সুপ্রিয় চক্রবর্তী: এক শাশ্বত বাঙালি

গৌতম রায়
Published : 30 July 2019, 02:06 PM
Updated : 30 July 2019, 02:06 PM
আলবার্ট সোয়াইৎজারের মহাপ্রয়াণের পর বিশ্ব নাগরিক অমিয় চক্রবর্তী লিখেছিলেন, ' সোয়াইৎজারের মহাপ্রয়াণে'  শিরোনামের একটি কবিতা। কবি বলছেন-
"প্রবাসী বাঙালি আমি ক্ষুদ্ধ দূরে বসে /হঠাৎ  ভোরের রোদে  দেখি দিন অশ্রু ঢাকা /প্রয়াণী গেছেন রাত্রে/ বিশ্ববাসী পরম আত্মীয় হারা।"
২৯ জুলাই সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটে ঢাকার বারডেম হাসপাতালে জীবন দীপ নির্বাপিত হওয়া ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম সেরা আইনজীবী,  ক্রীড়া সংগঠক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সর্বোপরি স্যার গুরুসদয় দত্ত বিশ্বমানব হওয়ার জন্য যে শাশ্বত বাঙালি হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন, সেই আহ্বানের এক অন্যতম সেরা যোদ্ধা সুপ্রিয় চক্রবর্তী।
সুপ্রিয় চক্রবর্তী পত্নীর সুলতানা কামাল ভারতীয় উপমহাদেশের একজন লব্ধ প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী এবং মানবাধিকার কর্মী। সুপ্রিয় এর শ্বশ্রুমাতা বাংলার নারী জাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ সুফিয়া কামাল। এসব পরিচয়কে অতিক্রম করে বাংলা ও বাঙালির সারস্বত চর্চার ক্ষেত্রে, মুক্তবুদ্ধির অনুশীলনের ক্ষেত্রে, বিবেকানন্দ প্রদর্শিত গীতা পাঠের থেকে ফুটবল খেলার ভিতর দিয়ে শরীরকে তৈরি করে গীতার প্রদর্শিত পথে আত্মনিয়োগে প্রস্তুত হওয়ার কারিগর তৈরীর নীরব নিভৃত কর্মী সুপ্রিয় চক্রবর্তী, যার একদিকে আয়কর সংক্রান্ত পেশাগত দক্ষতা তাবড় তাবড় আমলাদের পর্যন্ত আরশ কাঁপিয়ে দিত, অপরপক্ষে অতি সাধারণ মানুষ, যারা কোনো না কোনোভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের পেষণ প্রক্রিয়ার শিকার,  তাদের মুখে হাসি ফোটাতে সর সময় ক্লান্তিহীন-  সেই মানুষটিকে এপার বাংলার লোকেরা প্রায় জানেনই না।
বাংলাদেশে বেড়াতে যাওয়ার তাগিদে যারা বাংলাদেশ প্রেমী হয়ে উপদূতাবাসের সঙ্গে সখ্যতা তৈরি করে কথায় কথায় কবিতা উৎসব করেন, নানা ধরনের খাদ্যদ্রব্যের উৎসবের আয়োজন করে খাওয়া-দাওয়া, আর হৈ হুল্লোড়ের  ভেতরেই বাঙালিয়ানার মৌলিকত্ব খুঁজে বেড়ান , তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই এই মহান মানব প্রেমিকের চলে যাওয়া ঘিরে ।
প্রগতিশীল রাজনীতি যারা করেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, মৌলবাদবিরোধিতার সুন্দর সুন্দর কথা লেবাসে  যারা সবকিছুকে জড়িয়ে রাখতে চান, তাদেরও কোনো মাথা ব্যথা নেই ধর্মপ্রাণ অথচ আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক, মৌলবাদবিরোধী ,ষোলো আনা বাঙালি হয়েও জাতিবিদ্বেষকে যে মানুষটি ক্ষণিকের জন্য মনের কোথাও স্থান দেননি সেই সুপ্রিয় চক্রবর্তীকে নিয়ে।
১৯৪৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর সিলেটে সুপ্রিয় চক্রবর্তীর জন্ম। তিন ভাই, তিন বোনের ভিতরে সুপ্রিয় ছিলেন পঞ্চম। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন শিক্ষক। মুক্তিযুদ্ধে জীবন অর্পণ করে কখনো ভাবেনি পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতার হাত থেকে শেষ পর্যন্ত বেঁচে যেতে পারেন। শেষ পর্যন্ত বেঁচে যাওয়ার পর মুক্ত স্বাধীন, সার্বভৌম, বাংলাদেশ ১৯৭৩  সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি নিজেকে যুক্ত করেছিলেন আইন পেশার সঙ্গে ।
বাংলার সামাজিক আন্দোলনের অন্যতম সেরা যোদ্ধা পরিবারের মেয়ে  সুলতানাকে বিয়ে করেন সামাজিক রীতিনীতির প্রতি যথাযথ মর্যাদা দিয়েই। এই বিয়ের আগেও তিনি ছিলেন সুপ্রিয় চক্রবর্তী, বিয়ের পরেও তিনি থেকে যান সুপ্রিয় চক্রবর্তীই। বিয়ের আগেও সুলতানা কামাল যা ছিলেন, বিয়ের পরেও তাই-ই থেকে যান। ধর্ম এদের বিবাহিত জীবনে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারেনি।  তাদের কন্যা দিয়া- সুদেষ্ণা চক্রবর্তী,  নিজের যোগ্যতায় আজ লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত।
 আত্মনিবেদিত আইনজীবী, সংখ্যালঘুর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার  সুলতানা কামাল বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশে পারমাণবিক চুল্লির তৈরির  বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। সে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাল্য সখী তিনি।মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত আগেই ১৯৭০ সালে বাংলাদেশে যে প্রলয়ঙ্করী বন্যা হয়েছিল, সেই বন্যায় নিজের প্রাণ তুচ্ছ করে সবাই নিয়ি সুলতানা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ত্রাণকার্যে।
একটা সময় বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, যেটি কেবিনেট মন্ত্রীর সমপর্যায়ের পদ,  সেই পদ অলংকৃত করেছিলেন। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান গণতন্ত্রবিরোধী, মানবতাবিরোধী অবস্থান নিচ্ছেন, সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঝুঁকছেন, মৌলবাদের দিকে ঝুঁকছেন- এটা বুঝতে পেরে এক কথায় সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে পদত্যাগ করতে দ্বিধা করেননি মায়ের মেয়ে সুলতানা ।
 জানা নেই এসব কারণেই কিনা সুলতানা কামালের পরিবারকে ভারত সরকার ভিসা দেন না। আর সে কারণেই দীর্ঘদিন অসুস্থ সুপ্রিয়কে কলকাতা এনে চিকিৎসা করাবার আন্তরিক চেষ্টা সুলতানার সার্থক হলো না শেষপর্যন্ত। অল্প ক'দিন আগে তারা লন্ডনে গিয়েছিলেন মেয়ের কাছে।
ব্রিটিশ সরকার সুলতানা কামালকে ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রশ্ন না উঠালেও ভারতের মতো 'গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র' সুলতানা কামালকে ভিসা দেয় না। লন্ডন থেকে ফেরার অল্প ক'দিনের ভেতরেই সুপ্রিয়দা অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাডক্লিফের তৈরি কাঁটাতারের  বাঁধাকে অতিক্রম করে একটা দিন ভৌগোলিক দূরত্বকে যেন আমরা জয়  করে নিয়েছিলাম মানসিক নৈকট্য দিয়ে।
সুপ্রিয়দার  শেষ কটা দিন লুলু দি  (সুলতানা কামাল) বার বার বলছিলেন-
প্রার্থনা করো, তোমার দাদার কষ্টটা যেন আর প্রলম্বিত না হয়। যদি তাকে যেতেই হয়, যেন শান্তিতে যেতে পারেন। রোগ যন্ত্রণা সঙ্গে যুদ্ধ করবার মতো শক্তি শারীরিকভাবে আর তোমার দাদার নেই।
হাজার হাজার মাইল দূর থেকে আমার অগ্রজা প্রতিমেষূ  লুলু-দির বুক ফাটা কান্না অনুভব করতে পারছিলাম। কী সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে হেলায় অস্বীকার করে, বাবা-মা-ভাই-বোনদের ঐকান্তিক সহযোগিতায় সমাজের ভ্রুকুটিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ব্রাহ্মণ ঘরের সন্তান সুপ্রিয়ের সঙ্গে সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারের কন্যা সুলতানের বিয়ে হয়েছিল, তা যারা জানেন, তারাই উপলব্ধি করতে পারবেন।
মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে আইসিইউ-তে প্রাণপ্রিয় সুপ্রিয়-কে দেখবার পর 'চোখের জলের লাগল জোয়ারে' ভেসে সুলতানার সেইসব বার্তালাপ গুলি ছিল কান্নায় লেখা জীবনের কবিতা। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- "করিব নীরবে ত্বরণ" যেন কদিন ধরে ধীরে ধীরে আত্মসাথ করছিলেন সর্বংসহা লুলুদি।
বিজ্ঞান গবেষণায় মরণোত্তর দেহদান ভারতবর্ষে তথা পশ্চিমবঙ্গের যথেষ্ট জনপ্রিয় হলেও নানা সামাজিক প্রতিবন্ধকতা এই বিষয়টি এখনো বাংলাদেশ ততটা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। জীবন মরণের সীমানা পেরিয়েও এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন সুপ্রিয় চক্রবর্তী। তিনি অঙ্গীকার করে গিয়েছিলেন, তার মরদেহ ময়মনসিংহের কুমুদিনী হাসপাতাল দাতব্য চিকিৎসালয় বিজ্ঞান গবেষণার জন্য দান করার। সে অঙ্গীকার লুলু দি, টুলু – সাঈদা কামাল, দিয়ারা রেখেছেন।
প্রকৃত ধর্মপ্রাণ মানুষ যে কখনো তার বোধের সঙ্গে আধুনিকতা এবং বিজ্ঞানমনস্কতাকে গুলিয়ে ফেলতে পারেন না, মরণোত্তর দেহ দান নিয়ে সুপ্রিয়দার এই  সিদ্ধান্ত এবং সেই সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করার ক্ষেত্রে তার স্ত্রী, কন্যা পরিবারের ভূমিকা বাংলার সামাজিক জীবনে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ভাববাদ বস্তুবাদের চুলচেরা তর্ক করতে গিয়ে বাস্তবকে কার্যত ভুলেই যান অনেক প্রগতিশীলেরা। সুফিয়া কামালের পরিবার ছিলেন কিন্তু এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।
অমলেন্দু দে শেরে বাংলা ফজলুল হকের নাতনিকে বিবাহ করেছিলেন বলে সেই পরিবারটিকেই এপারের একাংশের প্রগতিশীল মানুষ ধর্মনিরপেক্ষতার পরাকাষ্ঠা বলে মনে করেন। আর অমলেন্দু দে নিজের মার্কসবাদী প্রজ্ঞাকে তুলে ধরতে শ্বশুরবাড়ির পরিবারকেই মুসলমান সমাজের প্রগতিশীলতার একমাত্র মাপকাঠি হিসেবে পরিমাপ করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া সুফিয়া কামালকে বাতিলের তালিকাতেই প্রায় ফেলতেন ।
আধ্যাত্মিকতার চর্চার ভেতর দিয়ে মানবিক দৃষ্টি ভঙ্গিতে বিজ্ঞান ভাবনাকে অস্বীকার না করে, ভাবের ঘরে চুরি না করে  কিভাবে অসাম্প্রদায়িক,  ধর্মনিরপেক্ষ, পরমতসহিষ্ণু, এমনকি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর যেসব উর্দুভাষী মুসলমান, যাদের এক কথায় বাংলাদেশের মানুষ 'বিহারী' বলে থাকেন ,তারা একটা অন্ধ ধর্মীয় আবেগে পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন, যদি কোনো অবস্থাতেই মুক্তিযোদ্ধাদের পাকহানাদারদের হানাদার বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেননি, সেই  মুহাজিরদের প্রতি হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে 'ভাত আর ভাষা মানে খালাম্মা সুফিয়া কামাল' হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিল সুফিয়া কামালের গোটা পরিবারটি, তা দেশকালের ভূগোল অতিক্রম করে অখণ্ড বাঙালি জাতিসত্ত্বার এক পরম গৌরবের বিষয় ।
সুফিয়া কামালের বসার ঘরে জয়নুল আবেদিনের আঁকা একটি ছবি আছে। সেই ছবির উপজীব্য ' কাক' কে প্রধান চিত্রকল্প করে অসাধারণ একটি কবিতা লিখেছিলেন শামসুর রাহমান-
"বিনীত শোভিত ঘর, সামান্যই আসবাবপত্র, কতিপয় ফটোগ্রাফ দেয়ালে, টেবিলে/ দেয়ালে সর্বদা জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষ ।/ ঘরময় পেলব বেড়াল করে আনাগোনা,/ কখনো ঘুমিয়ে থাকে এক কোণে শব্দহীন ট্রানজিস্টারের মতো একা, আলসের স্তুপ / ঘরের অত্যন্ত অভ্যন্তরে প্রায়শই মধ্যরাতে  কে যেন বাজায় এক করুণ বেহালা,/ মধ্যরাত ঝরেসতার হৃদয়ের নিঝুম চাতালে।…কবির সামান্য ঘর নিমেষেই সারা বাংলাদেশ হয়ে যায়।"
(কবির ঘর)।
সুপ্রিয় চক্রবর্তীর  মহাপ্রয়াণের পর সেই কবিতার মতোই শূন্যতা এখন বাঙালির হৃদয়ে। সুপ্রিয় চক্রবর্তীদের মত মানুষদের জীবন যতো বেশি করে মানুষের কাছে তুলে ধরা যায় দেশ কালের সীমা অতিক্রম করে, সেই জীবন চর্চা মানুষকে ততবেশি মানবপ্রেমী করবে । গণতন্ত্রপ্রেমী করবে। ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতি আকর্ষণ বাড়াবে। মৌলবাদের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে ঘৃণার উদ্রেকে সহায়ক হবে। সর্বোপরি মানব মুক্তির লড়াইয়েকে ত্বরান্বিত করবে।