অপ্রয়োজনীয় প্রতিযোগিতা এবং গুজব

রাজীব ঘোষ
Published : 29 July 2019, 02:25 PM
Updated : 29 July 2019, 02:25 PM

কেমন যেন একটা আতংক আতংক সময় পার করছি আমরা।  সম্প্রতি প্রতিদিনই সংবাদপত্রের পাতা অথবা টেলিভিশনের নিউজে নানান খবরে ভিড়ে চোখ আটকে যাচ্ছে, গণপিটুনিতে মারা গেছে, ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে অথবা শিশুর বিচ্ছিন্ন মাথা পাওয়া গেছে, আবার টানা কয়েকদিন বিদ্যুৎ থাকবে না।  কেমন যেন পুরো বিষয়টা,  আসলে কী ঘটছে ?

এক দুইদিন নয়, বা এক দুইটি ঘটনা নয় ধারাবাহিকভাবে এই গুজব কিছুদিন পরপরই আমাদের গ্রাস করে। আমরাও সচেতন অথবা অচেতনভাবে এই গুজবে গা ভাসাই। অনেক  দূরের ঘটনা নয়, এইতো গত বছরের জুলাইয়ের শেষ দিকে ঢাকার রাস্তায় বাসের ধাক্কায় দুই স্কুল পড়ুয়ার মৃত্যু হয়।  প্রতিবাদে তাদের সহপাঠিরা রাস্তায় নেমে আসলে গোটা ঢাকার স্কুল কলেজের শির্ক্ষীরা যোগ দেয়।  মুহুর্তে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে যুক্ত হয় দেশের বিভিন্ন জেলার শিক্ষার্থীরা।  সড়কে জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিতে বাচ্চারা যখন রাস্তায় , তখন একটি সরকার বিরোধী পক্ষ উঠে পরে লাগলো নিজেদের রাজনৈতিক ফয়দা হাসিলের জন্য।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের সফল একটি আন্দোলনকে সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো, শুধু গুজব ছড়িয়ে।  পেছনে পেছনে অপতৎপরতা চালানো একটি রাজনৈতিক মহলতো ছিলই, সাথে যোগ দিলেন আমাদের মুখ পরিচিত অনেক ক্যারেকটার। শেষ রক্ষা হয়নি, আইনি প্রক্রিয়াতে অপরাধীদের পড়তেই হয়েছে।  মাঝে ক্ষতি, বাচ্চাগুলোকে সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল।

নিশ্চয়ই ২০১৩ সালের মার্চ মাস ভুলে যান নি।  জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীকে চাঁদে দেখার গুজব মসজিদের মাইকে এবং মোবাইলে ছড়িয়ে দেয়া হল।  হোলি খেলল সুযোগ সন্ধানীরা।  গুজবের ভয়াবহ রূপ দেখা গেল সেসময়।  ঘরবাড়িতে আগুন, লুটপাট, ভাঙচুর কি হয়নি সেসময়। প্রাণ গেল কতগুলা নিরীহ মানুষের।

এখন যে ছেলেধরার গুজব শুরু হলো তার উৎপত্তি পদ্মা সেতু।  এই সেতুর জন্য কাটা মাথা প্রয়োজন, ফেইসবুকে ছড়িয়ে দেয়া হল এই তথ্য।  ব্যাস আর যায় কই।  যুক্ত করে দেয় হল ছেলেধরার জুজু। এটা একসময় থেমে যাবে। তবে মানুষের মধ্যে যে ভয় ঢুকেছে তা কাটতে সময় লাগবে।

তবে সবগুলো ঘটনার শুরু সাথে সাথে একটি রাজনৈতিক ফায়দাওয়ালা গ্রুপ দাঁড়িয়ে যায় , যারা বরাবরই চেষ্টা করে সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে।  একেতো গুজব মহামারী আকার ধারণ করেছে, অন্যদিকে আমরা সেসব গুজবকে ফুঁ দিচ্ছি।

বাড্ডার ঘটনাই বলি।

বাচ্চার স্কুলের খোঁজ নিতে এসে গুজবের বলি হলেন এক মা।   যারা মারছে ভিডিওতে একদমই স্পষ্ট কয়েকজন। আমরাই সেই ছবি স্টিল করে ফেইসবুক ভাসিয়ে দিলাম , পুলিশকে সহযোগিতা করার জন্য।  কিন্তু ঘটনা আরেকটি ঘটল।  আমাদের উতি উৎসাহের জেরে এক নিরপরাধ ছেলে ধরা পড়ল পুলিশের হাতে ২৩ তারিখ বিকালে।  শাহাবাগ থানায় নিয়ে যাওয়া হল ছেলেটিকে। মুহূর্তেই খবর রটে গেল বাড্ডার গণপিটুনিতে নেতৃত্ব দেয়া হৃদয় ধরা পড়েছে। মাঝে ছেলেটিকে রেখে দুই পাশে পুলিশের কনস্টেবলের একটি ছবি চলে আসল বাইরে।  নিশ্চিত না হতেই ছেলেটির ছবিসহ রেনুর হত্যাকারী গ্রেপ্তার হয়েছে মর্মে আবারও ফেইসবুক ভাসিয়ে দিলাম আমরা। ছেলেটি যে বাড্ডার প্রকাশ হওয়া ভিডিওর হ্নদয় না সেটা কিন্তু পুলিশ নিশ্চিত, কিন্তু আমাদের কি আর তর সয় ! ছবিসহ আরেকটা ছেলের জীবনকে বিপন্নের দিকে ঠেলে দিলাম। মুশকিল হল সেদিনই নারায়ণগঞ্জ থেকে আসল হৃদয়কে গ্রেপ্তার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল।

যে কারণে আমার এই লেখা এবার আসি সেই কথায়।  আমরা সংবাদ কর্মীরা কি করলাম ? নিশ্চিত না হয়েই নিউজ চালিয়ে দিলাম রেনুর হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।  একদম সচরাচর নিউজ যেভাবে হয়, ছবি দিয়ে প্রচার হলো। সেই ছবিতে দুই পুলিশ সদস্যকেও দেখা গেছে।  এই ছেলেটি যে হৃদয় নয় তা কিন্তু পুলিশের শাহাবাগ এবং বাড্ডা থানার ওসিরা ফোনে নিশ্চিত করেছেন।  গুলশান জোনের বড় কর্তারাও নিশ্চিত করেছিলেন।  কিন্তু ফেইসবুকের পোস্ট বিশ্বাস করে আরও একটা গুজব তৈরি করলাম।আমরা।

সংবাদমাধ্যমে একধরনের বাজে প্রতিযোগিতা আছে।  কে কার আগে দিবে পোর্টালে আপ করবে অথবা টেলিভিশনে সর্বশেষ স্ক্রলে দিবে।  এই প্রতিযোগিতা চলছে অনেকদিন ধরেই। এটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা।  যা সংবাদ মাধ্যমে কাম্য নয়।

আমি বলি কি, একটু রয়ে সয়ে যাচাই-বাছাই করলে সংবাদ পরিবেশন করলে কি হয়? খুব বেশি কি ক্ষতি হয়? মনে হয় না।  যতক্ষণ না পর্যন্ত সংবাদের তথ্যটা যাচাই করা না যায়। কোনভাবেই তা পরিবেশন করা ঠিক না।

একটা অঘোষিত নিয়ম রয়েছে আমাদের মাঝে, আগে দিলে পাঠক বা দর্শক গ্রহণযোগ্যতা পাবে পরে দিলে পাবে না । এই দর্শন মনে হয় ঠিক না।

যে সংবাদটি পরিবেশন করা হচ্ছে তার সত্যতা কতটুকু , তথ্যের ভিত্তি আছে কি না সেটাই পাঠক বা দর্শকরা গ্রহণ করবেন।  সেটা একটু দেরিতে হোক, সত্যি তথ্যটা সাধারণ মানুষের কাছে যাবে।  এই গ্রহণযোগ্যতা একটি প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ মজবুত করবে বলেই বিশ্বাস করি।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমরা এতটাই ফেইসবুক নির্ভর হয়ে গেছি যে সংবাদ সংগ্রহের সবচেয়ে বড় মাধ্যম বলে মনে করি একে।  অবশ্যই সংবাদ পাওয়ার বেশ কয়েকটি  মাধ্যমের একটি  এই ফেইসবুক , তবে এখানের তথ্য নির্ভর্যোগ্য কোন মাধ্যম হতে যাচাই করে তবেই তা শেয়ার অথবা পরিবেশন করা উচিত।  কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা হচ্ছে না।

আমরাই বলছি গুজবে কান দিয়েন না, বলে নিজেরাই গুজব ছড়াচ্ছি।  এখনও সময় ফুরিয়ে যায়নি।  আসুন বিকল্প পথে হাঁটি। আমাদের একটা ভুল সংবাদ বা মন্তব্য মানুষের জীবনকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে।  এটা বোঝার পরেও স্রেফ সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য যাচাই বাছাই ছাড়া কোন তথ্য যেন উপস্থাপন না করি। ও আরেকটি কথা, দিন শেষে কিছুটা জবাবদিহিতার জায়গাও থাকা উচিত আমাদের।