রাত ১১টার দিকে যুগ্ম সচিবের গাড়ি ঘাটে পৌঁছানোর পর ফেরি 'কুমিল্লা' রওনা হয়। কিন্তু মাঝ নদীতে অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যায় ১১ বছর বয়সী তিতাস। তার পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, তারা পুলিশ, বিআইডব্লিউটিসিএ-কে ফেরি ছাড়ার অনুরোধ করলেও কাজ হয়নি। এমনকি সরকারি জরুরি সেবার ফোন নম্বর ৯৯৯ এ ফোন করা হলেও ফেরি ছাড়েনি।

তিতাসের মামা বিজয় ঘোষ বলেন, "আমার বোন ফেরির লোকদের পায়ে ধরে মাটিতে পড়ে কেঁদেছে। তবু ওরা ফেরি ছাড়েনি। উল্টো বলেছে ফেরি ছাড়লে নাকি তাদের চাকরি থাকবে না।… তারা বলেছে- ভিআইপি আসবে। আর আমাদের রোগী যে মরে যাচ্ছে, সেদিকে তাদের কোনো নজর নেই।"

এবার ভাবুন এই রোগীটি কি আপনার আমার ভাই বোন বা তেমন কেউ হতে পারতো না? একজন সচিব আসলে কে? কী তার পরিচয়? সরকারি চাকুরে। ভালো বেতন পায়। মুষ্টিমেয় কিছু বাদ দিলে বাকিদের বেতনের দরকার পড়ে না। অফিসের মালি বাড়ির ঘাস কাটে। অফিসের পিয়ন বাড়িতে কাজ করে। সরকারি ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে ছেলে-মেয়েদের স্কুল কলেজ থেকে বন্ধুদের বাড়ি নিয়ে যায়। রাতে-বিরাতে পার্টিতেও নিয়ে যায় বৈকি। এই সরকারি আমলারা মনে করেন- মানুষ তাদের সেবাদাস। তারা আছেন বলেই দেশ আছে। এমনও শুনি তারা নামি মন্ত্রী মিনিস্টারদেরও তোয়াক্কা করেন না। কারণ এরা আসে যায়। তাদের আসন পাকা পোক্ত। এমন এক যুগ্ম সচিবের আগমন নিয়ে তটস্থ সাধারণ ফেরি কর্মচারিরা ভয়ে ফেরি চালাতেই পারে নি। আর তাতে কি হলো? আমাদের একটি বাচ্চা চিকিৎসার অভাবে অকালে ঝরে পড়লো।  এমন বলি না সে বাঁচতো-ই। কিন্তু চিকিৎসাহীন তো মরতো না। এই সান্তনাহীন মৃত্যুর দায় নেবে কে?

আমরা যে কথায় কথায় বলছি দেশ এগুচ্ছে- দেশের চারদিকে উন্নয়নের জোয়ার, তার সাথে এই ঘটনা কি মেলে? জানি কেউ কেউ বলবেন সরকারের এতে কী করার আছে? কী করার ছিল? ছিল এবং আছে আলবৎ- আছে। তারা যদি টাইট দিতেন সচিবের কি সাধ্য আছে এমন করে ফেরি আটকায়? সচিবের ভয়, আমলার ভয়, মন্ত্রীর ভয়, নেতার ভয়, ক্যাডারের ভয়-  এর নাম উন্নয়ন? একা প্রধানমন্ত্রী কেন সব সামলাবেন? এর কোনও ব্যাখ্যা আছে কারো কাছে? আওয়ামী লীগের আমলে আমাদের কি প্রত্যাশা ছিল? আমাদেরকে যারা এ দলের অন্ধ সমর্থক মনে করে তারা এখন ব্যঙ্গ করে বলে, বলেছিলাম না যে যায় লংকায় সেই রাবণ? মিলিবে নিন। আসলে তা মিথ্যা? একটি জাবাবদিহিতামূলক সরকার আর স্বচ্ছ সমাজ থাকলে- সচিব তো সচিব, মন্ত্রীর ও সাধ্য নাই জনগণের পথ আগলে দাঁড়ায়।

নাই এটাই সত্য। তাই আজ তিতাসের প্রাণ গেছে কাল অন্য কারো। আপনি লিখে রাখতে পারেন এই যুগ্ম সচিবের কিছু হবে না। যদি জনরোষ নামে কিছু হয় তাহলে আই ওয়াশের মতো কিছু একটা করে আপনাকে আমাকে এঘটনা ভুলে যাবার সময় দেয়া হবে। ততদিনে সচিব সাহেব অন্য কোথাও চলে যাবেন। বা অন্যকোনও রূপে ফিরে আসবেন। এটাই আমাদের নিয়তি। আরেক দুর্ভাগ্য হলো বিরোধী বলে কোন রাজনৈতিক শক্তির অস্তিত্ব নাই। যেভাবেই হোক তাদের সমূলে প্রায় উৎপাটন করা গেছে। আর যারা আছে তারা এসব ঘটনা নিয়ে এমন হাস্যকর সব কথা বলেন- যাতে মানুষ লজ্জায় মুখ লুকাতে বাধ্য হয়। এই বলগাহীন আদর্শহীন মূল্যবোধহীন এক সমাজে উন্নয়নের ঢোল বাজিবে আসলে কি লাভ?

মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কি হতে পারে? ঘটনাটি কত মর্মান্তিক। একটি ছেলে জান নিয়ে লড়াই করছে কিন্তু কোন এক ভিআইপি আসবে বলে ফেরি ছাড়ছে না। তাও তিন ঘণ্টা বসিয়ে রেখেছে। এই পাপ কি সমাজকে ছেড়ে কথা বলবে? খেয়াল করুন মানুষও কেমন নির্জীব আর তেজহীন হয়ে পড়েছে। আগে হলে এমন ঘটনা ঘটার সময়ই তুলকালাম হয়ে যেত। ভাঙচুর হতো। কাজগুলো ভালো না, নি:সন্দেহে খারাপ। কিন্তু এতে মানুষের বিবেকের রাগের বহির্প্রকাশ ছিলো। এখন? তাও নাই। কারণ সবাই বসে থাকে কখন ঘটনা ঘটবে আর ফেইসবুক টুইটারে এনিয়ে পোস্টিং দেবে। তারপর কার চাইতে কারটা ভালো আর জোরালো এ নিয়ে প্রতিযোগিতা। আর সে ফাঁকে সচিব পগারপার।

এমন দেশ এমন নিষ্ঠুর সমাজ আর এমন মায়া দয়াহীন মানুষ আমরা আগে দেখিনি। আমাদের শেষ গর্ব- মায়ার দেশ, ভালোবাসার দেশ- সেটাও  প্রায় শেষ হবার পথে। মানুষ এরপরও চুপ থাকে কী করে? এ কি কোন হ্যামিলনের বাঁশি যা মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখছে? না এ কোন লাভা উদগীরণের পূর্বাভাস? কিভাবে সম্ভব শিশু হত্যার পরও বিবেকহীন সচিবের থাকা? কিভাবে সম্ভব মানুষের এসব ভুলে ভোরে ঘুম থেকে জেগে নিজের সন্তানকে নিয়ে ফেরি করে পারাপার হওয়া? আমরা কি যান্ত্রিক রোবট? আমরা দূরদেশে থেকেও এই বেদনায় মুহ্যমান। আমাদের মনে একটাই প্রশ্ন- বাংলাদেশ কি এমন নিষ্ঠুর হবার জন্য জন্মেছিল? না এর কোনও প্রতিকার বা সমাধান আছে এখনো?